#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ16
মেঘ ফোন কানে ধরে অভির সাথে কথা বলতে বলতে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে হেটে মাঠের দিকে চলে আসলো। তারপর ‘ও’ মাঠে দাড়িয়ে দাড়িয়ে অভির সাথে কিছুক্ষন কথা বলে ফোনটা কেটে পিছনে ঘুড়ে ভিতরে আসতে নিলো। ঠিক তখনই ভার্সিটি গেট দিয়ে ফুল স্পিডে আট/দশটা বাইক এসে মেঘের চারপাশটা ঘিড়ে ফেললো। আর মেঘ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলন্ত বাইকে থাকা একটা ছেলে হকিস্টিক বের করে মেঘের ঘাড়ের পিছনে জোড়ে আঘাত করলো। আঘাত করার সাথে সাথে ‘ও’ মুখ ধুবরে মাটিতে উপুর হয়ে পড়ে গেলো।
আহির আর মিহির নিজেদের ক্লাস থেকে বের হয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে অনেক গুলো বাইক আসার শব্দ শুনে ওরা সবাই বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ওরা নিচে তাকিয়েই বুঝতে পারলো যে বাইকে আসা ছেলে গুলোর মধ্যে কেউই ভার্সিটির স্টুডেন্ট না। এরা সবাই বাহিরের ছেলে-পুলে। পাশ থেকে মিহিরের একজন ফ্রেন্ড ভ্রু কুচকে বলে উঠলো
“এই মূর্তিমানেরা আবার কোথা থেকে উদয় হলো? আর পারমিশন না নিয়ে এরা ক্যাম্পাসে ঢুকলো কোন সাহসে?”
ছেলেটার কথাটা শেষ হতেই আচমকা আহির আর মিহির “মেঘ” বলে জোড়ে চিল্লিয়ে উঠলো। ওদের চিৎকার শুনে আশেপাশের সব স্টুডেন্টরা ওদের দিকে তাকালো। টিচারেরা সবাই টিচার্স রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় বেড়িয়ে এলো। আহির, মিহির আর এক মূহুর্তও দেরি না করে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচের দিকে নামতে লাগলো। ওদের পিছনে পিছনে ওদের ফ্রেন্ডরাও সবাই দৌড়ে নিচের দিকে নামতে লাগলো। বাকিরা সবাই বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো মায়া (মেঘ) উপুর হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আর কতোগুলো ছেলে ওকে চারপাশ থেকে ঘিড়ে রেখেছে।
______________
আহির,মিহির নিচে এসে দেখলো তৃধা মেঘের মাথার উপর পা রেখে ওকে মাটির সাথে চেপে ধরে রেখেছে। আর মেঘ হাতে ভর দিয়ে বারবার ওঠার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হচ্ছে। মিহির তৃধার কাছে এসে ওর চুলের মুঠি ধরে ওকে দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারলো। এভাবে অচমকা আক্রমণে তৃধা ব্যালেন্সলেস হয়ে গেলো। আর ওর মাথা গিয়ে দেয়ালের সাথে জোড়ে আঘাত লাগায় ওর কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলো।
আহির দৌড়ে মেঘের কাছে এসে হাটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়লো। তারপর মেঘের মাথাটা নিজের কোলের উপর উঠিয়ে রক্ত বন্ধ করার জন্যে মাথার পিছনের দিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো। মূহুর্তের মধ্যে আহিরের হাতটা রক্তে লাল হয়ে গেলো। এতো রক্ত বের হচ্ছে দেখে আহিরের বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। তৃধা কপালের কাটা অংশ হাত দিয়ে চেপে ধরে মিহিরের দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিহির তৃধার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বললো
“তোর সাহস হলো কিভাবে ওর গায়ে পা রাখার? আজকে তোর পা ভেঙে আমি গুড়ো গুড়ো করে ফেলবো জানোয়ার।”
মিহিরের কথা শুনে তৃধা অবাক কন্ঠে বললো
“এই রাস্তার মেয়েটার জন্যে তুই আমাকে আঘাত করতে পারলি মিহির? জানিস এই মেয়েটা আজকে কি করেছে? ক্যান্টিনে সবার সামনে বসে একটু আগে আমাকে অপমান…..”
তৃধা পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মিহির এসে শক্ত করে ওর গলা টিপে ধরলো। তারপর চিল্লিয়ে বললো
” তোর এতো বড় কলিজা? তুই আমার সামনে দাড়িয়ে আমারই বোনকে রাস্তার মেয়ে বলিস? আজকে তোকে আমি খুন করে ফেলবো।”
মিহিরের কথা শুনে ওখানে উপস্থিত সবাই চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেলো। ওরা কেউ নিজেদের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এদিকে মিহির তৃধার গলা এতো জোড়ে চেপে ধরায় ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো। ‘ও’ মিহিরের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো। তৃধার এমন অবস্থা দেখে সেই ছেলেগুলো ভয় পেয়ে বাইক নিয়ে সবাই দ্রুত পালিয়ে গেলো। মিহিরের ফ্রেন্ডরা ওদের পিছনে দৌড়ে গিয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারলো না।
এদিকে মেঘ অতিরিক্ত মাথা যন্থনায় ছটফট করতে করতে ওর চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। আহির খেয়াল করলো মেঘের শরীর একদম নিস্তেজ হয়ে গেছে। মেঘকে এমন নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখে ‘ও’ ভীতু স্বরে মিহিরকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“মিহির ওকে ছাড়, এদিকে আয়। দেখ, ম-মেঘ রেসপন্স ক-করছে ন-না।”
আহিরের কথা শুনে মিহিরের হাতটা তৃধার গলা থেকে আলগা হয়ে আসলো। ‘ও’ তৃধাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে মেঘের কাছে গেলো। তৃধা গলায় হাত দিয়ে কাশতে কাশতে মাটিতে বসে পড়লো। আর কয়েক সেকেন্ড মিহির এভাবে ওর গলা চেপে ধরে থাকলেই আজকে ওর উপরে টিকিট কেটে যেতো। মিহির এসে মেঘের পাশে হাটু গেরে বসে ওর গালে হালকা চাপর মেরে কাপা কাপা কন্ঠে বললো
“ম-মেঘ তাকা আ-আমার দ-দিকে। ক- কি হয়েছে ত-তোর?চোল খোল প-প্লিজ!”
আহির ব্যাস্ত স্বরে বললো
“অনেক দেরি হয়ে গেছে মিহির।ওকে এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। মাথার পিছন থেকে অনেকটা ব্লাড বেড়িয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি এম্বুলেস কল কর।”
আহিরের কথা শেষ হতেই মিহির বললো
“এম্বুলেন্স আসা পযর্ন্ত অপেক্ষা করতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। এতো সময় আমাদের হাতে নেই। একটা কাজ কর। তুই গিয়ে ডিন’এর কাছ থেকে ওনার গাড়ির চাবিটা নিয়ে আয়। ”
“ওকে,আমি এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই আহির মেঘের মাথাটা মিহিরের কোলের উপর রেখে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো। মিহির নিজের শার্ট খুলে মেঘের মাথায় শার্টটা শক্ত করে বেধে দিলো। তারপর ওকে কোলে তুলে নিয়ে পার্কিং এরিয়ার দিকে হাটা দিলো। মিহিরের চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে,বুকের কেমন শূন্যতা অনুভব করছে। ওর হাত-পা থরথর করে কাপছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে মেঘকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিতে।
_________________________
রাত 12:00
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো মেঘ। তাকিয়েই চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলো যে ‘ও’ এখন হসপিটালের বেডের উপর শুয়ে আছে। কেবিনের মধ্যে আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষন পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে ‘ও’ আবার চোখ খুলে ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকালো। দেখলো দিশা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। মেঘকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দিশা দ্রুত মেঘের কাছে আসলো। তারপর মেঘের বেডের পাশে রাখা টুলস’টার উপরে বসতে বসতে বললো
“যাক বাবা,ফাইনাললি তোর জ্ঞান ফিরেছে তাহলে? জানিস সারাদিন কতো চিন্তার মধ্যে ছিলাম?”
কথাটা বলে দিশা একটা শস্তির নিশ্বাস ফেললো। মেঘ দিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। বিনিময়ে দিশাও মেঘের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। তারপর নরম স্বরে বললো
“কেমন ফিল করছিস এখন? মাথার মধ্যে কি এখনো পেইন করছে?”
মেঘ ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো
“আমি একদম ঠিক আছি। কিন্তু তোর এই অবস্থা হলো কিভাবে? চোখ, মুখ শুকিয়ে কেমন আমসপ্ত টাইপ হয়ে গেছে।”
দিশা অসহায় কন্ঠে বললো
“শুধু চোখ,মুখ না। আমি নিজেই আমশপ্ত হয়ে গেছি।”
মেঘ ভ্রু কুচকে বললো
“মানে?”
দিশা ফোশ করে নিশ্বাস ফেলে বললো
“তুই তো সারাদিন অজ্ঞান ছিলি। আর এইদিকে বেশ বড়সড় একটা টর্নেডো বয়ে গেছে আমার উপর দিয়ে।”
দিশার কথা শুনে মেঘ ওর দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো। দিশা বললো
“তুই ফোন করার পর গার্ডদের নিয়ে আমি আর অভি শপিংমল থেকে সোজা ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম তোর উপর অ্যাটাক করা হয়েছে। আর আহির ভাইয়া,মিহির ভাইয়া তোকে নিয়ে ওনাদের হসপিটালে গেছে। এই খবরটা শুনে আমরা ভার্সিটি থেকে ডিরেক্ট ওনাদের হসপিটালে চলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় পথে বসে ফোন করে আংকেল কেও সবটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ওখানে গিয়ে দেখি আহান ভাইয়া,আহির ভাইয়া,মিহির ভাইয়া ওটির বাইরে দাড়িয়ে আছেন। আর মিড়া আন্টি এক সাইডের বেঞ্চে বসে বসে কান্না করছেন। আমি আর অভি ওনাদের সাথে কোনো কথা না বলে এক পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওটি থেকে ডাক্তারের বের হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এরমধ্যেই আংকেল কতোগুলো গার্ড নিয়ে ওখানে চলে আসেন। তারপর সবাইকে বলেন যে উনি তোর ট্রিটমেন্ট ওখানে করাবেন না। তোকে নিয়ে গিয়ে উনি এক্ষুনি অন্য হসপিটালে ভর্তি করাবেন। ব্যাস এখান থেকেই ঝামেলার উৎপত্তি শুরু হয়। আংকেলের কথা শুনে আহান ভাইয়া সাফসাফ জানিয়ে দেয় তোর ট্রিটমেন্ট ওখানে বসেই হবে। ওখান থেকে কেউ তোকে নিয়ে যেতে পারবে না। এটা শুনে আংকেল ভিষন রেগে যায়। আর দুই দলের মধ্যে সমানে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। ঝামেলার এক পর্যায়ে আংকেল গার্ড নিয়ে জোড় করে ওটিতে ঢুকে তোকে বের করে আনার চেষ্টা করে। আর তখন আহান ভাইয়াও ওনার গার্ডদের দিয়ে আংকেলকে আটকে ফেলেন।”
এইটুকু বলে দিলা থামলো।মেঘ চোখ বড়বড় করে দিশার দিকে তাকিয়ে বললো
“তারপর?”
দিশা বললো
“তারপর? তারপর তো যা হবার তাই হলো। ওটির মধ্যে বসে এক দল আরেক দলের উপর গান পয়েন্ট করে দাড়িয়ে রইলো। আর ভিতরে থাকা ডাক্তারেরা সবাই হতোবম্ভ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাই কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমি ওদের মধ্যে ঢুকে দাড়িয়ে পড়লাম। তারপর তোর অসুস্থতার দোহাই দিয়ে এটা সেটা বলে কোনো রকম দুজনকে শান্ত করলাম।”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বললো
“ওহ, তারমানে আমি এখন মিড়া রহমানদের হসপিটালে আছি?”
দিশা মুখ বাকিয়ে বললো
“আজ্ঞে না ম্যাম! আপনি এখন অন্য হসপিটালে আছেন। তোর মাথায় ব্যান্ডেজ করার পর তোকে যখন কেবিনে শিফট করা হয়েছিলো, তার কিছুক্ষন পর আহির ভাইয়া, মিহির ভাইয়া আর আহান ভাইয়া হসপিটাল থেকে বের হয়ে কোথাও একটা চলে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে তোর ওই খারুচ বাপ আর তাড়ছিড়া ভাই তোকে নিয়ে এই হসপিটালে চলে এসেছে। জানিস, মিড়া আন্টি আংকেলের সামনে কতো আকুতি মিনুতি করেছে যাতে তোকে ওখান থেকে ওনি না নিয়ে আসেন সেইজন্যে। কিন্তু আংকেল হসপিটালের এতো গুলো স্টাফের সামনে উল্টোপাল্টা কথা বলে আন্টিকে অনেক অপমান করেছে। এরপর আমরা যখন এম্বুলেন্সে করে আসছিলাম তখন দেখলাম বেচারী রাস্তার পাশের মাটির উপর বসে পাগলের মতো কাদছে।”
কথাটা বলে দিশা মেঘের দিকে তাকালো। কিন্তু মেঘ উদাশীন ভঙ্গিতে এক ধ্যানে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে রইলো। ‘ও’ এমন একটা ভাব ধরে আছে যেনো মিড়া রহমান কি করলো,না করলো তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। মেঘের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে দিশা মোটেও আশ্চর্য হলো না। কারন ‘ও’ বেশ ভালো করেই জানে মেঘের মনে মিড়া রহমানের প্রতি যতোটা তিক্ততা আছে, তাতে মিড়া রহমান দেয়ালের সাথে কপাল ঠুকে মরে গেলেও মেঘের কিছু আসবে যাবে না।
_____________________
রাত 3:00
অন্ধকার একটা রুমের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে তৃধা। ওর ডান পা’টা একদম থেতলে গেছে। ওর সারা শরীরে অসংখ্য মারের দাগ। তৃধার গাল দুটোতে থাপ্পরের দাগে একদম কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। ওর চোখ থেকে নিঃশব্দে পানি গরিয়ে পড়ছে। শব্দ করে কান্না করার শক্তি টুকুও ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। হঠাৎ করে কারো পায়ের শব্দ শুনে তৃধা দরজার দিকে তাকালো। দেখলো রুমের দরজা খুলে একজন ব্যাক্তি ভিতরে প্রবেশ করছে। ভিতরে এসে ব্যাক্তিটি তৃধার দিকে একপা একপা করে এগিয়ে আসতে লাগলো। আর তৃধা ভয়ে পিছনের দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
#চলবে