মিশে আছো মুগ্ধতায় – পর্ব ২৬

0
610

#মিশে_আছো_মুগ্ধতায়
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ26

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ‍্যে ধোয়া উঠা কফি মগ হাতে নিয়ে ব‍্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে মেঘ। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস এসে মেঘের সারা শরীর ছুয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই বাতাসে তো কোনো ভালো লাগা নেই, আছে এক রাশ বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস। যেটা মেঘকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

কফিতে চুমুক দিয়ে কফি মগটা ব‍্যালকনির র‍েলিংয়ের উপর রেখে পাশের টি-টেবিলের উপর থেকে ভাঙা স্কিনের এন্ড্রয়েড ফোনটা হাতে নিলো মেঘ।তারপর ফোনটা অন করে মেসেজ অফশনে গিয়ে এক দৃষ্টিতে ‘ও’ একটা মেসেজের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে মেঘের চোখ থেকে টুপটাপ করে গাল গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো সেটা ‘ও’ টেড়ই পেলো না। মেঘ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে ফোনের স্কিনে ভেষে উঠা মেসেজের উপরে হাত বোলাতে বোলাতে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠলো

“এতোটা সার্থপর কিভাবে হয়ে গেলেন আহান? এই দুটো বছরে একটা বারও আমার কোনো খোজা খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না? আমি বেচে আছি, নাকি মরে গেছি সেটাও জানার চেস্টা করলেন না। আমি কি আপনার কেউ ছিলাম না? আপনি কি কখনো আমাকে এক বিন্দু পরিমানও ভালোবাসেন নি? যদি নাই ভালো বেসে থাকেন তাহলে আমি কেনো সেটা বিশ্বাস করতে পারি না? আমার কেনো মনে হয় যে আপনি আমাকে কখনো ঠকাতে পারেন না?”

কথা গুলো বলে মেঘ ফোনটাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। তারপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বললো

“আমি এখনো এই ফোনটা আমার কাছে রেখে দিয়েছি আহান। আমি আজও আপনার মেসেজের জন‍্যে অপেক্ষা করে থাকি। আমি জানি একদিন আপনি ঠিকই আমার কাছে ফিরে আসবেন। এসে আমাকে সরি বলবেন। তারপর আগের মতো আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ ফিরে আসুন না আহান। আপনার মেঘ আপনার জন‍্যে অপেক্ষা করছে।”

কথা গুলো শেষ করতেই মেঘের কানে কিছু ভাঙার বিকট আওয়াজ ভেষে এলো। ‘ও’ বসা থেকে ধরফরিয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে রুমে এসে কাবার্ড খুলে ফোনটাকে জামা-কাপড়ের মধ‍্যে লুকিয়ে বাইরে যাওয়ার জন‍্যে পা বাড়ালো। রুমের বাইরে আসতেই মেঘের চোখ জোড়া রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেলো। ‘ও’ মাথায় হাত দিয়ে ‘থ’ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

আহির ওর রুমে থাকা আসবাবপত্র গুলো একটা একটা বাইরে ছুড়ে মারছে। আর মিহির রুমের বাইরে দাড়িয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে আহিরের কান্ড দেখছে। মেঘ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে মিহিরের সামনে দাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বললো

“ওই গাধাটা নিজের রুমের জিনিস-পএ ভেঙে ফেলছে। আর তুই এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কোল্ড ড্রিংকস গিলছিস? আটকাতে পারছিস না ওটাকে?”

মিহির কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো

“আমি কেনো ওকে আটকাতে যাবো? আরেহ বাবা বিনা টিকিতে এতো সুন্দর সিনেমা দেখার সৌভাগ্য কয়জনের কপালে জোটে বল তো? আমার তো বেশ মজাই লাগছে। তুইও দেখ, তোরও মজা লাগবে।”

মিহির কথাটা বলার সাথে সাথে আহির একটা বালিশ উঠিয়ে ওর মুখের উপর ছুড়ে মারলো। তারপর চেচিয়ে বললো

“এতোগুলো লোকের সামনে ওই মেয়েটা আমার গায়ে কাচা ডিম ছুড়ে মারলো। তখন তো তুই মেয়েটাকে কিছু বললিই না, আর এখন এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছিস? তুই আমার ভাই নাকি আমার শএু?”

আহিরের কথা শেষ হতেই মেঘ ভ্রু কুচকে বললো

“কাচা ডিম ছুড়েছে মানে? কোন মেয়ে কাচা ডিম ছুড়েছে? তোরা তো বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলি তাইনা? তাহলে সেখানে কাচা ডিম আসলো কোথা থেকে?”

মেঘের প্রশ্ন শুনে মিহির হা হা করে হেসে দিলো। মিহিরকে হাসতে দেখে আহিরের রাগ আরো কয়েক গুন বেড়ে গেলো। ‘ও’ দাতে দাত চেপে মিহিরকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললো

“মিহির একদম হাসবি না বলে দিচ্ছি। তাহলে কিন্তু আজকে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

মেঘ বিরক্তির স্বরে বললো

“আরেহ ধ‍্যাত, ঝগরা ঝাটি না করে, কি হয়েছে আগে আমাকে সেটা বল।”

মিহির কোনো রকম নিজের হাসি চেপে রেখে মেঘকে বললো

“আরেহ ডাক্তার আংকেলের মেয়ের বার্থ ডে গিয়েছিলাম না আমরা? সেখানে কেক কাটা শেষে ওনার মেয়ের ফ্রেন্ডরা আমাকে আর আহিরকে গান গাওয়ার জন‍্যে বলেছিলো। কিন্তু আমি আর আহির সবার মধ‍্যে গিয়ে গিটার নিয়ে গান শুরু করার আগেই কোথা থেকে সাড়িকা এসে আহিরের মুখের উপর পরপর দুটো কাচা ডিম ছুড়ে মারলো। তারপর আহিরকে একটা ভেংচি কেটে এক দৌড়ে পার্টি হল থেকে বের হয়ে পালিয়ে গেলো।আমাদের আহিরও কম যায় না। সেও রেগে গিয়ে বার্থডে গার্লের কেক আর সব গিফট ফ্লোরে ছুড়ে মেরে বার্থডে পার্টির হলটাকে একদম শশ্মান বানিয়ে চলে এসেছে।”

মিহিরের কথা শুনে মেঘ অবাক কন্ঠে বলে উঠলো

“হোয়াআআআট?”

মিহির হাসতে হাসতে বললো

“জানিস যখন আমি আহিরকে ওখান থেকে নিয়ে আসছিলাম তখন মেয়েটার মুখ একদম দেখার মতো ছিলো। আহারে, বেচারী! কতো আশা নিয়ে বসে ছিলো ক্রাশের গান শুনবে বলে। অথচ ওর ক্রাশ গিয়ে ওর বার্থডে পার্টিটারই সর্বনাশ করে দিয়ে চলে এসেছে।”

মিহির এইটুকু বলতেই আহির একটা ফ্লোয়ার ভাস হাতে নিয়ে মিহিরের দিকে তেড়ে আসতে আসতে বললো

“তুই যদি নিজের মুখ থেকে আর একটা কথা বের করেছিস মিহির, তাহলে আজকে আমি তোর মাথা ফাটিয়ে ভর্তা বানিয়ে দিবো একদম।”

মিহির বললো

“আমার মাথা পরেও ফাটাতে পারবি। আগে গিয়ে ভালো করে শাওয়ার নিয়ে আয়। তোর গা থেকে কাচা ডিমের বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছে। এই গন্ধ নিয়ে তুই আর এক মিনিট এখানে দাড়িয়ে থাকলে বাসার সব মানুষ বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাই বলছি এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে যা।”

মিহিরের কথায় আহির নিজের মাথাটা একটু নিচু করে শার্ট থেকে স্মেল নিলো। দেখলো সত‍্যি সত‍্যি ওর শার্ট থেকে কাচা ডিমের গন্ধ বের হচ্ছে। ‘ও’ নাক, মুখ কুচকে রাগি দৃস্টিতে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বললো

“সময় আমারও আসবে। তখন আমি তোকে বোঝাবো কতো ধানে, কতো চাল।”

কথাটা বলে আহির হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর মিহির হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেলো। মেঘ মিহিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো

“এরা এতো বড় হয়ে গেলো। কিন্তু একজন আরেক জনের পিছনে লাগার অভ‍্যাসটা ছাড়তে পারলো না।”

কথাটা বলে মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আহিরের রুম গোছানোর কাজে লেগে পড়লো।
_________________________

আহির ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো ওর রুমটা একদম সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। ‘ও’ বেশ ভালো করেই জানে এইটুকু সময়ের মধ‍্যে এতো পরিপাটি করে রুম গোছানোটা একমাএ ওর বোনের দ্বারাই সম্ভব। ‘ও’ মুচকি হেসে হাতে থাকা টাওয়েলটা চেয়ারের উপর রেখে রুম থেকে বের হয়ে নিচে যাওয়ার জন‍্যে পা বাড়ালো। নিচে এসে দেখলো মেঘ ডাইনিং টেবিলের পাশে দাড়িয়ে ডিনার রেডি করছে। আর মিহির ড্রইংরুমের সোফার হাতলের উপর বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে। আহির নিচে নামতেই মেঘ, আহির আর মিহিরকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললো

“তোরা তো মনে হয় না খেয়েই ওখান থেকে চলে এসেছিস। আমিও এখন পযর্ন্ত ডিনার করিনি। আয় তাড়াতাড়ি খেতে বস।”

আহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিহির বসা থেকে উঠে মেঘের দিকে এগিয়ে এসে বললো

“আজকে আমরা কেউই বাসায় ডিনার করবো না। চল আমরা তিনজন মিলে বাইরে থেকে ঘুড়ে আসি।”

মেঘ চেয়ার টেনে বসে গম্ভীর স্বরে মিহিরকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললো

“কোনো দরকার নেই। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে তার উপর মাম্মাম, বাবাই কেউই বাসায় নেই। এতো রাতে যদি ওনাদের না জানিয়ে আমরা বাইরে যাই তাহলে ওনারা বকা দিতে পারেন।”

মিহির গিয়ে মেঘের হাত ধরে টেনে ওকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে দার করালো। তারপর ধমকের স্বরে বললো

“চুপচাপ উপরে গিয়ে রেডি হয়ে আয়। আমি যখন একবার বলেছি যে এখন আমরা বাইরে যাবো। তারমানে যাবোই! তাই অযথা তুই এমন মুরব্বি মার্কা কথা বলে আমার রাগ উঠাস না। তাহলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে।”

মিহিরের কথা শেষ হতেই আহির মেঘকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে অনুরোধের স্বরে বললো

“হ‍্যা আমারও আজকে মুডের পুরো তেরোটা বেজে আছে। বাসায় থাকতে একদমই ভালো লাগছে না। চল, এই সুযোগে ডিনারটাও করে আসি। আর ছোটো খাটো একটা রাইডও দিয়ে আসি।”

আহির আর মিহিরের কথা শুনে মেঘ বিরক্তির দৃস্টিতে একবার মিহিরের দিকে আরেকবার আহিরের দিকে তাকালো। এদের মাথার মধ‍্যে যে কখন কিসের প্লান ঘুড়পাক খায় সেটা মেঘের মাথাতেই ডুকে না। মাঝে মাঝে ওর আহির আর মিহিরের উপর ভিষন রাগ হয়। কারন ওরা একবার যেটা করবে বলে ঠিক করে, সেটা যেকোনো মূল‍্যে করেই ছাড়ে। আর ওদের ওই অদ্ভুত বায়নার ঝামেলা পোহাতে হয় মেঘকে। মেঘ দাতে দাত চেপে আহির আর মিহিরকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললো

“আমার মাথা চিবানো ছাড়া তোদের সারাদিনে আর কোনো কাজ নেই তাইনা? এইবার একটা বিয়ে করলেও তো পারিস। তাহলে অন্তত আমি তোদের আজব আবদার গুলোর হাত থেকে বেচে যাই।”

আহির মজার ছলে বললো

“আগে তোকে বিয়ে দিয়ে শশুর বাড়ি বিদায় করি। তারপর নাহয় আমরা আমাদের বিয়ের কথা ভা…..”

পুরো কথাটা বলার আগেই আহির কিছু একটা মনে করে দাত দিয়ে নিজের জিব্হ কাটলো। তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘের মুখটা একদম কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আহির মাথাটা নিচু করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। মুহূর্তের মধ‍্যে ড্রইংরুমের পরিবেশটা একদম থমথমে হয়ে গেলো। মিহির কিছু না বলে হনহন করে হেটে বাসার বাইরে চলে গেলো। আহিরও মিহিরের পিছন পিছন বের হয়ে গেলো। মেঘ চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে আসলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here