#কলঙ্কের_ফুল
#পর্ব_৩
#Saji_Afroz
.
.
ছলছল চোখে আদির দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বলে-
যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার বউ আছে। কিন্তু কোনো সন্তান নেই। মানে তার বউ সন্তান জন্মদানে অক্ষম। সেইজন্য আমাকে বিয়ে করতে চায় সে। যাতে আমি তাকে বংশধর দিতে পারি।
.
শান্ত গলায় আদি প্রশ্ন করে-
আপনার মা বাবা এমন একজন পাত্রের সাথে আপনার বিয়ে কেনো দিতে চাইছেন?
.
মাথা নিচু করে জবাব দেয় মেহেরীকা-
সেই অনেক কথা। আমি এই বিয়েটা করতে পারতাম না তাই পালিয়েছি।
-হুম।
.
আদির দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বলে-
আপনার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার কি সমস্যা?
-তেমন কিছুনা। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন আমার কারো সাথে…
-কাল আপনার বন্ধুকে বলেছিলেন তখন শুনেছি।
-তখন আপনার শরীর খারাপ ছিলো অনেক, এতো কিছু মনে আছে?
-হুম। শরীর খারাপ হলেও সেন্স ঠিক থাকে আমার।
-বাহ ভালোইতো!
.
কিছুক্ষণ নীরব থেকে মেহেরীকা বলে-
আমি চলে যাবো।
-বাসায়?
-নাহ।
-কোথায় যাবেন তাহলে?
-জানিনা।
-যদি সমস্যা না হয় আজ এখানেই থাকুন, কাল আপনাকে সাথে নিয়ে আপনার বান্ধবীর বাসায় গিয়ে দেখবো সে এসেছে কিনা।
-যদি না আসে?
-তখন না হয় ভাবা যাবে।
-ঠিক আছে।
-আচ্ছা আপনি রেস্ট নিন, আমি আসি এখন।
-হুম।
.
.
আদির রুম থেকে ছুটে এসে দিবা বলে-
ভাইয়াতো রুমে নেই বাবা।
.
চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে আমজাদ চৌধুরী বলেন-
আছে হয়তো কোথাও। ফোন দাও তাকে। বাচ্চার মতো লুকোচুরি খেলছে নাকি মেয়ের মতো কোথাও বসে কাঁদছে জিজ্ঞাসা করো।
-জ্বী বাবা, দিচ্ছি ফোন।
.
বাবার কথামতো দিবা ডায়াল করে আদির নাম্বারে।
একবার রিং হতেই আদি রিসিভ করে….
-হ্যালো দিবা?
-ভাইয়া তুই কইরে? নাস্তা খেতে আয়।
-আমি বাসায় নেই।
-বাসায় নেই মানে?
-বাবাকে জানিয়ে দে আমি বাসায় ফিরবো না আর। সানিয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
-তুই কি বলছিস কিছু বুঝছিনা আমি!
.
-আদি কি বলছে দিবা??
.
মায়ের করা প্রশ্নে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দিবা উত্তর দেয়-
ভাইয়া নাকি বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছে, আর ফিরবেনা।
-মানেটা কি! দে ফোনটা আমাকে দে।
.
সালেহা চৌধুরীর হাতে মোবাইল দিতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বলেন-
বাবা কোথায় গিয়েছিস তুই? চলে আয় বাবা, রাগ করেনা।
-বাসায় ফিরলে সানিয়াকে আমার বিয়ে করতে হবে। আর আমি তাকে বিয়ে করতে চাইনা মা।
-এমন পাগলামি করেনা বাবা।
-ওকে করবোনা। বাবাকে বলো সানিয়ার কথা যেনো আমায় আর না বলে।
-সানিয়ার কথা তোকে আর বলবেনা। তুই ফিরে আয় বাবা।
.
স্ত্রীর মুখে কথাটি শুনেই মেজাজ বিগড়ে যায় আমজাদ চৌধুরীর। একেতো ছেলে দোষ করেছে, আবার সেই ছেলের সাথে তোষামোদ করে কথা বলা হচ্ছে!
রাগে কটমট করে তিনি উচ্চশব্দে বলে উঠেন-
এই বাড়িতে ফিরে এলে সানিয়াকে বিয়ে করতেই হবে তার। নাহলে সে যেখানে আছে সেখানেই থাকতে বলো। আর তোমরাও কেউ যদি ওর হয়ে কথা বলতে আসো খারাপ হবে, খুব খারাপ হবে।
.
কথাটি বলে নাস্তা না সেরে আমজাদ চৌধুরী টেবিল ছেড়ে হনহন করে হেটে এগুতে থাকে নিজের রুমের দিকে।
.
এদিকে ফোনের ওপারে বাবার বলা কথাগুলো শুনে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে মায়ের উদ্দেশ্যে আদি বলে-
আমাকে নিয়ে ভেবোনা, আমি ভালো আছি। তোমারাও ভালো থেকো।
.
আর কিছু না বলে আদি লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দেয়।
ভেবেছিলো এমন কিছু করলে তার বাবার মনটা নরম হবে।
এখন কি হবে! নিজের পরিবার ছাড়া কিভাবে থাকবে সে?
.
আদিকে চিন্তিত মুখে সোফায় বসে থাকতে দেখে সিরাজ তার পাশে এসে বসতে বসতে বলে-
কি হলো দোস্ত?
-বাসা থেকে ফোন দিয়েছিলো, বাবা বলেছে সানিয়াকে বিয়ে না করলে না ফিরতে।
-ফিরবিনা। এখানে থেকে যা।
-আচ্ছা! কয়দিন বসায় বসায় খাওয়াবি?
-বসে বসে কেনো খাবি! আমাদের কাজের মেয়েটা চলে গিয়েছে, নতুন কাজের মানুষ পেতে ঝামেলা। তুই যদিও ছেলে তবুও চাইলে…..
-সিরাইজ্জা….! চৌধুরী বাড়ির পোলাকে দিয়ে তুই বাসার কাজ করাতে চাস?
-হাহাহাহা। তুইতো বসে খেতে চাইছিস না তাই।
-হু।
-এখন কি করবি?
-মাথায় কিছু আসছে নারে। কি করলে বাসায় ফিরতে পারবো! উফ্ফ…. এই সানিয়া মেয়েটা আমার লাইফ টাই শেষ করে দিলো। দোস্ত কোনো বুদ্ধি দেনা।
-উম্ম… ভাবতে দে আমাকে একটু।
.
ট্রে নিয়ে বৃষ্টি তাদের দিকে এগিয়ে এসে ছোট টেবিলটার উপর রেখে বলে-
ভাইয়া আপনার জন্য পরোটা বানিয়েছি গরম গরম। মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে ভালো লাগবে খেতে।
-ধন্যবাদ ভাবী।
-কাল রাতে আপনাদের কারো কাছেই ক্ষিদে লেগেছে কিনা জিজ্ঞাসা করিনি আমি। এতো বোকামি করি মাঝেমাঝে।
-আরেনা ঠিক আছে। আমিতো খেয়েছিলাম বাসায় রাতের খাবার। মেহের খেয়েছে কিনা জানিনা। তাকে দিয়েছেন ভাবী?
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বৃষ্টি বলে-
এহেম এহেম… মেহেরীকা থেকে মেহের!
কি ব্যাপার ভাই?
-কি ব্যাপার হবে ভাবী! কোনো ব্যাপার না। মেহেরীকা নামটা বড় তাই আর কি।
-আচ্ছা বুঝলাম। হুম দিয়েছি। আপনারাও খেয়ে নেন।
.
বৃষ্টি চলে যাওয়ার পরে সিরাজ বলে উঠে-
আদি পেয়েছি আইডিয়া।
-কি?
-তুই তোর বউ নিয়ে বাসায় উঠ।
-মানে!! মাথা ঠিক আছে তোর? বউ কোথায় পেলি?
-আরে ব্যাটা নকল বউ।
-আমিনা কিচ্ছু বুঝছিনা, কি বলছিস তুই?
-তুই বাসায় ফিরেলেই তোকে সানিয়ার সাথে বিয়ে করিয়ে দেবে। তাইতো?
-হুম।
-কিন্তু তুই যদি বউ নিয়ে যাস তোকে কি করে বিয়ে দিবে বস?
.
সিরাজের কথাগুলো বুঝতে আদির ১৫সেকেন্ড সময় লাগে।
হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে সিরাজের দিকে তাকিয়ে বলে-
দারুণ আইডিয়া দোস্ত, দারুণ আইডিয়া।
-জানতাম পছন্দ হবে।
.
কিন্তু নকল বউ কোথায় পাবে ভেবে আদির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
.
-কিরে মুখটা এমন হলো কেনো আদি?
-বউ পাবো কই?
-হাহা এই ব্যাপার! বউতো ঘরেই আছে দোস্ত।
-তোর বউ?
-দূর শালা।
-হেহে। তো কে?
-মেহেরীকা।
-মেহের!!
-হুম সে।
-কিন্তু তিনি রাজী হবেন নাকি!
-কেনো হবেন না? বিপদে পড়েছে, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বান্ধবীর বাসায় উঠলেও কতোদিন থাকবে সেখানে!
-কিন্তু তিনি আমাকে সাহায্য করবেন কেনো?
-টাকার বিনিময়ে। মোটা অংকের টাকা দিবি বলবি কিছুদিন তোর বউ সেজে অভিনয় করার জন্য। এই সময় তার টাকা খুব প্রয়োজন। আমি সিউর রাজী হবেন।
-যদি না হয়?
-আগেভাগে এতো কথা বলিস কেন তুই! নাস্তা খেয়ে যা কথা বলে আয় মেহেরীকার সাথে। কি বলে দেখ।
-হুম।
.
.
.
-তোমার জন্য আজ আমার ছেলে ঘর ছাড়া। সানিয়া আর এরশাদ তোমার কাছে আপন হয়ে গেলো। ছেলের ইচ্ছা, অনিচ্ছা কিচ্ছু দেখলেনা তুমি। কেমন বাবা তুমি!
.
একনাগাড়ে স্ত্রীর বকবকানি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যায় আমজাদ চৌধুরীর।
অনেকক্ষণ চুপ থাকলেও এপর্যায়ে মুখ খুলেন তিনি…
-আহ থামোতো! তখন থেকে প্যানপ্যান করে আমার মাথাটা খাচ্ছো তুমি।
-আমি তোমার মাথা খাচ্ছি? আমি! তুমি যে আমার ছেলেটাকে বাড়ি ছাড়া করলে….
-আমি কাউকে বাড়ি ছাড়া করিনি। যে গিয়েছে সে নিজ ইচ্ছেই গিয়েছে। তাকে আমি ফিরে আসতেও বলেছি।
-ফিরলে সানিয়ার সাথে বিয়ে করিয়ে দিবে বলেছো। এটা বলার কি খুব দরকার ছিলো? পরে না হয় বুঝিয়ে….
-যা বুঝানোর বুঝিয়েছি। আর কিছু বুঝানোর নেই। আর হ্যাঁ আমি এক কথার মানুষ। সামনে একটা পেছনে আরেকটা আমি বলিনা। যা বলার সোজাসুজিভাবে বলি। তোমার ছেলে সানিয়াকে বিয়ে করবে বললেই বাসায় আসতে পারবে।
.
সালেহা চৌধুরীকে চুপ থাকতে আমজাদ চৌধুরী বলেন-
চলে আসবে আদি। না এসে কোথায় যাবে! কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরো।
-হুম।
-আমি এরশাদকে ফোন করে সবটা জানায়। সানিয়াকে এখন কিছু না জানাতে বলি।
-আদি পালিয়েছে বলবে তুমি উনাকে?
-হুম বলবো। তার জানা দরকার।
-ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বুঝো।
.
.
.
বিছানার মাঝখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে মেহেরীকা। দুইটা ফোন নাম্বার তার মনে রয়েছে। একটা বাবার আরেকটা রাজীবের।
ছোট বেলা থেকে বাবা-ই মেহেরীকার আদর্শ ছিলো। মা মারা যাওয়ার পর তাদের দুই বোনের কথা ভেবে তিনি আর বিয়ে করতে চাননি। মেহেরীকার যখন বয়স ১৬ তখন তার মা মারা যান ক্যান্সারে। তার ছোট বোনের বয়স ১৪। তাদের দুই বোনের বিয়ের পর বাবা একেবারেই একা হয়ে যাবে ভেবে বাবাকে সে নিজে আরেকটি বিয়ে করার জন্য রাজী করিয়েছিলো। যেটি তার জীবনে ভূল সিন্ধান্তের মাঝে একটি ছিলো। কেননা যে বাবা মেহেরীকার কথা ছাড়া কোনো কিছুই করতোনা সে বাবা নতুন বউ এর কথা শুনে তার এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছেন যে লোকের কিনা অন্য একটি বউ আছে।
তার একটা কথাও তার বাবা শুনতে চাননি।
আর রাজীব….!
রাজীব তার সাথে কি করে এমন করতে পারলো!
খুবতো বলতো যাই হোক না কেনো কখনো ছেড়ে যাবেনা। আর এখন……
নাহ আর ভাবতে পারছেনা সে। এসব কথা মনে হলেই পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে এলোমেলো লাগে, নিজের জীবনের প্রতি মায়া কমে যায় তার।
বাবা, ছোট বোন মুনিয়া, রাজীব তাদের ছাড়া কিভাবে থাকবে সে!
অনেক বেশি মনে পড়ছে মেহেরীকার তাদের কথা।
একটা দূর্ঘটনা তার জীবনটা এলেমেলো করে দিলো পুরো।
.
.
.
নাস্তা সেরে আদি এগুতে থাকে মেহেরীকার রুমের দিকে। তিনি কি রাজী হবেন আদির প্রস্তাবে? যে মেয়ে তিনি মনেতো হয়না হবেন। তবুও একবার চেষ্টাতো করাই যায়।
.
.
(চলবে)