জীবনসঙ্গী
পর্ব ১৫
writer Tanishq Tani
আয়নায় সামনে দাড়িয়ে আয়নার ভেতর থেকেই শশীকে একদৃষ্টিতে দেখলো অনিকেত,, দুজনের কিছুক্ষন চোখাচোখি হলো,,
অনিকেত কিছু না বলেই চোখ সরিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে,,,যাবার সময় একটিবার পেছন ফিরে তাকালো না,,
অনিকেতের এমন আচরণ শশীর মনে যথেষ্ট আঘাত দিলো,,নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে,,কিভাবে অনিকেতের সামনে নিজের অনুভূতি জাহির করে দিলো,,
অনিকেত হয়তো এখন আর এসব পছন্দ করে না,,তাইতো সব শুনেও কিছু না বলেই চলে গেলো,,
ভালোবাসা প্রকাশ করলে তার কদর কমে যায়,,
চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠলো শশীর,,,
ভাবি কি হলো বসে আছ কেন,,ওমা তুমি দেখি এখনো তৈরি হও নাই,,যাবা না?
কোথায় যাব ফারিহা?
কেন ভাইয়া বলে নাই তোমাকে?
না,,মন খারাপ করে বলে,,
ওহ!হয়তো ভুলে গেছে,,আমার এক কাজিনের এংগেজমেন্টে এ যেতে হবে সবাইকে,,
চলো তোমাকে আমি রেডি করাই দেই,,,
বাহ! ভাবি তোমার শাড়িটা তো দারুন,,
ফারিহা শশীকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়,,খোঁপার পাশে গাজরা গুজে,,সাথে চোখে গাঢ় কাজল,ঠোটে লাইট লিপিস্টিক,কপালে নীল টিপ,,হাতভর্তি নীল চুড়ি,,
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় এই মুহূর্তে শশীর কাছে যে এই জিনিসগুলো ওর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফারিহা বের করে,,কিন্তু শশী নিজেও জানে না এগুলো কোথা থেকে আসলো,,
ফারিহা আমার ড্রয়ারে এসব আছে তুমি কি জানলে,,
কেন তোমাকে বলেছিলাম না? আমার কাছে জাদু আছে,,,
হুমম,,ঘোড়ার ডিম আছে,,কে আনছে বলো না,,
কে আর আনতে পারে বোঝো না,, তোমার স্বামী মহাশয়,,,
শশীর মন কথাটা শুনেই ভালো হয়ে গেলো,,
খুশি খুশি সেজেগুজে বাড়ি থেকে সবাই বের হলো,,,গাড়ির সামনে এসে শশী অনিকেত কে খুজে বেরায়,,গাড়িতে ওঠো,,
পেছন থেকে হঠাৎ কারো আওয়াজে চমকে ওঠে,,পেছন ফিরে দেখে অনিকেত
আপনি কই ছিলেন,,,হেসে বলে
ছিলাম কোথাও,,গম্ভীর স্বরে
এটা কেমন ধরনের উত্তর শশীর মোটেও ভালো লাগে না অনিকেতের এমন নিরস উত্তর,,,
অনিকেত শশীর উত্তরের অপেক্ষা না করে গাড়িতে উঠে গেলো,,,
শশীর খুব কান্না পায় অনিকেতের এমন ব্যবহারে,,যার জন্য এতো সুন্দর করে সাজলাম,,সেই মানুষটা একটু ভালো করে দেখলোও না,,বললোও না শশী তোমাকে আজ মায়াবতী রাজকন্যা লাগছে,,,
অনিকেত নামক রাজপুত্রের রাজকন্যা,,
বউ মা তুমি অনির সাথে সামনে গিয়ে বসো,,
শশী সামনে বসতে যাবে তখনি অনিকেত বলে ওঠে,,
নো মম,,রাতুলরা সামনেই ওয়েট করছে,,,আমরা সবাই এই গাড়িতে যাব,,ও তোমাদের সাথে পেছনের গাড়িতেই বসুক গিয়ে,,,
আচ্ছা তোমরা আস,,আমি সামনে ওদের পিক করে ওয়েট করবো তোমাদের জন্য,,
ড্রাইভার! ড্রাইভার!
জ্বী ভাইজান!
বাড়ির সবাইকে নিয়ে রাতুলের বাসার সামনে গাড়ি থামিও,, আমি ওখানে থাকবো,,
জ্বী,,
অনিকেত কাওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়,,,
অনির মা সহ বাড়ির সবাই শশীর দিকে স্বান্তনার দৃষ্টিতে তাকায়,,
শশী মেকি হাসি দিতেই সবাই গাড়িতে উঠে যায়,,,
ভাবি তোমার কি খারাপ লাগছে ভাইয়া যে একা একা চলে গেলো,,বুঝলাম না ভাইয়াটা এমন করলো কেন? ঝগড়া করছ নাকি?
আরে তেমন কিছু না,,হয়তো বন্ধুদের সাথে যাবে তাই,,শশী চাপা হাসি দিয়ে ফারিহা কে বলে,,
পুরো রাস্তায় ফারিহা নাসিফ কতো হাসি ঠাট্টা করে,,শশী শুধু ওদেরকে দেখানোর জন্য জোর করে হাসি দেয়,,
চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পরে থেকে থেকে,,
চোখের কোনার কাজল টা লেপ্টে গেছে কিছুটা,,
গাড়ি এসে থামে অনুষ্ঠানের ভেন্যুতে,,রাস্তায় অনিকেত ড্রাইভার কে কল দিয়ে বলেছে একবারে এখানেই চলে আসতে না থেমে,,
সবাই গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকে,,
ফারিহা, নাফিস, শশী, মা,ছোট মা একইসাথেই বসে একটা টেবিলে,,
শশীর শ্বশুর দূরে ছোট চাচা ও অন্যান্য লোকদের সাথে দাড়িয়ে আলাপ করছে,,কিছুক্ষণ পর মা, ছোট মা ও তাদের কাছে গেলো,,,
দাদাভাই! দৌড়ে অনিকেতের কাছে ছুটে যায় নাসিফ,,,
শশী ফারিহা দুজনেই অনিকেতের দিকে তাকায়,,অনিকেত একনজর ওদের দিকে তাকিয়ে নাসিফের হাত ধরে ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে থাকে,,
শশী চেয়ে আছে করুন দৃষ্টিতে অনিকেতের দিকে,,অনিকেত আড়চোখে শশীর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে বন্ধুদের সাথে,,
শশী নিচে তাকিয়ে হাতের চুড়িগুলো নাড়াতে নাড়াতে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে,,
বুকের বাম পাশটায় ভীষণ রকম কষ্ট অনুভব করছে অনিকেতের এমন অবহেলায়,,
বউ মা! শশী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাড়াতেই দেখে শ্বাশুড়ি ২ জন ভদ্রমহিলা সহ সামনে দাড়িয়ে আছে,,,এর মধ্যে একজন কে ও চেনে,,হ্যাঁ রুবিনা আন্টি রিমির আম্মু
এরা হচ্ছে তোমার খালা শ্বাশুড়ি,,
আমার ২ বোন,,এনি হচ্ছে মিনারা তোমার বড় খালা শ্বাশুড়ি আর ও হচ্ছে রুবিনা তোমার ছোট খালা শ্বাশুড়ি,,,
শশী সবাইকে সালাম করে,,রুবিনা আন্টি তো শশীকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে,,
কিন্তু বড় খালাম্মা মনে হয় খুশি হন নি আমাকে দেখে,,তেমন কোনো কথায় বললো না,,মুখটা কালো করে থাকে,,
আন্টি রিমি কই?
কেন তুই কিছু জানিস না,,
না আন্টি! ওর মনে আমি কষ্ট দিয়েছিলাম,, তাই হয়তো এখনো রাগ করে আছে আমার উপর,,,
ওহ্! ফারিহা,,
জ্বী খালামনি,,
শশীকে নিয়ে ভেতরে যা,,
আচ্ছা,,,
বড় আপা! তুমি একটু মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কি হতো,,মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে মনে হয়,,
তুই চুপ কর রুবিনা,,আর অরুনা,,আজ আজিম না বললে তো জানতামই না তুই আর অনি যে এতোবড় সর্বনাশ করেছিস,,
অনি তো বাচ্চা ছেলে,,তুই তো মা,,তুই কি করে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলি,,একটা ফকিন্নি তালাক হওয়া মেয়েকে ওর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে,,
আপা চুপ করো,,শশী শুনবে তো,,কিসব বলছ তুমি,,,
শুনুক,,এই মেয়েকে আমি অনিকেতের জীবন নষ্ট করতে দেবো না,,আমার প্রিন্সের মতো বাবাটার জীবনে তুই এইরকম একটা মেয়ে কি করে আনতে পারলি,,
শশী যেতে যেতে খালাম্মা কথা সব শোনে,,ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে শশীর,,আটকে রাখা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে,,
ফারিহা এসব কথা শুনে ভাবিকে তাড়াতাড়ি টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়,,
আপা! তুমি আমি এসব বলার কেউ না,যাদের জীবন তারাই সঙ্গী বেঁছে নিয়েছে,, আমার অনির খুশিই আমার কাছে সব,,তাছাড়া শশী লক্ষিমন্ত একটা মেয়ে,,মানুষের জীবনে দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে,
তালাকপ্রাপ্তা হওয়া কোনো পাপ না,,
আজ যদি তোমার আমার মেয়ের সাথে এমন হতো?
আমার তোর মেয়ের সাথে এমন হবে না,,কারন আমাদের মেয়ে খারাপ না,,খারাপ মেয়েদেরই তালাক হয়,,আর আমার মেয়ে তালাক নিতে চাইলে গলা টিপে মেরে ফেলবো না ওকে,,মেয়েরা রঙিন কাপড়ে পালকিতে শ্বশুরবাড়ি যায় আর সাদা কাফনে খাটিয়ায় শুয়ে সেই বাড়ি থেকে বের হয়,,
এটাই নিয়ম,,
ছি! আপা,,এই একবিংশ শতকে এসে তোমার মুখে এসব কথা মানায় না,,তুমি যা বললে তা হচ্ছে আদিম বর্বরতা,,মেয়ে মানুষ কোনো সস্তা জিনিস না,,যাকে যেভাবে ইচ্ছা যে কেউ ব্যবহার করবে,,
আল্লাহ পাক পুরুষের মতো মেয়েকেও সমান মর্যাদা দিয়েছে,,আদিম যুগের সকল বর্বরতা কে বাতিল করে মেয়েদের স্বাধীনতা দিয়েছে ইসলাম,, কিন্তু তোমাদের কথা মনমানসিকতা দেখে স্পষ্ট বোধগম্য তোমরা ধর্মের সারমর্ম এখনো বোঝো নাই,,
যুগ পাল্টে ছে আপা,,স্বামীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে শিখেছে মেয়েরা,,কেন উঠতে বসতে অত্যাচার নিপীড়ন সইবে,,
স্বামীর অত্যাচারে গলায় ফাস লাগিয়ে মরা ভালো,,কিন্তু তালাক নেওয়া ভালো না তাই না?
স্বামীর হাতে মরা পুণ্য কিন্তু তালাক নেওয়া পাপ,,
স্বামী পরকীয়া কিংবা বহুনারীর কাছে যেতে পারবে কিন্তু স্ত্রীকে মাটি কামড়ে পড়ে স্বামীর সব কুকির্তি সয়ে যেতে হবে,,তবেই সে ভালো বউ,,তালাক দিয়ে অত্যাচার থেকে মুক্তি চাইলেই বউয়ের চরিত্রে দোষ,,বউ খারাপ,,বাহ্ আপা কি অদ্ভুত নিকৃষ্ট বর্বর নিয়ম তোমাদের,,,
আপা! মেয়েদের জীবনেরও মূল্য আছে,তারাও মানুষ এটা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে আধুনিক মেয়েরা,,এতেই তোমাদের মতো আদিম ধ্যানধারণার মানুষের চোখ টাটানো শুরু হয়ে গেছে,,
ভাবি তুমি কেদো না,, বড় খালামনি একটু সেকেলে তো তাই এমন করে,,আর একটু কড়া স্বভাবের,,তুমি তার কথায় কষ্ট পেয়ো না,,
না না ফারিহা,,আমি কিছু মনে করি নাই,,তিনি তো সত্যি বলেছে,,
আমার মতো মেয়ের তো কোনো যোগ্যতা নাই তোমার ভাইয়ের স্ত্রী হওয়ার,,
অনি ভাই!শশীর পেছনে তাকিয়ে,,
ফারিহার মুখে অনির নাম শুনে শশীর গলা শুকিয়ে আসে,,শাড়ি শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে থাকে,,,
ফারিহা মমকে বলিস আমি বাসায় চলে যাচ্ছি শশীকে নিয়ে,,,
আচমকা শশীর হাত ধরে খুব দ্রুত সামনে হাটতে লাগলো,,শশী অনিকেতের হাটার সাথে তাল মেলাতে পারে না,,কিছুটা দৌড়ের স্পিডে হাটতে হয় শশীকে,,বোঝায় যাচ্ছে রেগে আছে অনিকেত,,
চলবে