#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১২ ( প্রথমাংশ )
.
মায়া জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। কখন কোথায় কার প্রতি যে তীব্রভাবে মায়ায় আঁটকে যায় মানুষের ছোট মন, সেটা বোঝা নিতান্তই কঠিন একটা কাজ। কোন জিনিসের প্রতি মায়ায় আঁটকে গেলে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা কষ্টকর। হোক সেটা কোন বস্তু, প্রাণী বা কোন জলজ্যান্ত কোন মানুষ। ভালো না বাসলেও গভীরভাবে আকৃষ্ট করে তাদের প্রতি। অন্যরকম একটা টান ও ভালোলাগা কাজ করে। ঠিক তেমনি আমার এই ছোট্ট মনটায় হঠাৎ করেই কারোর প্রতি মায়ার উদয় হয়েছে। চাইলেও কাটিয়ে উঠতে পারছি না সেই অদৃশ্য মায়ার বেড়াজাল থেকে। সেদিনের পর থেকে বিগত এই দেড় মাসে তাসফি নামক বজ্জাত লোকটার প্রতি নাম না জানা এক মায়ায় আটকে গেছি যেন। যে মানুষটার সাথে কথা বলতে গেলে গলায় এসে আঁটকে যেত, অকারণে ভয় পেতাম, তার সাথে এখন অনেক স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে পারি। কিন্তু ভয়টা কোন ভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারি নি।
হঠাৎ করেই নিজেকে অনেক বড় বড় লাগে। তাসফি ভাইয়ের সাথে এক অদৃশ্য মায়ায় আঁটকে যাবার পর এক অন্য আমিতে পরিণত হয়েছি যেন। বারবার মনে হয়েছে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যই এমন অবুঝ হয়ে যাচ্ছে আমার অবাধ্য মন? কিন্তু আমি তো কোনদিক থেকেই উনার যোগ্য নয়। প্রতিদিন উনার দেওয়া খোঁচা গুলো বারবার করে আমাকে সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।
উনার দেওয়া খোঁচাগুলো আমলে না নিলেও সেই রাতে উনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে, উনার মাঝে এক অন্য তাসফি ভাইকে দেখে কেন জানি উনার প্রতিটি কথায় অনেক খারাপ লাগতো। হঠাৎ সেই সন্ধ্যা রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল।
.
তাসফি ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে চেয়েও পারছিলাম না। কেন যেন উনার দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কিন্তু অবাধ্য চোখ দুটো বারবার এই বজ্জাত লোকটার দিকেই যাচ্ছিলো। আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে বজ্জাত লোকটা সযত্নে নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমের দেশে তলিয়ে গিছিলো। তাই অনেকটা সাহস নিয়ে তাকালাম তাসফি ভাইয়ের দিকে। উনার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম যেন। এভাবে কখনোই দেখা হয় নি উনাকে, আর না এতটা কাছে এসেছি। একদম বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টো ঘুমিয়ে আছেন। ফর্সা মুখটায় পানির ছোঁয়ায় আরও স্বজীব হয়ে উঠেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, মেয়েদের মতো লাল-গোলাপি ঠোঁট, গায়ে আধ ভেজা কালো শার্ট। একদম আমার কল্পনায় রাখা মানুষটার মতো। তখন নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেও আবারও চমকে উঠলাম, সাথে সেই চিরচেনা বুকের বা পাশটা ধুকধুক করে উঠলো। মনে হচ্ছে এই ধুকধুক শব্দটায় তাসফি ভাইয়ের গভীর ঘুম এখনই ভেঙে যাবে। বার কয়েক জোরে শ্বাস নিয়ে বুকে হাত দিলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারলেও পুরোপুরি ভাবে পারলাম না।
আমার এই কিছুটা স্বাভাবিক হওয়াকে আরও দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। চমকে উঠে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম বড়মা থতমত খাওয়া মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন খাবারের ট্রে হাতে। বড়মাকে দেখে চমকে উঠে বুকটা আরও জোরে ধুকধুক করতে লাগলো। তাড়াহুড়ো করে তাসফি ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে উঠতে চেয়েও পারলাম না। আমার সামান্য নড়ে ওঠায় উনি পুরো মাথাটায় এবার আমার কোলে রাখলেন, দু’হাতে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো আমার কোমর। আমি যেন আর নিজের মধ্যে নেই। বড়মার সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সে একদম অবাঞ্ছনীয়। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই বজ্জাত লোকটার গলা চেপে ধরি। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বড়মা আস্তে করে বলে উঠলো,
“ইস্! ছেলেটা কত ক্লান্ত, তা না হলে এভাবে ঘুমিয়ে যায়? সেই সকালে নাকি বাসা থেকে বেড়িয়েছে, সারাদিন কি খেয়েছে না খেয়েছে। বসার সময়টাও হয়তো পায় নি, এখন দেখ এভাবেই ঘুমিয়ে গেছে।”
এগিয়ে এসে টেবিলে খাবারের ট্রে রেখে দিলো বড়মা। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তাসফি ঘুম থেকে উঠলে খেতে বলিস ওকে, সাথে তুইও খেয়ে নিস। সকাল থেকে হয়তো কিছুই মুখে তুলেনি ছেলেটা।”
চুপ করে মাথা নিচু করে রইলাম আমি। বড়মার দিকে তাকানোর সাহসটা নেই আমার। তাই নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ালাম। আমার মাথা নাড়ানো দেখে চলে যেতে গিয়েও আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
“এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তাসফি তো আর তোর অন্য কেউ নয়।”
ফট করে মাথা তুলে তাকালাম বড়মার দিকে। আমার এমন ভাবে তাকানো দেখে শব্দবিহীন হাসলো। বড়মার বলা কথা ও হাসি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম আমি।
“ভুল কি বললাম রে মা? তাসফির সাথে তো তুই সবচেয়ে পবিত্র বন্ধনে বেঁধে গেছিস। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া চাইলেও কেউ তোদের আলাদা করতে পারবে না। সেদিন কোন ভুল না করেও সবাই তোদের ভুল ভেবেছে। কিন্তু এখন তোদের এভাবে থাকাটা কেউ ভুল চোখে দেখবে না, সে পথটা সেদিনই বন্ধ হয়ে গেছে। আর কাউকেই ভয় পাবার প্রয়োজন নেই। তাসফির সাথে সময় কাটা, বোঝার চেষ্টা কর । দেখবি রাগী, কথায় কথায় তোকে ধমক দেওয়া তাসফি না এক অন্য তাসফি কে দেখতে পাবি।”
এই মুহুর্তে বড়মাকে আমার কি বলা উচিত বুঝতে পারছি না। আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম,
“তাসফি ভাইয়া আ..আসলে এএভাবে ঘুম…..”
“তাসফি তোর স্বামী হয়, বড়মাকে দেখে লজ্জা অস্বস্তি নিয়ে থাকতে হবে না। আমি দরজা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে যাচ্ছি কেউ আর আসতে পারবে না। তাসফি উঠলে ওকে খেতে বলিস।”
“বড়মা, দরজা লক করতে হবে না….”
আমার কথাটা শুনতে পেল না বড়মা। কথাটা শেষ হবার আগেই চলে গেলেন, আর যাবার আগে দরজার লক ভেতর থেকে টিপে দিয়ে দরজা আটকে দিতে ভুলে গেলেন না। ইস্! কেমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হলো বড়মার সামনে। যদিও তাসফি ভাইয়ার সাথে কিছুই ছিলো না, তবুও কিভাবে দাঁড়াবো বড়মার সামনে আমি। আজকে আমার সাথে সবকিছুই যেন অন্যরকম কিছু ঘটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নতুন কোন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে যাচ্ছি। বড়মার কথাগুলো বারবার আমার এই ছোট্ট মস্তিষ্কে আঘাত আনছে। আসলেই তো আমি এই রাগী রগচটা লোকটার সাথে বিয়ে নামক এক পবিত্র বন্ধনে আঁটকে গেছি।
.
.
চলবে…..
ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সারাদিনের ব্যাস্ততায় এতটুকুই লেখার সময় পেয়েছি। এই পর্বে বাকী অংশ আগামীকাল দিবো ইনশাআল্লাহ।🙂