তুমি বললে আজ – পর্ব ১১

0
594

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১১

.
বরাবরের জন্য বই প্রেমি একজন মানুষ হলেও সামনে রাখা বইগুলোর প্রতি আজকে আমার ব্যাপক অনিহা কাজ করছে। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছা থাকলেও আগ্রহটা বরাবরই অনেক কম। ভালো কোথাও ভর্তি হবার ইচ্ছে থাকলেও এখন পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা একদমই হচ্ছে না। পরীক্ষার এতদিন পর বই নিয়ে বসায় তারাও যেন রাগ করে আছে আমার অলসতার উপর। কিন্তু কিছু করার নেই। কারণ রেজাল্টের পরের দিন থেকেই আমার এডমিশন পরীক্ষার জন্য টিউটর হিসেবে যুক্ত হয়েছেন দ্যা গ্রেট তাসফি ভাই। বজ্জাত লোকটা সবসময় আমাকে বাঁশ দেবার জন্য পিছনে লেগেই থাকে, আর যেন কোন কাজ খুঁজে পায় না।
রেজাল্ট দেবার পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই মিলে গল্প করতে করতে একসময় আমার ভর্তি হবার ব্যাপারটা উঠে। তখন বড় বাবাই কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার কথা বললেও তাসফি ভাইয়া খুবই দৃঢ়তার সাথে বলে সে নিজে থাকতে কারোর এতো চিন্তা করার দরকার নাই। সে নিজেই আমায় পড়ানোর দ্বায়িত্ব নিবেন। আর কি লাগে, সবাই তো হাত-পা ছেড়ে মহাখুশি।

সেদিন সকালেই রিমি আপু ও ভাইয়া চলে যান। ফুপি যেতে চাইলেও বড়মা আরও দু’দিন আঁটকে রেখেছিলেন ফুপিকে। সেদিন থেকেই আবারও পড়াশোনার প্রতি পীড়া দেওয়া শুরু হয়ে যায় বজ্জাত লোকটার। আজকে নাকি খুব ব্যাস্ত থাকার কথা তাসফি ভাইয়ের, কোন একটা কাজে। মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলাম। প্রায় একমাসে আমার জীবনটা পুরো তেজপাতা বানিয়ে দিয়েছেন উনি। কোন ভুল হলেই কান ধরে ওঠবস, পিঠে স্কেলের বারি আর সাথে ছিলো উনার অসভ্য মার্কা উল্টোপাল্টা কথাবার্তা। এই কয়েকদিনে তাসফি ভাইয়ের অন্য একটা রুপ আবিষ্কার করেছিলাম, কিন্তু আমাকে জ্বালানো মোটেও ছাড়েন নি। ভাবলাম আজকে উনি আসবেন না, আর আমিও আজকে অন্তত উনার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তু আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ছুঁড়ে দিলেন তাসফি ভাইয়া। রিফাপুর ইয়ার চেন্স পরীক্ষার পর দীর্ঘদিনের ছুটি পরেছে, তাই রিফাপু বাসাতেই আছে এখন। মনের সুখে খুব সুন্দর করে রিফাপুর সাথে গল্পটা জমিয়ে ছিলাম মাত্র, তখনই বড়মা দুজনকে বকতে শুরু করে দিলেন। সাথে এটাও বললেন তাড়াতাড়ি বই নিয়ে বসতে, সন্ধ্যায় চলে আসবেন তাসফি ভাই।

রুমে এসে বই নিয়ে বসলেও আজকে কোন মন মানসিকতা নেই পড়ার প্রতি। এত সুন্দর গল্পের আসর থেকে উঠে এসে পড়ার প্রতি মন বসানোটা খুবই কষ্টের একটা কাজ। বিছানায় বসে বইগুলো সামনে বিছিয়ে চকলেট খাচ্ছি আর হাতের মোবাইল ফোনটা ঘাটাঘাটি করে চলেছি। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম। হাত থেকে ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি করে বই হাতে নিলাম। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি তাসফি ভাইয়া। সোজা এসে বিছানায় ধরাম করে বসে পরলেন। উনার দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত উনি। প্রতিদিনের চেয়ে অন্য রকম লাগছে উনাকে দেখতে। ক্লান্ত শরীরে ঘামে ভেজা কালো রঙের শার্ট। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা, হাত দুটো ভাজ করে উপরে তুলে রাখা, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিনের কাজ সেরে সোজা এখানেই চলে এসেছেন উনি। আজকে একদম অন্য রকম লাগছে উনাকে দেখতে। কালো রঙে বরাবরই অনেক দূর্বলতা আমার, আর উনি প্রায় সবসময়ই হিরো সেজে কালো রঙের শার্ট-ই বেশি পরেন। উনাকে অনেক আগে থেকেই কালো ও সাদা রঙয়ের শার্টে দেখে অভ্যস্ত থাকলেও আজকে হঠাৎ উনাকে এমনভাবে দেখে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগলো মনে। বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে। আমাকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বলে উঠলেন,

“এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? জানি তো আমি অনেক হ্যান্ডসাম, তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবি?”

বলেই উনার সেই বিখ্যাত হাসিটা দিলেন। উনার হাসিটা দেখে বুকের মধ্যে কেমন যেন টিপটিপ আওয়াজ তুলে উঠলো। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে বইয়ের দিকে ত্যাগ করলাম। উফ্! মারাত্মক একটা লোক।

“সারাজীবন এভাবে দেখার সুযোগ পাবি। যেভাবে মনোযোগ দিয়ে আমায় দেখছিস, এভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনাটাও যদি একটু করতি, তাও জীবনে কিছু করতে পারতি। এখন চটপট এগুলো সল্লভ করে ফেল।”

কয়েকটা প্রশ্ন দাগিয়ে দিয়েছেন আর সেগুলোই করতে বলছেন আমাকে। শান্ত ভাবে কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালেন উনি। টেবিল থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে এক নিমিষেই শেষ করে ফেললেন বোতলে রাখা পানিটুকু। আমার মনে হলো এতটুকু পানিতে যেন উনার কিছুই হয় নি। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট লেগে আছে। কেমন যেন মায়া হলো উনাকে দেখে। তাই ভয়ভীতি কাটিয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম,

“আরও পানি এনে দিবো? আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে দেখতে, ফ্রেশ হয়ে আসেন।”

হুট করে কেমন করে জানি তাকালেন উনি আমার দিকে। ক্লান্তময় মুখে হঠাৎ হাসি ফুটে উঠলো। আজ প্রথমবার মনে হয় কোন ধমক দিলেন না, আমার কথায় সায় দিলেন উনি। মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হুম’ বলে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার যাওয়ার দিকে। আজকে হঠাৎ কি হলো এই বজ্জাত লোকটার? অন্যদিন হলে তো জোরে একটা ধমক দিয়ে বলতেন, ‘পড়াশোনা দেখলেই খালি ফাঁকিবাজি শুরু হয়ে যায় বেয়াদব। আমার দুটো পা আছে, নিজে গিয়েই পানি খেতে পারবো।’
কিন্তু আজকে উনি কিছুই বললেন না। হয়তো সত্যিই অনেক কাজের চাপ ছিলো। দাঁড়িয়ে এসব চিন্তা না করে রান্নাঘরে এসে জগ ভর্তি করে ঠান্ডা পানি নিয়ে রুমে আসলাম।

রুমে ঢুকতেই দেখি তাসফি ভাই বাথরুম থেকে মাত্র বের হয়ে তোয়ালে হাতে নিলেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে অর্ধ গোছল সেরে বেরিয়েছেন হয়তো। গায়ের শার্ট টা পুরোই ভিজে গেছে। মাথা ভেজানোর ফলে চুল থেকে টপটপ করে পানি পরছে। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে জগটা নিয়েই পানি খেতে লাগলেন। জগটা উঁচুতে উঠিয়ে পানি খাওয়ার ফলে পরে যেতে লাগলো উনার গলা বেয়ে বুকে। ভেজা শার্ট আরও ভিজে যেতে লাগলো। শুকনো একটা ঢোক গিললাম আমি। আবারও সেই টিপটিপ শব্দের সৃষ্টি হলো বুকে। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ওনার থেকে। উফ্! এভাবে তো তাকিয়ে থাকতে পারছি না উনার দিকে। কি করছি আমি এগুলো? দ্রুত গিয়ে বিছানায় বসে পরলাম। উনার দাগিয়ে দেওয়া প্রশ্নগুলো লিখতে ব্যস্ত হয়ে পারলাম। যদিও আজকে পড়ার প্রতি মন নেই। একটু পর উনি এসে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে পরার মতো করে বসে পরলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“রূপা, ওই রুম থেকে আমার শার্ট-টা নিয়ে আয় তো। এটা একেবারে ভিজে গেছে, পরে থাকা সম্ভব না।”

আমি উনার কথা শুনেও না শোনার ভান করে লিখতে লাগলাম। উনাকে বোঝাতে চাচ্ছি এই মুহুর্তে পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী আমি। কিন্তু উনি ধমকে উঠলেন এবার। বললেন,

“কি বলছি কানে যাচ্ছে না। শার্ট-টা এনে দিয়ে তারপর লেখা শুরু কর।”

এই তো, বজ্জাতটা আসল রুপে ফিরে এসেছে। এভাবে উনি ধমক না দিলে আর আমি উনার ধমক না খেলে দিনটাই তো বৃথা। মাথা ঝাঁকিয়ে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম।
এই বাসায় তাসফি ভাইয়ার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে আসলাম সোজা। উনি আসলেই এই রুম এবং আমার রুম ছাড়া অন্য কোন রুমে থাকতে চান না। উনার জন্য আমার রুমটাও মাঝে মাঝে বেদখল হয়ে যায় আমার। রুমে ঢুকে উনার শার্ট খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ রিফাপু আসলো রুমে। এসেই বলে উঠলো,

“বনু তুই এ রুমে কি করিস? তোর না এখন তাসফি ভাইয়ের কেলানি খাওয়ার কথা।”

“তোমার ওই বজ্জাত ভাইয়ের কেলানি খাচ্ছি না তো কি হয়েছে? বজ্জাত লোকটার অত্যাচার তো ঠিকই সহ্য করতে হচ্ছে। তোমার বজ্জাত ভাইটার মতোই বজ্জাত উনার শার্ট-টা, কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।”

হো হো করে হেসে উঠলো রিফাপু। হাসিটা দেখে মনে হলো কতই না মজার কথা শুনালাম তাকে। রিফাপু হাসতে হাসতেই বললো,

“তা ঠিক বলেছিস, আমার বজ্জাত ভাই। তোর তো বজ্জাত বর, তো বরের এইটুকু সেবা করতেই এমন বিরক্ত হচ্ছিস? বাকি জীবন কাটাবি কিভাবে আমার বজ্জাত ভাইটার সাথে?”

পেয়ে গেলাম উনার একটা টি-শার্ট। সেটা হাতে নিয়ে রিফাপুর কথার পাত্তা না দিয়ে বললাম,

“বর না ছাই। আমাকে দেখলেই মুখ থেকে তেতো কথার বন্যা শুরু হয়, সারাদিন আমাকে ধমকের উপর রাখে। উনার কর্মকাণ্ড দেখলেই আমার ভয় লাগে, আর তুমি বলছো বাকি জীবন একসাথে কাটাবো? এটা তো কখনোই সম্ভব না। মোটকথা উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না।”

বলেই চলে যেতে লাগলাম। রিফাপু বিরবির করে কিছু একটা বললো, কিন্তু শুনতে পেলাম না কথাটা। ‘তোমার বজ্জাত ভাইকে শার্ট-টা দিতে হবে’ রিফাপুকে বলেই চলে আসলাম আমার রুমে।

রুমে এসেই দেখি তাসফি ভাইয়া চোখ বন্ধ করে আছেন। উনার পাশে দাঁড়িয়ে দু’বার ডাকলাম শার্ট পাল্টে নেবার জন্য। কিন্তু সাড়া দিলেন না উনি, হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন। আজকে একটু বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো উনাকে। তাই চুলগুলো ভালো করে না মুছে, শার্ট না পাল্টে ওভাবেই ঘুমিয়ে পরেছেন। ভেজা শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে, মুখে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটায় একদম অন্যরকম লাগছে তাসফি ভাইকে দেখতো। এইটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেন ভেবেই অবাক হলাম অনেক। তাই সত্যিই ঘুমিয়ে গেছেন কি না দেখার জন্য একটু ঝুকে গেলাম উনার দিকে। না সত্যিই ঘুমিয়ে গেছেন। যাক আজকের জন্য অন্তত উনার অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলাম।

মনে মনে অনেক খুশি হয়ে সরে আসতে নিতেই হঠাৎ চোখ খুলে ফেললেন তাসফি ভাই। হঠাৎ এভাবে চোখ খুলে ফেলায় থতমত খেয়ে গেলাম। এগুলো আমার সাথেই কেন হয়, আল্লাহ! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো এইটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পরা আদোও সম্ভব কি না। উফ্ কি না কি ভাবছেন উনি, এভাবে তাকিয়ে থাকায়। কিছুটা ভয় নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলাম,

“আ..আসলে আমি, আ..আপনি ঘুঘ্ ঘুম…..”

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হঠাৎ আমার হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিলেন, বালিশটা সোজা করে বিছানায় রেখে মাথার অর্ধেক বালিশে আর বাকি অর্ধেক মাথা আমার কোলে রেখে শুয়ে পরলেন। একহাত দিয়ে আমার কোলে জড়িয়ে ধরলেন, যেন চলে যেতে না পারি। হঠাৎ তাসফি ভাইয়ের এমন কাজে চমকে উঠলাম আমি, থমকে গেলাম এক মুহুর্তের জন্য। বুকের টিপটিপ শব্দটা আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগলো। কি করলেন উনি হঠাৎ এটা? এভাবে কখনো উনার এত কাছে আসা হয় নি আমার। শুধু উনি না, কোন ছেলের সংস্পর্শেই যাই নি কখনো। আমি কিছু বলতে নিলেই আমাকে ডেকে উঠলেন উনি,

“রুপু”

উনার ঘুম জড়ানো কোমল কণ্ঠে ‘রুপু’ ডাকটা শুনে আরও জোরে হার্ড বিট হতে লাগলো। এতটা জোরেই বিট করছে যে, মনে হলো তাসফি ভাইয়াও শুনতে পাবেন হয়তো।

“রুপু, মাথাটা খুব ব্যাথা করছে একটু টিপে দে তো। একদম না করতে পারবি না কিন্তু।”

হঠাৎ কি হলো আমার জানি না। হাত দুটো আপনা-আপনি চলে গেল উনার মাথায়। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম হালকা গরম হয়ে আছে উনার শরীর, হয়তো জ্বর আসবে। আর কিছু না ভেবে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম উনার মাথায়।

.
.
(চলবে…..)

প্রথমেই অনেক সরি। আজকে ছোট হয়েছে বলে কেউ রাগ করবেন না কিন্তু।😐 রিচেইক করার সময় পাই নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না। আগামী দুইদিন হয়তো গল্প দিতে পারবো না, ফুপাতো ভাইয়ের এনগেজমেন্ট। নতুন ভাবীকে দেখতে যাবো ফুল ফ্যামেলি সহ।😍 তাই আগেই বলে রাখলাম, কেউ অপেক্ষা করে থাকবেন না। অনেক ভালোবাসা রইল সবাইকে।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here