তুমি বললে আজ – পর্ব ৪

0
1128

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৪

.
সকালের কোলাহল পূর্ণ বিয়ে বাড়ির আমেজে একদমই আলাদা এক রুপ ধারণ করে। হৈ-হুল্লোড়, বাচ্চাদের ছোটাছুটি, বাড়ির মহিলাদের বিভিন্ন কাজের তাড়া, ছেলেদের ছোটাছুটি করে রান্নার তদারকি করা, অপর দিকে ডেকোরেশনের কাজ করা। আর এদের মাঝে আমাদের কাজিন দলের একমাত্র কাজ খাওয়া দাওয়া, সাজগোছ আর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া। গ্রামের বিয়ের এমন আমেজ থাকলেও শহরের বিয়েতে এমন কিছুর দেখা পাওয়া দুরষ্কর। কিন্তু বাসার পাশে বিশাল পরিমাণ ফাঁকা জায়গা থাকার জন্য রিমি আপুর বিয়েতে ঠিক এমনটাই হচ্ছে। আর এর পুরো ক্রেডিটটা তাসফি ভাইয়ের।

নাচ গান আড্ডা দিতে দিতে প্রায় শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। সকালের দিকে ঘুমটা গভীর হলেও ঘুমাতে পারলাম না শান্তির ঘুমটা। কাজিন দলের অত্যাচার সহ আম্মুর কর্কশ কণ্ঠের ডাক শুনে উঠতে বাধ্য হলাম বিছানা ছেড়ে। এখনো তেমন একটা বেলা না হলেও বিয়ে বাড়ি হিসেবে অনেক বেলা হয়েছে বলা চলে। যে যার মতো ব্যাস্ত থাকায়, কাউকে না ঘাটিয়ে সোজা নিচে নেমে এসেছি। নিচে নেমে চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঘুমের রেশ কে*টে গেল যেন। মনটাও হয়ে উঠলো ফুরফুরে। সত্যিই তাসফি ভাইয়ার তুলনা হয় না। এত সুন্দর করে যে ব্যবস্থা করে দিবেন কেউ চিন্তাও করে নি।
রিমি আপুর বিয়েটা সবার ইচ্ছাতে গ্রাম থেকেই দিতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে উঠে নি। আপুর শ্বশুর বাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে। তাই সিদ্ধান্ত পাল্টে নেয় সকলে। আমি তো ভেবেছিলাম বড় বাবা হয়তো কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করবেন। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নিচে এসে এগুলো দেখে অবাকের মাত্রা ছড়িয়ে যায় আমার। পরে আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের থেকে জানতে পারি এগুলো সব তাসফি ভাইয়ার ক্রেডিট।
আমাদের বাসার সামনের তিন তালার এক অসম্পূর্ণ বিল্ডিংয়ে নিচ তালা ও দোতালায় খাওয়া দাওয়ার পুরো আয়োজন করা হয়েছে। বিল্ডিংয়ের শুধু ছাঁদ পর্যন্ত হওয়ায় ডেকোরেশন করতে কোন অসুবিধায় হচ্ছে না। চারদিকে বড় বড় কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। বাসার এক সাইডে ভাড়া করা কিছু পুরুষ ও মহিলারা রান্নার আয়োজন করে চলছে যবরদস্ত ভাবে।

একটু হেঁটে চলে আসলাম কালকের গায়ে হলুদের জায়গাটায়। কালকের পুরো ডেকোরেশনটাই খুলে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু খুলছে কেন? কেনোর মানেটা খুঁজে পেলাম যে এখানেই রিমি আপু ও দুলাভাইকে বসানো হবে হয়তো। তাই আমাদের সবার মহা বিজ্ঞ তাসফি ভাই এগুলো খুলে নতুন ভাবে সাজাতে চাইছেন। মনে হয় এটার দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে নিয়েছেন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাকি কাজিনদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কিভাবে কি করতে হবে। প্রচুর ব্যাস্ত তিনি। এতটুকু বেলায় হাঁপিয়ে উঠছেন যেন, হয়তো অনেক সকালেই উঠেছেন।
তাসফি ভাইয়ার কথায় কিছু কাপড়, ফুল, চেয়ার আনতে লাগলো সবাই। ফুল দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে একটা একটা করে নেড়ে নেড়ে দেখতে লাগলাম ফুলগুলো। হঠাৎ মাথায় কেউ টোকা দেওয়ায় ফিরে তাকালাম পিছনে। তাকিয়ে দেখি আমার ফুপাতো এবং চাচাতো ভাই দাঁত কেলিয়ে হাসছে। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে বললাম,

“মাথায় টোকা দিলি কেন? লাগে না আমার? শয়*তান!”

“তোর আবার লাগেও নাকি? জানতাম না তো। ফুলগুলো এভাবে নষ্ট করছিস কেন রে পেতনী? কত কষ্ট করে নিয়ে আসছি জানিস?”

কথাগুলো যে এভাবে শুনতে পাবো জানাই ছিলো আমার। বড় চাচা ও আব্বুর চাচাতো ভাই-বোনের ছেলে রাহাত। বয়সে আমার বড় হলেও তুই বলেই ডাকি ওকে। তার মূখ্য কারণ হলো সবসময় আমার পিছনে পরে থাকা, খোটা দেওয়া সহ সারাক্ষণ ল জ্বালানো। রাহাতের বাবা, আইয়ুব কাকু ও রোকেয়া ফুপি সম্পর্ক করে বিয়ে করেন। পরিবার থেকেও নাকি কোন প্রকার বাধা ছিলো না। আমাদের ছোট বেলার অনেকটাই গ্রামে বেড়ে ওঠায় রাহাতের সাথে সম্পর্কটা এমন হয়। ঝগড়া করা, একে অপরকে খোঁচানো, ভালোবাসা, দুজন দুজনকে কেয়ার করা লেগেই থাকে। আমি কিছুটা শান্ত স্বভাবের হলেও রাহাতের সাথে ঝগড়ায় অন্য রকম হয়ে যাই। তার মূল কারণটা অবশ্য রাহাতকেই ধরা যায়। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই। সবসময় ছোট বোনের মতো আগলে রাখতেও কখনো ভুলে না। মাঝে মাঝে রাহাতের খুনশুটি, কেয়ার, ভালোবাসায় নিজের হাড়িয়ে যাওয়া ভাইয়ের অভাব পূরণ হয়ে যায়। কটমট চোখে তাকালাম রাহাতের দিকে। বললাম,

“লাগে না? লাগে না আমার, তাই না? তোকেই শুধু লাগে? শয়তান!”

বলে কয়েকটা বাড়ি দিলাম রাহাতের হাতে। হাত ধরে ডলতে ডলতে ‘আহ্’ করে উঠলো। কান দিলাম না ওর কথার। আবারও ওর হাতে একটা বাড়ি দিয়ে বলে উঠলাম,

“আর কি বললি তুই? কি বললি? আমি পেতনী? পেতনী মনে হচ্ছে আমাকে দেখে? শয়তান ছেলে।”

“ভুল কি বলেছে ওই? ভুতের মতো চোখের নিচে যে হারে কাজল লেপ্টে রেখেছিস, তাতে তোকে পেতনী বলবে না তো রূপা পরী বলে ডাকবে নাকি? ভাগ্যিস তোকে দেখে হার্ট অ্যাটাক করেনি, বেচারা।”

রাহাতের মুখের বুলি ফোটার আগেই তাসফি ভাই কথাটা বলে উঠলেন। শেষের কথাটা বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই বললো। এতেই যেন সবার মাঝে হাসির রোল পরে গেল। মেজাজটা রীতিমতো বিগড়ে গেল আমার। আসলেই উনি হাই অতি উচ্চ লেভেলের বজ্জাত একটা মানুষ।
কালকের কাজল না উঠানোর ফলে চোখের নিচে কিছুটা লেপ্টে আছে। তাতে মোটেও খারাপ লাগছে না দেখতে। নিচে আসার আগে খুব ভালোভাবে দেখেই এসেছি। কিন্তু এটা নিয়েই উনার খোঁচানো শুরু হয়ে গেছে আমাকে। উফ্! অ*সহ্য। মুখে কিছু না বলতে পারলেও মনে মনে কঠিন একটা গালি দিলাম ওনাকে। তাসফি ভাইয়ার সাপোর্ট পেয়ে আগের চেয়েও জোরে আমার মাথায় টোকা দিয়ে রাহাত বলে উঠলো,

“দেখলি তো? কেন তোকে পেতনী বললাম? পেতনী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আর আমি বললেই দোষ? বজ্জাত মেয়ে, মা*রতে মা*রতে আমার হাতটা একদম লাল করে ফেলেছে। গার্লফ্রেন্ডটা আমার কষ্ট পাবে না বুঝি?”

এবারও রাহাতের হাতে মেরে বললাম,
“আবার মারলি? আবার মারলি আমায়? শয়তান ছেলে। ব্রেকআপ করাবো তোর। তখন আসিস আমার কাছে? গার্লফ্রেন্ডের দরদ দেখলে বাঁচি না। হুহ্!”

“দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র গার্লফ্রেন্ড ওর। তাও কত কষ্টে হলো। কিন্তু তোর তো আর বয়ফ্রেন্ড নাই, তাহলে কালকে ওভাবে হলুদটা লাগালোই বা কে তোকে? সত্যি করে বলবি কিন্তু।”

চাচাতো বোন রিমার কথায় চমকে উঠলাম। কালকের রাতের ঘটনাটা তো প্রায় ভুলেই গেছিলাম আমি। শীতল হাতের ঠান্ডা স্পর্শটার কথা মনে পরতেই এবারও কিছুটা কেঁপে উঠলাম। অন্ধকারে হঠাৎ এসে ওভাবে কে আমায় হলুদ লাগাতে পারে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
পিছন ফিরে আলোটা ধরলেও কাউকেই দেখতে পাইনি ওখানে। তখন এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, চোখ-মুখ বন্ধ করে ছুঁটে এসেছিলাম বাসার দিকে। পায়ের সাথে কিছু লেগে পরে যেতে লাগলেও তখন তাসফি ভাইয়া এসে ধরে ফেলেন আমাকে। ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিলাম না জন্য আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দেন আমার দিকে। পানিটা টকটক করে পুরোটা খেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি পুরো কাজিন দল আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু শান্ত হয়ে পুরো ঘটনা বলতেই তারাও অবাক
হয়। তাসফি ভাইয়ার বারণে তারপর তার কেউ এটা নিয়ে জিজ্ঞেসও করে নি তখন। তাই একদমই ভুলেই বসেছিলাম ঘটনাটা।
কয়েক সেকেন্ড পর চট করেই মাথায় কিছু খেলে গেল আমার। হয়তো বুঝতে পারলাম কে এই মহান কাজটা করতে পারে। কাল রাতে ভীষণ রকমের ভয় পাওয়ার ফলে কথাটা আমার মাথাতেই আসে নি। এই মহান কাজটা যে রাহাত ছাড়া কারোর নয় হয়তোবা। ওর তো নতুন নতুন ফোন সিমের অভাব নেই সেটা খুব ভালোভাবেই জানা আছে আমার। কালকের অচেনা নম্বরে কল আসার মূল কারণ যে আমাকে ভয় দেখানো সেটা নিশ্চিত আমি। দাঁতে দাত চিপে রাগী গলায় সবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম,

“ওই কাজটা যে কোন শয়তানের সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। নুন ঝাল দিয়ে যে তাকে চিবিয়ে খাই নি এটাই তার ভাগ্য। কিন্তু ঝাড়ু দিয়ে পিটুনি খাওয়া যে তার কপালে আছে সেটা হয়তো জানে না।”

আমার কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠলেন তাসফি ভাই। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও রিফাপু ও রাহাত হাসতে লাগলো। তাসফি ভাইয়ার দিকে একবার তাকালাম কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রাহাতের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলাম,

“এ্যাই শয়তান! তুই আমার আমার সাথে এমন করেছিস, তাই না? সত্যি করে বল বলছি। সারাদিন আমার পিছনে পরে থাকতে তোর খুব ভালো লাগে না? জানিস কাল কতটা ভয় পেয়েছিলাম।”

আমার কথায় এবার রাহাত খুকখুক করে কেশে উঠলো। ও হয়তো বুঝতেই পারে নি, আমি ওর কথা বলবো। রিফাপু সমানে রাহাতের পিঠ ডোলে যাচ্ছে। রাহাত কাশি থামিয়ে করুন চোখে তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকালো, তারপর আমার আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“দ্ দেখলাম তোর সাহস কতদূর। খুব তো বরাই করিস তোর সাহস বেশি, কিন্তু কালকেই দেখ সব প্রমাণ হয়ে গেল। ভীতুর ডিম একটা।”

“তোকে আ…..”

শেষ করতে পারলাম না কথাটা। তার আগের আমার মা জননী এসে গলা বাড়িয়ে ডাকতে লাগলো তাদের আদরের ছেলে তাসফিকে।

“তাসফি! কি রে বাবা, খাবি কখন তোরা? কতটা বেলা হয়ে গেছে দেখছিস। এসব পরে করিস আগে সকালের খাবারটা খেয়ে নে সবাই। তারপর এসবে হাত লাগাস। কত কাজ পরে আছে এখনো।”

“আসছি মামী, তুমি যাও।”

“তাড়াতাড়ি আয় সবাই। উফ্ বিয়ে বাড়ি কত কাজ। চারদিকে স….”

বলতে বলতে চলে গেল মা জননী আমার। এখানে যে আমিও আছি সেটা যেন তার চোখেই পরলো না যেন। তাদের আদরের ছেলেটাকেই চোখে পরেছে শুধু। আমরা যেন এখানে কেউ নেই।

“চল সবাই, খাওয়ার পর এই সাইডের কাজটা শুরু করলেই হবে। মামী তো আর সারাদিন খাবার নিয়ে বসে থাকবে না।”

সায় দিলো সবাই তাসফি ভাইয়ার কথায়। রাহাত একটু পর পর হেসে যাচ্ছে আমাকে দেখে। আর আমি রাহাতের উপর রাগ নিয়ে কটমট চোখ তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাসফি ভাই বললেন,

“তোকে আবার কেমন করে বলতে হবে যাওয়ার কথা? তোর জন্য কি মামী সারাদিন ধরে বসে থাকবে খাবার নিয়ে। বেয়াদব!”

“যাচ্ছি তো। আর তোকে…. তোকে তো আমি ঝাড়ু পেটা করবোই, মনে রাখিস।”

‘যাচ্ছি তো’ কথাটা তাসফি ভাইয়াকে বললেও শেষ কথাটা রাহাতকে উদ্দেশ্য করেই বললাম। বলেই আর দাড়ালাম না ওখানে। গটগট পায়ে এগিয়ে আসলে লাগলাম বাসার দিকে। কি মনে করে আমাকে সবাই? কাল না হয় একটু ভয় পেয়েছিলাম, তাতে সবার কি হাসাহাসি। আর ওভাবে অন্ধকারে হুট করে এসে হলুদ ছোঁয়ালে ভয় লাগাটা স্বাভাবিক নয় কি? যেতে যেতে একবার পিছনে তাকালাম। সবাই হাসি মুখে বাসার দিকেই আসছে। চোখটা তাসফি ভাইয়া ও রাহাতের উপর পরতেই সব রাগ গুলো তাদের উপর এসেই জমা হলো। সহ্য হচ্ছে না আর এই দুটোকে। সামনে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। খাওয়ার কথা শুনে সত্যিই প্রচন্ড খিদে পেয়েছে এতক্ষণে। আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি করে বাসায় ঢুকে পরলাম।

.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here