তুমি আমার -পর্ব ৩

0
466

#তুমি_আমার
#পর্ব_০৩
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

কলেজ এসেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে গেছি।ইতিমধ্যে সকলেই এসে পরেছে।মন মেজাজ এখন ফুড়ফুড়ে।আজ আর ধামড়া ছেলে মেয়েদের কান ধরে ক্লাসে দাঁড়াতে হবে না।রিয়া এখনও রাস্তার ব্যাপারটা নিয়ে বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছে আমার।আমি কিছু বলছি না শুধু শুনেই যাচ্ছি।আজ কিছু বলবো না মেয়ে কারণ বললে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে।আমি জানি এরপর ভাইয়ার সাথে দেখা হলে আজকের ব্যাপারটা তুই টানবিই টানবি।তাই ভাইয়াকে জ্বালানোর জন্য হলেও চুপ থাকতে হবে আমায়।তবে আমার ভাইয়া এমন না।তুই মাথা মোটা মেয়ে বেশি বুঝিস। একদিন ভাইয়াকে দেখিয়ে তোকে পুরো চমকে দিব।

ক্লাসে বসে আছি স্যারের অপেক্ষায়।এরমাঝে আয়ান বলল….

-‘জানিস আরু কাল তোর বার্থডে পার্টিতে কি হয়েছে’?

আয়ানের কথা শুনেই বিষম খেলাম আমি।এবার আমার মান সম্মান সব শেষ।সবকয়টা মিলে দফারফা করে ছাড়বে।আয়ানকে চোখের ইশারায় থামতে বলছি কিন্তু সেদিকে তাঁর কোনো হেলদোলই নেই।সে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।ওর কথার পিঠে আয়েশা সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল….

-‘কি হয়েছে কোনো মেয়ে তোকে প্রপোজ করেছে বুঝি’?

এবার হাসির রুল পরে গেলো সবার মাঝে।আয়ানের মুখখানা একেবারে চুপসে গেলো।আয়ান মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরে কিন্তু কেউ ওকে পাওা দেয় না।তবুও সর্বএ বলে বেড়ায় ওকে অনেক মেয়ে প্রপোজ করে কিন্তু ও তাঁদের পাওা দেয় না।আমাদের কথার মাঝেই আবেশ স্যার রুমে ঢুকলেন।উনাকে দেখে সবাই চুপ আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

চুপচাপ বসে ক্লাস করছি একবারও আবেশ স্যারের দিকে তাকাচ্ছি না।আবেশও নিজ মনে ক্লাস করাচ্ছে।আর মাএ কিছু সময় তারপরই আমরা সেইফ।কিন্তু আমার এই খুশিটা বেশিক্ষণ টিকলো না।হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে চমকে উঠলাম আমি।আমার দৃষ্টি এখন বেঞ্চের কর্ণারে যেখানে সকলের ব্যাগ জড়ো করে রাখা সেখানে।মূলত লেখার সুবিধার্থে সবমসময় আমরা এরকম রাখি।পুরো ক্লাসের সকলের দৃষ্টি এখন আমাদের বেঞ্চের দিকে নিবদ্ধ।আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছি কারণ আমি ফোন আনি না।হঠাৎ আবেশ স্যার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।উনাকে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পরলাম আমি।ওদিকে আয়ান আর আয়েশা মিলে ফুসুরফুসুর করছে আর আমাকে কিছু দেখানোর চেষ্টায় আছে কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই।আজ আমি বাঁশ খাচ্ছি না।আয়েশা সেই লেভেলের বাঁশ খাবে।জানু মনু বলে লোকের সাথে পিরিত করা আজকে তোমার পিরিতি ছুটাবেন।আবেশ স্যার স্থির চাহনী দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

-‘কার ফোন বাজছে?’

উনার কথার বিপরীতে কোনো শব্দ খরচ করলাম না আমি।কালকের অপমান ভুলিনি আমি।আমাকে চুপ থাকতে দেখে আরু বলল ‘আমাদের না স্যার কারণ’হাতের ইশারায় আরুকে থামিয়ে দিলেন উনি।আয়ানকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করার জন্য বললেন।আয়ান ভদ্র বালকের ন্যায় উপরের ব্যাগ নামিয়ে নিচের টা থেকে ফোন বের করলো।আমি এক নজর ওদিকে তাকালাম।স্যার ব্যাগটা আমার সামনে ধরে বললেন….

-‘এই ব্যাগটা কার’? ফট করে জবাব দিলাম আমার।ব্যাস হয়ে গেলো।তখনও জানতাম ন। আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।আমার হাতে ফোন দিয়ে উনি বললেন লক খুলে দাও।ওর লক আমরা সবাই জানি ‘সোনা’ তাই আমিও ভদ্র বাচ্চার ন্যায় লক খুলে দিলাম।স্যার কিছুক্ষণ ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর আমার হাতে দিতে যাবেন তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো।উনি সময় ব্যয় না করে কলটা রিসিভ করে লাউডে দিলেন।পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা।ওপাশের ব্যাক্তিটি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো….

-‘এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এই সব অশ্লীল টেক্সট পাঠানোর।আরেকবার যদি টেক্সট পাঠিয়েছো ত তোমার হাত পা আমি ভেঙ্গে দেবো’।টুট টুট টুট!ফোন কাটতেই সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পরলো।কথাগুলো শুনে স্যার একটি লম্বা শ্বাস ছাড়লেন।ওদিকে আয়েশার অবস্থা করুন।মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।আমি আর আরু অসহায় ফেস নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।চোখের ভাষায় এটাই বোঝাচ্ছি আজ আর ওর রক্ষ্যে নেই।সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন…..

-‘কলেজ আসার নাম করে ছেলেদের অশ্লীল টেক্সট করে ডিস্টার্ব করে বেড়াও সিরাত’?

উনার কথাটা কানে যেতেই উনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললাম আমি।এতক্ষণ উনার দিকে না তাকালেপ এখন ভালোভাবে খেয়াল করছি।ব্যাপারটায় উনি রেগে আছেন বেশ বুঝতে পারছি।রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে।আমি একটা ঢোক গিলে বললাম….

-‘আমি কেন এসব করতে যাবো স্যার’।

-‘তাহলে লোকটা কি মিথ্যে বলছে।নাকি আমি তোমার ফোন দিয়ে এসব কাউকে পাঠিয়েছি’।

-‘স্যার কিসব বলছেন।আমি তো কলেজে ফোন আনিনা’।

এবার উনার রাগের মাএাটা বেড়ে গেলো।চেঁচিয়ে বলে উঠলেন….

-আজকাল মিথ্যা বলাও শিখে যাচ্ছ।তাহলে তোমার ব্যাগে কি অন্য কারো ফোন ঢুকানো ছিল।নাকি ফোনের হাত পা গজিয়েছে যে উড়ে উড়ে তোমার ব্যাগে চলে এসেছে।তুমি নিজেই বললে ওটা তোমার ব্যাগ।ফোনের পাসওয়ার্ড ও তোমার জানা তবুও বলবে কলেজে তুমি ফোন ইউজ করো না।এত বড় মিথ্যাবাদী হয়ে গেছো’।

এবার আয়ানের দিকে তাকালাম আমি।আয়ান ইশারায় বুঝালো আয়েশা ওর ফোন আমার ব্যাগে রেখেছে।আর সেখান থেকেই ফোনটা বেড়িয়েছে।আয়েশা ক্ষমা চাচ্ছে।ওকে বাঁচানোর জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।আজ পুরো ক্লাসের সামনে আমার মান সম্মান নিয়ে খেলছেন উনি।বিষয়টা বুঝতেই নেএদ্বয়ে জলে চিকচিক করে উঠলো।পাশ থেকে আরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই উনি বললেন….

-‘ থাক কাউকে আর চামচামি করতে হবে না।হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়ার পর মন গড়া গল্প বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।পুরো ফোনেই একই ধরণের চ্যাটিং ফ্লাটিং ছি বলতে আমার রুচিতে বাধছে।মাএ এইচ এস সি ক্যান্ডিডেট এর মধ্যেই ভিতরে নোংরামি বাসা বেঁধেছে।আজ মানতে কষ্ট হচ্ছে তুমি সিয়ামের বোন।এক্ষুণি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাও’।মাথানিচু করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম।আরু হয়তো কিছু বলছে উনাকে কিন্তু সেগুলো শুনবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে এলো আবেশ।গাড়িতে বসে স্টিয়ারিংয়ে একটা ঘুষি মারলো।কলেজে আর মন টিকছে না।এটা কি করলো মেয়েটা।এই বয়সে এত বাজে ম্যাসেজ।’বাবু একটা কিস দাও না’।’একা বসে আছি যদি পাশে থাকতে তাহলে’ প্রত্যেকটা ম্যাসেজ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আর নিজের হাত মুষ্টি বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতেই পারছে না।এখন মেয়েটাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে ওর। যদি ক্লাস রুম না হয়ে অন্য কোথাও হতো তাহলে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিতাম।

বাসায় এসেছি অনেক্ষণ হলো।ক্লাস থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ী এসেছি।আজকে আবেশ ভাইয়ার বড় ভাই আবিদ ভাইয়ার বিয়ের পাকা কথা।তাই আব্বু আম্মু গেছেন।ভাইয়াও হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছেন।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমিও ওখানেই থাকতাম।কিন্তু আজ তা হওয়ার নয়।।শাওয়ার নিয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছি।কিছুই ভালো লাগছে না আজ।যদি ব্যাপারটা ভাইয়ার কানে যায় তাহলে কি হবে সবাই কি ভাববে যতটা আয়েশার উপর রাগ তারচেয়ে বেশি রাগ উনার উপর হচ্ছে।কিন্তু উনাকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না।ফোনে যা ছিলো তাই নিয়েই কথা বলেছেন উনি।আমার জায়গায় আয়েশা হলে খুশিই হতাম কারণ অন্তত আজকের অপমানের পর এসব ছেড়ে দিতো।কিন্তু সবসময় উনার সামনে ঝড়ের মুখোমুখি আমিই হই।যে ঝড় সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।পুরো ক্লাসের সামনে মুখ দেখাবো কি করে সবাই কি ভাববে।আপনি আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছেন ভাইয়া।এইগুলো সবার অগোচরোও তো সলভ করা যেত।এভাবে পাবলিকলি অপমান করার কি খুব প্রয়োজন ছিলো।তাছাড়া আমার উপর এতদিনেও কি এতটুকু বিশ্বাস জন্মেনি।একবারও ভাবলেন না সিরাত এরকম কিছু করবে না।করতে পারে না।চোখের দেখায়ও ভুল থাকে।আরেকটু যাচাই করলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো।

আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে কলেজ যাই না।কলেজ থেকে এক রকম ছুটি নিয়েছে।মান সম্মান বাঁচানোর ছুটি।আব্বু কলেজ না যাওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন।কিন্তু কোনো কাজ হয় নি।ভাইয়াও জোর করেছে কিন্তু কারো কথা কানে যায় নি।এরইমধ্যে আরু, আয়েশা, রিয়া, আয়ান এসে দেখা করে গেছে।আবিদ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের সপ্তাহে।দুইদিন পর ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য বলেছে কিন্তু আমি তো যাব না।উনার মুখোমুখি হতে চাই না আমি।আয়েশা ক্ষমা চেয়ে কলেজ যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেছে।এখন সবাই সবটা জানে ফোনটা আমার নয় আয়েশার ছিলো।সেদিনই আয়েশা উনাকে সবটা জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু উনি কারো কোনোকথা শুনেন নি।পুরনো কথাগুলো যখনই ভাবি তখনই নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না।পাগল পাগল অনুভূত হয়।সন্ধ্যায় ফোন হাতে নিয়ে ফেইসবুক স্কল করছি তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।আম্মু ঘুমোচ্ছে খালাও বাসায় নেই।এই সময় কে আসবে হয়ত ভাইয়া ভেবে অলস পায়ে দরজা খুলে দিলাম।দরজা সামনে লোকটাকে দেখে খানিকটা অবাক হলাম আমি।তারপর আবার নিজেকে ধাতস্থ করলাম হয়তো ভাইয়ার খোঁজে এসেছেন উনি।যত ভাবি উনার সামনে যাবো না তত ভাগ্য আমায় উনার সামনে বার বার দাঁড় করিয়ে দেয়।উনাকে দেখেই সেদিনের কথা মনে পরে গেলো।চোখ দুটো ভিজে গেলো।কিন্তু সেগুলোকে ঝরে পরার আগেই অতি সন্তর্পণে সেগুলো লুকিয়ে নিলাম।যার কাছ আমার মান সম্মানের দাম নেই তার কাছে চোখের জল দেখানো মানে নিজেকে অপমান করা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here