তুমি বললে আজ – পর্ব ৩৭

0
501

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৭.

.
বিষ্ময় বিমোহিত স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। একটা হাত আপনা আপনি পেটে চলে গেল, সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম প্রচন্ড গতিতে। অপর হাতে তাসফির হাতটা অজান্তেই খামচে ধরলাম। ঠিক শুনলাম কি কথাটা, নাকি আমার কোন ভুল আছে শোনায়। আমি… আমি সত্যিই মা হবো? আমার মধ্যে সত্যিই তাসফির অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে? অদ্ভুত এক নাম না জানা অনুভূতিতে ঘিরে ধরলো আমায়। মাথা ঘুড়িয়ে তাসফির দিকে তাকালাম। স্তব্ধ হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন উনি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“মাম্…মানে? ওও.. প্রেগন্যান্ট…?

ড. অসীম ওনার কথায় জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে মাথা ঝাঁকালেন। তারপর ড. রিয়াদের দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
“দেখুন মি. তাশরিফ আপনার ওয়াইফ এর ব্রেইন ক্যান্সারটা হলো ‘বেনাইন টিউমার’ মেটাস্ট্যাসিস বা সেকেন্ডারি টিউমার, এই মাধ্যমিক টিউমার শরীরের অপর কোনো অংশ থেকে বিস্তৃত হয়ে মস্তিষ্কে আসে যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ব্রেইন মেটাস্টাসিস টিউমার নামে পরিচিত। এটি খুব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, সো বুঝতেই পারছেন ওনার সমস্যাটা কত আগের। হয়তো আরও পাঁচটা রোগীর মতো উনিও সাধারণ মাথা ব্যাথা বা মাইগ্রেনের ব্যাথা ভেবেই কাটিয়েছেন, বিষটাকে তেমন গুরুত্ব দেন নি।”

কয়েক সেকেন্ডর মতো সময় নিয়ে আবারও বলতে লাগলেন,
“কিন্তু এখন বিষয়টা কিছুটা জটিল হয়েছে বলে আমি মনে করি। এই ব্রেইন মেটাস্টাসিস টিউমার মস্তিষ্কের টিউমারের অবস্থান অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যার ফলে ওনার মাঝে এর লক্ষণগুলো ধরা দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে মাথা ব্যাথা, খিচুনি, দৃষ্টির সমস্যা বা দৃষ্টিবিভ্রম, বমি করা, এবং বিভিন্ন প্রকার মানসিক পরিবর্তন। মাথা ব্যাথাটি সাধারণত সকাল বেলা তীব্রভাবে অনুভূত হয় যা বমি করার মাধ্যমে শেষ হয়। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হাঁটাচলা ও কথা বলাসহ অনুভূতি পাওয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে জ্ঞান হারানোর মতো ব্যাপারও ঘটতে পারে। উনিও জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন হয়তো।”

মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন তাসফি। ওনার পজিটিভ উত্তরে আবারও বললেন,
“ওনার ব্রেইন টিউমার ফাস্ট টেজে থাকলেও লক্ষণ গুলো গভীর ভাবে ধরা দিয়েছে। ওনার ‘বেনাইন টিউমার’ মেটাস্ট্যাসিস টিউমার হবার ফলে অপারেশনে তেমন ঝুঁকিও থাকবে না, সামান্য অপারেশনের মাধ্যমেই টিউমারটা অপসারণ করা যাবে। যদিও সেটা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। ওনার অপারেশনের পুরো ব্যবস্থায় আমরা করবো। যতদিন বাইরে দেশে না যাওয়া হচ্ছে ততদিন আমার অধীনেই থাকবেন, আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাবো। কিন্তু…. ”

উনি থামতেই ড. অসীম তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“দেখো তাসফি আমরা চাইলে তোমার ওয়াইফ এর চিকিৎসা আজকে থেকেই কন্টিনিউ করতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো একটা জায়গাতেই, তোমার ওয়াইফ এর প্রেগন্যান্সি। বাচ্চার ভ্রূণের বয়স প্রায় দুই মাস। বিকিরণ থেরাপি এবং হাই এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। তারপর ঠিক কি হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন। তাই এজ্ এ ডক্টর হিসেবে আমরা চাইবো উপস্থিতি রোগীর সুস্থতা এবং বাঁচানোর চেষ্টা।”

এবার প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠলাম আমি। উনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন, খুব স্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু এত অল্প সময়ের অনুভূতিটাকে আমি কিভাবে শেষ হতে দিতে পারি? আমার মাঝে বেড়ে ওঠা তাসফির অস্তিত্বটাকে আমি কিভাবে বিলীন হতে দিতে পারি? না… কিছুতেই আমি এটা হতে দিতে পারি না।
চোখ দুটো মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো। তাসফির হাতটা আগের চেয়েও জোরে খামচে ধরলাম। ওনার দিকে তাকালেও ঠিক ধরতে পারলাম না ওনার মনোভাব। সামনের দিকে তাকিয়ে ধীর গতিতে বলে উঠলেন,
“জি আঙ্কেল, বুঝতে পারছি।”

“তুমি বুদ্ধিমান একটা ছেলে, ডিসিশনটা অনেক ভেবেই নিবে। তাবে আমি চাইবো যা করবে খুব তারাতাড়ি, বিষয়টা যেন খারাপের দিকে না যায়।”

তাসফি মাথা ঝাঁকাতেই ড. রিয়াদ ওনার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন। বললেন,
“এটা আমার হসপিটালের কার্ড। আপনি হয়তো জানেন মি. তাশরিফ, আমি প্রতি মাসে এক সপ্তাহ এখানে রোগী দেখি। আমার হসপিটালে ওনার চিকিৎসাটা পুরো দমে চালিয়ে যেতে পারবো, যতদিন না ওনার পাসপোর্ট ভিসা তৈরি না হয়।”

ওনার থেকে কার্ডটা নিয়ে আরও দু’ একটা কথা বললেন তাসফি। খুব তারাতাড়ি ডিসিশন জানিয়ে দিবেন এটাও বললেন। তারপর আমার হাতটা সেভাবেই ধরে অপর হাতে ফাইলগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। সোজা হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে একটা রিকশা ডেকে আমাকে নিয়ে উঠে বসলেন। পুরো রাস্তা কোন কথা বললেন না উনি। আমিও কোন চেষ্টা করলাম না ওনার সাথে কথা বলার। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম ওনার ভাবগতিক বোঝার জন্য। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। উনি চাইছেনটা কি? তবে কি আমাদের অনাগত বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার আগেই…. ধক করে উঠলো আমার বুকটা। না… না এটা আমি কিছুতেই করতে দিতে পারবো না। এই অল্পক্ষণের অনুভূতিটা কিছুতেই শেষ করতে পারবো না।

.
বাসায় আসবার পর কারোর দিকে না তাকিয়ে, কারোর কথার জবাব না দিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। আম্মু এবং বড়মা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও তাদের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। রুমে এসে বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে নিলাম অসংখ্য বার। নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়েও শান্ত হতে পারলাম না। রুমে এসে মুখ না মুছেই বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসলাম। ভীষণ রকমের কান্না পাচ্ছে, গলার কাছে আঁটকে থাকা কান্নাটা বের করতে পারলাম। এক হাত পেটে রেখে নীরবে চোখের অশ্রুধারা গুলো বিসর্জন দিতে লাগলাম। নিজের মস্তিষ্কে বিশ্রিত টিউমারের অস্তিত্বের কথা জানার পর যতটা না খারাপ লাগছিলো, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি কষ্ট লাগছে আমার মাঝে তাসফির অস্তিত্বের নিঃশেষ হবার কথা ভেবে। আমি মা হয়ে কিভাবে আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তার অস্তিত্ব বিলীন হতে দিতে পারি? কিছুতেই পারবো না, কিছুতেই পারবো না আমি এত বড় ঘৃণ কাজ করতে।

কারোর স্পর্শে হাঁটু থেকে মাথা তুলে তাকালাম। চোখ মুখ শক্ত করে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাসফি। ওনার মুখের লাল আভা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। উনি পাশে বসে আমার দু’গালে হাত দিয়ে পুরো মুখটা ওনার দু’টো হাতের মাঝে নিলেন। চোখের পানি সহ পুরো মুখটা মুছে দিয়ে আলতো করে চুমু দিলেন কপালে। ওনার এই ছোট ছোট ভালোবাসায় এবার নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না আমি। ওনাকে ঝাপটে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণের আঁটকে রাখা কান্নাটা সহাসে বেরিয়ে আসতে লাগলো। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বেশ কিছু সময় নিয়ে বলে উঠলেন,
“এভাবে ভেঙে পরছো কেন রুপু? আমি আছি তো তোমার সাথে, কিছু হতে দিবো না আমি তোমার।”

আমার হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। আবারও বেশ কিছু সময় নিয়ে বললেন,
“কিছু হবে না তোমার, আমি হতে দিবো না। কিছুতেই পারছি না অশান্ত এই মনকে শান্ত করতে।এই খুশির খবর পেয়েও আমি খুশি হতে পারছি, তাই চাইও না এই খুশিটা উপভোগ করতে। আমার সব কিছুতেই তুমি আঁটকে আছো। তাই কিছুতেই হারাতে পারবো না আমি তোমাকে, সেই রিক্সটাও নিতে পারবো না। আমি জানি, মামা মামীরা আমার ডিসিশনেই প্রাধান্য দিবে। তুমিও আ….”

এতক্ষণে ওনার আদুরে কথাগুলোর মানে বুঝে উঠতেই চমকে উঠলাম আমি। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে আসলাম ওনার থেকে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“সরে যান আপনি আমার থেকে। একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। লজ্জা লাগলো না আপনার, এসব কথা বলতে? একটুও বিবেকে বাঁধলো না? কি ভাবে বলতে পারলেন আপনি কথাগুলো? নিজের অস্তিত্বকে শেষ করে দেবার কথাটা কিভাবে বলতে পারলেন?”

তাসফি আমার দিকে এগিয়ে এসে বোঝানোর চেষ্টা করলে আমি আবারও ওনার থেকে ছিটকে সরে আসলাম। কিছুতেই কানে তোলার চেষ্টা করলাম না ওনার কথাগুলো। এতক্ষণে আম্মু, বড়মা, রিফাপুও চলে এসেছে রুমে। আম্মু রুমে ঢুকেই আমার উপর ক্ষেপে উঠে বললেন,
“এমন চিৎকার করছিস কেন ছেলেটার সাথে। আসার পর থেকে চোখ মুখ শুকনো হয়ে আছে তোর চিন্তায়, আর এভাবে চিৎকার করছিস ওর সাথে। কি হয়েছে টা কি?”

“বেরিয়ে যেতে বলো ওনাকে, আমার সামনে যেন আর না আসেন উনি।”

আগের সুরেই কথাটা বলতেই আম্মু আবারও ধমকে উঠলো আমাকে। তাতে কিছুতেই দমে গেলাম না আমি। উনি মাথা নিচু করে বিছানায় চুপ করে বসে আছেন। এবার বড়মা আমার দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন কি হয়েছে। ওনার উপর এভাবে রেগে চিৎকার করছি কেন? আমি বড়মার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“ওনাকে এক্ষুনি আমার সামনে থেকে যেতে বলেন বড়মা, ওনার সাহস কি করে হয় আমাকে মা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত করার কথা ভাবতে? উনি বাবা হয়ে কি করে পারেন নিজের অস্তিত্বকে নিঃশেষ করার কথা চিন্তা করতে। চলে যেতে বলেন ওনাকে আমার সামনে থেকে, চলে যেতে বলেন….”

চিৎকার করে কথাগুলো বললেও শেষ কথা গুলো তে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ওনাদের ভাবমূর্তি দেখার জন্য তাকালাম না। কিন্তু কিছু সময় পর বড়মার কথাগুলো ঠিকই কানে আসলো। তাসফিকে জিজ্ঞেস করলেন আমি যা বলছি তা সত্য কি না? আর কেনই বা উনি বাচ্চাটা নষ্ট করার কথা বলেছেন? সাথে সাথে কোন জবাব দিলেন না তাসফি। বেশ কিছু সময় নিয়ে হসপিটালে বলা ডাক্তারের কথাগুলো আস্তে আস্তে খুলে বললেন। ওনার কথা শেষ হতেই নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল রুম জুড়ে। আমি মাথা তুলে তাকালাম না কারোর দিকে। না কারোর কিছু শোনার অপেক্ষায়, আর না কাউকে কিছু বলার জন্য। শুরু ফুপিয়ে ফুপিয়ে চোখের অশ্রুধারা গুলো বিসর্জন দিতে লাগলাম।

.
.
(চলবে…..)

পেইজের রিচ হঠাৎ এত কমে গেল কেন বুঝতে পারছি না🙁 যারা পড়বেন সবাই একটু সারা দেবার চেষ্টা করবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here