#তুমি_আমার
#পর্ব_০৪
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
এক সপ্তাহ পর উনাকে দেখছি।উনাকে সরে যাওয়া উচিৎ নাকি মুখের উপর দরজা বন্ধ করা উচিৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।হয়তো এসব করলে খারাপ দেখাবে ব্যাপারটায়।উনার দৃষ্টি আমার দিকে স্থির।খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে।নিজের অস্বস্তি কে পাওা না দিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বললাম…..
-‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।ভিতরে আসুন আমি আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি’।
কথাটা বলেই পেছন ফিরলাম আমি।আমার স্যার ডাকটায় যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন সেটা মুখ দেখে ঠিক অনুমান করতে পারছি।উনি ধীর পায়ে আস্তে আস্তে সোফায় বসলেন।আমি আম্মুর রুমের দিকে পা বাড়াতে যাব উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন….
-‘কলেজ যাচ্ছ না কেন? কোনো সমস্যা’?
উনার কথায় পেছনে ফিরে তাকালাম আমি।উনার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির।ভ্রু জোড়া খানিক কুচকে গেলো আমার।মনে মনে শ’খানেক গালি দিতে লাগলাম আমি।শালা রাম ছাগল আমার মান সম্মান নিয়ে টানা হ্যাচড়া করে কেন জিজ্ঞেস করছিস ‘কলেজ যাচ্ছ না কেন’ জানিস না কেন যাচ্ছি না।তোর জন্য হ্যাঁ শুধু মাএ তোর ওই অপমানের জন্য মুখ লুকিয়ে আছি।আমাকে কিছু বলতে না দেখে বসা থেকে উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন উনি।তারমধ্যে কলিংবেল বেজে উঠলো।আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলে দিলাম।ভাইয়া এসেছে ভিতরে না তাকিয়ে জুতো খুলতে ব্যস্ত সে।আমাকে গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাইয়া বললেন…..
-‘কিরে এমন পেঁচা হনুমানের মত মুখ করে আছিস কেন?কলেজ যাস না বলে শাস্তি স্বরূপ আম্মু তোকে চাকরানি কাটিয়ে সত্যি দুপুরে খেতে দেয় নি’?
ভাইয়ার কথায় চোখ দুটো বড় বড় তাকালাম তাঁর দিকে।সে আমার মাথায় চাপড় দিয়ে দিব্যি হাসছে।কিন্তু আমি ত হাসছি না।কারণ যম যে ঘরের ভিতরে।এই মূহুর্তে মায়ের ভয়ংকর শাস্তির কথা না বললে কি এমন হতো।পেছন থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে গেলাম…..
-‘যদি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে হয় সেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে তাই মুখটা এমন’।
উনাকে ভাইয়ার মুখের হাসিটা আরও প্রশ্বস্ত হলো।হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে উচ্ছাসিত কন্ঠে বললেন…..
-‘হেই ম্যান হোয়াট এ্যা সারপ্রাইজ!তুই কখন আসলি’।
-‘ এই তো আধ ঘন্টা হবে।তোর বোন এত কিপ্টা কি করে ভাই?এতক্ষণ হলো এসেছি অথচ এক কাপ কফি পর্যন্ত দিলো না।আরে না দিলেও ভদ্রতার খাতিরে একবার বলতে তো পারে কিন্তু তাও করলো না।ব্যাপারটা বিচ্ছিরি।দুই বছর পর এসেও যদি এক কফি না পাই তবে রোজ রোজ এলে কি বসার জায়গা পাবো।ভাইয়ের বন্ধু নিজের টিচার বেস্টুর ভাই এতগুলো সম্পর্ক থাকার পরও আমার এই দূর অবস্থা।বলে গাল ফুলালেন তিনি।ভাইয়ার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন….
-‘কিরে সিরাত এটা কি তুই ঠিক করলি।যতই হোক সে তোর টিচার মানুষ তাঁকে আপ্যায়নে এত ত্রুটি এটা কিন্তু একদম উচিৎ নয়’।
সকলের অগোচরে মুখ ভেংচি কাটলাম আমি।টিচার না ছাই।আর এতগুলো সম্পর্ক হুহ নিকুচি করেছে।তখন কোথায় ছিলো আপনার এতগুলো সম্পর্ক যখন আমাকে অপমান করেছিলেন।কিন্তু মুখের উপর এই তেতোঁ সত্যিটা বলে উঠতে পারলাম না।কোনো বাক্য ব্যয় না করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।দুই বন্ধু মিলে এতক্ষণে আড্ড জমিয়ে দিয়েছে।এরই মধ্যে আম্মুও উঠে পরেছেন।এসেই এই বহুরূপী কে দেখে আনন্দে আত্মহারা তিনি।আমি বুঝি না এই ছেলে আমার ফ্যামিলির উপর কি এমন জাদু করেছে যে উনি বলতে সবাই অজ্ঞান।
আমি কফি করতে করতে আম্মু ততক্ষণে ডিনারের ব্যবস্থায় বসে পরেছেন।উনি এতবছর পর এলেন খাওয়াতে হবে না।আমার মায়ের আচরণে খুবই ক্ষীপ্ত আমি।যেন জামাই ভোজন হবে নতুন জামাই আধিক্যেতা।কিন্তু কিছু বলা যাবে না তাহলে উল্টে বিনা সার্ফএক্সেলে আমাকে ধুয়ে দেবে।কফি নিয়ে এসে দেখি ভাইয়া নেই উনি বসে বসে মৃদু হাসছেন আর ফোন গুতাচ্ছােন।ফোন হাতে নিয়ে হাসা ভালো লক্ষণ নয় খুবই খারাপ।কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছেন নাকি কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু ঠাহর করতে ব্যর্থ হলাম।তাই কফিটা সেন্টার টেবিলে রেখে যেতে পা বাড়ালাম।তখনই উনি বললেন……
-‘কাপটা হাতে দিয়ে যাও’।পা দিয়ে ধুম ধুম শব্দ করে উনার হাতে তুলে দিলাম উনি এখনও হাসছেন।কিছু বললাম না হঠাৎ সেন্টার টেবিলে ফোন দেখিয়ে বললেন….
-‘ফোনটা কার’?এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে বললাম..
-‘আয়েশার’!আমার কথায় বিষম খেলেন উনি।তবুও মুখে হাসি লেগেই আছে তাঁর।ফোন হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-‘ওর ফোন তোমার কাছে কি করছে? ওয়ালপেপারে তোমার এমন পেত্নী মার্কা পিক কেন’?
-‘বেড়াতে এসেছে। বান্ধবী বান্ধবীর পিক দিতেই পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়’।
সিরাত যে ওর উপর রেগে ইচ্ছে এসব বলছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছে সে।কিন্তু সিরাতকে বুঝতে দেবে না।তাই আবারও প্রশ্ন করলো…..
-‘তা একে ইন্টারটেইন করার জন্যই বুঝি কলেজ কামাই করছো?কলেজ আর গেস্ট দুটোকে একসাথে সময় দিতে কষ্ট হচ্ছে হিমশিম খাচ্ছ।তবে এটা জেনে রেখো ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’লেখাপড়ার চেয়ে বড় কিছু নেই এমন কি বয়ফ্রেন্ডও না’।
শেষের কথাটা আমার চোখ বরাবর বললেন।লোকটা কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেলো।অবশ্য এর বাইরে ভালো কিছু ভাববেন না উনি ভাবার কথাও না।তাই কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে প্রস্থান করাই উওম।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি পেছন থেকে শুনতে পেলাম
-‘আমাক ভাব দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।আমি যথাসময় সময় যথাস্থানে এন্ট্রি নিতে জানি’।কথাটা ফোন কানে নিয়ে বলছেন কাকে বলছেন কে জানে।
🍁🍁🍁
চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।মিনার ছুটেছে বাইক নিয়ে অজানা উদ্দেশ্যে।রাএে বাইক নিয়ে ঘোরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।রাতের শহর গ্রাম সবকিছু নিজ চক্ষে দেখতে অতি মোহনীয় লাগে।তবে একা জার্নিটা ঠিক জমে না। রাস্তা থেকে আয়ানকে পিক আপ করে নেবে।লোকজন থেকে কিছুটা দূরে একটা গাছতলায় বসে আছে একটি মেয়ে।অন্ধকারের দরুন প্রথমে না দেখলেও বাইকের আলো গিয়ে মেয়েটার শরীরে পরায় এখন স্পষ্ট।গুটিশুটি মেরে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে সে।আলোর ছটা দেখে কিছুটা হাসি ফুটলেও আবার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো।মিনার কি ভেবে বাইক থামালো। একদম মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।মেয়েটির চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠলো।মিনার বললো…..
-‘এই মেয়ে এত রাতে এভাবে এখানে বসে আছো কেন’?
মেয়েটি একবার ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভীত কন্ঠে বলল….
-‘আমি এখানে কিছুই চিনি না।খালামনির বাসায় বেড়াতে এসেছি।সন্ধ্যায় বাইরে বেড়িয়ে ছিলাম এখন আর বাসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না’ বলে ফুঁপিয়ে উঠলো।মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে মিনারের মনের আকাশে কালো আধারে চেয়ে গেলো।ওর জন্য খারাপ লাগা কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।মিনার ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল….
-‘কেঁদো না।আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো।তোমার ঠিকানা মনে আছে’?
-‘হ্যাঁ মনে আছে।কিন্তু এখানে তো আমি নতুন কাউকে চিনি না।তাছাড়া সবাইকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে’?
মেয়েটি চোখে মুখে ভয়ের চাপ স্পষ্ট।কান্নার ফলে চোখগুলো ফুলে উঠেছে।ওর কথার মানে বুঝতে পেরে মিনার ভরসা দিয়ে বলল….
-‘বিশ্বাস রাখো তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।সসম্মানে তোমাকে তোমার আত্মীয়দের কাছে পৌঁছে দেবো’!মেয়েটি ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো কান্না মিশ্রিত গলায় বলল….
-‘ঠিক তো’!মিনার মুচকি হেসে বলে ‘হুম।মেয়েটিকে নিজের পেছনে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে তাঁর আগেই কল আসায় ফোন বের করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়ানের রাগী কণ্ঠস্বর শোনা গেলো….
-‘ওই শালা হারামি আমাকে লেনে দাঁড় করিয়ে এখন তোর কোনো পাওা নেই।কোথায় তুই কোনো মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিস’?
-‘সরি দোস্ত!আজ আসতে পারব না তুই বরং বাড়ী চলে যা আমরা কালকে বের হবো।আজ আমার একটা ইমপর্ট্যান্ট কাজ পরে গেছে’ ওপাশের ব্যাক্তিটিকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।এখন আয়ান ওকে আচ্ছামতো বকাঝকা করবে তাতেও যেন কোনো আক্ষেপ নেই তাঁর।বাইক নিয়ে মেয়েটির ঠিকানা অনুযায়ী একটি মোড়ের মাথায় থামলো ফট করে মেয়েটি বাইক থেকে নেমে সামনে হাঁটতে লাগলো।একবারও থ্যাংকস পর্যন্ত বললো না আজব!
🍁🍁🍁
তখন উনার সামনে থেকে আসার পর রুম বন্ধ হয়ে বসে আছি।আর বের হচ্ছি না।খাওয়া দাওয়া করে তবেই এ বাসা ছাড়ছেন উনি।ইতিমধ্যে বাসায় আব্বু এসে হাজির।ব্যস সবাই মিলে এখন খোশগল্পে বিজি।আম্মু গলা ফাটিয়ে অনেকবার ডেকেছেন কিন্তু পড়ার বাহানায় যাই নি।পড়ছি শোনেও ভাইয়া আর উনি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি করেছেন সেটা খালা নিশ্চিত করে গেছেন আমায়।তাতে আমার কি যা ভাবার ভাববেন।আমার এত দ্বায় নেই উনাকে এটেন্ড করার।ভাইয়ার বন্ধু ভাইয়া বুঝে নেবে।খাওয়ার জন্য অনেক্ষণ ধরে চিল্লাচিল্লি করছেন আম্মু কিন্তু উনার মুখোমুখি হতে চাই না তাই যাচ্ছি না।ঘুমের ভান ধরে পরে আছি।শেষমেশ আমাকে ছাড়াই খাওয়া শেষ করলেন তারা।আম্মু আমার খাবার রুমে রেখে চলে গেলেন।ক্ষিধে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে তাই চট করে উঠে খেতে বসলাম।হঠাৎ গলায় খাবার আটকে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম কিন্তু ঘরে পানি নেই।চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে ঢকঢক করে গ্লাস সাবাড় করে দিলাম।কিন্তু চোখের সামনে উনাকে দেখে চমকিত আমি।
-‘একি আপনি’
-‘হুম!ভালো লাগছে এখন’?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম।এখন খানিকটা লজ্জা অনুভূত হচ্ছে।কেমন করে খাচ্ছিলাম উনি কি ভাবলেন ভাবলেই লজ্জায় লাল হচ্ছি।আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন….
-‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো কথা আছে’।উনি গিয়ে বিছানায় বসে পরলেন।আমি আড়চোখে একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে খেতে লাগলাম।দুই লোকমা খেয়ে আর পারলাম না গিলতে খাওয়া শেষ সবকিছু গুছিয়ে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম…
-আপনি এখানে বসে আছেন কেন’?আমার কথা শেষ হতেই ফট করে দাঁড়িয়ে পরলেন উনি।উনার শার্ট ঠিক করলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকার দরুন দুজনের চোখাচোখি হলো।আমি তড়িঘড়ি করে চোখ নামিয়ে নিলাম।বাঁকা হাসলেন উনি।মোহনীয় কন্ঠে ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললেন….
-‘আমার সাথে এত লুকোচুরি এত অভিমান।ক্লাসে বকেছি বলে এত ইগনোর।বাড়িতে এসেও দেখা পাওয়া দুষ্কর।একজন স্যারের উপর এতটা রাগ করা কি মানায় সিরাত?’হতভম্ব বিস্মিত আমি।উনি কি কিছু টের পেয়েছেন সর্বনাশ।উনার কথাগুলো শুনে পুরো জমে গেছি।দু হাতে জামা খামছে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত।যেন নিজেকে ঠিক রাখতে অক্ষম সে।এরইমধ্যেই সিয়াম রুমে ঢুকলো।সিয়ামকে দেখে আবেশ বলল…..
-‘আগামীকাল থেকে যেন আর মিস না হয়’।কথাটা হুমকির সুরে বললেন নাকি আদেশসূচক বাণী এখনও বোধগম্য হলো না আমার।তবে একবার মনে হচ্ছে এটা ঠান্ডা মাথায় হুমকি।ভাইয়াও উনার কথায় তাল মিলালেন।আমি এখনও স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছি।উনি দরজা অব্দি গিয়ে ভাইয়া একটু এগুতেই আবার আমার কাছে ফিরে এলেন চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললেন ‘সরি’ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেলেন।সরি এই একটা ছোট্র শব্দ সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুললো আমার।মূহুর্তেই মনের আকাশে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করে দিলো।ভালোবাসা বুঝি এমনই সুন্দর মনোমুগ্ধকর।
#চলবে