রোদেলা,পর্ব: ৬৯

0
787

রোদেলা,পর্ব: ৬৯
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

সুফিয়ান তৈরী হয়ে পার্টি সেন্টারে চলে গেছে আগেভাগেই। রোদেলা অনিমার ননদকে দিয়ে প্রিসিলাকে পাঠিয়েছে পার্লারে। ও বাড়ি গুছগাছ করে সবাইকে তৈরী করে এক এক করে পাঠিয়ে দিলো। রেজওয়ান ও তৈরী হচ্ছে। রোদেলাকে দেখে অবাক হয়ে বললো –
: ভাবী আপনি এখনো তৈরি হন নি..!
: এই তো হচ্ছি, তোমার কি অবস্থা তা জানতে এলাম।
: আমার তৈরী হতে বেশী সময় লাগবে না, আপনি দ্রুত তৈরী হন।
: আচ্ছা….

বলে রোদেলা দ্রুত এলো ওর ঘরে। হঠাৎই চোখ গেলো খাটের উপরে ঝুলে থাকা বিশাল ছবিটায়। মনটাই ভালো হয়ে গেলো। এ বাড়িতে প্রথম বারের মতো এলে ও, বাড়িতে ঢুকেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে ও। বিশাল ফ্ল্যাট ওদের। প্রতি ফ্লোরো দুটি করে ফ্ল্যাট। পুরো ফ্ল্যাটটা এত সুন্দর করে গুছিয়েছে অনিমা কারো বোঝার উপায় নেই যে এ বাড়িতে গত তিনবছর কেউ থাকেনি। মাঝখানে মাস ছয়েকের মতো রেজওয়ান ছিলো যদিও। ও শুধু রাতে এসে ঘুমিয়েছে। ওরা আসছে এ উপলক্ষে মাসখানেক সময় নিয়ে অনিমা ঘরদোর পরিষ্কার করিয়েছে, গোছগাছ করেছে নিজের হাতে। বিশেষ করে ওদের ঘরটা, এত সুন্দর করে গুছিয়েছে ও আসার আগেই তা বলার মতো না। কেউ দেখলে বলবেই না এটা অতিথির ঘর। ওরা তো এ বাড়িতে এক প্রকারের অতিথিই।

বিশাল এই ঘরে সবচেয়ে বড় দেয়ালে খাট রাখা হয়েছে। একপাশে আলমারি আর আরেক পাশে ওয়ারড্রব। খাটের সামনে লম্বা আয়না দেয়ালে লাগানো। তার একপাশে রিডিং টেবিল আরেক পাশে ছোট্ট ডিভান। বারান্দার দিকে দুটো কিং সাইজ চেয়ার আর গোল সেন্টার টেবিল। এ ঘরে কেউ ঢুকলে সবার আগে তার চোখে পরবে খাটের ঠিক উপরে বিশাল সাইজের একটা ছবি। ছবিতে হাস্যজ্জ্বল লাজুক এক দম্পতি আয়নাতে মুখ দেখছে। তাদের দুজনকে ঢাকা হয়েছে লাল জরি বসানো বিয়ের ওড়নায়। পেছনে রুবিন আঙ্কেল, শাহনাজ আন্টি, নানু, আর তার ছোট রয়েছে। ক্যানডিড একটা ছবি। কেউই ক্যামেরায় তাকিয়ে নেই। নানু হাসি মুখে কি যেন বলছিলো সুফিয়ানকে, আন্টি উবু হয়ে রোদেলাকে আগলে রাখছে পেছন থেকে। রুবিন আঙ্কেল হাসিমুখে কাকে কি যেন জিজ্ঞেস করছে। ছোট মামাও হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন সেই দিকেই। অসম্ভব সুন্দর একটা ছবি।

দীর্ঘ জার্নির পর প্রথম বারের মতো এ ঘরে ঢুকে এ ছবিটাকে দেখে রোদেলা শুধু অবাকই হয় নি, ওর যাত্রা পথের সব ক্লান্তি উবে গেছে মুহূর্তেই। তখনি ওর হঠাৎ মনে পরে ওদের বিয়ের ছবি যখন পাঠানো হয়েছিল অনিমাকে। ও তখন সবচেয়ে পছন্দের একটা ছবি বেছে দিতে বলেছিলো ওকে। এখন বুঝতে পেরেছিলো কেন অনিমা সবচেয়ে পছন্দের ছবিটা চেয়েছিলো রোদেলার কাছে। এ ছবিটা সত্যি রোদেলার ভীষণ পছন্দের। জীবণে অনেক ছবি হয়তো রয়েছে ওর জীবণ। ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক ছবি হবে ওদের। কিন্তু এ ছবিটা সারা জীবণ ওর সবচেয়ে পছন্দের থাকবে। সাথে ছবির মানুষগুলোও। তারা কত কাঠখড় পুড়িয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছে শুধু মাত্র রোদেলা বিয়েতে এ্যাটেন্ড করতে।
ঠিক এই ছবিটা ফাইভ আর সাইজের একটা ফ্রেমে বাঁধা আছে ওর চেস্টারের বাসায়।

অনিমা সত্যি লক্ষ্মী মেয়ে। ননদ সম্পর্কে অনেক বাজে কথা ও শুনেছে। কিন্তু কখনো ওদের মধ্যে ননদ ভাবী সম্পর্ক ছিলো না। ওরা ছোট দুই ভাইবোন রেজওয়ান আর অনিমা ওকে মায়ের চোখে দেখে। রোদেলা ও দূরে থেকেও সব দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করে।

রোদেলার সংবিৎ ফিরলো একটা গাড়ির হর্ণের শব্দে। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো প্রিসিলা এসেছে তৈরী হয়ে। রেগে কটমট করে নিচে নামলো ও। কত করে বলেছে সেজা পার্টি সেন্টারে চলে যেতে। এখানে কেন আসলো আবার…?

নিচে নামতেই দেখলো প্রিসিলা নামছে গাড়ি থেকে।
রেগে রোদেলা বললো এখানে আবার এসেছিস কেন..? বললাম না সরাসরি ওখানে চলে যেতে…?

আপা সুফিয়ান ভাইয়া বললো আজ দুই ভাইয়ের বৌভাত একসাথে হবে। রোদেলা অবাক হলো এ কথা শুনে। রোদেলা দেখলো গাড়ি থেকে একজন মেয়ে নামছে মেকাআপ বক্স আর অন্যান্য সরঞ্জাম হাতে। অনিমার মামী মানে রোদেলা প্রিসিলার মামী শ্বাশুড়ি রোদেলাকে তাড়া দিয়ে উপরে যেতে বলে।

কি হচ্ছে কিছুই বোঝে না রোদেলা। ঘরে গিয়ে মামী খাটের নিচ থেকে ডালা বের করলো। রোদেলা হতভম্ব এসব দেখে। পার্লার থেকে আসা মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো-
: আপু আপনি অনেক ভাগ্যবতী… কাওকে এমন সারপ্রাইজ দিতে আমি কখনো দেখি নি। নিন উঠুন এইখানটায় বসুন। মামী রোদেলাকে বসিয়ে দিলো ড্রেসিং আয়নার সামনের চেয়রটায়। এক এক করে খোলা হলো লেহাঙ্গা, জুয়েলারি আর চুড়ির ডালাগুলো। লেহাঙ্গার ডালাতে ওর ভাঁজে ছোট্ট একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিলো-

“প্রিয়,
আমাদের বিয়েটা হঠাৎ আর অনাড়ম্বর ভাবে হয়েছিল। বৌভাত বলে যে আনুষ্ঠানিকতা থাকে তা আমাদের ছিলো না। তাই মনে হলো এমন একটা দিন তো তোমারও পাওয়ার কথা। তাই তো সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় কেনা হয়েছে তোমার অগোচরে। এমন ভাবে এসব করবার জন্য আমি দুঃখিত প্রিয়, আগে তোমাকে এসব বললে তুমি এমনটা হতে দিতে না। আমার কি শখ হয় না আমার বৌটাকে এভাবে দেখতে….?

রাগ করলে পরে করিও, আগে জলদি তৈরী হয়ে আস,তোমার বর তোমাকে দেখার অপেক্ষায় রইলো”

রোদেলা মুখে কপট বিরক্তি এঁকে রাখলেও ভিতরে ভিতরে ভীষণ রকমের সারপ্রাইজ হয়েছে সুফিয়ানের এমন কান্ডে। সত্যি এমনটা ও কল্পনাতেও ভবে নি। বৌভাত নিয়ে যে ওর মনে একটু কষ্ট ছিলো তা সত্যি। কিন্তু ও কখনোই তা প্রকাশ করে নি। তবে এমন অনেক কিছু ছাড় দেয়া যায় সুফিয়ানের মতো একজনকে পাশে পেলে। ওর চোখে পানি এসে পরলো। এ পানি আনন্দের…
ওর জীবণে একটা সময় ছিলো না পাওয়াদের দখলে, কেউ ভালোবেসে মাথায় একটু হাত রেখে কথা বললেই কান্না এসে যেতো, আর এটা তো কত্ত বড় কিছু ওর জন্য, জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ। রোদেলা দ্রুত চোখ মুছে মেয়েটিকে বললো লেন্স পরারলয় আমি অনভ্যস্ত তো তাই…..

সাজগোজের এক ফাঁকে রোদেলা প্রিসিলাকে বললো – এসব আমাকে আগে বললে কি হতো, সেজেগুজে এসে এখন গরমে তোর মেকাপ যদি নষ্ট হয়ে যায়…?

প্রিসিলা ওর পিছনে এসে আয়নাতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে- আপা কত কি করলি আমার জন্য, আমাদের জন্য, তোর জন্য এটুকু তো খুবই নগন্য…

মেয়েটি তখন চোখ সাজাচ্ছিলো, রোদেলা তাই এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলো, একথা শুনে মেয়েটিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে ঘুরে তাকিয়ে বললো, আমি বড় তাই, আমার জায়গায় তুই থাকলে তুই ও তাই করতি। এটাকে এভাবে বলার কিছু নেই। উত্তরে প্রিসিলা শুধুই হেসেছে, বাইরের একজনের সামনে কিছু বলতে চায় না তাই হয়তো…

মেয়েটি খুব দ্রুত রোদেলাকে তৈরী করে দিলো। দুই বোন বৌ সাজে গাড়িতে উঠলো। মামী আর অনিমা সাহায্য করলো দুজনকে।

একরকম পার্পল রঙের ভেলভেটের লেহেঙ্গা, গোল্ডেন জুতা, চুড়ি, জুয়েলারি, ওড়না, পার্স এমনকি সাজটা পর্যন্ত একরকম হয়েছে দুজনের।

পার্টি সেন্টারে আরেক চমক। রেজওয়ান আর সুফিয়ান দুজন দাঁড়িয়ে আছে ওদের দুজনের অপেক্ষায়। রোদেলা কটমট করে তাকিয়ে আছে গাড়ির ভেতর থেকেই। সুফিয়ান একহাতে কান ধরে সরির ভঙ্গিতে তাকালো ওর দিকে। ওর এমন ভঙ্গিতে হেসে দেয় রোদেলা।

এরপর দুই ভাই দুই দিকের গেইট খুলে ওদের দুই বোনকে নামালো গাড়ি থেকে। নিয়ে গেলো ভিতরের দিকে। রেজওয়ান প্রিসিলাকে হাত ধরে নিলেও সুফিয়ান আর রোদেলা হাঁটলো পাশাপাশি। স্টেজে এক জোড়া না চেয়ার রাখা হয়েছে দুই জোড়া…

জীবণে কখনোই এরকম গর্জিয়াস ভাবে সাজে নি এর আগে। সবারই চোখ কপালে ওকে এমন রূপে দেখে। চেনাই যাচ্ছে না একদম…
সুফিয়ান তো সুযোগ পেলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।

রোদেলা কিছুতেই বসবে না, ওর কত কাজ, এখানে বসে থাকলে ওর হবে। ফটোগ্রাফার অনুরোধ করলো আপু ছবি তুলে না-হয় চলে যান। পর অবশ্য রোদেলার ভাগের কাজগুলো সামাল দিয়েছে অনিমা আর ওর বর।

তারপর দুইজোড়া কপোত-কপোতীর ছবি তোলা হলে। এদিকে অনুষ্ঠান চলছে তার গতিতে। সুফিয়ানদের আত্নীয়রা সবাই এসে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে দুই বৌ এর সাথে। ছবিতোলার এক ফাঁকে রোদেলা দেখলো শোভন স্টেজের সামনে উদাস দৃষ্টিতে দেখছে এসব। রোদেলা তাকাতেই সেখান থেকে উঠে চলে যায় শোভন….

ব্যাপারটা কাছ থেকে লক্ষ্য করে সুফিয়ান। রোদেলার মনোযোগ ঘুরাতে কি যেন জিজ্ঞেস করতে দেখা যায় ওকে সে কথার উত্তরে হেসে ফেলে রোদেলা।

দুই বৌয়ের বৌভাত তাই দুই বৌই নাইওর গেলো কৃষ্ণচূড়ায়। নাতাশাও রয়ে গেলো এ বাড়িতে। কল্লোলকে থাকতে বললো কিন্তু কল্লোল জরুরি কাজ থাকায় বাড়ি ফিরে গেলো। শোভন, সারা আর বাকীরা সেন্টার থেকেই বাড়ি ফিরেছে। অনেক অনেক দিন পর কৃষ্ণচূড়া বাড়িটাতে আনন্দের জোয়ার বইলো। খুশি উপচে পরছে যেন সবার চোখেমুখে। একসাথে থাকাটা কত শান্তির কত আনন্দের। কিন্তু রোদেলা জানে ওর বদমেজাজী মায়ের জন্য এ পরিবেশ কতক্ষণ এমন থাকবে তা বলা মুশকিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুইটা ঘর সাজানো হয়েছে এ বাড়িতে। একটা প্রিসিলা রেজওয়ান আরেকটা রোদেলা সুফিয়ানের জন্য। এসব নিশ্চয়ই নোভেল হা*রা*ম*জা*দা*র কাজ। ও হাসবে না কাঁদবে বুঝলো না। সবাই হলঘরে বসে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলো একসাথে। একফাঁকে রোদেলা ভাবলো জীবণ সত্যি সুন্দর। যার যতটুকু পাওনা, প্রকৃতি কোন না কোন ভাবে তাকে সেটা ফেরত দেয়। হোক তা দুঃখ কিংবা এরকম অকৃত্রিম সুখ…..

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here