রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৬৭
প্রায় সাড়ে সাত বছর পর দেশে ফিরে এক সপ্তাহ না যেতেই একদফা ঝগড়া হয় নাসিমা আর রোদেলার। মৃ*ত মেয়েকে এত বছর পর ফিরে পেয়ে আবেগে যে শোক প্রকাশ করেছিলো সে আবেগের রঙ ম্লান করতে সাতদিন ও সময় নেয় নি নাসিমা। রোদেলা জানে যে সবাই যতই বুঝাক ওকে, ওর মা বদলাবে না জীবনেও।
ঝগড়ার উৎস দাওয়াত দেওয়া। দাওায়তের তালিকা রোদেলা নিজেই তৈরি করেছিল মায়ের সাহায্য নিয়ে। সে হিসেবে দাওয়াতের কার্ড ও লিখা হয়েছে। নাসিমা নিজেই মহোৎসবে দাওয়াত দেওয়ার কাজ শুরু করলো।
একদিন ফোনে রোদেলাকে বলেছিলো নাসিমা সময় করে ওর খালাদের বাড়িতে দাওয়াত দিতে তার সাথে যেন যায় ও। কথাটা শুনে বিরক্ত হয়েছিল ও। দাওয়াত দিতে ওর যাওয়ার কি দরকার…? বিরক্তি হজম করে রোদেলা সুন্দর করে বলেছে ও যাবে না। আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন সম্পর্কে আমাদের ধর্মে একটা বিধান রয়ে। তা না হলে ও ঠিক উপরে ফেলতো তাঁদেরকে ওর জীবণ থেকে। মনের কষ্ট মনে রেখে তাদের সাথে মোটামুটি একটা সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে ও। এতে গভীর ভালোবাসা বলে যে ব্যাপার থাকে সত্যি বলতে তা নেই। তাদের সাথে আবার সুসম্পর্ক হোক তা ও চায় না। তাছাড়া ঐদিকেও তো ওর নানান কাজ রয়েছে। তারউপর প্রথমবারের মতো শ্বশুর বাড়িতে এসেছে ও। শ্বাশুড়ি না থাকায় নানান ঝামেলার মধ্যে দিয়ে ওকে যেতে হচ্ছে।
ওর মা অতীতের সব কথা ভুলে গিয়েছেন। তার বোনদের প্রতি দরদ দেখলে মনে হয় তিনি ভুলেই গেছেন তার বিপদের দিনে সবাই যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন তার বোনেরা।
এর মধ্যে একদিন মায়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলো ও, এক বিকেলে কথা হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। খাওয়ার পদ, আর হলুদের শাড়ি হাবিজাবি বিষয়ে। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই হুট করে নাসিমা ফোন ধরিয়ে দিলেন রোদেলার হাতে-
: হ্যারে ছোট….(ছোট মামা) নে রোদেলা কথা বলবে তোর সাথে….
আজব….!
ব্যাপারটায় অপ্রস্তুত হয়ে যায় ও। সাথে অবাকও হয় ভীষণ রকমের। যে ভাই আরেক ভাইয়ের মৃ*ত্যু পরপর বাড়ি বিক্রি করে তাকে পথে নামিয়েছিলেন কি অবলীলায় তার সাথে কথা বলছেন তিনি। যেন এমন কিছুই হয়নি কোনদিন….
রেগে গিয়ে ফোনটা কেটে দেয় ও। তারপর বলে মা তোমার স্মরণ শক্তি কম তা আমি জানি, কিন্তু আমার স্মরণ শক্তি বেশ ভালো। তোমার ভাইবোন তুমি তো তাদের ছাড়তে পারবে না, ভালো কথা। আমি বলছিও না ছাড়তে, তবে আমার একটা অনুরোধ আমাকে এসবে জড়াবে না।
এ কথার বিপরীতে তিনি অনেকগুলো কথা জুড়লেন, একটা সময় তা রূপ নিলো ঝগড়ায়। প্রিসিলা অনেক চেষ্টা করলো নাসিমা কে থামাতে। রাগে ক্ষুব্ধ নাসিমা একসময় গায়ে হাত তোলে প্রিসিলার। যে মেয়েটার বিয়ে দুদিন পরে, তার গায়ে হাত উঠে কিভাবে….?
তারউপর তিনি এমন কিছু কথা বলেন, যা শুনে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার উপক্রম হলো রোদেলার। কথাগুলো ভাবলেও কলিজা ছিদ্র হয়ে যায় রোদেলার। ওর মা কি কখনোই বদলাবে না….?
নাসিমার এত কথার সারমর্ম হচ্ছে –
অতীত ভুলে গেছে রোদেলা , যে ভাইয়েরা খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে তাদের এখন ও চিনে না। ওর এমন ব্যবহার নাকি টাকার গড়িমা। অহংকারের ভার আল্লাহ ও সহ্য করতে পারে না তাও বললো এক ফাঁকে।
রোদেলা স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঐ এক কথা বলেই যে বন্ধ হয়েছিল মুখের জবান, তা আর খুলে নি। এ কথার বিপরীতে এসব কথা আসে কিভাবে…?
সে রাতেই ও কেঁদে ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গিয়েছিলো কৃষ্ণচূড়া ছেড়ে।
বিয়ের তারিখ এগিয়ে এসেছে, এরমধ্যে এমন মনমালিন্য চললে হয় না। কেও যখন কষ্ট দেয় সে সময়টা তার করা সকল অন্যায়গুলে, তার দেয়া সব কষ্ট গুলো এসে ভিড় করে মনের জানালায়। অনেক ভেবে সে সব কষ্ট দুঃখগুলোকে একপাশে সরিয়ে আবারো আসে রোদেলা কৃষ্ণচূড়ায়। মনের ক্ষত কিন্তু তখনো তাজা। সব ভুলে ও এসেছে এখানে অথচ নাসিমার ভাবভঙ্গি দেখে পিত্তি জ্বলে যায় ওর। তার মেয়ের বিয়ে, তার উচিত ছিলো রোদেলার সাথে মনমালিন্য দূর করা, তা তো করেনই নি। উল্টো মুখ ভার করে বসে আছেন।
অগত্যা রোদেলা এসব পাত্তা না দিয়ে কাজকর্মের তদারকি করে। নিজের কাছের কিছু বন্ধুদের দাওয়াত করে । কনে বাড়ির যাবতীয় কাজের দায়িত্ব ও নেয় সুফিয়ান। ডেকোরেটর, ইভেন্ট প্লানিং, এসব কাজ একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে দিয়ে দেয়। তাতে খরচ বাড়লেও ঝামেলা অনেক কমে যায়।
খালারা বিয়ের একদিন আগেই এসে পরেছেন। তাদের রোদেলার প্রতি আবেগের প্রদর্শন চলে ঘন্টাখানেক সময়। দুই খালা তাদের সেই সময়কার বর্ননা করতে থাকে এক এক করে। রেদেলার খুব ইচ্ছে করে তাদের জিজ্ঞেস করে, ওর মা যখন চলে যাচ্ছিল এ বাড়ি ছেড়ে, তখন কোথয় ছিলেন তারা। কিন্তু সব কথা কি বলা যায়…?
অসহ্য লাগে ওর, ও যেন এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে। কারন এদের একেক জনের আসল রূপ ওর দেখা হয়ে গেছে বহু আগেই….
একেক ঘর দখল করেছে একেক জন। হলুদের দিন সকালে সপরিবারে এসেছেন ছোট মামা। তাদের আন্তরিকতা দেখলে কে বলবে যে টাকার জন্য অসুস্থ ভাইকে মৃ*ত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন তিনি, আর তার মৃ*ত্যুর পরই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তাদেরকে। একটাবারও ভাবেন নি তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়বে…?
সাবই নিজের সেরা অভিনয়টা করতে ব্যাস্ত। একেকজন ছাড়িয়ে যাচ্ছে একেক জনকে। প্রিসিলা সবই বলেছে ওকে। একেকটা দিন কিভবে কেটেছে ওদের। আর এই যে এখন চারপাশে ঘিরে আছে সবাই, এরা তখন কত কত আলোকবর্ষ দূরে ছিলো তখন….
রোদেলা ম*রে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। প্রিসিলা নাসিমা নামক যাতা কলে পিষছে দিন পর দিন। রোদেলার মতো প্রতিবাদী ও না। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় জানা নেই ওর। তাই তো নিজের কাছে প্রিসিলাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা ও করেছে।
ওর দেবর রেজওয়ান পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে কাজকর্মের তেমন সুবিধা করতে পারে নি। পিএইচডি করা রেজওয়ানকে চাকরী দেয় নি আবদেন করা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই। তারা সরকারি খরচে শিক্ষকদের পিএইচডি করাতে বিদেশে পাঠায় কিন্তু পিএইচডি সম্পন্ন করা কাওকে নিয়োগ দেয় না। রাগে কষ্টে ও সুফিয়ানের পরামর্শে পাড়ি জমায় ইংল্যান্ডে। সেখানে এখন একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরী করছে ও। বিয়ে থা করা নিয়ে কোন উৎসাহই দেখায় না ও। সারাদিন কাজ আর কাজ। এদিকে বিয়ের বয়স যায় যায়। যখনি তাগাদা দিয়েছে রোদেলা, তখনি বলেছে আরেকটু গুছিয়ে নিই ভাবী। নেক্সট সামারে এ…..
সেই সামার আর আসে না….
একদিন হঠাৎ রাতের খাবারের পর কাওকে পছন্দ আছে কি না জানতে চায় রোদেলা। রেজওয়ান ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,
: ভাবি জীবণ চলে যাচ্ছে দৌড়ের উপর, এসবের সুযোগ পেলাম কই…? কর্মঠ হওয়ার অনেক জ্বালা ভাবি। গার্লফ্রেন্ড পাওয়া যায় না। তাদের সময় দেওয়ার সময় কই? অথচ দেখেন আমার বহু বেকার বন্ধুর দু-তিনটা করে গার্লফ্রেন্ড। বলে হাসিতে ফেটে পরে ও।
: আমরা তাহলে মেয়ে দেখা শুরু করি…?
: বিয়েটা কি করতেই হবে….?
: এটা কেমন কথা রেজওয়ান, এতদিন আমি ভাবতাম তোমার পছন্দের কেও আছে, তাই হয়তো এড়িয়ে যাচ্ছো,
: আরে না ভাবী।
: আমরা তাহলে মেয়ে দেখা শুরু করি,
কথা প্রসঙ্গে সুফিয়ান হুট করে বলে-
: আচ্ছা… , প্রিসিলাকে তোর কেমন লাগে…?
: ভালোই তো।
রোদেলা যেন চমকে উঠে কথাটা শুনে। বোনের জন্য সবসময় চিন্তা হয় ওর। মাঝে মাঝে ভাবে এখনে নিয়ে আসবে ওকে, কিন্তু এ কথাটা ওর একবারের জন্য ও মনে হয়নি রোদেলার।
: কি ম্যাডাম আপনার বোনকে বিয়ে দিবেন নাকি আমার ভাইয়ের সাথে, ছেলে নাইনটি নাইন পারসেন্ট ভালো মাঝে মাঝে কাজে ডুবে বাসায় আসতে ভুলে যায় আর কি….. হা.. হা… হা…..
সুফিয়ানের সেই হাসিতে যোগ দেয় রেজওয়ান।
রোদেলা কেন যেন যোগ দিতে পারে না এ হাসিতে। কারন এ ব্যাপারটায় অনিমার মতামতেরও একটা ব্যাপার আছে।
আল্লাহ সহায়…
কেন রকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা ঠিকঠাক হয়ে যায়। প্রিসিলা শুধু ওর মায়ের হাত থেকে বাঁচতে চায়। তারউপর ও ওর বোনের সাথে থাকতে পারবে। এ তো সোনায় সেহাগা, না চাইতেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার।
শুধুমাত্র বোনকে মুক্ত করতে দেশে এসেছে ও। নাহলে কোনদিন আসতো না এখানে। ও ভালো করেই জানে ওর মা একটুও বদলায় নি। তার প্রমাণ পেলো সাতদিন না যেতেই।
চলবে….