রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু ৭১

0
509

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
৭১.

বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলো। তিনদিন পর ওরা গেলো সেইন্টমার্টিন। রোদেলা সুফিয়ান যেতে না চাইলেও ওরা জোর করে নিয়ে গেলো ওদেরকে। রোদেলা মন থেকেই সেন্টমার্টিন যেতে চায় না। কারন ঐ জায়গাটা ওকে অনেককিছু মনে করিয়ে দিবে, যা ও চায় না। খাবার টেবিলে বসে রোদেলা বললো-
: আচ্ছা আমরা অন্য কোথাও যাই…
: ভাবী টিকিট কাটা হেটেল বুকিং সব কম্পিলিট।

এরপর কি বলবে ভেবে পেলো না রোদেলা। প্রিসিলার উপর রাগ হলো ওর মনে মনে। এসব করার সময় ওকে বারন তো করতে পারতো। রেজওয়ান না জানুক ও তো সব জানে…
কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। সুফিয়ান ইশারায় কি যেন বললো ওকে। ওর এই ভঙ্গিটা চেনে রোদেলা। এটার মানে রোদেলা নিজের মতো করে করে নিয়েছে। রোদেলা এ ভঙ্গিটার নাম দিয়েছে -লেট ইট গো…!

অনেক কিছু উপেক্ষা করবার ক্ষমতা রোদেলার আছে, কিন্তু ঐ সব দিন, ঐসব ঘটনাকে উপেক্ষা করতে পারবে তো ও…? এত ক্ষমতা ওর আছে।

পরদিন রাতে রওনা দিলো ওরা। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলো সেন্টমার্টিন। অবাক হয়ে খেয়াল করলো রেজওয়ান ব্লু মেরিনেই রুম বুকিং দিয়েছে। এই সেই ব্লু মেরিন যেখানে ওরা সবাই উঠেছিলো অনেক দিন আগে। জীবণের সবচেয়ে আনন্দের সময় গুলোর একটি সেটি। তবে ঐ সময়ে কিছু ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়েছিলো। সেসব অনেক পুরাতন কথা। ক্ষত শুকিয়ে গেছে। কিন্তু সেই ক্ষতের দাগটা রয়ে গেছে এখনো। মনের দাগের সাথে হাতের সেই চুড়ি দিয়ে কাটা দাগটাও রেয়ে গেছে অবহেলায়, অযতনে।
এমনিতে চোখে পরে না সেটা, খেয়াল করে তাকালে জানান দেয় রোদেলা আমি রয়েছি এখনো।

তবুও ও ভাবে এসে ভালোই হয়েছে। নিজেকে পরীক্ষা করবার এটা হয়তো একটা সুযোগ হিসেবে এসেছে ওর জীবণে। সবকিছুতে পজিটিভিটি খোঁজা রোদেলা শক্ত করে সুফিয়ানের হাতটা চেপে ধরলো। চকিতে সুফিয়ান তাকালো ওর দিকে। রোদেলা তাকানো সামনের দিকে। সুফিয়ান ভাবলো কেও ওকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললো নাকি…

আশেপাশে কেউ-ই নেই। রোদেলা তাকালো ওর দিকে স্মিত হেসে চোখে মুখে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির ছাপ, তবুও ওর এই ভুবন ভোলানো হাসিতে ক্লান্তির ছাপ উপেক্ষীত হলো। ইশারায় কি যেন জিজ্ঞেস করলো রোদেলাকে। রোদেলাও উত্তর দিলো ইশারাতেই। একফাঁকে রেজওয়ানের চোখে ধরা পরলো তা। মুচকি হেসে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে।

রোদেলা দেখেছে রেজওয়ানের সেই তাকানোটাকে। হঠাৎ ওর মনে পরে-
রেদওয়ান একবার বলেছিলো
: ভাবী আপনি ফ্রী হয়ে একটা ডিকশিনারি লিখে ফেলুন তো…
বিস্ময়ে রোদেলা জিজ্ঞেস করেছিলো-
: মানে…!
: এই যে ইশারায় কি সব কথা বলেন বর-বৌ মিলে। আমরা কিছুই বুঝি না মাথা মুন্ডু,
: ও এই কথা….!
হেসে গড়িয়ে পরেছিলো রোদেলা।
ভাষাহীন কোন পৃথিবী যদি থাকে তবুও ভালোবাসা প্রকাশে কোন সমস্যাই হয়তো হবে না ওদের দুজনের। সুফিয়ান বরাবর রিজার্ভ প্রকৃতির ছেলে। কথা বলে কম। নিজের এই প্রকৃতির জন্যই হয়তো কথা বলার এই মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে দুজন। মানুষের কাছে নিজের ওয়েটও থাকুক, আবার কথা চালাচালি ও চলুক দুজনের মধ্যে । রেজওয়ান যেদিন প্রথম নোটিশ করেছিলো কথাটা, রোদেলা এর আগে খেয়ালও করেনি ওদের অভিযোজিত এই অভ্যাসের কথাটা । বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলো ওরা দুজনেই।

ক্লান্তি সবার চোখেমুখে। কোনমতে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রেস্ট কটে ওরা দুপুর পর্যন্ত। বিকেলে বের হবে। ফোন-টোন সব সুইচ অফ করে ঘুম দেয় একটা।

বিকেলে বের হয় চারজন একত্রে। প্রায় বছর সাত আট আগে এসেছিলো ওরা, অনেক বদলে গেছে চারপাশ। ওরা রিসোর্টের নিজস্ব বীচের পথ ধরে হাঁটছে। সামনে রোদেলা সুফিয়ান ওদের পেছনে প্রিসিলা রেজওয়ান। একটু হাঁটতেই কথায় কথায় কি যেন জিজ্ঞেস করতে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে ওরা দুন পেছনে নেই। তারাহুরো করে ফোন খুঁজতে থাকে রোদেলা। সুফিয়ান ওর ব্যাস্ততা দেখে জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার…! কি খুঁজছো তুমি…?
ওরা দুজন তো পেছনেই ছিলো…? কোথায় গেলো হঠাৎ, একটু ফোন করে দেখি। সুফিয়ান হাঁটা থামিয়ে বললো থামো তো…, ওরা কি ছোট বাচ্চা…?
ওদের প্রথম হানিমুন ওরা কি আমাদের পিছন পিছন হাঁটতে এসেছে এখানে…?

ওরা ওদের মতো করে থাকুক। আমরাও আমাদের সেকেন্ড হানিমুনটা সেরে ফেলি। বলেই রহস্যময় হাসি হাসে সুফিয়ান। ফার্স্ট হানিমুন বলে কিছু নেই ওদের । বিয়ে করা সত্ত্বেও অনেক সময় নিয়েছে দুজনে কাছে আসতে, এক হতে। জড়তা দুজনের ই ছিলো, বেশী যা ছিলো তা সুফিয়ানের ধৈর্য। বিয়েটা নানুদের বাসায় হওয়ায় নানু ব্যাপারটা বুঝে ওদেরকে হানিমুনে পাঠিয়েছিলো।

ভালো সময় ওরা কাটিয়েছে সত্যি। দুজন ভালোবেসে এক না হলেও, ভালো বন্ধু হয়েছিল দুজনে। রোদেলা এ ব্যাপারটা নিয়ে অপরাধবোধে ভুগতো। হানিমুনে প্রথম রাত কেটেছে দুজন দুই বিছানায়। সকাল হতেই সুফিয়ানকে বুঝিয়ে বলেছিলো ওর একটু সময় লাগবে স্বাভাবিক হতে। বাবা-মা ছাড় বিয়ে হয়েছে তাই হয়তো মনের অবস্থা বিক্ষিপ্ত। তাই সুফিয়ান ও ঘাটে নি ওকে। রোদেলার মনের একচ্ছত্র মালিকানা পেয়েছে ও। বাকী সবকিছুকে ও বোনাস ভেবে নেয় আপাততর জন্য।

জীবণ তাইতো দ্বিতীয় বাসর, দ্বিতীয় হানিমুনে সাজিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। বীচের কাছে বসে দুজন। সমুদ্র এত বিশাল যে নিজেকে সত্যি ক্ষুদ্র মনে হয় রোদেলার। আর এই ক্ষুদ্র আমির কষ্ট গুলো আরে ক্ষুদ্রতর হয় এর বিশালতায়। সুফিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে অপলক তাকিয়ে থাকলো ওরা দুজনে। সন্ধ্যা মিলাবে কিছুক্ষণ পরেই। দিন ও রাতের এই যে সন্ধিক্ষণ এটা খুব প্রিয় সময় রোদেলার। আর এই প্রিয় সময়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো পাশে থাকা এই লোকটাই। গতবার যখন এসেছিলো তখন।
ঐ যে সেদিন – রোদেলা ভেবেছিলো ডাব হাতে ভাব জমাতে এসেছে সুফিয়ান। সেই দিন… অনিমাকে খুঁজে পেয়ে ছবি তোলার পর ছবিগুলো সুন্দর হওয়ার কারন বর্ননা করতে গিয়ে বলেছিলো কথাগুলো।

একটা সময় এমন জীবণ যাপনে অভ্যস্ত ছিলো ও যেখানে এসব ভাবার সময় ছিলো না। জীবণকে ভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ভাবার, দেখার, এক্সপ্লোর করার কোন ফুরসতি ছিলো না ওর। সারা সারা দিন পার হয়েছে ব্যস্ততায়, দিনশেষে যখন গোধূলী আসতো ও তখন ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত থাকতো। রোদেলার চিবুকে যে ক্ষুদ্র একটা টোল আছে তা ও যখন জেনেছে তখন ওর বয়স বাইশ। আর গোধূলীর সৌন্দর্য লক্ষ্য করা তো আরো গভীর ব্যাপার। রোদেলা এখনো মনে মনে ভাবে সেসব দিনের কথা, কষ্টের কথা। আর খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে না ও। আল্লাহ চাইলে সব পারেন। কোথায় থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে ওকে।

আনমনা রোদেলা কি ভেবে যেন হঠাৎ হেসে ফেলে, সুফিয়ান না চমকেই বললো –
: হাসলে যে…?
: জানেন সুফি…! গতবার যখন আমি এ জায়গায় এসেছিলাম তখন আমি আপনার মায়ার জাল কাটাতে ব্যাস্ত ছিলাম…
: আর এখন….
: আপনি নেই এমন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারিনা সুফি, এরচেয়ে বেশী কষ্ট, দুঃখ আমি সইতে পারবো, অর্থ, বিত্ত সব চলে যাক আমার কেন দুঃখ নেই কিন্তু আপনাকে….

কথাগুলো শেষ করতে পারলো না রোদেলা…
সুফিয়ানের মোহময় দৃষ্টি ওকে যেন থামিয়ে দিলো হঠাৎই। চোখ নামিয়ে ও বললো-
: আপনি আমার জীবণে একমাত্র অবলম্বন, সেই অর্থে না যাকে কেন্দ্র করে জীবণ আবর্তিত হয়, সেই অর্থে যাকে আমার সব আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার রাগ ক্ষোভ দেখাতে পারি, ভালোবাসতে পারি। জানেন সুফি আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়… , আপনি বদলে যাবেন না তো…?
: উত্তরে মুচকি হাসে সুফিয়ান। বলে তোমাকে সব বললেও একটা কথা বলা হয় নি…
তুমি আমার জীবণে একমাত্র স্ট্রাগল। তোমার দেখা পেতে আমি আমার মেধা আর শ্রমের যে ব্যাবহার করেছি, তা যদি টাকা তৈরীতে করতাম তাহলে অনেক ধনী হতাম আমি। অবশ্য আমি এখনো নিজেকে অনেক ধনী মনে করি। টাকার অংকে না। মানসিক ভাবে। মানসিক ভাবে আমি অনেক ধনী।
আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য কি জানো…?
: হুম, তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই…
: অকপটতা…, আমাদের মধ্যে ছল, গোপন কিছু নেই, দুজনেই খোলা বই দুজনের কাছে।
: হুম আমারও তাই মনে হয়। জানেন সুফি…
আমার বন্ধু সিমি, একবার ভীষণ অবাক হয়েছিল যে আমি আপনাকে শোভনের ব্যাপারে সব বলেছি। বলেছি আঁকিবের কথাও। অবাক হয়ে ও সাবধান করেছিলো আমাকে। বলেছিলো-
: বরকে সব বলা ঠিক না বুঝলি, একটু ঢেকে রেখে কথা বলবি….

বিয়ের আগে ওর মামাতো ভাই ওকে পছন্দ করতো, বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছিলো ওদের বাসায়, একথা সিমির বর শুনে ওর উপর ভীষণ রাগ করেছিলো, এবং বলেছিলো ওর মামাদের বাড়িতে ও যেন কখনো না যায়। লোকটা এমনি মানসিকতার যে সিমির মায়ের বাড়ির দিকে পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে গেলে ওর বর ওকে চোখে চোখে রাখে।
: এজন্যই তোমাকে সব বলতে নিষেধ করেছে।
: হুম হয়তো… আপনি অনেক অন্য রকম সুফি,
: তুমিও
দু’জন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। ওদের চাহনিতে গোধূলির আলো লজ্জায় নিজের পসরা গুটিয়ে নেয়। রোদেলার আরো কাছে আসে সে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে-
: আই লাভ ইউ…..
এভাবে বলাটা রোদেলা কেবল কান দিয়েই শুনে না। পুরো ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়কে কাজে লগায় ও । সেটা আত্মস্থ করে একটু সময় পর উত্তর দেয়
: আই লাভ ইউ টু….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here