রোদেলা,পর্ব: ৭০

0
753

#রোদেলা,পর্ব: ৭০
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

রোদেলা বাড়িতে ঢুকেই সন্ধ্যা নাগাদ ভারী সাজপোশাক সব খুলে ফেলেছে, অনেক হয়েছে আর সম্ভব না এসব পরে থাকা। দফায় দফায় চা আর ভাজাভুজি খাওয়া হলো সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত। সবার মুখে খুশি উপচে পরছে। আজকের এই খুশি তৈরির কারিগর আবু সুফিয়ান

এই বাড়িতে, এই পরিবারের এমন একটা আড্ডা কোন দিন বসবে তা কেউই হয়তো কল্পনাই করে নি। রোদেলার সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে এ বাড়িটাকে কিনেছে সুফিয়ান রোদেলার নামে। যদিও নাসিমার নামেই কিনবে বাড়িটা তাই ঠিক করেছিলো ওরা, কিন্তু বেঁকে বসেছেন তিনি নিজেই। কেন তা কেও জানে না।

নায্য দামের চেয়ে অনেক বেশী টাকা হাঁকিয়েছিলো ওরা। ভেবেছে না নিয়ে যাবে কই। পরে অবশ্য ব্যাপারটা ইমোশনালি হ্যান্ডেল করেছে রোদেলা। এরকমটা হবে কল্পনায়ও ভাবে নি ও। বাড়ি কিনেছেন যে মামার বন্ধু, তার বাবা-মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন রোদেলার নানা নিজে দায়িত্ব নিয়ে। তখন তারা ঘরহীন ছিলো। তাদের সেই দুঃসময়ে পাশে ছিলেন এই পরিবারের মানুষ গুলো। সে কথা তুলে নি রোদেলা, শুধু তার মাকে ফোন করে বলেছিলেন – নানু আপনাদের সাথে তো আমাদের টাকার সম্পর্ক না। আমার নানা আপনাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। সে থেকে আমাদের পরিবারের সাথে আপনাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। আমাদের কখনো বুঝতে দেয়া হয় নি যে আপনারা আমাদের অনাত্মীয় কেও। আপনার ছেলেকে আমরা আপন মামাই ভাবতাম। কত কত দিন টাকা চেয়ে বিরক্ত করেছি তাঁকে, আপন মামাদের যেভাবে করতাম। এখন এসব ভাবলে লজ্জা লাগে, হাসি পায় । তারাও আমাদেরকে ভাগ্নী ভাতিজির মতোই ভালোবেসেছেন সবসময়। সেই দাবিতেই ফোন করেছি আপনাকে।

এ কথার বিপরীতে তিনিই অনেক কথা তুললেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সেসব দিনের কথা মনে করে। দিন ঘুরেছে তাদের, ঘরহীন এই পরিবার এখন এলাকার স্বনামধন্য লোক। গত দুইবারের কাউন্সিলর তার বড় ছেলে। আল্লাহ এখন তাদের অনেক দিয়েছেন। তবুও সেসব দিনের কথা তিনি আজও মনে রেখেছেন। মানুষের ভালো কাজ তার মৃ*ত্যু*র পরও তাকে বাঁচিয়ে রাখে। তিনি রোদেলা কে বললেন চিন্তা না করতে পুরো ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। ব্যাস তারপর ম্যাজিকের মতো সব হয়ে গেলো। যে টাকায় তারা বাড়িটা কিনেছিলেন সে-টাকায়ই ওদের কাছে বিক্রি করলেন বাড়িটা। রোদেলাদের লাভের মধ্যে লাভ হলো বাড়ির যে পুকুরটা ছিলো তাকে তারা সংস্কার করেছেন। অনেক গাছ লাগিয়েছেন। বাড়ির গেইট বদলেছেন। এসবের জন্য তিনি অবশ্য কিছু টাকা বেশী চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মা তাকে বুঝিয়েছেন। সত্যি বলতে রোদেলা প্রস্তুত ছিলো টাকাটা দিতে। শেষ পর্যন্ত দিতে হয়নি তাতেই রক্ষা। তা না হলে একেবারেই হাত খালি হয়ে যেতো ওর। বিয়ে উপলক্ষে সবাই একেকটা আসবাবপত্র দিয়েছেন উপহার হিসেবে। সেদিকে তাই হ্যাপা পোহাতে হয় নি নাসিমার। রোদেলা তাই দু হাতে খরচ করেছে মেহমানদারিতে।

রোদেলা নিজেও বুঝতে পারেন নি নানুকে বলা কথাটা ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। টাকার পি*চা*শ যারা তারা ইমোশনাল কথা বার্তায় থিতু হওয়ার লোক না। কিন্তু ভদ্রমহিলা সত্যি ভালো মনের মানুষ। উপকারীর উপকার মনে রেখেছেন।

এক ঝলকে দেখলো যেন সেই সময়গুলো। দিনরাত কেবল একটাই ভাবনা ছিলো তখন। জীবণের একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের জীবণের কত কত লক্ষ্য থাকে। একটা সময় ও ভাবতো ও এই হবে সেই হবে, জীবণে জ্ঞানের পরিধির সাথে সাথে লক্ষ্যও বদলায়।
কেও যদি এখন ওকে জিজ্ঞেস করে রোদেলা তোমার জীবনের লক্ষ্য কি….

ও একমুহূর্ত না ভেবেই জবাব দিবে- “একজন ভালো মা হওয়া…..”

কি অদ্ভুত কথা তাই না…!
কিন্তু এই লক্ষ্য ও অনেক অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করেছে। জন্ম দিলেই যে মা হয় সে মা না,
ও সেই মা হতে চায়- যেই মা তার সন্তানকে দুনিয়ার সবার চেয়ে বেশী প্রায়োরিটি দেয়, যেই মা দুনিয়ার সকলের থেকে সন্তানদের আগলে রাখে, যে মা মুখের দিকে চেয়ে বলতে পারে তার সন্তানের মনে কি চলছে, যে মা মুখ ফুটে বলতে পারে
আই লাভ ইউ মাই চাইল্ড।

মেয়ে হিসেবে বাকী যা কিছু লক্ষ্য তা জীবণটাকে ভালোভাবে পার করবার জন্য। এটা ওর নিজস্ব থিউরি। ওর কাছে সুখের দাম সফলতার চেয়ে বেশী।
এই যে ব্যাস্ততা, কাজের ধকল, সামাজিকতা মেন্টেনেন্স জীবণে সব শেষে হয়ে যায় একটা সময় পর, কিন্তু দিনশেষে যারা পাশে থেকে তারা হচ্ছে সন্তান। অথচ অনেক বাবা-মাই সন্তানদেরকে টেক ফর গ্রান্টেড করে নেয়। ধরেই নেয় যত যাই করি ওরা তো আছেই, পালায়া তো যাচ্ছে না কোথাও। কিন্তু তারা জানেনা ভিতরে ভিতরে এমন অবহেলা তৈরী করে আলোকবর্ষ দূরত্ব। হঠাৎ একদিন দেখা যায় সন্তান তার কথার মূল্য দিচ্ছে না, বাবা মায়ের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করছে না, এ ব্যাপারটা কিন্তু একদিনতে তৈরী হয় না। অনেক অনেক কষ্ট, না পাওয়া, অবহেলা একদিন দেয়াল তৈরী করে।

এসব কথা ভাবছিলো চা খেতে খেতে। অনেক রাত হয়ে গেছে। খেয়ালই করে নি ও। প্রিসিলা রেজওয়ানকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে উপরে ওদের ঘরে। সুফিয়ান ইশারায় কিছু একটা বলে উপরে চলে গেলো। রোদেলা কিছু বুঝলো না সেই ইশারার। চা শেষ করে সবকিছু গোছগাছ করে উঠে গেলো উপরে। ওর কিছুটা লজ্জা ও লাগছিলো ওদের জন্য ও ঘর সাজানো হয়েছে এটা ভেবে।

রোদেলা রুমে গিয়ে দেখে সুফিয়ান বারান্দায়। দড়জা আটকে নিঃশব্দে সেখনে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সুফিয়ানকে, সুফিয়ানের পিঠে মুখ ঘসে বলে- থ্যাংক্স ফর ইচ এন্ড এভরিথিং….

সুফিয়ান একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছুর জন্য। ও রোদেলাকে কিছুটা সময় দিয়ে ঘুরে ওর সামনে টেনে নিলো রোদেলাকে । ওর নাকটায় আলতো স্পর্শ করে বললো-
: ইচ এন্ড এভরিথিং….!
: হুম…, বিলিন হয়ে যাওয়া আমায় খুঁজে বের করা, আমার হাত সারাটা জীবনের জন্য ধরা, আমার স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকা, আমার দুশ্চিন্তা দূর করা……
সবশেষে আজকের দিনটাকে উপহার দেয়া….!

সুফি প্রিসিলার জন্য আমার অনেক চিন্তা হতো, কিন্তু আমি একবারের জন্য ও রেজওয়ান আর ওর বিয়ের কথা ভাবি নি। আপনি হঠাৎ কি করলেন…, চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা হলো আমার
উত্তরে লাজুক ভঙ্গিতে হেসে সুফিয়ান বলে-
: প্রশংসায় ফুলে যাচ্ছি আমি, আর একটু হলে উড়ে যাবো কিন্তু।
: মোটেও প্রশংসা নয় সুফি, আপনি যা করেছেন যতই বলি তা কম হয়ে যাবে।
: হইছে, হইছে আর বলতে হবে না…
: একটা কথা জিজ্ঞেস করি….
: হুম…
: ওদের বিয়ের কথাটা কি কো-ইনসিডেন্ট বলেছেন…?
: নাহ্ রোদ , আমি জানতাম তুমি সবসময় প্রিসিকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকতে। তাই ভাবলাম…,
তাছাড়া প্রিসি খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওর যেটা সবচেয়ে ভালোলাগে তা ওর ধৈর্য। এটুকু মেয়ের এত ধৈর্য আমি দেখি নি।
আর কিছু..?

সুফিয়ানের দিকে এতক্ষণ তাকিয়া থাকা রোদেলা হঠাৎই আবারো জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ানও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম মমতায়। কিছু সময় পর সুফিয়ান টের পায় ওর গায়ের পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। দ্রুত টেনে দাঁড় করায় ও। বলে
: কাঁদছ কেন….!?
: আমার জন্য এত ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমি তা কল্পনায় ও ভাবতে সাহস পাই নি।
: ধূর…! তুমি এভাবে বলছো কেন…?
: সত্যি..!
চোখ মুছে দিয়ে সুফিয়ান বলে-
আজ শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে বাসর রাত উপহার দিয়েছে। সেটাকে কি তুমি নষ্ট করতে চাও…?

চোখ মুছতে মুছতে হেসে দেয় রোদেলা। বলে-
: বুড়ো হয়েছে তবুও রং শেষ হয়নি, আসছে বাসর রাতের খবর নিয়ে….

: বিয়ে হইছে মাত্র বছর কয়েক, বুড়া বানিয়ে দিলে আমায়…? আসো আজ দেখাবো তোমায়, আজকে তুমি শ্যাস…
বলেই পাঁজা কোলে তুলে নেয় সুফিয়ান রোদেলাকে। রহস্যময় হাসি হাসে রোদেলা…..

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here