#তোমাতে বিলীন🍁
#লেখিকা—আমায়া নাফশিয়াত ☘
#পর্ব—|| ২১ ||
নামাজ শেষে ঊদিতা আশিয়ানের রুফটপের ফুলগাছ গুলোতে পানি দিলো।ততক্ষণে আশিয়ান মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসায় চলে এসেছে।আশিয়ানের মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে হয়ে আছে।নামাজ পড়ায় মনে এক আলাদা শান্তি বিরাজ করছে তার।খুশমেজাজে বাসায় এসেছে সে।আজ এতটাদিন পর মনটা একদম হালকা হয়ে গেছে তার।সব ধরনের দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
হাসিমুখে রুমে ঢুকলো আশিয়ান।দেখলো ঊদিতা সারা রুম পরিপাটি করে করতে ব্যস্ত।আশিয়ানকে দেখতে পেয়ে ঊদিতা প্রশস্ত হেসে সালাম দিলো।আশিয়ানও হাসিমুখে জবাব দিলো।ঊদিতা একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো আশিয়ানকে।আশিয়ান অবাক হলো ঊদিতার পানির গ্লাস এনে দেয়ায়!সে কীভাবে জানলো তার পানির পিপাসা পেয়েছে?তার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন ঊদিতা জবাব দিলো;
ঊদিতা:-এত অবাক হতে হবে না,,আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনার পানি পিপাসা পেয়েছে।নিন পানি খান।
আশিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নিলো।ঊদিতা তাকে জিজ্ঞেস করলো;
ঊদিতা:-আপনি কী আজ অফিসে যাবেন?
আশিয়ান:-নাহ,,পরশুদিন থেকে যাবো।
ঊদিতা:-ওহহ,,,তাহলে আপনি এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন।কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করলে ভালো লাগবে।
আশিয়ান:-হুমম,,,।ঠিক আছে।
ঊদিতা:-আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।কোনো দরকার পড়লে ডাক দিয়েন।
আশিয়ান:-ওকে।
আশিয়ান গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।আর ঊদিতা গেল রান্নাঘরে সবার জন্য নাশতা তৈরি করতে।মিসেস ইয়াসমিন বারবার মানা করেছেন ঊদিতাকে কাজ করতে।কিন্তু ঊদিতা এসবে কান দেয় নি।নিজের সংসারের জন্য কাজ করতে আবার কারও পারমিশন লাগে নাকি।এটা তো একান্তই নিজের সংসার।পরের সংসার তো আর না।
ঊদিতা একাহাতে সব কুটে বেছে ধুয়ে পরিষ্কার করে রান্না করছে।মিসেস আনিতা ওনার দুই মেয়েকেই ছোট থেকে ঘর সংসারের সমস্ত কাজকর্ম হাতে কলমে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন।মেয়েদের যাতে কখনো কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে না হয় সেজন্য সবকিছু শিখিয়েছেন।ছোটবেলায় মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন ঊষা আর ঊদিতা তারা দুইবোন মিলে ঘর সামলাতো।বড় হওয়ার পরও মিসেস আনিতাকে কোনোপ্রকার কোনো কাজকর্ম করতে দেয় নি ওরা।উসামা আসার পর থেকে তো মিসেস আনিতা চাইলেও কোনো কাজ করতে পারেন না।মূলত উসামাই দেয় না।এরকম ভালো পুত্রবধূ ভাগ্যগুনে পাওয়া যায়।
ঊদিতা আজ সবার জন্য পছন্দের খাবার তৈরি করেছে।যেমন-গরুর কলিজা ভুনা,রুটি,ডিমের পরোটা,বুট ডাল ঝাল দিয়ে ভুনা যা আশিয়ানের অনেক পছন্দের খাবার,বিফ এন্ড এগ স্যান্ডউইচ,চকোলেট কাপ কেক,এবং মুরগির মাংস ও সবজি দিয়ে রসালো নুডুলস ব্যস।সবাই ঘুম থেকে ওঠার পরে গরম গরম কফি অথবা চা বানিয়ে দেবে ঠিক করলো সে।নাশতা বানাতে বানাতে সকাল ৯ টা বেজে গেছে প্রায়।কেয়া রান্নাঘরে এসে দেখে ঊদিতা সমস্ত কিছু কমপ্লিট করে ফেলেছে।কেয়া তো ঊদিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কেয়া:-জানো তো ঊদিতা,,,তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে।আমি অনেক বেশি খুশি তোমাকে নিজের জা হিসেবে পেয়েছি বলে।আগে আগে অনেক ভয়ে থাকতাম যখন ইলিয়ানার সাথে আশিয়ানের রিলেশন ছিলো।ইলিয়ানাকে আমি পছন্দ করতাম না তেমন একটা।ভাবতাম ইলিয়ানা আশিয়ানের বউ হয়ে এলে আমার সাথে তার কখনোই বনবে না।কারণ আমি যেরকমটা সেরকমটা ও নয়।আল্লাহর কাছে আশিয়ানের
জন্য ভালো একটা মেয়েকে লাইফ পার্টনার হিসেবে চাইতাম।নিজের আপন ভাইয়ের মতো স্নেহ করি আমি তাকে।তাই সবসময় তার ভালো চাইতাম।ভাবি নি আল্লাহ আমার দোয়া এভাবে কবুল করবেন।তাই তো তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে আমি আমার ভাইটার বউ হিসেবে পেয়েছি।(আন্তরিক কন্ঠে)
ঊদিতা কেয়াকে জড়িয়ে ধরলো।কেয়াকে সে প্রথম থেকেই অনেক পছন্দ করে।নিজের বড় বোনের মতো মানে তাকে সে।হাসিমুখে বললো;
ঊদিতা:-জানো তো ভাবী,, আমিও অনেক খুশি তোমার মতো একজন বড় আপু পেয়ে।অনেকের কাছ থেকে শুনেছি সংসার জীবনে জায়েরা নাকি খুব জল্লাদ টাইপের হয়।হিংসুটে হয়।কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সেই ধারণাটা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে।তোমার মতো এত ভালো বড়বোনের মতো আদুরে জা ক’জন পায় বলো তো?আমি নিজেকে নিয়ে অনেক প্রাউড ফিল করি যে আমি এত ভালো একটা আন্তরিক পরিবার পেয়েছি।একজন বড়বোনের মতো জা পেয়েছি।মায়ের মতো শ্বাশুড়ি ও চাচী,বাবার মতো শ্বশুর ও চাচা,বড়ভাইয়ের মতো ভাসুর ও দেবর পেয়েছি,,আর নিজের বোনের মতো আদুরে আরেকজন অমায়িক বোন পেয়েছি।বিশ্বাস করো আমি কখনো ভাবিইনি আমার জন্য আল্লাহ এত ভালো কিছু লিখে রেখেছেন।তোমাদের মতো পরিবার পেয়ে আমি অনেক অনেক অনেক খুশি।
কেয়া ঊদিতার থেকে আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো;
কেয়া:-তাই বুঝি?তা আমার ভাইটার কথা তো কিছু বললে না!ওকে পেয়ে বুঝি খুশি হওনি তুমি?হুমম?
ঊদিতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।লজ্জায় তার গালদুটো পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে প্রায়।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো;
ঊদিতা:-ধ্যাত ভাবী,,,কী যে বলো না তুমি!আমাকে খালি লজ্জা দেয়ার ধান্দায় থাকো!
কেয়া ঊদিতার লজ্জা পাওয়া দেখে হাহ হা করে হেসে ফেলে।ঊদিতা পালিয়ে বাঁচতে চাইলো যেন।নাশতাগুলো টেবিলে নিয়ে সাজিয়ে রাখতে লাগলো সে।আস্তে আস্তে বাসার সবাই ঘুম থেকে ওঠতে লাগে।
আশিয়ানও ঘুম থেকে ওঠে ট্রেডমিলে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে রেগুলারের রুটিন অনুযায়ী ১৫০ বার পুশআপ দিলো।আগে আগে ইলিয়ানা,তৌহিদ ও আসিফের সাথে জিমে যেত সে রেগুলার।বাট এখন আর যাওয়া হয় না।বাসাতেই সব জিম করার এসেসরিজ কিনে রেখে দিয়েছে আলাদা জিম করার রুমে।সেখানে আশিয়ানের সাথে তাজিম আর তাসকিনও জিম করে।তাশজিদ এসবে নেই।বেচারা চিকনাচাকনা মানুষ পড়তে পড়তেই জীবন শেষ।এক্সট্রা কিছু করার কথা চিন্তাও করতে পারে না কখনো।
ঘামে সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে আশিয়ানের।ব্যায়াম শেষ করেই রুমে এসে রুফটপে গিয়ে সুইমিংপুলের পানিতে ধপাস করে পড়ে গেল সে।বার কয়েক ডুব দিয়ে পানির ওপরে মাথা তুললো সে দুহাত দিয়ে চুল মুঠ করে।ঊদিতা আশিয়ানকে ডাকতে রুমে এসেছে।রুমের কোথাও আশিয়ানকে দেখতে না পেয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় সে।কারণ ওখান থেকে দাপাদাপির আওয়াজ আসছে।আশিয়ানকে সুইমিংপুলে দেখে ঊদিতার চোখ কপালে।সে মনে মনে ভাবছে;
“এই লোকটার সাথে নির্ঘাত পানির জ্বীন লাগানো আছে।নয়তো একদিনে মানুষ কয়বার গোসল করে।হাজার গরম হলেও সবাই একবার অথবা বেশি হলে দুইবার গোসল করে।কিন্তু এই লোক সকালে একবার,দুপুরে একবার,বিকালে একবার,রাতে একবার খালি গোসলই করতে থাকে।পারতো যদি তাহলে মাঝরাতেও মনে হয় গোসল করতো।”
ঊদিতাকে দেখেও আশিয়ানের কোনো ভাবান্তর হলো না।সে পানিতে দাপাদাপি করতেই ব্যস্ত।ঊদিতা গালে হাত দিয়ে বেঞ্চে বসে আশিয়ানের সাঁতার কাটা দেখছে।ঊদিতা সাঁতার জানে না।পানি দেখলেই ভয় লাগে তার।তবে কাউকে পানিতে সাঁতরাতে দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে।যেমনটা এখন লাগছে তার।আশিয়ানের দিকে মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে আছে সে।আশিয়ান লক্ষ করলো সেটা।আশিয়ান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো;
আশিয়ান:-হোয়াট?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?কী দেখো?
ঊদিতা:-কী দেখবো আবার?আপনার লাফালাফি দেখি।এছাড়া তো এখানে আর ইন্টারেস্টিং কিছু নেই যে সেটা দেখবো।
আশিয়ান:-খোঁচা দিচ্ছো আমাকে?
ঊদিতা:-একদমই না!সে যাকগে,,আপনি এবার পুল থেকে ওঠে আসুন।বেশি সময় পানিতে থাকলে আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।নিচে সবাই আপনার অপেক্ষা করছে।নাশতা করবেন আসুন।
আশিয়ান:-হুম আসছি।
আশিয়ান পুল থেকে ওঠে এলো।হাত দিয়ে চুল ঝাড়া দিতেই পানির ছিটে এসে ঊদিতার মুখে পড়লো।ঊদিতা কিছু বললো না এতে।বাথরোব পড়ে শর্ট টাওজারটা খুলে ঊদিতার হাতে দিলো সে।ঊদিতা সেটা নিয়ে ঝুড়িতে রাখলো।ঊদিতা টাওয়েল হাতে নিয়ে আশিয়ানের পিছন পিছন রুমে এলো।আশিয়ান বেশি লম্বা হওয়ায় ঊদিতা তার মাথার নাগাল পাবে না তাই বাধ্য হয়ে আশিয়ান বিছানায় বসে।ঊদিতা এগিয়ে এসে আশিয়ানের চুল মুছতে লাগলো টাওয়েল দিয়ে।
আশিয়ান ঊদিতার কোমড়ের দুপাশে তার হাত রাখলে ঊদিতা মৃদু কেঁপে ওঠে।কোনোরকম চুলটা মুছে দিয়ে আশিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে সে নিচে চলে যায়।আশিয়ানও কাপড় পড়ে নিচে চলে এলো নাশতা করতে।মি.মোরশেদ ও মি.এনামুলের নাশতা করা শেষ ততক্ষণে।ওনারা দুজন তাদের রুমে চলে গেছেন রেডি হতে।আশিয়ান চেয়ার টেনে বসতেই ঊদিতা তার প্লেটে নাশতা বেড়ে দিলো।তাদের সাথে সে নিজেও বসে পড়লো নাশতা করতে।আশিয়ান বুট ডাল ভুনা দিয়ে পরোটা খাচ্ছে তৃপ্তিসহকারে।অনেক মজা হয়েছে খেতে।
নাশতা করা শেষে ঊদিতা এনার সাথে বাসার ছাদে গেল।আশিয়ানদের বাসাটা বিশাল বড়।যা ঊদিতার কিছুই দেখা হয় নি।তাই এনা তাকে সারা বাসা ঘুরে দেখাচ্ছে।বাসার ছাদটা প্রচুর খোলামেলা।সেইফটির জন্য মোটা করে রেলিঙ দেয়া হয়েছে।রেলিঙের ওপর ছোট ছোট কালারিং ফুলের টব রাখা।যা দেখতে অনেক দৃষ্টিনন্দন লাগছে।সারা ছাদ জুড়ে অনেক সুন্দর আর দামী দামী ফুলগাছ টবে লাগানো।গাছ গুলো ফুলে ফুলে ভরে আছে একদম।সারা ছাদ ঘুরে দেখলো ঊদিতা।তারপর নিচে বাসার বাইরে ফ্রন্ট এরিয়ার গার্ডেনে গেল এনা ঊদিতাকে নিয়ে।ফুলগাছগুলোর নিয়মিত যত্নের জন্য একজন মালি রাখা আছে।যে প্রতিদিন গাছগুলোর পরিচর্যা করে।
তাসকিন আলেয়াকে নিয়ে সেখানে এলো।দুজন কেমনে যে সারাদিন রাত রোমান্টিক মুডে থাকে বুঝতে পারে না ঊদিতা।তাসকিন আলেয়াকে এখন অবধি নিজের হাতে খেতে দেয় নি শুধুমাত্র গতকাল ছাড়া।সবসময় নিজেদের রুমে বসে মুখে তুলে খায়িয়ে দেয় তাকে তাসকিন।ভালোবাসা উপচে পড়ছে তাদের।আলেয়া তো জান কলিজা বাবু এসব বলা স্টার্ট করে দিছে।দুজনে মিলে এত এত রোমান্টিক ফটোগ্রাফি করে সারাদিন,টিকটক বানায় আর সেগুলো ফেসবুক,ইন্সটাগ্রামে আপলোড করে।এসব এনা দেখিয়েছে ঊদিতাকে।আর আশিয়ান এসবের ধারেকাছেও নেই।সে তার নিজের মতো আছে।যদিও এতে ঊদিতার মনখারাপ হয় না তেমন একটা।
তাসকিন এনার হাতে তার ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললো যে তার আর আলেয়ার একটা টিকটক ভিডিও করে দিতে।এনা ক্যামেরা ধরতেই তাসকিন বাগান থেকে একটা লাল গোলাপ ছিড়ে নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে আলেয়াকে প্রপোজ করলো।আলেয়া তো লজ্জা পেয়ে একদম শেষ এরকম প্রপোজাল পাওয়াতে।আলেয়া একটু এক্টিং করে তাসকিনের হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে নিলো।তাসকিন বসা থেকে দাঁড়াতেই আলেয়া হাসিমুখে তাসকিনকে জড়িয়ে ধরে।তাসকিনও তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ব্যস,, ভিডিও হয়ে গেছে।
এনা ভিডিও করে ফোনটা তাসকিনের হাতে দিয়ে দিলো।এতক্ষণ ঊদিতা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।এসব নির্লজ্জ কাজকর্ম দেখতে সে পছন্দ করে না।এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ ওপরে তুলে বাসার দিকে তাকালো ঊদিতা।কোণের আশিয়ানের রুমের বারান্দায় চোখ পড়তেই আশিয়ানকে দেখতে পেল সে।আশিয়ান এদিকেই তাকিয়ে আছে।ঊদিতা ২য় দফা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।তারপর লজ্জা কাটাতে ফুলের বেড দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।তাসকিন আর আলেয়া একজন আরেকজনের হাত ধরে হেসে হেসে কথা বলে বাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে লাগলো।
এনা আর ঊদিতা সারা বাড়ি ঘুরে দেখে আবারও বাসায় ফিরে এলো।দুপুরের রান্না করতে চাইলো ঊদিতা কিন্তু কেয়া আর মিসেস ইয়াসমিন করতে দিলেন না।তাই বাধ্য হয়ে রুমে চলে এলো সে।আশিয়ান ল্যাপটপে কাজ করছে একধ্যানে সদা গম্ভীর হয়ে।আশিয়ানের কাছে এসে বসলো ঊদিতা।আশিয়ান তাকে একপলক দেখে আবারও ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলো।ঊদিতা বলে উঠে;
ঊদিতা:-এই যে শুনছেন!
এত আদুরে ডাক শুনে আশিয়ানের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।ঊদিতার দিকে না তাকিয়েই বললো;
আশিয়ান:-হুমম,,শুনছি বলো!
ঊদিতা ওড়নার আঁচল মোচড়াতে মোচড়াতে মাথা নিচু করে বললো;
ঊদিতা:-একটা জিনিস চাইবো,,এনে দিবেন?(অনেক আশা নিয়ে জানতে চেয়ে)
আশিয়ান:-বলো কী চাই?
ঊদিতা:-আমার না মোটেও সময় কাটে না।এখন তো পড়াশোনার চাপ নেই।মা আর ভাবী আমাকে কোনো কাজই করতে দেন না।পরশু থেকে আপনিও অফিসে চলে যাবেন।এনা আপু তার ক্লাসে চলে যাবেন।পিচ্চি দুইটাও বাসায় থাকে না।তাই আমার সময় কাটানোর জন্য কিছু জিনিস চাইতাম আপনার কাছে।দিবেন?(সংকোচ করে)
আশিয়ান:-হেয়ালি না করে সোজা কথায় বলে দাও কী চাই?জলদি!
ঊদিতা:-আমাকে কয়েক রকমের কিছু কালারিং পেজ,গাম,অফসেট পেপার,কয়েক কালারের রেশমি সুতা,কয়েক রকমের পুতি,হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের সরঞ্জাম,,এসব কিনে দেবেন প্লিজ!আর যদি পারেন তাহলে একটা সেলাই মেশিন আর সুই সুতা ও এককালারের সুতি কাপড় কিনে দিয়েন।আমি মামণির কাছ থেকে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শিখতে চাই!মানা করবেন না প্লিজ!(অনুরোধ করে)
আশিয়ান:-সব বুঝলাম,,।তবে কাপড় সেলাই করা কিন্তু রিস্ক আছে।যদি হাতে সুই ঢুকে যায় তখন কী হবে?(জানতে চেয়ে)
ঊদিতা:-কিচ্ছু হবে না।আমি মনযোগ দিয়ে সাবধানে কাজ করবো।তাও আমি শিখতে চাই প্লিজ।
আশিয়ান:-ঠিক আছে।আমি দেখছি।
ঊদিতা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে যারপরনাই খুশি হয়ে বললো;
ঊদিতা:-অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!আপনি অনেক ভালো।
আশিয়ানের ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ফুটে ওঠেই মিলিয়ে গেল।গম্ভীর কন্ঠে বললো;
আশিয়ান:-হুমম,,,এখন যাও আমার জন্য এককাপ সেই সুগন্ধি চা বানিয়ে নিয়ে এসো।মাথা ধরেছে।
ঊদিতা তড়িৎ গতিতে বসা থেকে ওঠে বললো;
ঊদিতা:-আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
ঊদিতা চলে যেতেই আশিয়ান মাহবুবকে ফোন দিয়ে ঊদিতার বলা সব জিনিসের নাম বলে তাকে এগুলো কিনে নিয়ে আসতে বললো।মাহবুব আশিয়ানকে জানালো সে এখনি এসব কিনতে রওনা দিচ্ছে।আশিয়ান ফোন রেখে মুচকি হেসে ল্যাপটপে মনযোগ দিলো।
আশিয়ান ভেবেছিলাে একটু দামী কোনো জিনিস চাইবে ঊদিতা।কিন্তু নাহ,,তাকে আবারও ভুল প্রমাণিত করলো তার বউ।সামান্য জিনিসেই যে কেউ এত খুশি হতে পারে তা ঊদিতাকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে।
🍁🍁🍁
প্রায় একঘন্টা পর মাহবুব সবকিছু কালেক্ট করে কিনে নিয়ে এলো।ঊদিতা তখন সবেমাত্র ওয়াশরুমে গোসল করতে ঢুকেছে।মাহবুব একটা লোককে সাথে নিয়ে এসে সবকিছু আশিয়ানের কথামতো রুমের এককোণে রেখেই চলে গেল।আশিয়ান আবারও কাজে বিজি হয়ে গেল।প্রায় আধাঘন্টা পর ঊদিতা গোসল করে ওযু সেড়ে বেরোলো।আজকে আর আয়নার ধারেকাছে না গিয়ে বড় একটা খিমারের হিজাব মাথায় জড়িয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে লাগলো।আজকে নামাজে ওঠতে একটু দেরী হয়ে গেছে তার।তাই এত তাড়াতাড়ি করছে।
আশিয়ান আরচোখে ঊদিতাকে বারবার খেয়াল করছে।কেন জানি ঊদিতাকে বারবার দেখার পরও তার চোখের তৃষ্ণা মেটে না।আশিয়ান খুব ভালোই বুঝতে পারছে যে সে ২য় বারের মতো একটা পিচ্চি মেয়ের প্রেমে পড়তে যাচ্ছে।আর এই পিচ্চি মেয়েটা আর কেউ নয় তারই বউ ঊদিতা।
ঊদিতা নামাজ আদায় করে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।এমন সময় কোনায় রাখা জিনিসগুলোর ওপর চোখ পড়লো তার।প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সেদিকে একবার তাকিয়ে আশিয়ানের দিকে তাকালো সে।জিজ্ঞেস করলো;
ঊদিতা:-প্যাকেট করা এসব কী রাখা এখানে?
আশিয়ান নির্বিকারচিত্তে সোফায় হেলান দিয়ে বললো;
আশিয়ান:-খুলে দেখে নাও কী!
ঊদিতা হাত থেকে টাওয়েল রেখে এগিয়ে গিয়ে সবকিছুর প্যাকেট খুলতে লাগে।একে একে তার কাঙ্ক্ষিত প্রত্যেকটা জিনিস দেখতে পেয়ে ঠোঁটে এক অমূল্য হাসি ফুটে ওঠলো ঊদিতার।খুশিতে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে তার।হাসিমাখা মুখ নিয়ে আশিয়ানের দিকে তাকালো সে।আশিয়ান তারই দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।ঊদিতা প্রত্যেকটা জিনিস পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।ঊদিতা অল্পস্বল্প চেয়েছে কিন্তু আশিয়ান এককার্টুন করে আনিয়েছে সব।প্রত্যেকটা কালারের সুতো,পুতি,পেজ,কালরিং পেন,হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের সরঞ্জাম,আরও এক্সট্রা বহু জিনিস।কি যে নেই বলা মুশকিল।আধুনিক একটা সেলাই মেশিনও আছে।হাতের কাজ শেখার প্রতিটি জিনিস আছে।কোনোকিছু বাদ রাখে নি আনতে।সব রঙের ভালো মানের সুতির কাপড়,থান কাপড়,হাফ সিল্ক সব রয়েছে অন্য একটি কার্টুনে।
ঊদিতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে এসে আশিয়ানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।আশিয়ান ভাবে নি ঊদিতা এভাবে এসে তাকে হাগ করবে।আশিয়ান ঊদিতাকে নিজের বুকে আগলে নিলো।নিজের অজান্তেই ঊদিতার মাথায় ভেজা চুলে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিলো সে।ঊদিতার খুশি দেখে সে নিজেও প্রচুর খুশি হয়ে গেছে।বৈধ সম্পর্কের জোড় আল্লাহ এত মজবুতভাবে গড়ে দিয়েছেন যে আশিয়ান চাইলেও কখনো ঊদিতার থেকে বিমুখ হতে পারবে না।এখন ভালোবাসে না তো কী হয়েছে?একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসাটা ঠিকই হয়ে যাবে তাদের দুজনের মাঝে।
ঊদিতা আশিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে ফেললো খুশির ঠেলায়।আশিয়ান ঊদিতার পাগলামি দেখে মুচকি হাসলো।ঊদিতা যখন নিবিড়ভাবে আশিয়ানের দিকে তাকালো তখন আশিয়ান ঊদিতার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।কারও চোখ এত আকর্ষণীয় হয় জানতো না আশিয়ান।পানি লেগে চোখের লম্বা পাপড়ি ও ভ্রু যুগল লেপ্টে আছে।বড় বড় হরিণী চোখে এক অন্যরকম মাদকতা বিরাজ করছে।এই চোখের মায়ায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে আশিয়ান।যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন।
আশিয়ান নিজেও জানে না সে কী করছে।ঊদিতার চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে শক্ত করে ধরে নিজের আরও কাছে টেনে নিলো তাকে।ঊদিতাও সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আশিয়ানের দিকে।দুজন দুজনের থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।ঊদিতার রক্তলাল টসটসা কমলার কোয়ার মতো ভেজা ঠোঁট জোড়া আশিয়ানকে পুরোই পাগল বানিয়ে ফেলেছে।আশিয়ান মাথা নিচু করে কোনো দিক চিন্তা না করেই ঊদিতার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিলো।ঊদিতা পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে শিউরে ওঠে।আশিয়ান স্লো মোশনে ঊদিতার ঠোঁট চুষছে।ঊদিতা আশিয়ানের টি শার্টের কলার খামচে ধরে আছে।আরেকহাত আশিয়ানের পিঠে রাখা।
প্রায় মিনিট দশেক পর আশিয়ান ঊদিতার ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিলো।ঊদিতার অবস্থা শোচনীয়।লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে আশিয়ানের বুকে মাথা রাখলো সে।আশিয়ান যত্নের সহিত ঊদিতার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।ঊদিতা চোখ বন্ধ করে আশিয়ানের বুকে মুখ গুঁজে আশিয়ানের কোলে বসে আছে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে।
কয়েক মিনিট এভাবে থাকার পর হঠাৎ দরজায় কে জানি নক করলো।ঊদিতা লাফ দিয়ে আশিয়ানের কোল থেকে ওঠে পড়ে।আশিয়ান জোরে ডাক দিয়ে বললো এসো।রুমের ভেতর এনা ঢুকে বললো;
এনা:-মিষ্টিভাবী পাপা তোমাকে নিচে যেতে ডাকছেন।
ঊদিতা:-হু,,হুম,,আসছি আপু।
ঊদিতা আশিয়ানের দিকে একপলক তাকিয়ে এনার সাথে নিচে চলে গেল।আশিয়ান ঊদিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।আনমনে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল বোলালো সে।ঠোঁটে ফুটে ওঠলো মুচকি হাসি।
ঊদিতা রোবটের মতো এনার পিছন পিছন নিচে এলো।মি.মোরশেদ ও মি.এনামুল আলেয়া ও তাসকিনের সাথে নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।ঊদিতা আর এনাও তাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।মিসেস ইয়াসমিন ও মিসেস তারানা কেয়া ও তারিনও এসেছে।মি.মোরশেদ আলেয়াকে ও ঊদিতাকে নিয়ে বাইরে চলে এলেন।আলেয়া বাইরে নীল রঙের একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের কার দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে লাফাতে লাগলো।তাসকিন ও মি.মোরশেদ আলেয়ার খুশি দেখে তারা নিজেরাও খুশি।মি.এনামুল এবার আলেয়াকে একটা ল্যাপটপ আর একটা আইফোন গিফট করলেন।আলেয়া তো খুশিতে ফেটে পড়ছে যেন।মি.মোরশেদ আলেয়ার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিয়ে তাসকিনকে বললেন;
মি.মোরশেদ:-তাসকিন,,আজকে আলেয়া মা কে নিয়ে লংড্রাইভে চলে যাও।
তাসকিন:-আচ্ছা চাচ্চু।
তাসকিন আলেয়াকে নিয়ে রেডি হতে চলে গেল বাসায়।মি.এনামুল ঊদিতাকে ডেকে কাছে নিয়ে গেলেন।ঊদিতা কাছে যেতেই মি.এনামুল ঊদিতার হাতে একটা বক্স দিলেন।ঊদিতা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকাতেই মি.এনামুল হাসিমুখে বললেন;
মি.এনামুল:-এটাতে তোমার জন্য একটা আইপ্যাড আছে আম্মু।জানি তুমি ফোন-টোন ইউজ করো না তারপরও দিলাম যাতে তুমি ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখে আমাদের জন্য সবসময় মজাদার খাবার তৈরি করতে পারো।
ঊদিতা হাসিমুখে জবাব দিলো;
ঊদিতা:-ধন্যবাদ বাবাই।
মি.মোরশেদ এবার ঊদিতাকে সাথে নিয়ে আশিয়ানের রুমের বারান্দার নিচের খালি জায়গাটায় এলেন।ঊদিতা দেখলো সেখানে দুটো লোক আগাছা পরিষ্কার করে মাটি খুঁড়ে ঝুরঝুর করে ফেলেছে।কাজ প্রায় শেষের দিকে।মি.মোরশেদ ঊদিতাকে বললেন;
মি.মোরশেদ:-তোমার সবজির বাগান করার সকল কাজকর্ম প্রায় শেষের দিকে।এখন তুমি নিজের হাতে বীজ লাগাবে।ওখানে দুটো মাচা তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে।তুমি তোমার সুবিধা অনুযায়ী কোথায় কী লাগাতে চাও সেটা তুমি বুঝবে!সবরকমের বীজ ও চারাগাছ কিনা হয়ে গেছে।
ঊদিতার খুশিতে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে।মি.মোরশেদ একজন লোককে বলতেই সে বীজের প্যাকেট গুলো এনে দিলো।ঊদিতা সেগুলো নিয়ে নিজে বীজের প্যাকেট খুলে বীজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগলো।তারপর কয়েকটা চারাগাছ নিজে লাগালো।নিজের হাতে সযত্নে সব শেষ করে ড্রামের পানিতে হাত ধুয়ে ফেললো সে।ওই লোকগুলোর মধ্যে একজন হোসপাইপ দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে মাটিতে।মি.এনামুল এবার ঊদিতার জন্য কিনে আনা দশজোড়া কবুতর সেগুলো দেখালেন ঊদিতাকে।দশটা পিঞ্জিরাতে কবুতর সবগুলোকে রাখা হয়েছে।বেশ ভালো জাতের কবুতর।ঊদিতা তো খুশিতে শেষ।আজ শুধু সারপ্রাইজই পাচ্ছে সে।
(আমি ভীষণ ব্যস্ত আছি।এত পরিমাণ অসুস্থ এরমাঝে বাসায় প্রচুর মেহমান এসেছেন।এতকিছুর মাঝে আমি ফোন হাতে নিতেই পারছি না।পোস্ট করতে দেরী হয়েছে বলে কেউ কিছু মনে করবেন না প্লিজ।আমি সুস্থ হয়ে গেলে বোনাস পার্ট দিয়ে আপনাদের সবার ক্ষোভ মিটিয়ে দিবো।হ্যাপি রিডিং❤️।)
চলবে…🍃