তারিমের বিয়েটা ভেঙে গেছে ভাইয়া! তুমি বিয়েটা করবে ভাইয়া! তারিম কে ওরা বাঁচতে দিবে না ! মেরেই ফেলবে, আমি তোমার পায়ে পড়ছি ভাইয়া। বাঁচাও আমার তারিমকে!
ইমারজেন্সী মেডিক্যাল বোর্ড বসেছিলো ডক্টর আতইয়াবের আন্ডারে। একজন হার্টের রোগিকে নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। যে করেই হোক লোকটিকে বাঁচাতে হবে, না হলে হসপিটালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে আকস্মিক মেয়েলি কথায় সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকালো সেদিকে। লাল টকটকে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং চুড়ি, জুয়েলারি, মাথায় লাল অর্কিড ফুল; ফোলাফোলা ছলছল চোখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে একজন অপরূপা মেয়ে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনো বিয়ে বাড়ি থেকে এসেছে। ডক্টর আতইয়াব বোনের এমন অবস্থা থেকে নিজের অবস্থান থেকে দাড়িয়ে পড়লো। কোনদিক না তাকিয়ে ছুটে আসলো বোনের কাছে। বোন তার কলিজা! আতইয়াবের আদুরে ছোঁয়ায় মেয়েটি হু হু করে কেঁদে দিলো। আতইয়াব বোনের হাত ধরে বেরিয়ে আসলো হল থেকে। তার কাছে বোনের থেকে বড় কেউ না; নিজের জীবনও না। আতইয়াব জানে বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসার খবর যদি ‘সে’ পায় তাহলে আতইয়াবের অবস্থা খারাপ হবে। কিন্তু আতইয়াব তাতে পরোয়া করে না। নিজের কেবিনে ঢুকবে তার আগেই মেয়েটি বলে উঠলো,
ভাইয়া আমার হাতে সময় নেই। এতক্ষণে কি হচ্ছে কে জানে! তুমি চলো, গেলেই বুঝতে পারবে সব।
আতইয়াব বোনের কথায় বাইরের দিকে হাটা ধরলো। সে জানে তার বোন কখনো মিথ্যা বলবে না তাকে। আর খুব সিরিয়াস বিষয় না হলে বিয়ে বাড়ি থেকে এভাবে ছুটে এসে এসব বলতো না। সাবধানে বোনকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো আতইয়াব। উদ্দেশ্য বিয়ে বাড়ি। বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। মলিন মুখটা দেখলে তার বুকটা প্রচণ্ড জ্বালা করে। আহ্লাদ করে নাম রেখেছিলো ‘আদর’। দেখলেই কেমন আদর আদর পায়। ছোট্ট থেকে একটুও কষ্ট পেতে দেয়নি বোনকে সে। হালকা ব্যাথা পেলেই আদরের থেকে তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতো বেশী। ভাই-বোনের ভালোবাসার এক আমুল দৃষ্টান্ত!
বিয়ে বাড়ি পৌঁছেই আতইয়াবের মনে হলো না এটা কোনো বিয়ে বাড়ি ; মনে হচ্ছে শোকসভা হচ্ছে। ভাইকে রেখেই আদর দৌড়ে চলে গেলো ভেতরে। আতইয়াব ও বোনের পিছে ছুটলো। গিয়ে চোখে পড়লো তারিমের মা তারিমকে মারছে। কখনো থাপ্পড় দিচ্ছে, কখনো চুল ধরে টানছে; আর মুখে ব্রিশ্রি ভাষা তো আছেই। আতইয়াব স্তব্ধ হয়ে গেলো তারিমের এমন অবস্থা দেখে। প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে মার খেতে দেখে আদর রেগে এক ধাক্কা বসালো তারিমের মা কে। উনাকে মা বলা যায় কিনা আদর ভেবে পায়না। তার তো মা নেই; কত আফসোস হয় তার; কিন্তু তারিমের মা কে দেখলে তার মনে হয় মা নেই তাই ভালো। আবার ভাবে সব মা তো এক না। তিনি তো তার ছোট্ট মেয়ে ঐশীকে খুব ভালোবাসে কিন্তু তারিমের বেলায়’ ই এত নিষ্ঠুরতা কেন আদরের বুঝ আসেনা। কত বার তারিম কে অনুরোধ করেছে তাদের সাথে থাকতে কিন্তু তারিম কিছুতেই মানবে না। হঠাৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে তারিমের মা মিসেস দেলোয়ারা মাটিতে হুমডি খেয়ে পড়লো। এতে তিনি আরো রেগে গেলেন। মাটি থেকে উঠে আদর কে কিছু বলবে; আতইয়াবের দিকে চোখ যেতেই সে চুপসে গেলো। এই আতইয়াব কে সে ভালো করেই জানে, আদর কে একটু কথা শুনিয়েছিলো বলে থাপ্পড় দিয়ে ঐশীর গালটা একদম লাল করে দিয়েছিলো। সেদিন থেকেই জমের মতো ভয় পায় এই ছেলেকে। আতইয়াব তারিমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
কি হচ্ছে এসব? বিয়ে ভেঙে গেছে মানে কি? তোর না ফালাহ’র সাথে বিয়ে হচ্ছিলো। সে কোথায়?
আতইয়াবের কথায় আদর রেগে গেলো। কিসব বলছে তার ভাই। মাথা ঠিক আছে? বিয়ের কণে কে বিয়ে ভাঙার কারণ জিজ্ঞেস করছে! তার ভাই কেমনে এতবড় হার্টসার্জেন্ট হলো সে ভেবে পায় না। এখন ভাবার সময় ও নেই। আদর চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আতইয়াব ভড়কে গেলো। সে কি বললো ; যে তার বোন রেগে গেলো। এমন সময় আতইয়াব চারপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই এটা ওটা বলাবলি করছে। আতইয়াব স্পষ্ট শুনতে পেলো তারিমকে খারাপ বলছে অনেকেই। রাগ হলো তার। বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ছেলে; এখানে তারিমের দোষ টা কোথায়! কিন্তু হঠাৎ আদরের কথায় আতইয়াব, তারিম বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
এখন তুমি তারিম কে বিয়ে করবে ভাইয়া। আমি কিচ্ছু জানিনা। এখানে থাকলে ওই বুড়ি মহিলা তারিম কে আরো মারবে। আর এই সমাজের মানুষ তারিমকে নানা কথা শুনাবে। আমি থাকতে এমন কিছুই হবে না। তুমি তো জানো তারিমের বিষয়ে!
আদর আকাঙ্ক্ষার সহিত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আতইয়াবের মনে হচ্ছে মনের ভেতর এক মণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। তার তো ভালোবাসার মানুষ আছে। খুব ভালোবাসে তাকে। অর্ণাবি নামক মেয়ের সাথে তার ৬ মাসের রিলেশন। সে এভাবে ধোঁকা দিতে পারবে না । মেয়েটি তাকে খুব ভালোবাসে। একদিকে বোন আরেকদিকে নিজের ভালোবাসা, আর যাই হোক সে তার বোনকে এক ফোঁটা কষ্ট দিতে পারবে না। কিন্তু অর্ণাবি! মেয়েটি সহ্য করতে পারবে? এমন সময় আশেপাশের লোকজনের কথা শুনে সে সামনে দিকে তাকালো। ফালাহ একটি মেয়ের হাত ধরে এদিক ই আসছে। চোখ তার নিচের দিকে। ফালাহ’র বাবা-মা ছুটে গেলো ছেলের কাছে। ফালাহ তখনো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আদর গিয়ে সোজা ফালাহ’র শেরওয়ানির কলার চেপে ধরলো। রাগে মুখ একদম থমথমে; ফোলা গালদুটোও রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ফালাহ চমকে তাকায় সামনের দিকে। আদর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
তুমি এটা কি করে করতে পারো ফালাহ ভাইয়া। তারিম কে বিয়ে করবে বলে এখন অন্য মেয়েকে নিয়ে এসেছো। তারিম কে কেন ঠকালে? ওর কি দোষ ছিলো? উত্তর দাও!
ফালাহ তীক্ষ্ম চোখে আদরের দিকে তাকাতেই আদর চুপ করে গেলো। ফালাহ তার বাবা-মা কে বলল,
বাবা-মা আমি সুবাহ কে ভালোবাসি। তোমাদের বলতে পারছিলাম না। তোমরা তার আগেই তারিমের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেললে ; আমার মতামত জানার প্রয়োজন ই মনে করোনি। আমি ভালোবাসাকে ভুলতে পারবো না। তাই আমাকে ক্ষমা করো।
ফালাহ’র কথায় তারিম এবার রেগে ফুসে উঠলো। ঠাসস করে চড় বসালো ফালাহ’র গালে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো ফালাহ’র। তারিম চিৎকার করে বলে উঠলো,
আপনাকে আমি অনেক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম মি. ফালাহ। আপনি প্রত্যেক বারই হাসিমুখে হ্যা বলেছেন। আপনার উদ্দেশ্যেই ছিলো সমাজের কাছে আমাকে অপমানিত করা। তাইতো? সেদিনের প্রতিশোধ নিলেন এইভাবে। আপনি খুশী হয়েছেন এবার? আর তুই সুবাহ! আগে একবার বলে দেখতি তোর আর মি. ফালাহ’র রিলেশনশিপের কথা। তোর কি আমাকে সেসব মেয়েদের মতো মনে হয় যারা বেস্ট ফ্রেন্ডকে ধোঁকা দেয় লাইক ইউ!
তারিমের কথায় সুবাহ কেঁপে উঠলো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। ফালাহ শক্ত করে সুবাহ’র হাত টা ধরলো। এবার আতইয়াব ফালাহ’র কাছে এসে বলল,
তোর থেকে এরকম কিছু আশা করিনি ফালাহ। কি করে পারলি একটা মেয়ের সর্বনাশ করতে। আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে তুই আমার বন্ধু। জানের বন্ধু!
আতইয়াবের কথায় ফালাহ’র কষ্ট লাগলেও চুপ রইলো। সে সবকিছু ভালোর জন্যই করছে। যখন সবাই আসল সত্যটা জানতে পারবে তখন নিশ্চয় ফালাহ কে দূরে সরিয়ে রাখবে না। আতইয়াব মলিন চোখে তারিমের দিকে তাকালো। তারিম ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। আদরের কাছে এটাই মুখ্যম সময় মনে হলো। আতইয়াব, তারিমের হাত ধরে কাজীর সামনে নিয়ে গেলো। আতইয়াব চুপটি করে বসে রইলো। প্রথমত, সে তার বোনকে কষ্ট দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, আজ বিয়ে না হলে তারিমের বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। আর তারিম! সে তো মানতে পারছে না কিছু। আদরের হাত থেকে নিজের হাতটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
আমি এ বিয়ে করতে পারবো না আদু। তুই নিজেও ভালো করে জানিস তোর ভাই মিস অর্ণাবি কে ভালোবাসে। জোর করে বিয়ে হলেও, জোর করে সংসার হলেও, জোর করে সুখে থাকা যায় না। আর আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমি এতটাও দুর্বল না। এত সহজে মরবো না।
তারিমের কথা আদরের বুকে তীক্ষ্ম ভাবে আঘাত করলো। ছলছল করে উঠলো চোখ। কারণে অকারণে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদার অভ্যাস থাকলেও যখন প্রচন্ড কষ্টে কান্না পায় তখন আদরের চোখ টকটকে লাল হয়ে যায়। আতইয়াব একপলক সেদিকে তাকিয়ে তারিমের হাত শক্ত করে ধরে নিজের পাশে বসালো। হালকা রাগি সুরে বলে উঠলো,
চুপচাপ বসে পড়ো। আমার বোন বলেছে মানে বিয়েটা হবে। সো নো সাউন্ড।
আদরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারিম স্তব্ধ হয়ে তাকালো আতইয়াবের দিকে। আদর তারিম কে ঠেস দিয়ে কানে কানে বলে উঠলো,
একেই বলে ভাগ্য! ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবনের জন্য পাচ্ছিস একদম বৈধ ভাবে। ভালোবাসা সৃষ্টি করার দায়িত্ব তোর!
ফট করে আদরের দিকে তাকালো তারিম। চোখ মুখে ভয়। হয়তো ভাবছে এতদিন ধরে ভালোবাসা গোপন করেও লাভ হলো না। সেই আদর জেনেই গেলো।
কবুল বলার সময় মেয়েরা দেরী করে, গলা কাঁপে, খানিকটা ভয় নিয়ে নিজের জীবনকে অন্যের জীবনের সাথে জড়ায়। কিন্তু এইবার ভিন্ন! কবুল বলায় আতইয়াব যতটা দেরী করেছে; তারিম তার কিছুই করেনি। বিয়ে শেষ হতেই আদর একপ্রকার নেচে উঠলো। ফালাহ’রা সেখানেই দাড়িয়ে আছে। ফালাহ’র দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দিতেই ফালাহ হালকা হেসে উঠলো। কেউ দেখার আগেই আবার নিজের মধ্যেই গুপ্ত করে নিলো হাসিটা। আতইয়াব আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দুইহাতে তারিম আদরের হাত ধরে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। ওরা চলে যেতেই ফালাহ ওরাও নিজেদের গন্তব্যে হাঁটা ধরলো। কষ্ট হলেও নিজেকে হালকা লাগছে। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে!
আদর দের বাড়ি পৌঁছাতে আধাঘন্টার মতো সময় লাগলো। এখন রাত ৯ টা বাজে। আতইয়াব কে আবার হসপিটাল যেতে হবে। আদরের থেকে বিদায় নিয়ে বের হতে যেয়েও ফিরে আসলো। তারিমের সামনে দাড়িয়ে বলল,
আমি কে, কি সম্পর্ক সেসব বাদ। নিজের বাড়ির মতো এবং আদর যেভাবে থাকে তেমন করেই থাকবি। তুই এই বাড়ি নতুন চিনিস না। আর এখন থেকে ঠিক আধাঘন্টা আগে কি হয়েছে সব ভুলে যা। আমি এসে আপসেট দেখলে কি করবো জানিস তো! আমার আসতে দেরী হতে পারে খেয়ে ঘুমিয়ে যাবি দুজন। আর আমার কলিজাকে দেখে রাখিস।
আতইয়াব হাটা ধরলো। পিছু ফিরে একবার চাইলে হয়তো তারিমের মুখে প্রাপ্তির হাসিটা দেখে যেতে পারতো। আতইয়াব চলে যেতেই আদর দৌড়ে এসে তারিম কে জড়িয়ে ধরে ঘুরতে লাগলো। তার যে কত আনন্দ হচ্ছে বলার বাহিরে। সে তো খুব করে চাইতো তারিম তার ভাবি হোক। একটু সুখ দিবে সে তারিম কে। আজ সে সফল! ভাবতেই সে নাচানাচি শুরু করে দিলো। আদরের পাগলামি তে তারিমের মন খারাপ একদম কেটে গেছে। সে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে আদর কে বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে পেয়ে। অথচ সুবাহ! সে কি করলো? একটাবার বলতো তাকে। সে কিছুতেই রাজি হতো না বিয়েতে। যে করেই হোক ভেঙে দিতো। এসব ভেবে মন খারাপ করতে চায় না সে তাই আদরের দিকে ধ্যান দিলো। পুরো বাচ্চা একটা মেয়ে!
আতইয়াব হসপিটাল পৌঁছাতেই খবর এলো হলরুমে যাওয়ার। তার মধ্যে কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। কেমন যেন নিজেকে নির্জিব লাগছে। হলরুমে পৌঁছাতেই আতইয়াবের কানে চেঁচানোর শব্দ আসলো। যা ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো। সে তাড়াহুড়ো করে ভেতরে ঢুকতেই সবার চোখ পড়লো তার উপর। সবার চোখেই অসহায়ত্ব ভর করেছে ; শুধু একজনের চোখ জ্বলজ্বল করছে; যেন রক্ত ঝরবে ওইচোখে। আতইয়াব এগিয়ে গিয়ে বলল,
আ’ম সরি মি. চৌধুরী। আমার ভুল হয়েছে আমি মানছি বাট আমার জীবনে আমার বোনের থেকে ইমপরটেন্ট কিছুই না। আর পরিস্থিতিটাই এমন হয়েছিলো আমাকে যেতে বাধ্য হতে হলো।
আতইয়াবের কথায় মি. চৌধুরী তেড়ে এসে কলার চেপে ধরলেন। রাগে তার মাথা একদম বিগড়ে গেছে। বাম হাতে রিভলবার। ইনি হচ্ছে মাশহুর বিজনেসম্যান হৃদান চৌধুরী; তার আরেকটা পেশা হলো নাহ ঠিক পেশা না শখ বলা হলে, মডেলিং। মডেলিং টা কে সে শখ হিসেবেই নিয়েছে। হৃদান চৌধুরী! নাহ আছে দয়া, না আছে ভালোবাসা। সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতার পরিচয় হলো হৃদান চৌধুরী। যে তার কথায় একবার না শব্দ উচ্চারণ করবে তার জীবনের প্রদীপ নিভে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। কিন্তু এসব সে নিজের হাতে করে না; নিজ সামনে নিজের লোককে দিয়ে হাসিল করে। আর সে তৃপ্তি নিয়ে দেখে যায়। পৈশাচিক এক আনন্দ পায় সে। তার একমাত্র আনন্দ বিরোধী দলের মৃত্যতে! মৃত্যকে সামনে দেখে যখন মানুষ বাঁচার জন্য ছটফট করে, প্রাণ ভিক্ষা চায় তখন তার অন্তরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।
এমন নিষ্ঠুর মানুষকে রিভলবার হাতে নিজের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখেও আতইয়াবের মনের ভেতর একটু ভয়ও কাজ করছে না। সে নিবার্ক তাকিয়ে আছে। আতইয়াবের ভয়হীন চোখ হৃদান কে অবাক হতে বাধ্য করলো। ছেড়ে দিলো কলার। সে তো মানুষের চোখে নিজের জন্য ভয় দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু আতইয়াব ভয় পাচ্ছে না কেন? তার কি প্রাণের মায়া নেই? তার মতোই দয়াহীন নাকি? আতইয়াব হদানের ছটফট ভাব দেখে বলে উঠলো,
না আমি আপনাকে ভয় পাই, না ভয় পাই মৃত্যকে। মুসলমান হয়ে যখন জন্মগ্রহণ করেছি তখন একদিন মৃত্যর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু আপনি হয়তো ভুলে গেছেন এটা হসপিটাল এন্ড অলসো আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ তার ডিউটি সম্পর্কে খুব কঠোর। একজন ডক্টরের কাছে তার রোগি মানে তার একটা জীবন। রোগির সুস্থতায় একজন ডক্টরের সফলতা। ঔষধ দিলাম, রোগি বিদায় করলাম আর টাকা আদায় করলাম এমন ডক্টর যদি আমাকে ভেবে থাকেন তাহলে ভুল করবেন। আপনার পেশেন্টের অপারেশন আরো তিনদিন পর। তাই আশা রাখবো আমাদের স্পেচ দিবেন। এখন আসতে পারেন, দরকার হলে আপনাকে জানাবো।
এমন দৃঢ় কথায় হৃদানের কপালের রগ গুলো রাগে ফুলে উঠলো। কিন্তু যার মনে ভয় নেই তাকে সে মৃত্য দেয় না। আতইয়াবের চোখে ভয় দেখবে, বাঁচার জন্য ছটফটানি দেখবে তবেই সে শান্তিতে ঘুমাবে। কিন্তু তার জীবনে কি শান্তি আদও আছে? না আছে ঘুম? আতইয়াবের চোখের দিকে তাকিয়ে হৃদান বলল,
ওই চোখে ভয় দেখতে হৃদান চৌধুরী সব করবে! মাইন্ড ডেট!
আর দাড়ালো না সে। বেরিয়ে এলো হলরুম থেকে। তার পিছুপিছু তার গার্ডসরা। হৃদান চৌধুরীকে দেখেই সবাই পেছনে সরে যেতে লাগলো। কে না জানে তার নিষ্ঠুরতার কথা। কিন্তু প্রমাণ! না আছে প্রমাণ, না আছে সাক্ষ্য! তাই এখনো বুক ফুলিয়ে চলতে পারে সে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে হৃদান গাড়িতে বসে পড়লো। গার্ডসরা আসার আগেই সে ছুট লাগালো। গার্ডসরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জীবন বাজি রেখে হৃদান চৌধুরীর সাথে চলাফেরা করতে হয় তাদের।
হৃদানকে এইভাবে বের হয়ে যেতে দেখে হলরুমের সবাই আতইয়াব কে বাহুবা দিতে লাগলো। যা আতইয়াবের কাছে খুব বিরক্তিকর। মিটিং কেন্সেল করে সে বের হয়ে আসলো হসপিটাল থেকে। এই হসপিটালের ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার তার। আর ফিফটি পার্সেন্ট ফালাহ’র। তাই সবাই তার কথা শুনতে বাধ্য। বাড়ি পৌঁছে আগে বোনের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে আদর। বোনকে ঠিকঠাক ভাবে শুয়িয়ে দিয়ে সে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরলো। সে জানে তার বোন আবার হাত পা ছুড়োছুড়ি করবে। নিজের রুমে ঢুকে সে আরেকটা ধাক্কা খেলো। কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলেই গিয়েছিলো তার জিবনে পরিবর্তন এসেছে। বৈধ ভাবে একজন নারী তার জীবনে জড়িয়ে গেছে। বিছানার দিকে চোখ যেতেই আতইয়াবের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আগে সে একটা বাচ্চাকে সামলাতো এখন তার দুটো বাচ্চাকে সামলাতে হবে। তারিম নিজেও হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। আতইয়াবের কেন যেন হাসি পেলো। হালকা হাসলো সে। তারিম কে ঠিক ভাবে একপাশে শুয়িয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। একটু ঘুম দরকার। আজ সারাদিন কম দখল যায়নি। তারিমের থেকে অনেকটা দুরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লো আতইয়াব। সে মানুক, না মানুক তারিমের সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার পাশে ঘুমানোর।
অন্যদিকে বিলাশবহুল হোটেল রুমে বসে একের পর এক মদের বোতল শেষ করছে হৃদান। তার চোখে শুধু আতইয়াবের ভয়হীন চোখদুটো ভাসছে। যত বার ঘটনাগুলো মনে পড়ছে ততবার রাগে শরীর কাঁপছে তার। এই শহরে শুধু একটাই ভয় থাকবে; সে হলো হৃদান চৌধুরী। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধা সবার চোখেই তার জন্য ভয় থাকবে। হৃদান চৌধুরী নামটা মনে হলেই গলা কেঁপে উঠবে। হাতে থাকা মদের বোতল টা শেষ করে ফোন লাগালো তার এসিসটেন্সের কাছে। ঠিক এসিসটেন্স না; হৃদানের জীবনে ৪ টা মানুষের অস্তিত্ব খুব সফট। তার মধ্যে পিয়াস অন্যতম।
শান্তির ঘুম দিচ্ছিলো পিয়াস। দিন শেষে এই রাতটুকুই শান্তিতে সে ঘুমাতে পারে। ঘুমে এতটাই বিভোর ছিলো যে এতবার ফোন বেজে কেটে যাচ্ছে তার কোনো ধ্যান ই নেই। ঘুমটা হালকা হয়ে আসতেই ভ্রু কুচকে এলো তার। রাতটুকুও শান্তি নাই। ফোনের উপর জানু নামটা দেখেই পিয়াসের হার্টবিট বেড়ে গেলো। একরাশ ঘুম ততক্ষণে উবে গেছে। ফট করে ফোন রিসিব করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে শুনা গেলো,
ডক্টর আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজের অল ডিটেলস চাই। কালকে সকালের মধ্যে। কডেট? বাই!
বাই বলাও শেষ ফোন রাখাও শেষ। পিয়াস মনে হলো হৃদানের মাথাটা ফাটাতে পারলে তার শান্তি লাগতো। আরামের ঘুম বাদ রেখে এখন কাজ করতে হবে। করতেই হবে; হৃদান তার বন্ধু হলেও জমের মতো ভয় পায় সে। গম্ভীর মানুষটার মুখের দিকে তাকালেই শরীর কাঁপে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো পিয়াস। কাজে লেগে যেতে হবে। তার তো ভয় হচ্ছে ডক্টর আতইয়াবের জন্য। আহারে বেচারে কি করেছে বুঝতে পারছে না সে! কি যে হবে!
চলবে….?
#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#সূচনা_পর্ব