মন পাথরে হঠাৎ ঝড় – পর্ব 02

0
390

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২
Tahrim Muntahana
অন্ধকার ঘরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে আদর। জ্ঞান নেই; সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় ফ্লোরে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। পিনপতর নিরবতা বিরাজ করছে ঘরটাই। মনে হচ্ছে আশেপাশে কেন দশ গজের মধ‍্যেও কেও নেই।
কিছুক্ষণ পর আদর হালকা নড়ে উঠলো। আস্তে আস্তে চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ শক্ত ফ্লোরে শুয়ে থাকার জন‍্য সারা শরীর ব‍্যাথা করছে। উঠতে চেয়েও যখন উঠতে পারলো না তখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আদর। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারছে না সে। অনেকক্ষণ ধরে না খাওয়ায় শরীরটা দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়তে চায়ছে। আদর তবুও পা মুডিয়ে উঠে বসলো। মনে পড়ে গেলো সকালের ঘটনা,
সূর্য যখন আঁধার কাটিয়ে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে জানান দিচ্ছিলো নিজ আগমনের ঠিক তার কিছুক্ষণ আগে আদরের ঘুম ভেঙে যায়। প্রতিদিন এই সময়টাতেই ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে ছাদে চলে যায় সে। পূর্ব দিকে তখন আকাশ কে রক্তিম বর্ণে সাজাচ্ছে সূর্য। দৃশ‍্যটা মুগ্ধ হয়ে দেখার অভ‍্যাস বহুদিনের। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস টা যখন শরীর ছুয়ে যায়; আদরের মনে ভিন্ন অনুভূতি জন্ম নেয়। ছোট বেলায় ভাইয়ার বলা কথা গুলো মনে পড়ে যায়। আতইয়াব বলতো সকালের এই স্নিগ্ধ বাতাসে তাদের মায়ের ছোঁয়া আছে। যা তাদেরকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করে। তারপর থেকেই আদর ভাইয়ার বলা মায়ের ছোঁয়াটা প্রতিদিন অনুভব করে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে সকালের জন‍্য হালকা নাস্তা রেডি করে ; কিছুটা খেয়ে জগিং করতে বের হয় আদর।
আজকেও প্রতিদিনের অভ‍্যাস মতো জগিং করতে বেরিয়েছিলো আদর। হোয়াইট জ‍্যাকেট, কালো জিন্স, চুল গুলো উপরে জুটি করা একদম বাচ্চাদের মতোই লাগছিলো। কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে পার্কে এসে বসে সে। মূলত অপেক্ষা করছে; এখানে কিছু বাচ্চারা এই সময়ে আসে ; তাদের সাথেই কিছুক্ষণ সময় কাটায় আদর। অনেকক্ষণ বসার পরেও যখন বাচ্চাগুলো আসছিলো না তখন আদর আর অপেক্ষা না করে বাড়ির পথে রওনা হয়। বেশী দেরী হলে আবার ভাইয়া চিন্তা করবে। পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছিলো। একটু পর লক্ষ‍্য করলো তার পেছনে দুটো মহিলা আসছে। পথযাত্রী ভেবে পাত্তা দেয়নি আদর। কিন্তু যখন ই টের পেলো তার নাকের উপর কেউ রুমাল চেপে ধরেছে তখনই ভয়ে জমে যায় সে। কত নিউজ দেখেছে কিডন‍্যাপিংয়ের। এভাবেই তো রুমাল চেপে ধরে অজ্ঞান করে উঠিয়ে নেয়। আকস্মিক নিজের সাথে হওয়া এমন ঘটনায় আদর ভয় পেয়ে চিৎকার টাও করতে পারে না। তারপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফিরেই নিজেকে অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করে সে। এখন রাত না দিন সেটিও টের পাওয়া যাচ্ছে না। খিদেয় পেটের ভেতর গুডগুড করছে। রাগ ও লাগছে অনেক। তাই হালকা শব্দ করে বলে উঠলো,
‘কেউ আছো? এনিবডি হেয়ার? আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? সামনে আসো? একদম কাঁচা চিবিয়ে খাবো। আয় সামনে। কার এত বড় সাহস এই আদর কে তুলে নিয়ে আসে!’
‘কেউ কথা বলছে না কেন? তোরা কি সব বোবা নাকি? আমার মতো অবলা বাচ্চাকে তুলে এনেছিস? তোদের লজ্জা করে না। সামনে আয়! ফাইট কর আমার সাথে। বেঁধে রেখেছিস কেন এভাবে। একজন মেয়েকে এভাবে বেঁধে রেখেছিস তোদের ঘরে কি মা-বোন-বউ নাই? সামনে আয় এক কিকে আমাজনে পাঠিয়ে দিবো সেখানে সংসার করিস! আরে কেউ আসে না কেন? আর কত ডাকবো? একবার ছাড়া পাই এই আদর কি তা দেখিয়ে দিবো সবাইকে। আমার ভাইয়া যদি জানতে পারে তার কলিজাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস তোদের অস্তিত্বও পাওয়া যাবে না। সাহস থাকলে সামনে আয়।’
আদর চাইছে তার কথায় রেগে গিয়ে কেউ না কেউ আসুক। কিন্তু কেউ আসছে না দেখে চুপ করে রইলো। আর পারছে না। দরজার পাশে গার্ড দুটো বিরক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কখন থেকে মেয়েটি চিৎকার করেই যাচ্ছে। কিছু বলতেও পারবে না তারা। হুকুমের বাইরে একটু পরিমাণ কিছু করলে মরন নিশ্চিত! তখনই সেখানে উপস্থিত হলো একটি ছেলে। ছেলেটাকে দেখেই গার্ডস রা দরজা খুলে দিলো সাথে লাইট ও অন করে দিলো। লাইট অফ ছিলো দেখে ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘লাইট অফ করে রেখেছো কেন? ভেতরে একজন আছে জানা নেই?’
একজন গার্ড অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
‘বসের আদেশ স‍্যার; অমান‍্য করার সাধ‍্য নেই।’
ছেলেটি আর কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সত‍্যিই তো তারা তো হুকুমের গোলাম। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠতেই আদর খানিক টা চমকে যায়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে শুরু করে। রুমের একপাশে একটি টেবিল আর দুটো চেয়ায়; আর কিচ্ছু নেই। সে বুঝতে পেরেছে এখন কেউ হয়তো আসবে। পায়ের শব্দ কানে আসতেই সামনের দিকে তাকালো সে। তাকাতেই আদরের চোখ বড় বড় হয়ে এলো। ছেলেটিকে সে ভালো করেই চেনে। পিয়াস আনাফ! হৃদান চৌধুরীর জানের বন্ধু! এখন সে বুঝতে পারলো তাকে হৃদান চৌধুরী তুলে এনেছে। কিন্তু কেন? সে তো কিছুই করেনি! তাকে কি এরা মেরে ফেলবে? সে কি আর ভাইয়াকে দেখতে পারবে না? ননদ-ভাবির যে ঝগড়া হয় সেটিও করতে পারবে না? মেইন কথা হচ্ছে তার যে অনেক বড় স্বপ্ন আছে সেটিও কি পূরণ করতে পারবে না? ভেবেই আদরের খুব কান্না পেলো। সবকিছু ভুলে ভ‍্যা ভ‍্যা করে কাঁদতে লাগলো। পিয়াস মাত্রই চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলো হঠাৎ এমন কান্নায় ভড়কে যায় সে। বসার সুযোগটাও মেলে না। সামনের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। এত বড় মেয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করছে? বেশীই ব‍্যাথা পাচ্ছে নাকি? সে আবার হৃদান চৌধুরীর মতো এত নিষ্ঠুর নয়। নেহাত বন্ধু; তাই কাজের সব ক্ষেত্রে থাকতে হয়। পিয়াস কে এগিয়ে আসতে দেখেই আদর কান্না থামিয়ে করুণ সুরে বলল,
আমার খুব খিদে পেয়েছে। তোমরা খুব নিষ্ঠুর। একটু খাবার দিলে কি হয়? আমি বেশী খাইনা। একটু খাবো। দিবে খাবার?
পিয়াসের খুব মায়া হলো। এটাও বুঝে নিলো, মেয়েটি বয়সেই বড় হয়েছে আচরণে না। ম‍্যাচিউরিটি থাকলে মেয়েটি এমন অন্ধকার ঘরে একটি ছেলের সামনে থাকার পরেও এভাবে খাবার চাইতো না। ভয়ে আড়স্ট হয়ে থাকতো।
পিয়াস জানে হ‍ৃদান যদি জানতে পারে মেয়েটিকে খাবার দেওয়া হয়েছে তাহলে তার উপর রেগে যাবে। তবুও সে দিবে। মেয়েটিকে দেখেই কেমন মায়া মায়া লাগে। গার্ডকে ডেকে খাবার দিতে বলতেই গার্ডটি ভুত দেখার মতো চমকে গেলো। মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে। পিয়াস চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই গার্ডটি খাবার আনতে চলে গেলো। পিয়াসকে এমন নরম হতে দেখে আদর বাঁকা হেসে বলল,
‘তুমি তো খুব ভালো। আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে ভাইয়ু ডাকি? তুমি কি রাগ করবে?’
আদরের কথায় পিয়াস মুচকি হাসলো। তারও যে মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে সে তার হাসিতেই বুঝতে পেরেছে। গিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন টা খুলে দিলো। আদর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হাত-পা ভালো করে ঝাড়া দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। খিদেয় দাড়িয়ে থাকা কষ্টকর। গার্ডটি পিয়াসের হাতে খাবার দিয়েই বাইরে চলে গেলো। পিয়াস আদরের সামনে খাবারের প্লেট টা রেখে মাথা দিয়ে ইশারা করলো খাওয়ার জন‍্য। কিন্তু আদর ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে। পিয়াস এবার গাঢ় চোখে আদরকে পরখ করতেই বুঝতে পারলো আদরের ঠোঁট উল্টানোর বিষয়টা। আদরের হাত পায়ে ময়লা লেগে আছে অনেক। এই রুমে এডজাস্ট করা ওয়াশরুম ও নেই। পিয়াসের বড্ড মায়া লাগছে সামনের মেয়েটিকে দেখে। খেতে পারছে না বলে কেমন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বসে আছে। হয়তো চোখের ভাষায় বুঝাতে চায়ছে অপারগতার কথা। পিয়াস পানির বোতল টা খুলে নিজের হাত টা ধুয়ে নিলো; আদরের সামনেই ফ্লোরে বসে এক লোকমা তুলে ধরলো তার মুখে। আদর প্রথমে খুব অবাক হলেও পাত্তা না দিয়ে খেতে লাগলো। পরোটা আর কসা মাংস। আদরের তেমন পছন্দ না হলেও খিদেয় খাবার টা দারুণ লাগছে। আদরের বুঝতে বাকি নেই পিয়াস নামক ছেলেটা অত্যন্ত ভালো। পিয়াস চলে যেতে নিবে তার আগেই আদর বলে উঠলো,
পিয়াস ভাইয়ুওওও! আমার ফোনটা কোথায়?
পিয়াসের ভ্রু টা এবার কুচকে এলো। এই মেয়ে কি তাকে ব‍্যবহার করছে নিজের বাচ্চামো দিয়ে? নাকি নিজেকে এমন ধারায় দেখাতে চাচ্ছে? পিয়াস গম্ভীর কন্ঠে হালকা চেচিয়ে বলে উঠলো,
তুমি কি চাইছো বলোতো? এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবে? অসম্ভব! এটা কোথায় তুমি নিজে কেন কেউ জানে না। এখানের লোকেশন ও কানেক্ট হবে না। তাই ফোন নিয়ে কাউকে ফোন করলেও লাভ নেই।
পিয়াসের কথায় আদরের চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। সে তো ছেলেটাকে ভালো ভেবেছিলো। কিন্তু ছেলেটা ভালো না। সে কি এতকিছু ভেবেছে নাকি। আদরের এবার কান্না পাচ্ছে। কিছু না বলে চুপটি করে বসে রইলো। পিয়াস একপলক সেদিকে তাকিয়ে বাইরে চলে গেলো। এমনিতেই খাবার, বাঁধন খুলে অপরাধ করে ফেলেছে তার উপর ফোন দিলে হৃদান তাকে খুন ই করে ফেলবে।
সারাদিন হন্নে হয়ে খুঁজে চলছে আতইয়াব আদরকে। তারিম কেঁদে কেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। আতইয়াব সবদিক থেকে দিশেহারা হয়ে গেছে। বোন কে আর কোথায় খুঁজবে। পুলিশ কেও জানিয়েছে।তারা কোনো লোকেশন বের করতে পারছে না। আতইয়াব এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মনে হচ্ছে বুক থেকে কেউ হৃদপিন্ডটাই আলাদা করে নিয়েছে। কোনো ক্ষতি হলো না তো! ঠিক আছে তো বোন! এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বিকট শব্দে ফোন টা বেজে উঠলো। হয়তো পুলিশ ফোন দিয়েছে খবর জানাতে ভেবে তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিব করে কানে ধরলো। তখন ই অপর পাশ থেকে কিটকিটিয়ে হাসির শব্দ এলো। আতইয়াব দাড়িয়ে গেলো। চুপ করে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,
ভয় লাগছে! ডক্টর আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ! বলেছিলাম ওই চোখে ভয় দেখবো। আমি সফল!
আতইয়াব শান্ত হয়ে বসলো। রাগ চেপে বসেছে মাথায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
ভয় আর হৃদান চৌধুরীর জন‍্য ভয় আলাদা নয় কি মি. চৌধুরী?
আতইয়াবের এই একটা কথায় যথেষ্ট হৃদান কে রাগিয়ে দিতে। পাশের থাকা ফ্লাওয়ার বেসটা ছুড়ে মারার সাথেই সাথেই বিকট শব্দে ভেঙে পড়ে রইলো ফ্লোরে। আতইয়াব হালকা হাসলো। যার শব্দ হৃদানের কানে পৌঁছাতেই হৃদান বলে উঠলো,
হৃদান চৌধুরীর কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। বোনকে খুব ভালোবাসেন না? বোনকে যখন কাছে পাবেন না তখন?
আতইয়াব হালকা কেঁপে উঠলো। মনের মধ‍্যে একরাশ ভয় এসে হানা দিচ্ছে। সে কি তার বোন কে সত‍্যিই দেখতে পারবে না? হৃদান কে বুঝতে না দিয়ে আতইয়াব শান্ত সুরে বলে উঠলো,
এখন তো সন্ধ‍্যা! ঠিক রাত ৯ টার মধ‍্যে আমার বোন অক্ষত অবস্থায় আমার সামনে না থাকলে এই আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিবে। আর আর! ডাক্তারি পেশা ছাড়লে আপনার পেশেন্টের অপারেশন ও ডক্টর আতইয়াবের হাতে হবে না! আর হ‍‍্যাঁ আমার বোন যেন এসব রেষারেষির কিছু না জানে!
ফোনটা টুস করে কেটে দিলো আতইয়াব। নিজের ঘরে চলে গেলো। তারিম কান্না করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো তাই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আতইয়াব নিশ্চিত তার বোন এবার ৯ টার আগেই তার সামনে আসবে। কারণ হৃদান চ‍ৌধুরীর কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। অন‍্যদিকে হৃদান আতইয়াবের এটিটিউট দেখে রেগে ঘরের জিনিস একের পর এক ভেঙে চলছে। বাইরে দাড়িয়ে গার্ড গুলো ভয়ে কাঁপছে। না জানি এই ঝড় টা তাদের উপর দিয়ে যায়। ঘরের জিনিস ভাঙা শেষ হলে মদের বোতল নিয়ে নিচে বসে পড়ে হৃদান! কিছুতেই রাগ কমছে না তার। ফোন লাগালো পিয়াস কে। পাশের রুমেই ল‍্যাপটপে কাজ করছিলো পিয়াস। হৃদানের ফোন পেয়েই ভয় হলো তার। খাবার দেওয়ার কথা জেনে গেলো নাকি! ভয় ভয় নিয়ে ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে হৃদান চেচিয়ে বলে উঠলো,
‘মেয়েটি কোথায়? ৯ টার আগে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবি। আর মেয়েটি যেন এসব না জানে।’
‘মেয়েটি কোডেটে। আর আমিও এখানেই আছি।’
পিয়াসের কথা শুনে হৃদান চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘হোয়াট? তোর মাথা খারাপ? সামান‍্য একটা বিষয়ে তুই মেয়েটিকে ওখানে নিয়ে গেছিস?’
পিয়াস এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। সে কি করলো? তার উপর চেচাচ্ছে কেন? তার কথা মতোই তো এখানে নিয়ে এসেছে। পিয়াস বলার জন‍্য মুখ খুলবে তার আগেই হৃদান বলে উঠলো,
‘তুই কোডেটে মানে এই যে তুই মেয়েটাকে কোড সময়টাতেই সেখানে নিয়ে গেছিস?’
‘আরো আগে কিডন‍্যাপ হয়েছিলো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। আর তুই ই তো আমার বললি কোডেট! তাই আমি ভেবেছি এখানে আসতে বলেছিস!’
পিয়াসের কথায় হৃদান ভাবনায় পড়ে গেলো। অবশেষে মনে পড়লো সে রাগে পিয়াসকে কোডেটের কথায় বলেছে। তাই কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো। রাগ কে সংযত করতে হবে। না হলে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে। কোডেট হলো codet! Code-কোড; t থেকে time মানে সময়। এই বাড়িটা হৃদান চৌধুরী অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরী করেছে। যেন শত্রুপক্ষ বাড়িটির খুঁজ পেলেও বাড়িতে ঢুকতে না পারে। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রেখেছে সেই সময়েই কোড বসালে দরজা খুলবে নাহলে না। আর একবার যে কোড ভুল করবে সেদিন আর দ্বিতীয় অপশন থাকবে না বাড়িটাতে ঢুকার। এই সেই বাড়ি যেখানে হৃদান চৌধুরী পৈশাচিক আনন্দ নিতে আসে। আর এখানেই তার নিষ্ঠুরতার সব প্রমাণ লোপাট হয়!
হৃদানের কথা মতো পিয়াস আদরের কাছে গেলো। সময় বেশী নেই। গিয়েই আদরের চোখ বেঁধে দিলো। আদর চিৎকার করছে, হাত-পা ছড়াছড়ি; না পেরে পিয়াস বললো,
‘আরে এভাবে হাত-পা ছুড়াছুড়ি করছো কেন? তোমাকে তোমার ভাইয়ার কাছেই নিয়ে যাবো এখন। ভুল করে তোমাকে তুলে এনেছে আমাদের লোক। তুমি নয় যাকে কিডন‍্যাপ করার কথা ছিলো।’
আদরের এবার পিয়াস কে খুন করতে ইচ্ছে করছে। মানে কি? এতটা সময় সে বিনা দোষে কষ্ট পেয়েছে। তবুও কিছু বললো না। যদি মেরে দেয়। কেউ তো টের ই পাবে না। ৯ টা বাজার ৩ মিনিট আগেই আতইয়াবদের বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। আতইয়াবের ধারণা তার বোন এসেছে। ছুট লাগালো দরজার দিকে। দরজা খুলতেই চোখে পড়লো আদরকে। ঝাপটে ধরলো আতইয়াব। এতক্ষণে মনে হচ্ছে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। আতইয়াবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আদর জোরে বলে উঠলো,
পিয়াস ভাইয়ুওওওও তুমি খুব ভালো। নাহলে এই আদর তোমাকে ভাইয়ুও ডাকতো না। আর ওই হৃদান চৌধুরীকে বলে দিও কোনোদিন যেন আমার সামনে না পড়ে। তাহলে তার মাথার চুল একটাও থাকবে না। পরে দেখা যাবে এত মেয়ের ক্রাশ হৃদান চৌধুরীর জন‍্য বউ খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিহিহি!
আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো আদর কিন্তু আতইয়াব সে সুযোগ দিলো না। টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। গাড়িতে বসেছিলো পিয়াস। সেখানে বসেই ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখছিলো। হঠাৎ ই ফোন আসে হৃদানের। কানে ধরে হেলো বলবে তার আগেই আদরের মুখে নিজের নাম শুনে কথা বলা অফ রেখে এদিকে কান দেয়। আদরের কথা শেষ হলেই মুচকি হাসলো পিয়াস। পরক্ষণেই আদরের শেষের কথা আর হৃদানের ফোন আসার কথা ভাবতেই পিয়াস ভয় পেয়ে গেলো। হৃদান রেগে আদরের ক্ষতি করবে না তো? হৃদান কে তার বিশ্বাস নেই। যে মানুষ সামনে বসে এক এক করে মানুষের অঙ্গ কাটার নির্দেশ দেয় আর দেখে আনন্দ পায় তার দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কানে ধরেই বলে উঠলো,
‘প্লিজ ভাই মেয়েটি একদম বাচ্চা। দেখলে কেমন আদর আদর লাগে। তাই ওসব বলে ফেলেছে তুই মেয়েটির কোনো ক্ষতি করিস না।’
ফট করে কল কেটে দিলো হৃদান। পিয়াসের বুকটা ধক করে উঠলো। এই অল্প সময়েই মেয়েটিকে বোনের আসনে বসিয়ে ফেলেছে কিছু হলে সে ঠিক থাকতে পারবে না। অন‍্যদিকে হৃদান ঝিম মেরে বসে আছে। কি শুনলো সে? বার বার শুধু আদরের কথা গুলোয় বাজছিলো কানে। এত মায়া মায়া কন্ঠ কারো হয়? সব থেকে বড় কথা সব মেয়ে হৃদান চৌধুরীকে নিয়ে অন‍্যকিছু ভাবে আর এ মেয়ে তার চুল ছিড়ার জন‍্য বসে আছে? সিরিয়াসলি? মেয়েটিকে দেখার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে তার। পরক্ষণেই নিজের মাথা টা ঝেরে নিলো। কি সব ভাবছে সে? হৃদান চৌধুরীর জীবনে কোনো মেয়ের জায়গা নেই, না আছে ভালোবাসা! হৃদান চৌধুরীর হৃদয় পাথর, নিষ্ঠুর সে! হৃদান চৌধুরীর তো তখন ভালো লাগে যখন সে মৃত‍্যু যন্ত্রণায় কাউকে ছটফট করতে দেখে। তাছাড়া তার মনে কোনো অনুভূতি নেই। না কোনোদিন হবে?
আতইয়াব আদর কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আদর কিছুক্ষণ আগেই কেঁদে কেটে বন্ধী থাকার সম্পূর্ণ ঘটনা বলেছে। পিয়াসের কথাও বলেছে। তাই আতইয়াব সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে অপারেশন করবে। যেহেতু তার বোন সেইভ আছে সেহেতু সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। হয়তো লোকটিকে বাঁচানোর জ‍ন‍্য হৃদান চৌধুরী কিছুটা নরম হবে। তার সাথেই যেমনটা করুক না কেন তার বোনকে নিজের আক্রোশের মধ‍্যে টানবে না! কিন্তু ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে আদর ভাবছে অন‍্যকিছু। তার ভাবনাতে রয়েছে, হৃদান পিয়াস আর ওই বাড়িটি! তার পরিকল্পনা আকাশ ছোঁয়া! আদও সফল হবে?
_______________________
ফালাহ’র বুকে মাথা রেখে সুবাহ সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদার কারণ হলো আদরের নিখুঁজ। হসপিটাল থেকে খবর পেয়েছে ফালাহ। সে ও সাধ‍্য মতো চেষ্টা করেছে খুঁজার কিন্তু লাভ হয়নি। অসাবধানতাবশত কথাটা সুবাহ’র কান পযর্ন্ত যেতেই সে সব ভুলে আদর দের বাড়ি যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ফালাহ চায়নি সুবাহ নতুন করে কটু কথার সম্মুখীন হোক তাই আটকে দিয়েছে। তখন থেকেই কেঁদে চলছে। তারিম যতটা আদর কে ভালোবাসে সেও ততটাই ভালোবাসে। কিন্তু এখন কিছু মিথ‍্যার বেড়াজালে তার ভালোবাসাটা চাপা পড়ে গেছে। এমন সময় ফালাহ’র ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিতেই চোখ পড়লো ফোনের উপর জ্বলজ্বল করছে আদুবুড়ি নামটি। ফালাহ ফোন ধরেই অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
‘আদুবুড়ি তুই ঠিক আছিস? কোথায় গিয়েছিলি না বলে? হন্ন হয়ে খুঁজেছি তোকে। তোর বোন তো সেই যে কান্না শুরু করেছে থামার নামই নেই।’
আদুবুড়ি নামটা শুনেই সুবাহ ফট করে মাথা তুললো ফালাহ’র বুক থেকে। একপ্রকার ফোনটা লুফে নিলো। কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো,
‘সবাইকে টেনশন না দিলে তোর ভালো লাগে না আদু? কোথায় ছিলি? জানিস কতটা কষ্ট হয়েছে? ঠিক আছিস তো তুই?’
ওদের কথায় আদর বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
‘আহ চুপ কর তো। ঠিক না থাকলে ফোন দিলাম কেমন করে। ওইসব বাদ আগে বল রিসিপশন হচ্ছে তো?’
আদরের গা ছাড়া ভাব দেখে সুবাহ’র মাঝে মাঝে রাগ হয় খুব। এতটা বাচ্চামো কেউ করে? আদর যেহেতু চায়ছে না ওসব কথা শুনতে তাই তারাও প্রসঙ্গ পাল্টে রিসিপশন নিয়ে কথা বলতে লাগলো। হঠাৎ করেই মনে হলো কেউ এদিকে আসছে। দরজা খুলার শব্দ কানে আসতেই আদর নিজের ফোনটা ফট করে লুকিয়ে ফেললো। কেউ দেখলে কি যে হবে। কিন্তু তারিমের চোখে ফোন লুকানোর ব‍্যাপারটা ধরা পড়েই গেলো। সে আদরের কাছে এসে বলল,
‘কার সাথে কথা বলছিলি যে আমাকে দেখে লুকাতে হলো? তুই ও কি সুবুর মতো লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছিস?’
তারিমের কথাটি শুনে সুবাহ’র খুব কষ্ট লাগলো। সে তো প্রেম করেনি। শুধু ভালোবেসেছিলো। এটাও কি অপরাধ! ভাবার আগেই আদরের কন্ঠ কানে এলো,
‘শুন তারিম সহসা আমরা যা দেখি তা হয়না। আর যা না দেখি, অসম্ভব ভেবে বসে থাকি সেটাই সম্ভব হয়।তাই আমি তোকে বলবো সুবুকে দোষ দিস না। ওর এখানে কোনো দোষ ই নেই। ওকে এসব বলিস না। যেদিন সত‍্যটা সামনে আসবে সেদিন হয়তো এসবের জন‍্য কষ্ট পাবি।’
তারিম আর কিছু বললো না। আদর কখনো মিথ‍্যে বলেনা সে জানে। তাই ধরেই নিলো কোনো না কোনো অপ্রকাশিত সত‍্য আছে। দেখা যাক সামনে কি হয়!
সবার জীবন যেন একটা স‍ত‍্যের উপর নির্ভর করছে। হৃদান কি আদর কে ছেড়ে দিবে? নাকি ক্ষতি করবে? আতইয়াবের প্রতি আক্রোশ সে আদর কে দিয়েই শোধ তুলবে? নাকি এমন রেষারেষির মধ‍্যে হঠাৎ করে অনুভূতি নামক ঝড় বয়ে যাবে পাষাণ হৃদয়ে?
চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here