মায়াবন বিহারিনী – পর্ব 07

0
248

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তম_পর্ব
১৭.
অদৃশ্য মানবীর‌ গলার স্বর নিয়ে চিন্তিত হতেই আর বসতে পারে না আবেগ। গানের সুর কর্নগোচর‌ হতেই তাতে ধীরে ধীরে বিমোহিত হয়ে পড়ে আবেগ। সুর অনুসরণ করে পাশে থাকা বড় গাছটার দিকে পা বাড়াতেই সুর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টত‌র হতে শুরু করে তার নিকট।
“মেঘের ওপর আকাশ উড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা,
মনে বন্ধু বড় আশা……
মেঘের ওপর আকাশ উড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড় আশা……..
যাও পাখি যারে উড়ে,,,
তারে কইয়ো আমার হয়ে,
চোখ জুড়ে যে দেখব তারে
মন চলে যায় অদূর দূরে!
যাও পাখি বলো তারে,,
সে যেন ভোলে না মোরে।
সুখে থেকো ভালো থেকো; মনে রেখ এই আমারে।”
আবেগ অন্যমনস্ক হয়ে গাছটার দিকে এগোতে থাকে ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই অজানা সুর তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। হঠাৎ শুকনো পাতার মধ্যে কারো পদধ্বনি শোনা যেতেই গুনগুন করা থামিয়ে দেয় উপমা। আশপাশে কেউ আছে নাকি? অতি সন্তর্পণে নিশ্চুপ হয়ে অপেক্ষা করে আগন্তুকের জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই হৈমন্তীর কথা মনে পড়তেই কিছুটা নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। একরাশ খুশি নিয়ে দ্রুত ভাঙা গাছের ডালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে হঠাৎ করে সেই অজানা সুর থেমে যাওয়ায় ধ্যান ভেঙে যায় আবেগের। সুর তো গাছের পেছন থেকেই আসছে। তবে কি পেছনে কেউ রয়েছে? আর থাকলেও কি তাকে দেখা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আবেগের নিকট?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার সামনে কোনো মানবী গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই হকচকিয়ে যায় আবেগ। সাথে করে সামনে থাকা মানবীও‌। হৈমন্তীর বদলে অন্য কাউকে মোটেও আশা করে নি উপমা। গোলগোল চোখে ভালো করে তাকাতেই বলিষ্ঠ যুবকের মুখশ্রী চেনা চেনা লাগে তার। মস্তিষ্কে একটু জোর দিতেই মনে পড়ে যায় সেদিনের ক্যাম্পে থাকা ডাক্তারের কথা। নামটা যেন কি ছিল? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আবেগ; এ ব্যক্তি তো আর কেউ নয় বরং ডক্টর আবেগ।
হুট করেই কারো সামনে এসে পড়াতে বেশ খানিকটা বিস্মিত হলেও পরক্ষণে মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায় আবেগ। কাজল কালো দুটো চোখ, চুলগুলো বেশ লম্বা এবং কোঁকড়ানো। কানের কাছে ছোট আকারের একটা পদ্মফুল গুঁজে রাখা। পড়নে‌ লাল পাড়ের শাড়ি; আঁচলটা কোমরে গুঁজে রাখা। ঠিক যেন গ্রামীণ কিশোরী। আবেগকে এভাবে নিজের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আবেগের দিকে,
– “এইযে ডাক্তার মশাই, এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতোন তাকাইয়া আছেন কেন শুনি? পলকও‌ দেখি ফেলতে ভুইলা গিয়েছেন।”
উপমার এমন প্রশ্নে কাশি উঠে যায় আবেগের। ছোট কিশোরী হলেও প্রশ্ন যেন তার বিরাট। কি উত্তর দিবে এখন সে? এই যে সে এতক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে মগ্ন ছিল। তার ভাবনার সুতো কাটে উপমার দ্বিতীয় প্রশ্নে।
– “কি হলো এখনো ভাবনার সুতো কাটে নাই বুঝি? আপনি তো দেখি আসলেই ভ্যাবলা কান্ত মশাই। বাহ্ জীবনে কোনো ডাক্তার ও ভ্যাবলা কান্তের খাতায় যোগ হবে ভাবি‌নাই।
তা এইখানে চুপিচুপি দাঁড়াইয়া কি করতেছিলেন‌ শুনি? কোনো রোগীর খোঁজে এসেছিলেন নাকি?”
– “না! আমি তো এখানে তোমার গান শুনে,,”
আর কিছু বলতে পারে না আবেগ। তার পূর্বেই তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিয়ে দেয় সে কি বলতে যাচ্ছিল। অন্যদিকে আবেগের মুখশ্রীর ভাব দেখে ফিক করে হেসে দেয় উপমা। প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেও পরবর্তীতে আবেগও‌ মৃদু হাসে তার নিজ কান্ডে‌।
১৮.
বসন্ত প্রায় শেষের দিকে। গাছের সব পাতা ঝরে পড়ার সূচনা ঘটেছে। সূর্যের প্রখর রৌদ্রতাপও দুপুর বেলা উপলব্ধি করা যায়। ক্যাম্পে আজ গত দিনের তুলনায় বেশ কম লোকজন ই উপস্থিত হয়েছে। সকাল থেকে বেশি ভীড়ভাট্টা‌ না থাকায় বেশ খানিক সময় পরপর দু একজন রোগীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। সকাল ৯:৩০ নাগাদ ক্যাম্পে এসে হাজির হয় আবেগ। সকালের ঘটনার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করে নি সে। এমন বিব্রতকর অবস্থায় আগে কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না তার।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ, আজ আপনার মুখশ্রী একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ত্রিমোহিনীর‌ আলো, বাতাস বোধহয় আপনাকে খুব ভালো করেই ছুঁয়ে দিয়েছে।”
সায়ানের কথায় প্রেসক্রিপশন থেকে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। প্রত্যুত্তরে মাথা নেড়ে বলে উঠে,
– “না ডক্টর সায়ান, ত্রিমোহিনীর‌ আলো বাতাস না বরং ত্রিমোহিনীর‌ কিছু স্মৃতি বোধহয় আমাকে খুব ভালো করে ছুঁয়ে দিবে। এখানের সবকিছুই যেন অদ্ভুত সুন্দর।”
সায়ানও‌ মুচকি হেসে তার নিজ কার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– “আচ্ছা বুবু অয়ন্তিকা মা কোথায়?”
কল পাড়ে বসে কাঁচা আমগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে ব্যস্ত ছিল উপমা। বাড়ির পাশের আম গাছটা অন্য সব গাছের চেয়ে ভিন্ন। নির্দিষ্ট মৌসুমের পূর্বেই সে গাছে মুকুল আসে এবং ফল ধরে। পেছন থেকে হঠাৎ পূর্ণার এ প্রশ্ন শুনে থেমে যায় উপমা। অয়ন্তিকার কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে তার। হাত পা ও ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
– “পূর্ণা তুই? এই সময় কল পাড়ে কি করছিস? কাইল না তোর পরীক্ষা; যা গিয়ে পড়তে বস।”
– “উফফ বুবু একটু আগেই তো তোর সামনে পড়া শেষ কইরা উঠলাম। আর তুই উল্টাপাল্টা জবাব দিচ্ছিস কেন? আমি তো জিগ্গেস করছি অয়ন্তিকা মা কোথায়? সে আমাগো সাথে থাকে না কেন?”
– “পূর্ণা তোরে কতবার বলব যে অয়ন্তিকা মারে নিয়া আমার কাছে কিছু জিগ্যেস করবি না। আমি সত্যিই জানি না অয়ন্তিকা মা কোথায়; দেখি আমারে যাইতে দে। ঘরে মেলা কাজ পইরা আছে।”
পূর্ণাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কল পাড় থেকে উঠে ঘরের দিকে চলে যেতে নিলেই উপমার আঁচল ধরে থামিয়ে দেয় পূর্ণা।
– “আমি জানি বুবু তুই সব জানিস। বল না অয়ন্তিকা মা কোথায়? আব্বা তারে কোথায় রাখছে?”
– “মইরা গেছে অয়ন্তিকা মা! হইছে? আর কিছু শুনবি? খবরদার এই ব্যাপারে আমারে আর কিছু জিগ্যেস করবি না।
কাইল তোর পরীক্ষা; ঘরে আইসা খাইয়া পড়তে বস।”
বলেই ভেতরের দিকে গট গট করে হাঁটা শুরু করে দেয় উপমা। অন্যদিকে উপমার এমন রূঢ় আচরণ পূর্ণার মনকে বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত করে তোলে।
১৯.
রক্তাক্ত লাশ। চারপাশের স্বচ্ছ পানি লাল বর্ণে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। দু তিন দিন পুরনো হওয়ায় তা থেকে মাংস পঁচা গন্ধ ছুটেছে তাও খুব বিশ্রীভাবে। লাশের আশপাশে যেন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গ্রামের কয়েকজন এসে সেই লাশ উঠানোর পর মুখশ্রী দেখানোর দৃশ্যপট মনে পড়তেই পুরো শরীর শিউরে ওঠে উপমার। কপাল বেয়ে দুশ্চিন্তার ঘাম ঝরছে অনবরত। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য মনে পড়লে তাই হবার কথা।
– “আচ্ছা উপমা বল তো প্রেম ভালোবাসায় মানুষ কি এমন পায়? কি লাভ এই প্রেম ভালোবাসার? দিন শেষে তো দুইটা মানুষ শুধু শুধুই কষ্ট পায়।”
উপমার সুক্ষ্ম ভাবনায় ছেদ পড়ে হৈমন্তীর প্রশ্ন শুনে। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? এর উত্তর কি আদৌ দেয়া সম্ভব? মিনিট কয়েক চুপ থেকে শীতল কন্ঠে উপমা জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আকাশ ভাইয়ের সাথে তোর আবার কথা কাটাকাটি হইছে তাইতো?”
উপমার প্রশ্ন শুনে হৈমন্তী গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই ছোট্ট করে শ্বাস নেয় উপমা। হৈমন্তী আর আকাশের সম্পর্ক ধরতে গেলে অদ্ভুত রকমের। কয়েকদিন পর পর কথা কাটাকাটি হলেই উপমার নিকট হাজির হয়ে উদ্ভট সব প্রশ্ন ছুঁড়ে বসে হৈমন্তী।
– “শোন হৈমন্তী প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা হইতাছে গিয়া একটু মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের মতোন। ব্যাপারটা উপভোগ না কইরা উপলব্ধি করতে হয়। আর যদি ভালবাসা একবার জীবনে আইসা পড়ে তাহলে এটা‌রে আর কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না।
তয় যদি কষ্টের কথা আসে সেটা নির্ভর করে দুইটা মানুষের উপর। তাদের একজনের প্রতি আরেকজনের বিশ্বাসের উপর।
আমি খুব ভালো কইরাই জানি তুই আকাশ ভাইরে ভালোবাসিস। আকাশ ভাই ও ভালোবাসে। এইসবের মাঝে টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়। ঐসব ব্যাপার না।”
উপমার কথার ভাবার্থ যে হৈমন্তী ঠিক বুঝতে পারে নি তা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
– “তোর কথায় মনে হইতাছে যে তুই জন্মের সময়ই কারো প্রেমে পইড়া গেছিলি আর তার তার সাথেও অনেক বছর কাটাইছিস। আজ পর্যন্ত প্রেম ভালোবাসার আশপাশে গেলি না অথচ জ্ঞানভাণ্ডার বিশাল এই বিষয়ে?
তুই ও কি তয় কারো প্রেমে পড়ছিস?”
হৈমন্তীর প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠল উপমা। অতঃপর হাসি থামিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে,
– “পড়িনি তো কি হইছে? একদিন আমিও কারো প্রেমে পড়ব। খুব কইরা পড়ব।কাউরে উজাড় কইরা ভালোবাসব। আর সেই মানুষটাও একান্তই আমার থাকব!”……………….
#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here