মায়াবন বিহারিনী – পর্ব 21(1)

0
206

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একবিংশ_পর্ব ( অন্তিম খন্ডাংশ-১)
৫৩.
মধ্যাহ্নের প্রহর গড়িয়ে অপরাহ্নে পড়েছে। সাথে করে সূর্যের তেজস্ক্রিয়তাও পশ্চিমে খানিকটা হেলে পড়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। ইফতেখার সাহেব সহ সকলেই গম্ভীর মুখে বিশেষ করে উপমা ইফতেখার সাহেবের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু আগে থেকে ইফতেখার সাহেবের মুখ থেকে যা যা শুনেছে তাতে ক্রমাগত অবাকই হচ্ছে সে। তাকে আরো একধাপ অবাক করে দিয়ে ইফতেখার সাহেব পুনরায় বলে উঠলেন,
– “তখন অয়ন্তিকা পোয়াতি। আস্তে আস্তে কইরা ছনের ঘর থেইকা টিনের ঘর হইলো। এই আশপাশের ভিটা জমিও তিন চারখান‌ নিজ আয়ত্তে আইলো। এইসব উন্নতি দেইখা তোর মা অয়ন্তিকা মনে করা শুরু করলো এইসব বুঝি তোর আগমনের কারণেই ঘটতাছে অথচ ঐ সময়ে আমি এইসব ব্যবসায় বহুত গভীরে জড়াইয়া গেছি। ব্যবসায় খালি লাভ ই হইতে শুরু করলো। হরিবাবুও ততদিনে এক দুর্ঘটনায় গত হইয়া গিয়াছেন। তয় সব ঠিকঠাক ই চলতাছিল‌; বিপত্তি ঘটলো তখনই যখন তোর বয়স এক বছর। চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়ন পত্রে যখন আমার নাম‌ উঠলো তখন এই গ্রামের সেই সময়ের মোড়ল নজরুল মোহাম্মদ আমার পেছনে লোক লাগায়। লোকখান‌ একটু বেশিই নাক গলাইয়া ফেলছিল আমারে নিয়া তাই সেই সমস্যা একদম গোড়া সহই উইপড়া‌ ফেলেছিলাম যাতে কইরা এই ক্ষমতার পথে কেউ বাধা না দিবার পারে। তয় ঐ যে কইলাম‌ অয়ন্তিকা বরাবরের মতো একটু বেশিই উৎসুক ছিল আমার ব্যাপারে। এই জন্যেই মাইয়া মাইনষের অত পড়ালেখা করান লাগে না। এরা অল্পতেই বেশি উড়ে। আর এই সামান্য পড়ালেখার জোরে অয়ন্তিকা ও তার চালাকি দিয়া আমার এইসব কাজের ব্যাপারে সব জাইনা যায় তখনই সেইটা তার জন্যে কাল হইয়া দাঁড়ায়।
মাইয়াডার‌ একটু বোকামির লাইগাই অল্প বয়সে প্রাণ হারাইতে হইলো। কি দরকার ছিল এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কইরা তা পুলিশের কাছে জানানোর? অয়ন্তিকা যদি এইডা না করত তাইলে আইজ তোর মা আর পুলিশ দুইজনেই বাইচা থাকত। কষ্ট লাগে মাঝেমধ্যে কিন্তু কি করমু বল? আমার কাছে আবার জানের আগে ঐ ক্ষমতাটাই একটু বেশি প্রিয়। ঐটারে আর চাইলেই কি হাতছাড়া করোন যায়?”
এবার যেন সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা উপমাই খায়। সজল আর আমেনা বেগমের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই যেন তারা সব আগে থেকেই জানে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে চিনতে আজ একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে উপমার। জন্মদাতা পরিচয় ছাড়াও যে তার পেছনে এত বড় ভয়ংকর, অমানবিক চরিত্র লুকিয়ে আছে‌ তা কল্পনাও করতে পারে নি সে।
– “তার মানে‌ সত্যি সত্যিই সেইদিন অয়ন্তিকা মাকে আপনে ঐভাবে‌ খুন করছিলেন?”
ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা। আখি যুগল অশ্রুসিক্ত তার। উপমার প্রশ্ন শুনে ইফতেখার সাহেব মোটেও অবাক হন নি কিংবা হকচকিয়ে যান নি। বরং নির্দ্বিধায় বলে উঠেন,
– “হয়, ঠিকই কই‌ছিস তুই! সেইদিন ঐভাবে‌ অয়ন্তিকার লাশটা আমিই ফেলেছিলাম ঐ নর্দমায়। সেইদিন রাইতেও‌ যখন তোর মা অয়ন্তিকা এইসব বিষয় নিয়া আমারে হুমকি ধামকি দিতাছিল‌ তখনও আমি তারে বুঝাইয়া গেছি যে না এইসব বললে লাভ হইব না। আর আমি যদি জেলেই চইলা যাই তাহলে দুই মা মাইয়ার‌ কি হবে। কিন্তু উড়ন্ত পাখি যখন হাতছাড়া হইয়া যায় তখন কি আর তারে খাঁচায় ফেরান যায়?
পানি বেশিদূর গড়াই‌য়া গেছিল। তাই ভাবলাম গোড়া শুদ্ধ সেই আগাছা উপড়ে ফেলা দরকার। তাইতো তোর মা যখন রাইত দুইটায় গভীর ঘুমে তলা‌ইয়া ছিল তখন আমার জমির ধান কাটার দা টাই কামে আইলো। অনেকদিন ধইরা ঘষামাজা হয়না দেইখা বেচা‌রির গলায় সেইটা চালানোর পর মুরগির মতো ছটফটাইতেছিল‌। তয় চিন্তা করিস না তোর মার কষ্ট দেইখা আমিও নিজেরে আর সামলাইতে‌ পারি নাই। তাই দ্বিতীয়বার সেইটা গলায় চালানোর মিনিট কয়েক বাদেই চাতক পাখি শান্ত হইয়া গিয়াছে। রাত গভীর হইতে শুরু করল, সাথে কইরা একজনের খু*ন হওয়ার কাহিনী, রহস্য ও! অবশ্য সকাল হওয়ার আগেই সবকিছু এমন ভাবে সাজানো হইছিল যে তাতে যে দেখব সেই বলব এ কোন সন্ত্রাসীর কাম। তয় আমার এই কামে অবশ্য সাহায্য করছিল সজলের বাপ হারুন। যাক মেলাখান কইয়া ফেলছি; এই আমেনা এক মগ ঠান্ডা পানি নিয়া আহো তো। গলাটা ভারী শুকাইয়া গেছে আমার!”
ইফতেখার সাহেবের বলতে দেরি আমেনা বেগমের ছুটতে দেরি নাই। অন্যদিকে উপমার পায়ের তলা দিয়ে যেন মাটি সরে গিয়েছে। অসাড় শরীরে প্রাণের সঞ্চার নেই বললেই চলে। একজন কি করে পারে ক্ষমতার লোভে পড়ে এত নৃশংসভাবে হত্যা করতে কাউকে। এসব ভাবতে ভাবতেই উপমার শরীর হিম হতে শুরু করছে। বাবা নামক শব্দটার প্রতি এখন আর বিশ্বাস নেই তার। এভাবে এক পর্যায়ে তার শরীর আর তার সায় দেয় না। মুহূর্তেই হাঁটু গেড়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে উপমা।
৫৪.
মিনিট পাঁচেক পরেই আমেনা বেগম পানি ভর্তি মগ নিয়ে এসে ইফতেখার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতেই ইফতেখার সাহেব সেটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটুকু পানিই খেয়ে নেন। উপমার এমন করুণ শোচনীয় পরিস্থিতি আমেনা বেগম আড়চোখে তাকিয়ে পৈশাচিক হাসি দেন যেন ঘটনাটি তার কাছে বেশ মুখরোচক।
– “কিন্তু ক্ষমতার জোরে আর কতদিন এভাবে মানুষ খুন করতে থাকবেন চেয়ারম্যান সাহেব? আপনার কি মনে হয় না যে আপনার এবার সেই সব রহস্য হাঁটে হাঁড়ি ভাঙতে চলেছে?”
হঠাৎ করেই পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বেশ নড়েচড়ে উঠেন ইফতেখার সাহেব। সাথে উপমাও। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করেন সেদিনের মত আজও কন্সটেবল আলী সহযোগে দাঁড়িয়ে আছেন অফিসার আমান। কই আজ তো তাকে কোন খবর দেয়া হয়নি তাহলে সে এখানে কি করছে? তবে কি উপমাই কোনোভাবে অফিসার আমানকে খবরটা দিয়েছে? মনে মনে এসব ভাবলেও মুখশ্রীতে কোনো চিন্তার ছাপ নেই ইফতেখার সাহেবের। তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠেন,
– “আরে অফিসার সাহেব আপনে? তো হঠাৎ কইরা আমার বাড়িতে? আর কি সব বলতেছেন খু*ন খারাবি‌ নিয়া? এই আমেনা বড় সাহেব গো লাইগা দুই কাপ চা আনো কড়া লিকার দিয়া!”
ইফতেখার সাহেবের কথানুযায়ী চুপচাপ ভেতরে চলে যান আমেনা বেগম। সব ঠিকঠাক থাকলেও সজলের মুখশ্রীতে হালকা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে যা ওতটা‌ স্পষ্ট নয়। অফিসার আমান ও মুচকি হাসলেন। অতঃপর ভেতরে প্রবেশ করে একবার উপমার দিকে তাকালেন। মেয়েটার উপর যে একটু আগেই বেশ খানিক অত্যাচার হয়ে গিয়েছে তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমান সাহেব সামান্য গলা খাঁকারি দিলেন।
– “অতিথি আপ্যায়ন আপনার করতে হবে না চেয়ারম্যান সাহেব। দেখুন না আমরাই আপনার অতিথি আপ্যায়ন করতে চলে এসেছি। তো এখন কি আপনি আমাদের সাথে সোজাসুজি চলবেন নাকি,,?”
অফিসার আমানের পুরো কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ইফতেখার সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
– “কি কইতে চাইতাছেন‌ অফিসার সাহেব? যা কইবেন তা সরাসরি বইলা ফেলেন।”
– “এটাই যে একটু আগেই আপনার সব অপরাধের স্বীকারোক্তি এই রেকর্ডারে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আজকে সকালে নদীর পাড়ে আপনার আর সজলের মাদকদ্রব্য মালামাল পরিবহনের ভিডিও ফুটেজ ও রয়েছে। এত এত প্রমাণ থাকতেও আপনার আপ্যায়ন কিভাবে না করি চেয়ারম্যান সাহেব? তাইতো আর বিলম্ব না করে চলে আসলাম আপনার কাছে। কন্সটেবল‌ আলী, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন যান গিয়ে আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবকে অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিয়ে চলুন।”
অফিসার আমানের কথা শুনে উপমা চমকালেও‌ ইফতেখার সাহেব বোধহয় একটুও চমকাননি‌। তার ভাবমূর্তি দেখে মনে হচ্ছে তিনি এমন কিছু হওয়ারই আশা করেছিলেন। অন্যদিকে উপমা গোল গোল চোখে অফিসার আমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক সেদিন পথিমধ্যে তার দোয়া কবুল হয়ে গিয়েছিল আর অফিসার আমানের সঙ্গে ও তার দেখা হয়েছিল। আর সেদিনই অফিসার আমানকে তার দেখা ও শোনা সবটুকুই খুলে বলে উপমা। এটাই যেন ইফতেখার সাহেবের প্রতি সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল অফিসার আমানের নিকট।
৫৫.
এ পর্যন্ত বলা অফিসার আমানের কথাগুলো শুনে তাচ্ছিল্য হাসলেন ইফতেখার সাহেব যা কিছুক্ষণ পরেই অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হলো। আমান সাহেব তার এ উদ্ভট আচরণের কারণ খুঁজে পাননি।
– “আমারে আপনার কি মনে হয় অফিসার সাহেব? আমারে কি এতটাই বলদ মনে হয় যে আমি এত সহজেই আপনের কাছে ধরা দিমু? ইশ্, আপনে তো দেখি মস্ত বড় ভুলে ডুইবা আছেন।
আপনে কি কইরা ভাবলেন যে আমি আমার ক্ষমতার খেলায় এত সহজেই সবকিছু হাতছাড়া কইরা দিমু? এইসব খেলায় মাথা খাটাইতে হয় বুঝলেন; এইসব ছবি, ক্লিপ, শব্দ আমার কিছু করতে পারব না। আর ধরলাম পারলো ও। কিন্তু আমার খেলায় যে একটা গুটির আয়ু একদমই শেষ, তাইনা উপমা?”
শেষো‌ক্ত কথাটির ভাবার্থ বুঝে উঠলো না উপস্থিত কেউই। বাহিত হলো মিনিট কয়েক। উপমার চঞ্চল চোখ খুঁজল চারদিকে কাউকে। হ্যাঁ, মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কের সব নিউরনগুলো‌ জাগ্রত হয়ে উঠলো। পূর্ণা, মেয়েটা কোথায়? আশেপাশে তো তাকে দেখাই যাচ্ছে না।
– “পূর্ণা কোথায় আব্বা?”
ধাতস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা।
– “এইজন্যই তো তোরে বুদ্ধিমতি বলি উপমা একদম অয়ন্তিকার মতন। দেখ কেউ না বুঝলেও তুই ঠিক বুইঝা ফেললি।”
– “কথারে ঘুরায় প্যাচায়েন না, আব্বা! পূর্ণা কই? ওরে কই লুকায় রাখছেন?”
– “আমি যদি বইলাই দেই তাহলে খেলা জমব কি কইরা? পারলে খুঁইজা নে পূর্ণারে। সময় মাত্র পনেরো মিনিট।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে উপমার। ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে আজ। অফিসার আমান মুহূর্তেই তার গান বের ইফতেখার সাহেবের দিকে তাক করেন,
– “চেয়ারম্যান সাহেব, ভুল করেও কিছু করার চেষ্টা করবেন না। চুপচাপ বলুন পূ‌র্ণা কোথায়? কি করেছেন আপনি তার সাথে?”
– “আহা অফিসার শান্ত হও। এত চিন্তা শরীরের জন্য ভালা না। আর ঐসব দেখাইয়া লাভ নাই। তার চেয়ে বরং তুমি এইটা দেখ।”
বলেই সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট আয়তকার রিমোট বের করলেন ইফতেখার সাহেব। অফিসার আমানের দেখে আর বেগ পেতে হয় না ইফতেখার সাহেব কি করতে চলেছেন।
– “এইযে এইটা কি দেখতাছ? একটা পুরো জান আমার হাতে। যদি এখানের লাল বাটনে আমি একবার ভুল কইরা চাপ দেই তাহলে ঐ পনেরো মিনিট ও থাকব না পূর্ণার জীবনে। সব বুমম হইয়া যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় উপমার। কোনো বিলম্ব না করেই যে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে অফিসার আমানের কথা ভেসে আসে,
– “উপমা ভেতরে যেও না, ভেতরে বোমা আছে। সেগুলো যেকোনো সময় ফেটে যেতে পারে।”
কিন্তু সেগুলো আর উপমার কর্ণগোচর হলো না উপমার। সেসব না শুনেই সে ছুট লাগালো ভেতরের দিকে। প্রথমেই নিজের ঘরটাতে ভালোভাবে পরখ করে নিল সে। পুরো আনাচে কানাচে খুঁজেও পূর্ণার হদিস পেল না। একে একে ইফতেখার সাহেবের রুম থেকে শুরু করে সবটাই খোঁজা শেষ প্রায়। কিন্তু পূর্ণা কোথায়? তাকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা এমন কোথাও কি আছে যেখানে পূর্ণাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? একেতো সময় নেই তার উপর মাথা কাজ করছে না উপমার। এভাবে ভাবতে ভাবতেই তার চোখ পড়ে বেশ কয়েক বছর পুরনো একটা ছোট পকেট রুমে। অয়ন্তিকা মাঝেমধ্যে এখানেই সময় কাটাত। তবে তার মৃত্যুর পর সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাতপাঁচ না ভেবেই সে এগিয়ে রুমের দিকে।……………..
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here