#অবুঝ_প্রেম
পর্ব ৬
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
আমার ভয় পাওয়া দেখে সবাই হাসছে কেন বুঝলাম না। মা আমার নাকে এবং মুখের চারিপাশে আঙুল দিয়ে তারপর আমাকে চোখ খুলতে বলে। যেহেতু পাশে সবাই আছে তাই সাহস করে পিটপিট করে চোখ খুলে দেখি মায়ের আঙুলে চকলেট লেগে আছে। কোন কিছু না ভেবেই বলা শুরু করি,
মা তুমি তাহলে আমার পড়ার ফাঁকে চকলেট খেয়ে ঠোঙা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছো?
মা ইয়া বড় চোখ বের করে বলে,, আমি খায় নি,, তুমি নিজেই খাইছো পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলে হয়তো তাই ভুলে গেছো। এই দেখো তোমার মুখে নাকে চকলেট লেগে আছে। আর আয়নাতে ভুত নয় তোমাকেই দেখেছো!!
আমি মাথা চুলকিয়ে ভাবছি,, কখন খেলাম এতো চকলেট টেরও পেলাম না,, ভাবা যায়!!
তুর্জ ওর ল্যাপটপের ব্যাগ টা ধপাস করে সোফার উপর ফেলে দিয়ে বলে,,,
তোমরা কি এর পরেও বলবা,, মেয়েটার মাথায় কোন গন্ডগোল নাই??ভাবতে পারো কতটা পাগল হলে নিজেকে নিজেই ভুত ভাবতে পারে??
মা ধমকের সুরে বলেন,, তুই চুপ করবি? সব সময় মেয়েটার দোষ খোঁজা তোর বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মেয়েটা কত্ত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ভেবে দেখছিস, পড়াশোনাতে এতো মন দিয়ে ছিলো যে অন্য কিছু সে খেয়াল করে নি। আর বিভিন্ন জ্ঞানীগুনী মনীষীদের জীবনি পড়ে দেখিস,, বুঝবি,, উনারা সবাই এমন উদাস মনের ছিলো।
মায়ের কথা গুলো শুনে মনে মনে আমি সপ্তম আসমানে উড়াউড়ি করছি আর তুর্জ প্যাঁচার মতো মুখ করে ওয়াশরুমে চলে গেছে। মা ময়না সবাই চলে গেছে। আমি ভাবলাম,, এখন থেকেই স্বামী সেবা শুরু করা উচিত। উনি ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে, কপালে উপর ছোট্ট ছোট্ট ভেজা চুল দেখে আমি টাসকি খেয়ে গেলাম। আমি বিছানা থেকে নেমে উনার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি পুরো স্ট্যাচু হয়ে গেছে। উনি এতো লম্বা যে আমার ঠোঁট উনার বুকের কাছে। যদি কিস করতে চাই তাহলে পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হতে হবে। আমাকে উনার এতো কাছে আসতে দেখে তুতলিয়ে বলে,ককি–করতে তাওওও!!! ঠিক তখনই আমি উনাকে কদমমুছি করে ওয়াশরুমে দৌড় দিলাম ।
চকলেটের সাথের ক্রিম গুলো মুখের উপর তেলের মতো লেগে গেছে। পাশে থেকে ফেসওয়াশটা নিতে গিয়ে কি যেন নিচে পরে গেলো। এতো কিছু দেখার সময় নাই ভেবে ফ্রেশ হয়ে যেই না বের হতে যাবো অমনি চিৎপটাং। ওওবাবাগো মাগোওওওও ওওআল্লাহরেএএ কেউ আমাকে বাঁচান, আমি মনে হয় জমের ঘরে আছি গোওও,,,,,,,
এই ফকিন্নি তোমার প্রব্লেম টা কি? সব সময় এমন চিল্লানোর উপর থাকো কেন?
আমি আহত আর আপনি আমাকে এভাবে বকা দিচ্ছেন। প্লিজ আমাকে তুলুন আমি উঠতে পারছিনা। সাবানে পা দিয়ে পিছলে গেছি।
উনি আমাকে তোলার জন্য কাছে আসতেই, উনিও সাবানে পা দিয়ে আমার উপর পড়ে গেলেন। এতো বড় প্রাণী এমন স্পীডে আমার মতো মশার উপর পড়লে ভর্তা হয়ে যাবো ভেবে, তৎক্ষনাৎ হাত উঁচু করে আটকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু বিষয় টা হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। মহব্বত আলির ঠোঁট অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমার বুকে স্পর্শ করে আর আমার হালকা বড় নখ উনার চোখে নিতে আঁচড় লেগে যায়। উনার চুল গুলো আমার মুখের উপর,, স্মেইল টা অসাধারণ। মাত্র ৪/৫ সেকেন্ডের আকস্মিক ঘটনায় লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছি। উনি আমাকে ছেড়ে খুব তারাতাড়ি বেরিয়ে যান।
কিভাবে উনার সামনে যাবো, কিভাবে উনার সাথে কথা বলবো এইসব ভাবতে ভাবতে কোন রকম বাইরে চলে আসি। লজ্জায় স্বামী সেবা তো দূরের কথা উনার মুখোমুখি হতে পারছিনা।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুল ড্রেস পড়ে নাস্তা করতে আসছি। মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর তুর্জকে বললেন, যাওয়ার সময় সারা কে ওর স্কুলে পৌঁছে দিবে এবং মাস্টারের সাথে এই বিষয় গুলো জানিয়ে আসবে। যেন কেউ সারা কে নিয়ে কটুক্তি করতে না পারে।
কিন্তু মা!! আমার অফিস তো অন্য দিকে,, উল্টো হয়ে সারা কে স্কুলে দিতে গেলে আমার দেরি হয়ে যাবে।
আচ্ছা তুমি কি ভুলে গেছো! তুমি অন্যের কোম্পানিতে জব করো না। তুমি নিজেই কোম্পানির মালিক। তাই দেরি করে গেলেও কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না।
কিন্তু ম,,,,,
আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে নাও। সারা মামুনি,, তুমি ধিরে ধিরে খাও।
উনি না খেয়ে উঠে চলে গেলেন,, তারপর ২ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গাড়িতে বসে বারবার হর্ন দিচ্ছেন। আমার এতো তাড়া কিসের তাই,, আমি আস্তে আস্তে খেয়ে ধিরে ধিরে বাইরে গেলাম।
উনার পাশের সিটে বসবো ভেবে যেতেই, কর্কশ গলায় বললেন,, চুপচাপ পিছনে গিয়ে বসো। একটা শব্দ ও করবা না।
এমন রাগী ভাবে প্রথম আমার সাথে কথা বলাতে বেশ ভয় পেয়ে পিছনে বসলাম। তারপর গাড়ি স্টার্ট করার কিছুক্ষণ পরেই একটা মোড়ে থামিয়ে উনি কাউকে বারবার ফোন করে যাচ্ছেন। উউফফ বিরক্ত লাগছে এভাবে বসে থাকতে, কেন এবং কার জন্য অপেক্ষা করছেন কিছু জানি না বলে বিরক্তের মাত্রা দ্বিগুন হয়েছে।
অবশেষে একটা ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়ে সেই সুন্দরী মেয়ে, যাকে রাস্তায় এবং ওইদিন রাতে বমন করার পরে দেখেছিলাম, সেই মেয়েটা আসে।তুর্জ মেয়েটাকে দেখা মাত্র বাইরে বেরিয়ে এসে huge করে। এই মুহূর্তে নিজেকে কন্ট্রোল করা টা আমার পক্ষে সম্ভব না। তবুও চুপ করে থাকলাম। মেয়েটা গাড়িতে উঠার সময় আমাকে দেখেই, তুর্জকে জিজ্ঞেস করে।
এর মানে কি তুর্জ?? এই মেয়েটা তোমার সাথে কেন?
প্লিজ রাগ করো না,, আগে সবটা শোন তারপর যদি রাগ করার হয় তাহলে রাগ করো।
তারপর তুর্জ সব কিছু বলে দিলো। কিন্তু সবার সামনে আমাকে তুর্জের wife পরিচয় দিতে আপত্তি করে মেয়েটার।
তুর্জ বললো, আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমি গিয়ে সবাইকে এমনই বুঝিয়ে আসবো তাও অন্তত আর রাগ করো না প্লিজ।
চোখের সামনে নিজের সব চেয়ে প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সাথে এইভাবে কথা বলা দেখাটা এতো যন্ত্রণার তা আগে কখনো বুঝিনি। দুজন পাশাপাশি সিটে বসে তুর্জের কাঁধে মেয়েটা মাথা দিয়ে আছে। সামনের লুকিং গ্লাসে দেখলাম,, তুর্জ আমাকে দেখছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই তুর্জ চোখ সরিয়ে নিলো।
স্কুলে আসার পরে তুর্জ আর ওই মেয়েটা পাশাপাশি হাটছে আর আমি পিছনে। আমাকে আর আমার সাথে তুর্জকে দেখার সাথে সাথে তুতুল, মিঠি, রাহুল, শিমুল সহ আরো সবাই আমার কাছে আসে। আমাদের ম্যাম হয়তো কোন ক্লাসে যাচ্ছিলেন, তিনিও আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি উনাকে সালাম দিয়ে কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করলাম। ম্যাম সালামের জবাব দিয়ে, আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
কি ব্যাপার আদিবা? সাথে উনি কেন?
আসলে ম্যাম, আমাদের বিয়ে হয়েছে গত দুই দিন আগে। উনি চান আমার পড়াশোনা কন্টিনিউ রাখতে। তাই আমাকে যেন কেউ কিছু না বলতে পারেন সে জন্য উনি এসেছেন। কি গো, চুপ করে আছো কেন? বলো ম্যাম কে সব কিছু?
হঠাৎ আমার এমন কথায় মহব্বত আলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। তাই আমতা আমতা করে বলে,,
জ্বী ম্যাম,, আদিবার সাথে আমার কোন রকম সম্পর্ক ছিলো না। জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাতে গিয়ে, আসল কালপিট গুলো আমাদেরকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সামাজিক দিক থেকে আদিবা এবং তার ফ্যামিলি বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাই আদিবাকে সামাজিক মর্যাদা দিতে বিয়ে করেছি। আশা করি, সবাই বিষয় টা মাথায় রাখবেন।
ম্যাম চলে যাওয়ার পরে,, তুতুল আর মিঠি আমাকে জরিয়ে ধরে। আমি ওই মেয়েকে দেখিয়ে দেখিয়ে তুর্জের হাত ধরে বলি,,
জানো,,এর নাম তুতুল আর এ মিঠি, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর বেবিরা!! এইযে এই হ্যান্ডসাম লম্বু মহব্বত আলি থুক্কু তুর্জ তোদের একমাত্র জিজু। যা ইচ্ছে ট্রিট নে তোরা। আমার লক্ষি বর টা অনেক দুষ্টু রে,,ঠিক তোদের মতো হিহিহিহি।
আমার এইসব বলতে দেরি কিন্তু ওই মেয়েটার হনহন করে যেতে দেরি নাই। আমি তুর্জের হাত ছাড়ছি না। তুর্জ যদিও চেষ্টা করছে ছাড়ানোর কিন্তু সবার সামনে বেশি জোর করতে পারবে না তাই এই সুযোগ টা কাজে লাগালাম।
ক্লাসের সময় হয়ে গেছে তাই তুর্জকে বললাম, আমাকে যদি আপনি নিতে না আসেন তাহলে আমি এখান থেকে এক ধাঁপও নড়বো না। তুর্জ আমাকে চোখ রাঙানি দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে, তুমি ভাবলে কিভাবে এর পরেও এই তুর্জ তোমাকে নিতে এখানে আসবে?? জাহান্নামে যাও তুমি,, যা ইচ্ছে করো,,তোমাকে করুনা করাটা আমার বেশি হয়ে গেছে। আমার জীবন টা তুমি শেষ করে দিয়েছো। তোমাকে যতটা ছোট দেখায় তুমি আসলে ততটা ছোট না।
অনেক দিন পরে স্কুলে আসাতে খুব ভালো লাগছে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কখন সময় শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারি নি। সবাইকে বিদায় দিলাম, তুর্জ আমাকে নিতে আসবে বলে। কিন্তু বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তবুও তুর্জের আসার নাম নেই। মনের মধ্যে জিদ চেপে ধরে, তাই এক চুলও না নড়ে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মধ্যে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন কার জন্য অপরের করছি কিন্তু আমি তাদের কোন উত্তর দিইনি।
কয়দিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে হতেই ভয় জেকে ধরে আমাকে। আমি স্কুলের ওয়ালের পাশে গা ঘেঁষে চুপিচুপি বসে আছি যেন কেউ আমাকে দেখতে না পাই। সেই সকালে খেয়েছি, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত কিচ্ছু খায়নি। প্রচুর খিদা পেয়েছে। অন্য দিন রাগের চেয়ে খিদার যন্ত্রণা বেশি হতো কিন্তু আজ রাগ আর জিদ টা বেশি হচ্ছে।
অন্য মেয়ের জন্য তুর্জ বারবার সরি বলে, তার মন রক্ষার্থে কত কি করে। আর আমাকে নাকি শুধু করুনা করে। কে চেয়েছিলো উনার এই করুনা। তখন তো একটি বদনাম ছিলো আর উনার এই করুনা নামক বিয়ের জন্য দুটো বদনাম হবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে চারিদিকে অন্ধকার ঘন হতে থাকে।
চলবে,,,,,