বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ) – 06

0
181

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৬
উঠোনের মাচার উপর বসে আছেন সমির বাবু। সময়টা তখন রাতের প্রথম প্রহর। ছায়া রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে সমির বাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সমীর বাবুর তখন চিন্তিত মুখ। ভাবুক হয়ে কী যেন ভাবছেন। ছায়া গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“নেও, খাবারটা।”
সমির বাবু কী নিয়ে যেন একটা গভীর ভাবনায় ছিলেন। ছায়ার কথায় তার ধ্যান ভাঙলো। ধ্যান ভাঙতেই মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো শব্দ হলো। এতে ছায়া চোখ মুখ কুঁচকালো। কিছুটা ব্যস্ততা মিশালো কণ্ঠে বললো,
“কী গো? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
“না না, তেমন কিছু না।”
ছায়া আর কিছু বললো না। থালাটা সমির বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার দ্রুত ভঙ্গিতে রান্না ঘরে গিয়ে বসলো। চুলায় ডাল গরম করছেন। ডালের মাঝে চামচ নাড়াতে নাড়াতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শুনছো, একটা কথা ছিলো।”
সমিরবাবু ভাতের লোকমা টা মুখে নিতে নিতে বললেন, “হ্যাঁ বলো।”
“পদ্ম’র ব্যাপারে কী ভাবলে? একবার তো বিয়ে ভাঙলো, আর কী চেষ্টা করবে না?”
সমির বাবুর ভাতের থালে থাকা হাতটা আপনা-আপনিই থেমে গেলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে চাইলেন স্ত্রীর দিকে। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“মেয়েটার বয়স আঠারো হবে না যেন হলো হলো ভাব। এমন উঠেপড়ে লেগেছো কেন বুঝি না।”
ছায়া কিঞ্চিৎ খেপে উঠলো। কণ্ঠও আরেকটু উঁচু করে বললেন,
“আজকাল যুগ ভালো? বাগানে কত কিছু হচ্ছে। কখন কী খারাপ হয় সেটার কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? তোমার তো কেবল মেয়ে মেয়ে। যতোসব আহ্লাদী পনা।”
সমিরবাবুও বোধহয় খানিকটা রেগে গেলেন। হাতের হালটা ছুঁড়ে ফেললেন সুদূরে। মাটিতে পড়ে স্টিলের থালাটা ঝনঝন শব্দ করে উঠলো। যে শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পদ্ম,পত্র ও পুষ্প। সমির বাবুর হাতের রগ কিঞ্চিৎ ফুলে উঠেছে ততক্ষণে। চোখের ভেতর সাদা অংশটায় দেখা দিয়েছে লাল লাল সরু কিছুর আভা। সে মাচার পায়ে বেশ বড়সড় এক লাথি দিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বললেন,
“তোমার ঠিক সমস্যা টা কোথায় শুনি? কী কারণে তুমি এমন পাগলের মতন আচারণ করো? যখন যা ইচ্ছে তা-ই সকলের মাথায় চাপিয়ে দিতে চাও। তোমার সিদ্ধান্তই কী সব! আমার মেয়েদের জীবন কিছু না?”
ছায়া স্বামীর এই শক্ত-পোক্ত চোহারার আদল দেখে বোধহয় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কোনো মতে উচ্চারণ করলেন,
“আমি তো ভালোর জন্য ই বলেছিলাম।”
“রাখো তোমার ভালো। এ কেমন ভালো, যে অন্যের হাসি কেড়ে নেয়।”
সবাই কেবল নীরব রইলো। ছায়াও আর মুখে মুখে তর্ক করলেন না। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ছায়া, একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“হয় বিয়ের ব্যাপারে কথা শুরু করবে, না-হয় আমাকে চিরতরে হারাবে। বাকিটা তোমাদের ব্যাপার।”
“মা!”
পদ্মের চোখে-মুখে বিস্ময়। সাথে বিস্ময় পত্র ও পুষ্পের চোখমুখেও। ছায়া আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না। ছুটে গেলেন নিজের ঘরে এবং শক্ত হাতে দোর দিলেন। সমিরবাবু যেন মুহূর্তেই স্তম্ভিত ফিরে পেলেন। ধপ করে বসে পড়লেন মাচার উপর। যে যার মতন নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন। কেবল পত্র ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তার বাবার দিকে। সে রাতে বাবা মেয়ে অনেকটা সময় চুপচাপ বসে রইলো। পত্র বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, বাবার আজ সঙ্গী দরকার। তাই সে ই হলো নিশ্চুপ সঙ্গী টা।
_
পরেরদিন ভোর হলো। কাক ডাকলো, সূর্য উঠলো, আকাশে ভেসে বেড়ালো তুলোর মতন মেঘেরা। কিন্তু ছায়া দরজা খুললেন না, শব্দ করলেন না। সমির বাবু মাচার মাঝেই ঘুমিয়ে রাত কাটালেন। বুকে জমে গেলো ঠান্ডাদের উৎসব। ভোর হতেই শুষ্ক কাশির দেখা মিললো। পত্রও কিছুটা আধো ঘুম, আধো জাগরণের মাঝে রাত্রি যাপন করলো। সকাল হতে হতেই উঠোন পরিষ্কার করে চা বসিয়ে দিলো চুলায়। বাবাকে চা মুড়ি দিয়ে, ভাত চড়িয়ে দিলো। সমির বাবু স্নান করে রোজকারের মতন কাজে চলে গেলেন। যেমন সাদামাটা চলে নিত্যদিন, ব্যস্ততার আবরণে ঠিক তেমনই সাদামাটা গেলো এই দিনটাও।
বিকেল হতেই পত্র পুকুরে গেলো কলসি ভরে জল আনার জন্য। কলসি ভরে জল নিয়ে ঘাটে উঠতেই দেখা মিললো আতসের। চোখে মুখে লেপ্টে আছে তার মায়া মায়া হাসি। এক বিশাল মোহনীয়তা। পত্রও আতসের হাসির পরিবর্তে ফিরিয়ে দিলো হাসি। আতস দু’কদম সামনে এগিয়ে এলো, বেশ মিষ্টি করে শুধালো,
“আছো কেমন?”
“বেশ ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো। তা আজকাল তোমার যে দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপার কী?”
“খোঁজ নিলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়, আমি তো সামন্য মেয়ে।”
পত্রের সুচালো কথায় আতসের ডান ভ্রু আপনা আপনি উপরে উঠে গেলো, বেশ প্রশংসার স্বরে বললো,
“ঈশ্বর আর মানুষের মাঝে এখানেই তো পার্থক্য। ঈশ্বর ব্যাথা বুঝেন কিন্তু মানুষ তা নয়।”
আতসের কথার বিপরীতে পত্র খিলখিল করে হেসে উঠলো। বেশ ঠাট্টা করেই বললো,
“যে ব্যাথা দেয়, তারও বুঝি ব্যাথা লাগে?”
পত্রের হেয়ালি কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো আতসের। সে যেন কিছু একটা আঁচ করতে গিয়েও করতে পারলো না। কেবল সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“ব্যাথা দিয়েছি! কাকে?”
“আরে মজা করেছি। তা চা বাগানে আপনাদের কিসের প্রজেক্ট যেন!”
“ঐ তো একটা কারখানা তৈরী করার। ও কিছু না। বুঝবে না তুমি।”
আতসের কণ্ঠনালী স্বাভাবিকের তুলনায় কাঁপছিল। মিথ্যা বলার সময় যেমন অন্যান্য মানুষের কাঁপে, ঠিক তেমন। পত্রের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক অব্দি সে কম্পন্ন ঠিক ধরা পড়লো কিন্তু সে আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলো না। বাঁকা হেসে বললো,
“সত্যিই, ওসব শহুরে ছলচাতুরী আমাদের বোঝার সাধ্য নহে।”
আতস হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তন্মধ্যে কোথা থেকে যেন হুড়মুড় করে নভ চলে এলো। মাথায় একঝাঁক চুল, সাদা পাঞ্জাবি পড়নে। বেশ গুছানো হাবভাব। এসেই বলিষ্ঠ হাতে ছোটো চ/ড় লাগালো আতসের পিঠে। ব্যস্ততা মাখা কণ্ঠে বললো,
“এখানে কিরে শা° লা। চল তাড়াতাড়ি।”
“আমি আসছি, তুই যা।”
আতসের কথাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না নভ। কেবল ব্যস্ততা, তাগা দিতে লাগলো। অতঃপর এক পর্যায়ে আতস না পেরে চোখের ইশারায় পত্রকে কিছু বলেই ছুট লাগালো নিজের গন্তব্যে। আতসের পিছে ধীর গতিতে নভও পা বাড়াতে নিয়ে আবার থেমে গেলো। পিছে ঘুরে পত্রের পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। চারপাশে নিরেট নিশ্চুপতার দেয়ালকে ভেদ করে বললো,
“চুল গুলো আমার প্রিয় ছিলো।”
_
আরও একটা নিকোষ কালো রাত নামলো প্রকৃতির বুক চিরে। দূর হতে খেঁক শিয়ালের ডাক রাতটাকে দিয়েছে গা ছমছমে রূপ। ঠাকুর বাড়ির জেঠা মশাই এর আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাহিরে তখন ভরা জ্যোৎস্না। সচারাচর বর্ষাকালে রূপসী চাঁদ থাকে না। তাই জ্যোৎস্নারও আমরা দেখা পাই না। তবে আজ ব্যাপার টা ভিন্ন। আজ চারদিকে কেমন আলো আর আলো। জেঠামশাই মানে দুলাল ঠাকুর নিজের খাট ছেড়ে উঠে বসলেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। ছেলেটা মা রা যাওয়ার পর থেকেই ঘুম হয় না তেমন৷ যার জন্য সে বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচে তাদের উঠোনে তাকাতেই তার শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো। লাল শাড়ি পড়ে বধূবেশে বসে আছে কেউ। পায়ের নুপুর জোড়া বাজছে কী মিঠে শব্দে!
দুলাল ঠাকুর তৎক্ষনাৎ নিচে নেমে এলেন। এ শাড়ি, এ নুপুর জোড়া যে তার বড্ড চেনা। নিচে নামতেই দেখে নারী অবয়বটা আগের জায়গাতেই ঠাঁই বসে আছে। নেই কোনো নড়চড়। দুলাল ঠাকুর যেন বরফ হয়ে গেলেন জমে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“কে?”
নারী কণ্ঠটা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
“আমায় ক্যান ভালোবাসলা না?”
#চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here