বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ) – 09

0
160

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৯
ভর সন্ধ্যা বেলা পত্রদের অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ বাড়িটাই হাজির হলো পত্রদের সবচেয়ে প্রিয় পরেশ মামা। দুই হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি নিয়ে গমগমে আয়োজনে হাজির হয় সে। তার উপস্থিতি অনুষ্ঠান বাড়িটাকে আরও দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসিত করে তুলে। মুহূর্তেই সবাই ভুলে যায় কিছুক্ষণ আগের হৈচৈ এর কথা। পত্র তো মামাকে দেখেই তীব্র বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আনন্দের সাথে বলে,
“কবে আসলা মামা সদর থেকে? তোমারে অনেক মনে পড়েছে।”
ভদ্রলোক মিষ্টির হাঁড়ি গুলো ছায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাসিখুশি কণ্ঠে জবাব দেয়,
“এইতো আজই এলুম। তোদের ছাড়া কী আমার মন টিকে সেখানে বল? তাই চলে এলাম।”
পুষ্পও খুশি হয়ে রান্নাঘরের দরজা থেকে নেমে মামার কাছে আসে, মিষ্টি কণ্ঠে শুধায়,
“কেমন আছো, মামা?”
“ভালো আছি, মা। তুই কেমন আছিস?”
প্রশ্ন করতে করতে পুষ্পের মাথাও আদুরে হাত বুলিয়ে দেয় সে। পুষ্প মাথা দুলিয়ে বলে,
“ভালো আছি, মামা। আসো ভেতরে।”
পুষ্পের কথায় পত্রও মামাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। জায়গা দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ মামা, আসো ভেতরে। কতখানি রাস্তা এসেছো। আসো আসো।”
ভদ্রলোক প্রাণখোলা হাসি দিয়ে উঠোনে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে বসলো। তন্মধ্যে পুষ্প জল এনে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলো লোকটার পানে। পরেশ জলটুকু নিয়ে তৃপ্তি মনে খেলো। অতঃপর ছায়ার দিকে তাকিয়ে বেশ প্রশংসার স্বরে বললো,
“কী ব্যাপার ছায়া? পুষ্প মা দেখি বড়ো হয়ে গেছে কয়েক মাসে! আগে তো দৌড়ে গিয়েই সদর থেকে কী উপহার এনেছি তা দেখার জন্য ছটফট করতো কিন্তু আজ! আজ তার রূপ একেবারেই ভিন্ন যে!”
পুষ্প খানিক লজ্জা পেলো বোধহয় মামার ঠাট্টায়। ছায়াও নরম হেসে বললো,
“বড়ো হচ্ছে তো, বুদ্ধি-জ্ঞান বাড়ছে। তা আপনি তো নিশ্চয় ক্লান্ত, ঘরে গিয়ে বসুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“হ্যাঁ একটু ক্লান্ত কিন্তু এই হৈচৈ দেখতে খারাপ লাগছে না। যেন আনন্দের হাট বসেছে তোদের উঠোনে। তা সমিরবাবু কই? তার যে কোনো খবর নেই?”
“ঘুমাচ্ছে। আপনি ঘরে যান, আমি ডেকে দিচ্ছি।”
“আরে না না, তার দরকার নেই। পরে উঠলেই দেখা করবো নে। তা পদ্ম মা, তুই অমন চুপচাপ কেন? কী হয়েছে মা তোর? দেখি এদিকে আয় তো।”
উঠোনের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মের ধ্যান ভাঙলো পরেশের ডাকে। সে অনেক কষ্টে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মামার কাছে যেতে যেতে বললো,
“কিচ্ছু হয় নি, মামা। তোমাকেই দেখছিলাম ; অনেকদিন পর এলে তো।”
“অনেকদিন পর এলে মানুষ আরও খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় অথচ তুই মন মরা হয়ে বসে আছিস। মন খারাপ, মা?”
মামার প্রশ্নে পুষ্পের ঠেলে কান্না আসে কিন্তু সে কাঁদে না। যেখানে কান্নার বিষয়বস্তু অহেতুক সেখানে কান্নার যে আদৌও মূল্য নেই। নিজেকে অনেক বুঝানোর পরে কান্না গিলতে সক্ষম হলো পদ্ম। মেয়ে জাতি চাইলেই তার সকল অনুভূতি গিলে নিতে পারে। উপচে পড়া কান্না ঠেলে সরিয়ে সে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে বজায় রেখে আলতো হেসে বললো,
“ঐ তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে তো, তাই একটু মন খারাপ। তুমি এসেছো দেখে আমি অনেক খুশি।”
পরেশ মামা তার ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙের ছোটো বাক্স এগিয়ে দিলো পদ্মের দিকে, খুশি মনে বললো,
“এই যে ধর, এটা তোর জন্য। দেখতো পছন্দ হয় কিনা।”
পদ্ম বাক্স টা হাতে নিলো। চারপাশে সকলের কৌতূহল মেটানোর জন্য বাক্সটা খুলতেই দেখে স্বর্ণের এক জোড়া ভারী দুল জ্বলজ্বল করছে। তা দেখে ছায়ার হাসি হাসি মুখ মুহূর্তেই চুপসে গেলো, কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“ওমা, আপনি এত দামী জিনিস আনতে গেলেন কেন? এটার তো অনেক দাম হবে। না না, এত দামী কিছু পদ্ম কীভাবে নিবে। না না, এটা উচিৎ না।”
“কেন উচিৎ না? আমি কী তোদের কেউ না? তোর ছোটোবেলা থেকে তোর মেয়েদের শৈশব কৈশোর আমি ছিলাম, সে নিশ্চয় ভুলে যাস নি? তবে কীভাবে এসব বলছিস?”
ছায়ার তবুও কাঠ কাঠ মুখের প্রতিচ্ছবি বদলালো না। সে ঠাঁই আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“না তবুও, এতো দামী উপহার দিবেন না পদ্মকে। আমার এটা দৃষ্টিকটু লাগবে। আপনি বরং কমদামী কিছু দিয়েন, আমার পদ্ম হাসি মুখে গ্রহণ করবে। আপনি এটা ফিরিয়ে নিন।”
পরেশ মামাও নিজের কথায় অটল। অতঃপর অনেকটা সময় তর্ক-বিতর্ক করার পর হার মানলেন তিনি। ছোটো শ্বাস ফেলে ছায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ঠিক আছে তবে, তোর কথা ই রইলো। আমি তো তোদের পর, আমার থেকে তোরা নিবি ই বা কেন।”
“পর আপনের কথা না। উপহার দিলেই আপন, নাহয় পর, এসব কেন ভাবছেন? আপনার আন্তরিকতাতেই আমরা সন্তুষ্ট।”
“ঠিক আছে, তবে পদ্মের বিয়ের শাড়িটা আমি-ই দিবো। এটা তো নিবি নাকি?”
অবশেষে ছায়া না পেরে রাজি হলো এই প্রস্তাবে। এর মাঝের পুরোটা সময় পদ্ম পত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রশ্ন মাখা দৃষ্টিতে। কিছু একটা বলতে চেয়েও ভরা সমাগম দেখে সে বললো না। আনন্দ, হৈচৈ-এ আবার মেতে উঠলো পুরো বাড়ি। পত্র মামাকে ঘরে যেতে বললেও সে গেলেন না। আনন্দ পছন্দ করা মানুষ সে। সবসময় আনন্দে মেতে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন। বেশিরভাগ সময় সে সদরে থাকলেও হুটহাট গ্রামে এসে পত্রদের বাড়িতে থাকেন। আনন্দে ভরিয়ে রাখেন তখন বাড়িটা।
_
সকল আনন্দ আমেজ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির উঠোনে অনেক আলো থাকলেও মানুষ মাত্র তিনজন। ছায়া, পত্র ও পুষ্প। তারা রান্না-বান্নার সব গুছিয়ে রাখছে। কেটে-কুটে, ধুয়ে রাখছে। আগামীকাল এত কাজ সামাল দেওয়া সম্ভব না তাই এখনই করে রাখছে। বর্ষার প্রকৃতি তো, তাই শীত শীত ভাবটা একদম জুবুথুবু হয়ে এসেছে। ছায়া মাংসের টুকরো করতে করতে বললো,
“তোমরা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হলো তো।”
পত্র কল পাড়ে গিয়ে মাংসের আলু ধুচ্ছিলো তখন আর পুষ্প মশলা পিষছিলো। মায়ের কথায় দু’জনই মায়ের দিকে তাকায়। পুষ্প নরম কণ্ঠে বললো,
“কাজ গুলো হাতে হাতে শেষ করে দেই, মা। তাহলে তোমার কষ্ট কম হবে।”
ছায়া এক পলক দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোটো শ্বাস ফেলে বললো,
“পুষ্প, আমার কষ্ট কমাতে চাও? তবে এমন সাদামাটা চালচলন টা বাদ দিয়ে দেও। আগের মতন রঙিন হও, আমার ভালো লাগবে। আর পত্র, তুমি, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখো। সারাজীবন তো ভুল মানুষের সাথে থেকে ভুলই শিখলে।”
পত্র হয়তো বুঝতে পারলো মা কার কথা বলেছে। তাই সাথে সাথে তার মাথায় রাগ উঠে গেলো, বেশ হুঙ্কার দিয়ে তাই মাকে বললো,
“তুমি এবার তো ক্ষান্ত হও মা। মানুষটা তো আর নেই তবে কেন তাকে প্রতি কথায় টানো?”
“টানার কাজ করেছে বলেই টানি।”
পত্র ধোয়ার কাজটা ফেলেই উঠে চলে গেলো গটগট করে। পুষ্প মায়ের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“আমি নিজেকে এখনো ক্ষমা করতে পারি নি, মা। সেদিন যদি আমি এমন চিৎকার চেঁচামেচি না করতাম তবে এতকিছু হতো না। আজ সবটা ভিন্ন থাকতো। এসব বলে আমার খারাপ লাগাটা বাড়িয়ে দিও না, মা।”
“তোমার খারাপ লাগা কমে যাবে, ধৈর্য ধরো।”
পুষ্প আর কিছু বললো না। নিজের মতন সবটা কাজ শেষ করলো। ছায়াও রইলো নিরিবিলি।

আজ সকালটাও আঁধার মেঘের ভেলা নিয়ে এসেছে। চারপাশে অশান্ত বাতাস। উঠোনে রান্নার জন্য তৈরী করা বড়ো চুলাটাও জ্বালাতে পারছে না বাতাসের জন্য। গা শীতল করা বাতাস হিমশীতল করে ফেলছে চারপাশ।
ছায়া ব্যস্ত হাতে কিছু রান্না নিজেদের রান্নাঘরেই বসিয়ে দিলেন। অন্তত পক্ষে নতুন অতিথিদের জন্য তো খাবারের আয়োজন করতে হবে। পদ্ম মাত্র স্নান করে এলো পুকুর থেকে। বাড়িতে তখনও পাড়া-প্রতিবেশির ভিড় পড়ে নি দেখে বার বার চিন্তায় কপাল কুঁচকাচ্ছে ছায়া। পদ্ম উঠোনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছছে। পুষ্প চা বানিয়ে এনেছে পরেশ মামা আর বাবার জন্য। পরেশ মামা চায়ে চুমুক দিয়ে সমিরবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন,
“কী ব্যাপার? কাল শুনলাম আপনাদের বাড়িতে নাকি জায়গা জমি নিয়ে ঝামেলা হলো?”
সমির বাবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
“হ্যাঁ, আমাকে তো পদ্মের মা ডাক দেয় নি। আসলে কোয়াটারে আসা মালিকের ছেলে ও ছেলের বন্ধুরা যে প্রজেক্টের জন্য এসেছে সেটার জন্য আমাদের বাড়ির জায়গাটাও প্রয়োজন। ওরা আমাকে বললেও আমি নিষেধ করে দেই। তাই কাল লোক পাঠিযেছে। ছায়া তো নাকি নিজেই ওদের সাথে কথা কাটাকাটি করেছে।”
“ছায়া তো চিরকালেরই সাহসী। ওর বিয়ে তো কম বয়সেই হলো কিন্তু সেই কম বয়সেই কত ছেলেকে শায়েস্তা করেছে ও। একদম বীরকন্যা। ওর যে রূপ, ছেলেদের ভয়ে তো ওর জেঠু জেঠিমা বেরই হতে দিতেন না। কিন্তু ছায়া ছিলো চঞ্চল। ও ঠিক বের হতো আর ছেলেরা কিছু বললে শিক্ষাও দিতো।”
পরেশ হেসে উঠলো ছায়ার শৈশব বর্ণনা করতে করতে। তা শুনে পুষ্প বেশ অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“মা চঞ্চল ছিলো! এ জীবনে তাকে গম্ভীর রূপ ছাড়া দেখিই নি।”
“বয়স হয়েছে, সংসার হয়েছে। আর মেয়েদের বিয়ের পর বদলে ফেলতে হয় তাদের সব। মেয়ে থেকে বউ হয়ে উঠা জীবনের ত্যাগ অনেক।”
পরেশ মামার কথার বিপরীতে ছায়া কিছু বললেন না তবে উঠোনের প্রত্যেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই নারীটির দিকে। কেবল মনে হলো এই নারীটা বোধহয় কোনো রহস্যের গোপন সমুদ্র।
তার মাঝেই উঠোনে ছুটতে ছুটতে হাজির হলো পত্র। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“মা, বাবা, তাড়াতাড়ি চলো। অভ্রদা’র বাবা আর নেই। মানুষটা আর নেই।”
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here