মধ্যবিত্ত – Part 14

0
280

#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_১৪
#নুসরাত_রিতু
ঘরিতে সময় প্রায় বারোটা।
জাফর সাহেব শুয়ে থাকার লোক না তাই আগেই হুইল চেয়ার কিনতে পাঠিয়েছেন সেলিনা চৌধুরী।
জাফর সাহেবের রুমে এসে দেখেন সে এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
সে যে কোন গভির ভাবনায় আছে সেটা বুঝতে সময় লাগলো না সেলিনা চৌধুরীর।
সে দ্রুত জাফর সাহেবের পাশে পানি ভর্তি জগ আর গ্লাস রেখে রুম থেকে বিদায় নিলো। দরজার বাইরে পা দেয়ার সময় “সেলি” বলে ডাক দিলেন জাফর সাহেব।
জাফর সাহেব সেলিনা চৌধুরীকে বকাবকি করছেন না এক্সিডেন্টের পর এটা খেয়াল করেছে সেলিনা চৌধুরী। কিন্তু এটাকে জাফর সাহেবের স্বার্থপরতা ভেবে বসেছেন তিনি। যেহেতু জাফর সাহেবের সব কাজ সেলিনা চৌধুরীর করতে হবে তাই বকাবকি করছেন না এমন সমীকরন মিলিয়ে নিয়েছে সে মনে মনে।
জাফর সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললেন, “আমার পাশে একটু বসবে সেলি?”
সেলিনা চৌধুরী ধীর পায়ে গিয়ে জাফর সাহেবের পায়ের কাছে বসলেন।
জাফর সাহেব: মাথার কাছটায় এসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেও তো। একটু ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠেও যেন তোমায় মাথার কাছেই দেখি।
ইচ্ছে করেই একটু কঠিন গলায় কথাগুলো বললেন জাফর সাহেব। সে জানে সে এতোদিন সেলির সাথে অন্যায় করেছ তাহলে সেলি তাকে আটকালো না কেন? সরাসরি কেন কোনদিন প্রশ্ন করেনি ন্যান্সির সাথে তার এতো মাখামাখির কারন কি? স্ত্রীদের আরেকটু শক্ত হওয়া উচিৎ স্বামীদের নিয়ে। কিভাবে কোন দ্বিতীয় নারীকে মেনে নিলো সেলি তার জীবনে। সেলির তো উচিৎ ছিলো দুজনকেই জবাই করে ফেলা।
সেলিনা চৌধুরী এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন জাফর সাহেবে দিকে। এতোক্ষণে এই কণ্ঠ তার কাছে চেনা লাগছে৷ মধুর কন্ঠ শুনলে তার ভয় হয় ইদানীং। জাফর সাহেবের প্রতি তার বিশ্বাসের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। ইদানীং তাই আর বিশ্বাস করতে পারেন না জাফর সাহেবকে। মাথার কাছটায় বসে জাফর সাহেবের মাথায় হাত বুলানো শুরু করলেন তিনি। ততক্ষণে জাফর সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন।
অতীতে ডুব দিলো সেলিনা চৌধুরী।
মাস তিনেক আগে জাফর সাহেবের কোন এক ক্লাইন্ট তার ফ্যামিলি সহ দাওয়াত করেছিলেন একটা পার্টিতে। জাফর সাহেব বিভিন্ন অযুহাত দিয়েছিলেন ফ্যামিলিকে না নেয়ার জন্য। কিন্তু কোন অযুহাতই ধোপে টেকেনি। শেষে যখন বললো সেলিনা চৌধুরী কারে সামনে যায়না, পর্দা করে। সেটাকেও মেনে নিলেন তার সেই ক্লাইন্ট। তার স্ত্রী ও নাকি পর্দা করে তাই সমস্যা হবে বলে জানালেন তিনি।
জাফর সাহেব বাধ্য হয়েই নিয়ে গিয়েছিলেন সেলিনা চৌধুরীকে। রাহির এক বান্ধবীর বার্থডে পার্টি ছিলো তাই রাহি সেখানে যায়নি।
সেলিনা চৌধুরী তার সবচেয়ে সুন্দর আবায়াটা ঐদিন পরেছিলেন। সাথে ম্যাচিং হিজাব-নিকাব আর স্কিন কালারের হাতমোজা পা মোজা।
পার্টিতে গিয়ে দেখে ন্যান্সি সেখানে আগেই অপেক্ষা করছে। যদিও ন্যান্সির দাওয়াত ছিলোনা তবুও কিছু বলতে পারলেন না জাফর সাহেব বা তার ক্লাইন্ট। জাফর সাহেবকে দেখেই জড়িয়ে ধরে গুড ইভেনিং জানিয়েছিল ন্যান্সি। সেলিনা চৌধুরীর বুকটা পুরে উঠেছিলো এমন দৃশ্য দেখে। এমন সময় তার ক্লাইন্টের স্ত্রী হাজির হলো সেখানে। সে লং গাউনের সাথে হিজাব ম্যাচিং করে পরা। শরীরের সাথে আটসাট হয়ে লেগে থাকা গাউনকে সেলিনা চৌধুরীর কাছে পর্দা তো একেবারেই মনে হয়নি আর হিজাবটা শুধু মাথাতেই পেচানো ছিলো তাই দেখতে আরো বিশ্রী লাগছিলো তাকে। সেলিনা চৌধুরীকে নিয়ে বসানো হলো জাফর সাহেবের জন্য বরাদ্দ টেবিলে। সাথে বসেছিলেন জাফর সাহেব আর ন্যান্সিও।
এলিট শ্রেণীর মানুষের পার্টিতে নেশা জাতীয় পানিয় থাকবে না এটা ভাবা ভুল। জাফর সাহেব শরীরের প্রতি ভিষণ যত্নবান তাই সে ড্রিংক করলো না। কিন্তু ন্যান্সি সহ পার্টির প্রায় সকলেই অল্পস্বল্প ড্রিংক করেছিলো। এক ক্লাইন্ট জোড় করে সেলিনা চৌধুরীর হাত ধরে টানছিলো ডান্স ফ্লোরে নেয়ার জন্য। অন্য হাত তার কোমরে যাওয়ার পর চোখ ফেটে কান্না আসছিলো তার। জাফর সাহেবের সাথে থাকতে থাকতে সেলিনা চৌধুরীও শরীরের প্রতি যত্নশীল হয়েছে৷ শরীরে একফোঁটা মেদ নেই তার। হিজাব নিকাবে আবৃত তাকে দেখতে ৩০ বছরের বেশি মনে হচ্ছিল না।
জাফর সাহেবের পাশে বসেই যখন সেলিনা চৌধুরীর হাত ধরে টানাটানি করছিলে তখন জাফর সাহেব তার ডিনার করতে ব্যাস্ত ছিলেন। সাথে ডিস্ট্র্যাক্ট করার জন্য ন্যান্সি তো ছিলোই। একপর্যায় না পেরে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এসেছিলেন সেলিনা চৌধুরী। ঐদিন রাত একটার দিকে বাসায় ফিরেছিলো জাফর সাহেব। তাকে একবারো জিজ্ঞেস করেনি ওখানে কি হয়েছিলো। শুধু বলেছিলো “ঐ তো তোর বুড়া শরীর ধরছে তো কি হইছে? খয়ে পরে গেছে? অন্য মানুষ পর্দা করে না? শফিক সাহেবের বউ ও তো পর্দা করে সেও তো ফর্মালিটি রক্ষা করতে সবার সাথে ডান্স ফ্লোরে গিয়েছিলো। তুই গেলে কোন মহাভারত অসুদ্ধ হতো?”
ঐদিনের পর বাকিটাও মন উঠে গেছিলো তার জাফর সাহেবের উপর থেকে। যে পুরুষের গাইরত নেই সেই পুরুষ কেমন পুরুষ? স্ত্রী হিসেবে না বলুক তার সন্তানের মায়ের পাশে তো দাড়াতে পারতো!
_________________________________
মেইন গেটের বাইরে দাড়িয়ে আছে রাহি আর রাফি। একটা রিকশার অপেক্ষা করছে তারা। এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে হেটে যাওয়া সম্ভব না। যদিও রাফির কাছে বিষয়টা দুধভাত কিন্তু রাহির জন্য তা অসম্ভব। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের কাছে যে কাজটা খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক একজন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানের জন্য সেই কাজটাই অসম্ভব এর কাতারে পরে। রিকশা পেয়ে দরদাম করে উঠে পরলো রাফি আর রাহি।
এবারো একপাশে চিপকে বসে আছে রাফি। রাহির বিষয়টা মজা লাগছে। তার ইচ্ছে করছে রাফির দিকে এগিয়ে বসতে। কিন্তু গলির মধ্যে এমন কাজ করা ঠিক হবে না তাই সে অপেক্ষা করছে মেইন রোডে উঠতে।
এদিকে আজও দোকানের লোকজন লক্ষ করেছে রাহি আর রাফিকে একসাথে। এবার আর দুয়ে দুয়ে চার না, পুরো চারে চারে আট বানিয়ে ফেলেছে তারা। তাদের মতে বড়লোক ঘড়ের মেয়ে পটিয়ে ভাগিয়ে এনেছে রাফি। এতোদিন সকলের সামনে ভালো সেজে থাকলেও এটাই তার আসল রুপ।
মেইন রাস্তায় উঠতে দেরী রাহির রাফির দিকে আগাতে দেরী নেই। তারপর এমন ভাব করেছে যেন সে কিছুই বোঝে না। রাফি আরো একটু পাশে চাপার চেষ্টা করলো কিন্তু দুঃখের বিষয় পাশে আর জায়গা নেই৷ রাফি খেয়াল করে দেখলো রাহির ঐপাশে যথেষ্ট জায়গা আছে। রাহি চাইলেই একটু চেপে বসতে পারে
কিন্তু সে বসেছে ঠিক মাঝ বরাবর।
এবার রাহি আরেকটু দুষ্টুমি করতে বললো, “মামা হুডটা একটু তুলে দিন তো! গরমে অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছে। ”
রিকশাওয়ালা মামা রিকশা পাশে রেখে হুড তুলে আবারো চালানে শুরু করলো। এবার রাহি পুরো রাফির সাথে মিশে আছে। রাফি একটু কেশে বললো, “একটু এগিয়ে বসবে প্লিজ? এপাশে আর জায়গা নেই।”
রাহি: কেন স্যার? এরকম বসলে সমস্যা কই?
রাফি: না মানে সমস্যা নেই। কিন্তু একটু এগিয়ে বসলে ভালো হতো। কম্ফোর্ট এর একটা বিষয় আছে না!
রাহি: আপনার আবার কম্ফোর্ট! আমি ঐদিকে এগিয়ে বসলেও আপনি ঠিকই মাঝে ফুটবল মাঠের মতো জায়গা ফাঁকা রেখে ঐদিকে এগিয়ে বসবেন। তারচে বরং আমিই আরাম করে বসি।
রাফি: এবার আমি ঠিক করেই বসবো। তুমিও একটু এগিয়ে বসো না প্লিজ।
এবার রাহি ঠিকই একটু এগিয়ে বসলো আর রাফিও স্বাভাবিক হয়ে বসলো কিন্তু মাঝে ফাঁকা টা ঠিকই রেখেছে রাফি।
______________________________
বাজার করে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দুইটা বেজে গেলো রাতের। একেবারে লান্সের খাবার নিয়ে ফিরেছে তারা। এবার আর রাফি ভুল করেনি৷ ফেরার সময় সি এন জি করে ফিরেছে তারা। মালপত্র আর রাহিকে দিয়েছে পিছনে আর নিজে বসেছে ড্রাইভার এর পাশে।
গেটের কাছে দারেয়ানকে দেখে তার হাতেই মালামাল ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েছে রাফি
আর অবশিষ্ট টাকা আর হিসেবটা খামে ভরে রাহির হাতে দিয়ে বলেছে সেলিনা চৌধুরীকে দিতে।
রাহি বাসায় ফিরে দেখে তার মা স্যুপ রেডি করে বসে আছে। রাহি আসার সাথে সাথে ফ্রেশ হতে পাঠালো তারপর স্যুপ আর ঔষধ নিয়ে রাহিকে পাঠালো জাফর সাহেবকে খাওয়াতে।
দিনটা এমনই ভাবে কেটে গেলো দু পরিবারের।
________________________________
পরদিন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে অফিসে গেলো রাফি। অফিস টাইমের দশ মিনিট আগেই সে অফিসে পৌছুতে পেরেছে। কিন্তু তবুও রিসিপশনে গিয়েই শোনে তাকে অলরেডি ডেকেছেন অফিসের এম ডি। রিসিপশনের মহিলার মুখটা খুব শুকনো দেখাচ্ছিল। মনে হয় কেঁদেছে এমন অবস্থা। সেদিকে খুব একটা নজর দেয়ার সময় পেলোনা রাফি।
এমডির রুমে নক করতে যাবে এমন সময় ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো “কাম ইন”
রাফি ভিতরে গিয়েই অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে।
কারন এমডির চেয়ারে বসা ন্যান্সি।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here