#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_১৫
#নুসরাত_রিতু
ফজর, তিলাওয়াত আর দোয়া দুরুদ পড়ে একেবারে ইশরাকের পর জায়নামাজ ছাড়া সেলিনা চৌধুরীর বহুদিনের অভ্যাস। রাহি যদিও ফজর পড়েই আবার ঘুমায় কিন্তু আজ তার ঘুম আসেনি তাই মায়ের কাছে বসে তিলাওয়াত শুনেছে কিছুক্ষণ। অর্থ সহ কুরআন পড়ে সেলিনা চৌধুরী। নারী পুরুষের পর্দা আর মাহরাম এর আয়াত গুলো যখন সেলিনা চৌধুরী পড়লো তখন ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠেছিলো রাহির। সে এর আগেও আয়াত গুলো পড়েছে কিন্তু কখনো এমন লাগেনি। আজ মনে হলো তার এই বিষয়টা জানতে হবে।
জাফর সাহেবের পরিচিত কিছু লোক বাসায় আসবে৷ সকাল সকাল বাসায় গেস্ট আসবে তা আগের রাতেই বলেছিলেন জাফর সাহেব। তাই সেলিনা চৌধুরীও দারোয়ানকে দিয়ে ফলমূল আনিয়ে নিয়েছিলো।
তারপর মা মেয়ে লেগে পরেছিলো নাস্তা তৈরির কাজে৷ যদিও খুব বেশি কিছু করেনি৷ ক্রিমি পাস্তা আর স্যুপ বানিয়েছে৷ গেস্ট আসলে চা আর ফল কেটে দিবে। যদিও রাহি এখনো জানে না কারা আসবে। তার জানতেও মন চায়নি। কিছুই ভালো লাগেনা আজকাল তার।
রাহিদের এখানে এখনো কোন খাদেমা নেই। খুশিকে খবর দেয়া হয়নি। রাহিই খাবারের পরিবেশনের জন্য গিয়েছিলো। তখন যা শুনলো তাতে বুঝলো ন্যান্সির অন্যায়ের শাস্তি পাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
___________________________
ভালো লাগছে না৷ অপেক্ষা করছে কখন রাত হবে আর সবাই বাসায় আসবে৷ তার কিশোরী মন যে তার কাছ থেকে বহু দূরে সেটা বুঝে গেছে সে। সারাক্ষণ মাথায় রাফির চিন্তা ঘুরঘুর করে। রাফির কি কখনো তার কথা মনে পরে? রাফি কি আদৌ জানে একটা মেয়ে সারাক্ষণ তার কথা মনে করে? রাফির সাথে পরিচয় হয়েছে পনেরোদিন হয়নি এখনো। তবুও রাফিকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন মনে হয়৷ সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে মনে চায়।
কি আছে ঐ ছেলেটার মধ্যে? আগে যেই দাড়ি রাহির এতো বিশ্রী লাগতো এখন সেই দাড়িই যেন তার সবচেয়ে প্রিয়। বরং রাস্তাঘাটে দাড়ি ছাড়া কেউকে দেখলে তার বিরক্ত লাগে। মনে হয় ছেলে মানেই তার গাল ভর্তি দাড়ি থাকবে। দাড়ি ছাড়া পুরুষ কেমন পুরুষ?
_______________________________
“ওয়েলকাম মিস্টার রাফায়েল শাহরিয়ার। আসুননা, বসুন। ” হাসিমুখে বললো ন্যান্সি।
রাফি ন্যান্সিকে এখানে দেখে বিষয়টা হজম করতে পারছিলো না। তবে কি ন্যান্সিই এমডি? তবে তার উদ্বেগ সে চেহারায় প্রকাশ হতে দিলো না। মিষ্টি হেসে ন্যান্সির অপজিটের চেয়ারে বসে বললো, “আসসালামুআলাইকুম ম্যাম।”
ন্যান্সি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম। কেমন আছেন রাফায়েল?
রাফি: আলহামদুলিল্লাহ ম্যাম। আপনি?
ন্যান্সি: ভালো। প্রথম দিনেই বসের পর অফিসে আসলেন?
রাফি: অফিস টাইমের দশ মিনিট আগেই এসেছি ম্যাম।
ন্যান্সি: তাই বুঝি! অফিস টাইম শুরু হতে এখনো ছয় মিনিট বাকি৷ তবে কি আমরা অফিস টাইম শুরু হওয়ার আগে ব্যাক্তিগত আলাপ করতে পারি?
রাফির বিরক্ত লাগছে। অনেক কষ্টে এই জবটা পেয়েছে সে। তাই কিছু বলতে পারছে না। ন্যান্সি এখানের এম ডি কি করে হয় সে বুঝতে পারছে না। যতোদূর জানে ন্যান্সি তো জাফর সাহেবের পিএ ছিলো। নিজের বিরক্তি লুকিয়ে বললো, “যেমন?”
ন্যান্সি: যেহেতু এখনো অফিস টাইম শুরু হয়নি আমি তোমাকে তুমি করেই বলি! যদিও অফিস টাইমেও তুমি বলতে আমার আপত্তি নেই।
রাফি: যেহেতু আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় সুতরাং তুমি বলতেই পারেন। কিন্তু প্রফেশনাল ফিল্ডে আপনি সম্বোধনটাই মানানসই।
কথাটা গায়ে লাগলো ন্যান্সির। তবুও ভালালাগায় ছেয়ে গেলো মন রাফির এমন কাটাকাটা কথা শুনে।
ন্যান্সি: আচ্ছা আচ্ছা।
বেল বাজিয়ে পিওনকে ডাকলো ন্যান্সি। পিওন আসলে বললো রাফিকে তার ডেস্ক দেখিয়ে দিতে আর ম্যানেজার আসলে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে । রাফি সালাম জানিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো।
আজ ন্যান্সি তাড়াতাড়ি অফিসে এসেছে৷ এখনো জাফর সাহেব কোন একশন নিচ্ছে না তাই সে অবাকই হয়েছে। তাই অফিসে থাকা সব ক্যাশ টাকা আর একাউন্ট এর টাকা তার নিজের একাউন্টে ট্রান্সফার করবে ভেবেছিল।
কিন্তু অফিসে এসে শুনলো আজ নতুন দু’জন জয়েন করবে। একটা মেয়ে আর একটা ছেলে। তাদের সিভি টেবিলে রাখা আছে তাও জানিয়ে গিয়েছে পিওন। উপরের সিভিটাই ছিলে রাফির। রাফির সিভি দেখে সে ভুলেই গেলো সে কোন কাজে এসেছিলো।
এই ছেলেটা তাকে এতো কেন টানে সে জানে না। কি আছে এই ছেলেটার মধ্যে। ছেলেটার নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলা নাকি স্থির দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকানোর প্রেমে পরেছে ন্যান্সি? ছেলেটার দরাজ কন্ঠে বলা প্রতিটা কথা কেন এতো আঘাত করে ন্যান্সির বুকে। জীবনের এতোগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসে হঠাৎ কি হলো এই ছেলেটাকে দেখে তার।
সেই পাসপোর্ট সাইজের ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ ন্যান্সি। রিসেপশনিস্টকে বলে রেখেছিলে রাফি আসার সাথে সাথেই যেন তাকে কেবিনে পাঠিয়ে দেয়। পিওন আসার সাথে সাথেই ঠিক এমডির কেবিনের সামনে দুটো ডেস্ক এর ব্যাবস্থ করিয়েছে নতুনদের জন্য। রাফিকে তার সারাক্ষণ সামনে বসিয়ে রাখতে মন চায়। কিন্তু রাফি কি তা কখনো বুঝবে?
রাফি ডেস্কে এসে বসতেই তার পাশের ডেস্কে বসলো একটা মেয়ে। পিওনই তাকে তার ডেস্কে বসিয়ে গিয়েছে। পিওন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনারা দুইজনেই আজকে জয়েন করলেন। বন্ধু পাতাইয়া নেন। তাইলে কাজ করে মজা পাবেন” বলেই হাহা করে হাসলো পিওন রাজু।
রাফি তাকালো পাশের মেয়েটার দিকে। সম্পুর্ন কালো বেরখায় আবৃত্ত মেয়েটাকে দেখে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো।
পাশের মেয়েটি বললো, ” আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু ভাইয়া। আমি আয়শা”
রাফি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আমি রাফায়েল শাহরিয়ার।
তাদেরকে শুরুতেই কোন কাজ দেয়া হলো না। কিছুক্ষণ পর কিছু ফাইল দিয়ে বললো কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি করতে। এটাই নাকি আজকের কাজ। দুজনেই অবাক হলো। এতোটুকু কাজ তাদের?
অফিসের পরিবেশও কেমন যেন। সবাই ছন্নছাড়া। কিছু একটা নিয়ে কানাকানি হচ্ছে বুঝতে পারলো তারা। শুধু তারা দুজনই কিছু জানেনা।
_______________________________
বেলা বারোটার দিকে অফিসে ঢুকলো রনি। অফিসে ঢুকেই তার বেলেল্লাপনা শুরু। রিসেপশনিস্ট মেয়েটার গালে হাত দিয়ে বলে, “এমডির রুমটা কোনদিকে মামনি?” রিসেপশনিস্ট অতি দ্রুপ পিছন সড়ে দেখিয়ে দিলো দিকটা।
এমডির রুমের দিকে ঢোকার সময় একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিলো আয়শার দিকে। অন্যরা সবাই স্বাভাবিক থাকলেও আয়শা ছিলো সম্পুর্ন পর্দা করা তাই হয়তো এমন দৃষ্টি। সামনে দাড়িয়ে বলে “অফিসে এমন সং সেজে আসা যাবে না। কাল থেকে শাড়ি পরে আসবা। দেখি এখন নিকাবটা খোলো তো!”
আয়শা বলিষ্ঠ কন্ঠে জবাব দিলো, “ইন্টারভিউয়ের সময়ই আমি ক্লিয়ার করেছি বিষয়টা। আমি নিকাব খুলবো না। অফিসের প্রয়োজন আমার ব্রেন, চেহারা না।”
রনি: ঐ মেয়ে তুমি জানো কার সাথে কথা বলছো তুমি? আজথেকে এই অফিসের মালিক আমি। আগে কি হইছে না হইছে সব বাদ। এখন থেকে আমি যা বলব তাই হবে।
আয়শা: অফিসের মালিক বদল হলেও নিয়ম বদল হয়নি আশা করি। যদি আমার পোশাকে সমস্যা থেকেই থাকে তবে কাগজে কলমে সেটা লিখে পাঠিয়ে দিন।
কথাটা বলেই নিজের কম্পিউটার স্ক্রিনে নজর দিলো আয়শা। এমন থার্ডক্লাস লোকের সাথে কথা বলতে তার রুচিতে বাধে। মুখে সবাই বলে মাই লাইফ মাই রুলস। একটা মেয়ে যদি নিজের ইচ্ছেতে জিন্স টপ্স পরতে পারে তবে অন্য একটা মেয়ে কেন নিজের ইচ্ছেতে বোরখা পরতে পারবে না?
রনিও ধপধপ পা দিয়ে এমডির ক্যাবিনে ঢুকলো। রনির ক্যাবিনে ঢুকতে না ঢুকতেই পুলিশ এডভোকেট আর তাদের সাথে অফিসে আসলো সেলিনা চৌধুরী।
রাহিকে তিনি বাসায় রেখে এসেছেন জাফর সাহেবের সাথে।
এমডির রুমের সামনে গিয়েই দাড়ালেন তারা। একজন পুলিশ গিয়ে ন্যান্সি আর রনিকে ডেকে বাইরে আনলেন। অফিসের সবাই জরো হয়েছে সেখানে। রাফি আয়শা সহ অন্য যাদের ডেস্ক সেখানে ছিলো তারা সেখানেই দাড়িয়ে পড়েছে।।।
পুলিশ: অফিসে জোরপূর্বক অবস্থান করার অভিযোগ এসেছে আপনাদের উপর।
আপনারা চৌধুরী কম্পানির কি হন যে ঐ গদিতে বসেছেন?
ন্যান্সি: চৌধুরী কম্পানি ছিলো এটা। এখন এটা আমার কম্পানি।
রনিকে ইশারা দিতেই দ্রুত গিয়ে ন্যান্সির ব্যাগ নিয়ে আসলো সে। ন্যান্সি সেখান থেকে কাগজপত্র বের করে দিলেন পুলিশের হাতে।
পুলিশ হেসে কাজগুলো নিলেন তারপর এডভোকেট কে দিয়ে বললেন চেক করতে। এডভোকেট চেক করে জোড়ে হেসে ফেলে বললো,” এখানে তে দেখছি জাফর সাহেবের সাক্ষর আছে মিস। কিন্তু আপনি কি জানেন যে এই কম্পানির মালিক জাফর সাহেব না!” মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলছে।
ন্যান্সি: কি বলছেন আপনি এসব? চার বছর ধরে কাজ করি আমি এখানে। এটা জাফরের অফিস ছিলো। যা সে আমার নামে লিখে দিয়েছে।
এবার মুখ খুললেন সেলিনা চৌধুরী। বললেন, “যে জিনিসটা তার না সে সেটা কিভাবে লিখে দেয় মিস ন্যান্সি?”
ন্যান্সি: তাহলে এই অফিসের মালিক কে? রাহিকে লিখে দিয়েছে ঐ জাফর তাইনা? ওকে আমি ছাড়বো না।
হাইপার হয়ে গেছে ন্যান্সি। তার এতোদিনের পরিশ্রম বিফল গেলো। এটা বুঝলে সে রনকে রাহির পিছনে লাগাতো। এডভোকেট সাহেব হেসে বললেন, “এই কম্পানির মালিক রাহিও না মিস। এই কম্পানির মালিক সেলিনা চৌধুরী। এতোবছর চাকরি করেন আর এটা জানেন না?”
ন্যান্সি: এতো বছরে আমি কখনোই তাকে অফিসে আসতে দেখিনি। সে কি করে মালিক হয়?
পুলিশ: এতো সময় দিতে পারছি না মিস। বাকি কথা নাহয় থানায় হবে। আরো বহু অভিযোগ আছে আপনার উপর।।
ন্যান্সি: আমি কেন যাবো? আমি এখানে চাকরি করি। জাফরের পিএ আমি। আমি তার ক্যাবিনে থাকতেই পারি।
রানো চেচিয়ে বলে উঠলো, ” তোমাকে আমি আগেই বলছিলাম টাকা সড়াতে আর এখন যাবা না কেন? সব বুদ্ধি তো তোমারই। তুমি এখানে এখন নাটক শুরু করছো? ”
পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার কোন দোষ নেই স্যার। আমি শুধু ন্যান্সির সাথে দেখা করতে আসছি। ও এখানে চাকরি করে। এটা তো আর অন্যায় না! ”
সেলিনা চৌধুরী এবার তাকালেন রাফির দিকে। অফিসে ঢুকেই রাফিকে দেখেছিলো সে। এবার বললো, “রাফি ম্যানেজারকে বলো ন্যান্সিকে ফায়ার করতে। এক্ষুনি। আমি দেরী চাই না। ”
চলবে……