#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_২১
#নুসরাত_রিতু
অসুস্থ থাকাকালীন জাফর সাহেবের সেবা যত্ন সেলিনা চৌধুরী নিজেই করতেন। যখন হাতে খেতে পারতো না তখন যদিও রাহি খায়িয়ে দিতো।
কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর সেলিনা চৌধুরী জাফর সাহেবকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। সকালের চা সাধারণত রাহির হাতেই পাঠায়। দুপুরের খাবার ড্রাইভারকে দিয়ে অফিসে পাঠিয়ে দেয়। রাতের খাবারটাও নিজে ইশার আগে খেয়ে ফেলেন। রাতে তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত এসবের অযুহাতে নামাজের রুমেই কাটিয়ে দেয়। যদিও বা কখনো রুমে যায় তো গিয়েই ঘুমিয়ে পরে।
ন্যান্সিকে যখন আদালতে তোলা হলো তখন জাফর সাহেবের নামে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে এমন অনেক কথাই বলেছিলো যাতে সেলিনা চৌধুরীর অভিমানের পাহাড় সীমা অতিক্রম করেছিলো। তারপর থেকেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে সে।
আজ খুব ভোরে রাহি আর রিমি ঘুরতে গিয়েছে। তাই আজ সকালের চা নিয়ে খুশিকে পাঠিয়েছে সেলিনা চৌধুরী।
কিছুক্ষণ পর চা হাতে ফিরে এলো খুশি।
সেলিনা চৌধুরী : কি হলো? চা নিয়ে ফিরে এলি যে!
খুশি: বড় সাব আমারে ধাবরি দিছে। কইছে আমনেরে চা লইয়া যাইতে।
সেলিনা চৌধুরী : কেনো বকেছে? তুই কিছু করেছিস?
খুশি: না খালাম্মা। আমিতো চা লইয়া দরজার বাইরেই খারাইয়া ছিলাম। বড় সাব কার লগে যেন কতা কইতাছিলো। আমারে দেইখা জিগায় রাহি আপায় কই। আমি কইলাম ঘুরবার গেছে। তারপর জিগায় আম্নে কই। আমি কইলাম রানতাছেন। তারপর কি কয় জানেন?
সেলিনা চৌধুরী : না বললে কিভাবে জানবো? বল তারপর কি বললো।
খুশি: কয় তয় তুই আমার মাথার উপরে নাচতাসোস ক্যান? যা এনতে, তোর খালারে এখনি রুমে পাঠা।
বিশ্বাস করেন খালাম্মা আমি নাচতাছিলাম না। আম্নেই কন নাচলে চা পইরা যাইতো না? বড় সাব আমারে হুদাই দাবড়াইলো।
সেলিনা চৌধুরী : মন খারাপ করিস না। তোর বড় সাহেবের হয়তো কোন কারনে মেজাজ খারাপ ছিলো তাই রাগারাগি করেছে। আচ্ছা শোন তুই বরং বাকি রুটি গুলো ভেজে খেয়ে নে। আমি একসাথে তার জন্য নাস্তাও নিয়ে যাই।
খুশি: আমনে খাইবেন না?
সেলিনা চৌধুরী : আমি রোজা।
খুশি: কিয়ের রোজা?
সেলিনা চৌধুরী : আইয়ামে বীজের রোজা। এই রোজা তিনটা রাখলে সারাবছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায় ইনশাআল্লাহ।
খুশি: হাছা নি? তাইলে কাইলগোত্তে আমিও রাখুম।
সেলিনা চৌধুরী : আজকেই রোজার শেষ দিন ছিলো। তুই সামনের মাসে রাখিস।
খুশি: আইচ্ছা।
সেলিনা চৌধুরী জাফর সাহেবের খাবার ট্রেতে সাজিয়ে নিলো। চা টা আবার গরম করে নিয়েছে। রুমের কাছে গিয়ে দেখে জাফর সাহেব রুমের ভিতরে পাইচারি করছে। এই কাজটা জাফর সাহেব তখনই করেন যখন সে খুব বেশি চিন্তায় থাকেন। সেলিনা চৌধুরী বুঝতে পারলেন কিছু একটা নিয়ে জাফর সাহেব চিন্তিত। তবুও সে বিষয়ে কিছু না বলে টেবিলের উপর ট্রে রেখে বললো, “চা থান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
জাফর সাহেবের দৃষ্টি তখন সেলিনা চৌধুরীর দিকে। সেলিনা চৌধুরী রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়া শুরু করলে জাফর সাহেব বললেন, “রাহি কোথায় গিয়েছে?”
সেলিনা চৌধুরী : রাহি আর রিমি ঘুরতে গিয়েছে।
জাফর সাহেব হাক দিয়ে খুশিকে ডাকলেন। খুশিও পড়িমরি করে দৌড়ে এলো। সেলিনা চৌধুরী নিরব দর্শক। খুশি আসতেই জাফর সাহেব বললেন, “সেলির নাস্তাটাও আজ রুমে দিয়ে যা।”
খুশি: কিন্তু খালাম্মা তো কইলো হেয় রোজা রাখছে।
জাফর সাহেব একটু অবাক হলো। এখন কিসের রোজা চলছে সেটা জানা নেই জাফর সাহেবে। তবে নফল রোজার জন্য উপলক্ষ লাগে না তাই সে বিষয়টাকে সহজ ভাবেই নিলেন।
খুশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা তুই তাহলে যা। গিয়ে তুই খেয়ে নে। নাকি তুইও রোজা?”
খুশি: না না আমি রোজা না।
জাফর সাহেব: আচ্ছা তাহলে তুই গিয়ে খেয়ে নে।
খুশি: আইচ্ছা।
খুশির প্রস্থান পর্যন্ত চুপ করে ছিলেন জাফর সাহেব। তারপর সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো, ” তুমি রোজা রাখছো জানাও নি তো।”
সেলিনা চৌধুরী : রোজা রাখায় জানানোর কি আছে?
জাফর সাহেব : এখন ফরজ রোজা চলছে না। আর নফল রোজা রাখার আগে স্বামীর অনুমতি নিতে হয় বলেই তো জানতাম।
বিস্ময়ের চোখে তাকালেন সেলিনা চৌধুরী। যদিও তা ছিলো খুবই ক্ষনস্থায়ী। চোখে চোখ পরতেই চোখ সড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। পুনরায় চলে যেতে নিলেই জাফর সাহেব বললেন, “কোন ভাবেই কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না সেলি?”
সেলিনা চৌধুরী তখনও নিরব। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি জাফর সাহেবের দিকে। চোখে চোখে হাজার বছরের জমানো কথার আদানপ্রদান চলছে। ঠোঁট জোড়া আজ অপ্রয়োজনীয়।
হুট করেই চোখ সড়িয়ে নিলেন সেলিনা চৌধুরী। দ্রুতবেগে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। পিছনে ফেলে গেলেন বিস্ময় ঘেরা দুটো চোখকে।
_____________________________
“রাহি চলো আমরা সবার জন্য চা নিয়ে আসি। একা চারটা কাপ আমি আনতে পারবো না। ” রাফির এই কথা শুনে যতটা চমকালো রাহি ততটাই চমকেছে রিমি। পুনরায় খামচে ধরেছে সে রাহির হাত। সাদ আড় চোখে একবার বিষয়টা দেখলো। মৃদু হেসে চোখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
রাফি: কি হলো! চলো।
[রিমির দিকে তাকিয়ে] তুই সাদের সাথে কথা বল। আমরা আশেপাশেই আছি। কার সাথে তুই বাকি জীবনটা কাটাবি তাকে জেনে নেয়াটা জরুরি তাই কোন প্রশ্ন থাকলে সরাসরি করবি। আশা করি সাদ কিছু মনে করবে না।
সাদ: এই বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
রাফি পুনরায় রাহির দিকে তাকিয়ে বললো, “চলো!”
রাহি রিমির হাতটা ছাড়িয়ে একবার করুন চোখে তাকালো রিমির দিকে তারপর চলে গেলো রাফির পিছন পিছন। যাওয়ার পথেও বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলো রাহি। রাফি খেয়াল করে বললো, “বার বার তাকিও না। ওরা অস্বস্তি বোধ করবে। ” ভুল বুঝতে পেরে রাহি দ্রুত হাটা শুরু করলো।
চায়ের দোকান ছাড়িয়ে সামনে চলে যাওয়ার সময় রাহি অবাক চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে বললো, “দোকান তো ফেলে যাচ্ছি। আমরা চা কিনবো না?”
রাফি: কিনবো তবে এখনি না। চলো সামনে থেকে হেটে আসি। সাদ এখানে রিমির সাথে কথা বলতে এসেছে। ওদের কথা শেষ হলে তবেই আমরা যাবো।
রাহি: ওহ আচ্ছা। তাইতো ভাবি হুট করে তিনি এখানে হাজির হলো কিভাবে।
রাফি: এতোক্ষণে বুঝলে!
রাহি: ওয়েট ওয়েট! তিনি জানলো কিভাবে আমরা এখানে আছি। আপনি জানিয়েছেন না? জানেন রিমি কতো ভয় পাচ্ছে? আমার হাত খামচে চামড়া তুলে ফেলেছে।
রাফি: ও ফোন করেছিলো। তখনই শুনলো এখানে আসবো তাই ও ও চলে আসলো। আর রিমি তোমায় খামচেছে মানে?
রাহি: ও তো কখনো ছেলেদের সাথে কথা বলেনি। তাই ভয় পেয়েছে। আর ভয় প্রকাশ করেছে আমাকে খামচে।
রাফি: হা হা। ভয় প্রকাশের পদ্ধতিটা সুন্দর।
একটু থেমে আবার বললো, “তুমি ছেলেদের সাথে কথা বলতে ভয় বা লজ্জা পাও না?”
রাহি আফসোসের ভঙ্গিতে বললো, “নাহ, ভয় আল্লাহ বাদে কেউকে পাই না। আর লজ্জাও খুব বেশি কাজ করে না। আসলে জেনারেল লাইনে এতো বেশি ফ্রি মিক্সিং যে ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার পার্থক্যটাই অনুভব করতাম না। সবাইকে একইরকম লাগতো।”
রাফিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ” আসলেই। আল্লাহ সাহায্য না করে জেনারেল লাইনে পড়ে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব। ”
রাহি: হুম। আপনার সংকোচ হয় মেয়েদের সাথে কথা বলতে?
রাফি: এটা নির্ভর করে মেয়েটা কে তার উপর। কলিগদের সাথে প্রয়োজন বাদে কথাই হয় না। ছাত্রীদের সাথে কথাও পড়ানোতেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
রাহি: আর বান্ধবীদের সাথে?
রাফি একনজর তাকালো রাহির দিকে। পুনরায় নদীর দিকে তাকিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো। রাহিও বসলো কিছুটা দুরত্ব রেখে।
রাফি নদীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো, “আমার কখনোই কোন বান্ধবী ছিলো না। মা আর রিমি বাদে আমি হয়তো তোমার সাথেই সবচেয়ে বেশি কথা বলেছি।”
বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠলো রাহির। তারমানে রাফির জীবনে একটু হলেও তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ভাবনাটা খুব বেশি আগাতে পারলো না সে। চোখ দুটো ভিজে এসেছে তার। সারাক্ষণ দোয়ায় রাফিকে চায় সে। যদিও পরক্ষণেই বলে যদি কল্যানকর হয় তবেই যেনো পায় নাহলে দরকার নেই। আল্লাহর সিদ্ধান্তেই সন্তুষ্ট থাকবে বলে মনে মনে শপথ করেছে রাহি। কিন্তু চোখের পানিকে বাধ মানানো কঠিন। পানি তো কারো কথা শোনে না। গড়িয়ে পড়বেই।
_______________________________
রাহি যাওয়ার পর রিমি লজ্জায় আরো গুটিয়ে গিয়েছে। সাদ বললো, “দাড়িয়েই থাকবো! চলুন হাটতে হাটতে কথা বলি।”
রিমি: দূরে চলে গেলে যদি ভাইয়া খুজে না পায়?
সাদ: হা হা। ফোন আছে তো, খুজে না পেলে ফোন করবে।
রিমি: ওহ।
সাদ: দাড়িয়েই থাকবেন! হাটতে ইচ্ছে করছে না? বসবেন কোথাও?
রিমি: না ঠিকাছি আমি।
কথাটা শেষ করেই গুটিগুটি পায়ে হাটা ধরলো যেদিকে রাফিরা গিয়েছে সেদিকে।
সাদ পুনরায় বললো, “ওদিকে তো রাফি ভাইরা গিয়েছে। আমরা বরং অপর দিকটা ঘুরে আসি!”
কোন কথা না বলে সাদের থেকে একটু দুরত্ব রেখেই হাটা শুরু করলো রিমি।
সাদ: আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো, তাই এতো সকালে এখানে আসা।
রিমি…………
সাদ: বলি?
রিমি: জি বলুন।
সাদ: বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। আমার জন্মের পর মায়ের আর কোন সন্তান হয়নি। তাই জীবনে নারী বলতে শুধু মাকেই পেয়েছি। বাবার মৃত্যুর পর মা একা হাতে সব সামলেছে। আমাকে দ্বীনি ও দুনিয়াবি দুই শিক্ষায় বড় করেছেন। কখনো কোন মেয়ে বন্ধু হয়নি আমার। আমিও বানানোর চেষ্টা করিনি। নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছি নিজের আহলিয়ার জন্য। আপনাকে দেখতে যাওয়ার আগে ও দেখে আসার পরে ইস্তেখারা করেছি আমি। মনে হচ্ছে আপনিই সেই রমনী যার জন্য এতোগুলো বসন্ত অপেক্ষা করেছি আমি। আপনার এই বিষয়ে মতামত কি? আপনার কি আমাকে অর্ধেক দ্বিন হিসেবে পছন্দসই মনে হচ্ছে?
রিমি আগেই লজ্জা পাচ্ছিলো। এসব কথা শোনার পর লজ্জা, সংকোচে সে পুরোপুরি গুটিয়ে গিয়েছে। পা চালিয়ে সামনে এগোতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তবে এটাও সত্যি সাদের কথাগুলো পছন্দ হয়েছে তার।
সাদ রিমির উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো। রিমির কোন জবাব না পেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “অর্ধেক দ্বিন হিসেবে আমাকে পছন্দ হয়নি? আপনি ভয় পাবেন না। নিঃসংকোচে বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।” মুখে এই কথা বললেও মনে মনে সাদ প্রচুর ভয় পাচ্ছে। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে রিমিকে হালাল ভাবে চাচ্ছে সে।
রিমি খেয়াল করলো সাদ উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।
মৃদু আওয়াজে বললো, “বাবা-মায়ের আপত্তি না থাকলে আমারো নেই।”
চলবে…..