প্রনয় পর্ব–৩৩ (The End)

0
775

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব–৩৩
কোলাহল পূর্ন রাস্তা।আশেপাশে গাড়ির ছড়াছড়ি। জ্যামে ভর্তি পথ,কখনও সিগন্যাল।সাথে রোদের প্রকোপ।কোনো কিছুই আজ মন ছুঁতে পারছেনা রুদ্রর।এক বিন্দু বিরক্তি নেই মুখে।সে উদাস,অন্যমনস্ক। যেন ভিন্ন কোনো গ্রহে তার বাস এখন।দুনিয়ার মাটিতে শুধু পরে আছে দেহটা।সামনে রেহান মৃদূমন্দ গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।মুখ ভার রেহানের।মন ও খারাপ।রুদ্র আজীবনের মতো দেশ ছাড়ছে।রুদ্র হোক রাগী,মেজাজি কিন্তু কতটা উদার,দয়ালু সে জানে।আজ অব্দি বিপদে পরেছে আর রুদ্র সাহায্য করেনি এমন সময় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।কত বছর ধরে রুদ্রর অধীনে কাজ করছে।মনে মনে সে রুদ্রর অন্ধভক্ত বলা যায়।অথচ আজ রুদ্র যখন চলে যাচ্ছে একবার মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা স্যার যাবেন না।রেহান বারবার ভিউ মিরর দিয়ে রুদ্রকে দেখছে।অনেকক্ষন পর রুদ্র শান্ত কন্ঠে বলল ‘ কিছু বলতে চাও রেহান?
রেহান নড়েচড়ে ওঠে।স্টিয়ারিং এ রাখা হাত দুটো কেমন কেঁপে এলো।রুদ্র একী প্রশ্ন আবার করল।সাথে বলল,
“কিছু বলার থাকলে বলে দাও।পরে আর দেখা হবেনা।
রেহানের যেন কান্না পেলো।মেয়ে মানুষ হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই দিত।ধরাধরা গলায় বলল
‘ স্যার,বলছিলাম কী,যদি না যেতেন!
রুদ্র হাসলো।হাসির সাথে বের হলো দীর্ঘশ্বাস। রেহান উত্তর পেলো এতেই।রুদ্রকে আজ থামানোর ক্ষমতা তার নেই।রুদ্র যাবেই।ছাড়বেই মাতৃভূমি।
রুদ্র জানলা গলিয়ে বাইরে তাকালো।প্রকৃতি আজ হাস্যজ্জ্বল।সোনারোদ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।রুদ্র শুধালো
‘ কীসের এত আনন্দ তোমাদের?আমার বিরহে কেন কাঁদছোনা তোমরা?
জবাবে ওরা আরো হাসে।হেসে কুটিকুটি হয়।রুদ্রর বিষন্নতা বাড়লো।সেলফোন বের করে শেফালির মেসেজটি বার করলো।বাংলায় লেখা ‘সেঁজুতি রাফসানের গায়ে হলুদ শেষ।এখন বিয়ের তোরজোর চলছে।কালকের বদলে বিয়ে হবে আজকেই।এইতো আধঘন্টা পর।
মেসেজটি এসেছে আরো ঘন্টাখানেক আগে।তারমানে এতক্ষনে সেঁজুতির বিয়ে শেষ। ও এখন অন্য কারো বউ?এটা ভেবেই রুদ্র চিৎকার করে কেঁদেছে।বাড়ি ভরা সার্ভেন্ট,অভ্র, কাউকে মানেনি।কারোর তোয়াক্কা করেনি।ভাঙচূর করেছে। অভ্র ধরেবেঁধে রাখতে হিমসিম খাচ্ছিলো বড্ড।রুদ্র মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে পরে তারপর। হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়।কতক্ষন নিশব্দে কাঁদে।এরপর হুট করেই উঠে দাঁড়ায়।সার্ভেন্ট কে বলা হয় ব্যাগ গুছিয়ে দিতে।আজ এই মুহুর্তে দেশ ত্যাগ করবে।সাথে ত্যাগ হবে সেঁজুতির মায়া।অভ্রর শত অনুরোধ ফিকে হয় সেখানে।রুদ্র শোনেনা।বেরিয়ে পরে রেহান কে সাথে নিয়ে।অভ্র বহুবার সেঁজুতিকে ফোন করলো,চিন্তায় তার মাথা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।এত কিছু শুনেও মেয়েটা মত বদলালো না? এ কেমন পাষন্ড নারী?তবে ওর কান্নাগুলো ছিলো মিথ্যে?সেঁজুতির ফোন বন্ধ পেয়ে অভ্রর যেন আরো রাগ বাড়লো।বিড়বিড় করে সেঁজুতি কে গালি দিতে মন চাইলো।কিন্তু বড়ভাইয়ের প্রেয়সী বলেই বিবেকে বাঁধলো হয়ত!
____
রুদ্রর চোখ ভিজে উঠছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছলো কবার।লাভই হচ্ছেনা। আবার ভিজে যাচ্ছে।রেহান বারবার চোরা চোখে,মুখ কালো করে রুদ্রর কান্না দেখছে।রুদ্র বিরক্ত হলো নিজের ওপর। একটা মেয়ের জন্যে এত কীসের কান্না?কীসের শোক?বিরক্তিটা ঝাড়লো রেহানের ওপর। কঁড়া কন্ঠে বলল ‘ গ্লাস ঘোরাও।
সঙ্গে সঙ্গে রেহান ভিউ মিরর ঘুরিয়ে দিলো।এখন আর রুদ্রকে দেখা যাচ্ছেনা।রুদ্র ঠোঁট কামড়ে ধরে রাস্তা দেখছে।কান্না আটকাচ্ছে হয়ত।
এ জীবনে আর সেঁজুতিকে পাওয়া হলোনা। কথাটি যতবার মাথায় আসছে ততবার ভেতরের রক্তক্ষরন কয়েক গুনে বাড়ছে।কেন ভালোবাসতে গেলো?একপাক্ষিক ভালোবাসায় এত কষ্ট!এর থেকে তো আগের জীবনই ভালো ছিলো।ঝঞ্জাট মুক্ত,নির্ভেজাল।অন্তত ক্ষত বিক্ষত হৃদপিন্ড টা কে বয়ে বেড়াতে হয়নি।কাউকে না পাওয়ার দুঃখ সেখানে ছিলোনা।না ছিলো ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়।
সেঁজুতি সব আশা,ভরসা মিথ্যে প্রমান করলো।বউ হয়ে গেলো আরেকজনের।রুদ্র অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করলো “স্বার্থপর মেয়ে!
‘ এসিটা বন্ধ করো রেহান।
রেহান তাই করলো।রুদ্র গ্লাস খুলে দিলো গাড়ির।সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো।হঠাৎ কী মনে করে সিগারেটের উড়ে যাওয়া ছাই গুলোর দিক মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থাকলো।ভালোবাসাটা কী এই সিগারেটের মতন নয়?যার শুরু আগুন দিয়ে হলেও শেষ হবে ছাই দিয়ে?
রুদ্রর ধ্যান ভাঙলো গাড়ি ব্রেক কষায়।রেহান ঘাড় ফিরিয়ে বলল
‘স্যার এসে গেছি…
রুদ্র মাথা দোলায়।সিগারেট ফেলে দিয়ে নেমে দাড়ালো।রক্তিম চোখদুটো লোকাতে সানগ্লাস পরলো।রেহান ও বের হলো।গাড়ির ডিকি খুলতে যাবে তখন রুদ্র এসে কাঁধে হাত রাখলো ওর।রেহান অবাক চোখে তাকালো।রুদ্র নম্র কন্ঠে বলল
” অনেক বকাঝকা করেছি তোমায় রেহান।পারলে ভুলে যেও সেসব।পরিবারের সাথে নিজেরও খেয়াল রেখ।আর আমার ভাইটারও।
রেহান এবার কেঁদেই ফেলল।রুদ্র ক্ষীন হেসে রেহান কে বুকে জড়ায়।রেহানের চোখ যেন তাতে বেরিয়ে আসে।রুদ্র সরে এলো। বলল ‘ যাও। লাগেজ নামিয়ে আনো।
রেহান মাথা নাড়ে।চোখ মুছে ডিকি খুলতে এগোয়।
‘ভাই?
অভ্রর গলা শুনে রুদ্র চমকে পেছনে তাকালো।ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘সেই এলিই?
অভ্র এগিয়ে এলো।বোজা কন্ঠে বলল,
‘যেওনা ভাই,,,প্লিজ
রুদ্র মেকি শক্ত কন্ঠে বলল,
‘আর লাভ নেই অভ্র।সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ আমার।
‘ঐ একটা মেয়ের জন্যে সব ছেড়েছুড়ে যাবে ভাই?
রুদ্র উদাস হাসে,
‘ ঐ মেয়েটাই যে আমার কী ছিলো রে অভ্র। আজ বুঝছি।
‘ আমার কথা ভাবছোনা?তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো?আমি তোমার নিজের ভাই হলে পারতে এমন করতে?
রুদ্র বোবা বনে গেলো সেকেন্ডের জন্যে।ফিচেল কন্ঠে বলল
‘ এভাবে বলতে পারলি?তুই আমার পর?
অভ্র কথা বলেনা।বিদ্যুৎ বেগে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে।
‘ যেওনা ভাই যেওনা।
রুদ্র স্ফীত হাসলো,অভ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘আমি কি একেবারে যাচ্ছি নাকি রে বোঁকা!কয়েক বছর পর আবার ফিরবো।তোর বিয়ে দিতে হবেনা?? ভাসুর হবো তারপর তোর বাচ্চাদের জেঠু হবো… অনেক কাজ বাকি এখনও।
অভ্র হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো,রুদ্র বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,
‘ছাড় অভ্র।মেয়েদের মতো কাঁদবিনা।আর বাচ্চাদের মতোন বায়না তো একদম ধরবিনা।
অভ্র সরে এলো।কপট রাগ দেখিয়ে বলল ‘ তার মানে তুমি যাবেই?
রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো। ‘ ফ্লাইটের সময় হয়ে এসছে অভ্র।
অভ্রর পাশ কাটিয়ে রুদ্র চলে যায়।অভ্র রাগে দুঃখে গাড়িতে লাথি মারলো।এই সব কিছুর মূলে ওই মেয়ে।অকৃতজ্ঞ কোথাকারে!
_____
এয়ারপোর্টের চেকিং গেটের সামনে দাঁড়ালো রুদ্র।রেহানের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালো। অভ্রকে দেখা যাচ্ছে।মন মরা হয়ে চেয়ে আছে ছেলেটা।একিরকম মন মরা রেহান ও।রুদ্র দুজনকেই একবার একবার করে দেখে নেয়।হাত নেড়ে বিদায় জানায়।চারপাশে ক্লান্ত দৃষ্টি ফেলে কাউকে মিথ্যে মিথ্যে খোঁজে,মনে মনে বলে,
“ভালো থাকবেন সেঁজুতি।নিজের নতুন জীবনে সুখী হবেন।আর আমি জ্বালাবোনা আপনাকে।এই শেষ!
অনেক কষ্টে ফেরত আসা অশ্রুটুকুন সংযত করলো রুদ্র। কাঁচের গেট ঠেলে ঢুকবে এর আগেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো কেউ একজন।রুদ্র এবার সত্যিই বিরক্ত হলো।ফিরে না তাকিয়ে বলল
“এবার আর নিতে পারছিনা অভ্র।ছাড়। আমি যাবোই।
” যেতে দিলে তো যাবেন।
কাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বর শুনে স্তব্ধ রুদ্র।বিদ্যুৎ বেগে ঘাড় ঘোরালো।সেঁজুতি মুখ ফুলিয়ে চেয়ে আছে।রুদ্র অবিশ্বাসের কন্ঠে বলল,
‘আপনি?
সেঁজুতি নাক মুখ ফুলিয়ে বলল ‘আমাকে এভাবে একা রেখে চলে যাচ্ছেন?এত সাহস কোথ থেকে পেলেন আপনি?
রুদ্র যেন এখনও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এটা কী সেঁজুতি?
‘ আপনি কী সত্যি সত্যি এসেছেন?
‘ না।আমার ভূত এসেছে।
তর্ক করার বহরে রুদ্র বুঝলো এটা সত্যিই সেঁজুতি। কিন্তু খুশির বদলে অভিমান মাথা চাঁড়া দিলো।অন্যদিক চেয়ে বলল,
‘ কেন এসেছেন?আপনি না এখন অন্যের বিয়ে করা বউ?
সেঁজুতি দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ও তাই?তাহলে আপনি ধরেই নিয়েছেন আমি অন্যের হয়ে গেছি?তবে আর কি!ফিরে যাচ্ছি আমি।
সেঁজুতি চলে যাওয়ার ভান করতেই রুদ্র তড়িঘড়ি করে হাত টেনে ধরলো। সেঁজুতি পেছন ফিরলোনা।মিটিমিটি হাসছে।রুদ্র অনুরোধ করলো,
“যাবেন না সেঁজুতি!
“তবে যে বললেন আমি অন্যের।
‘তাহলে আপনি কার?
সেঁজুতি ঘুরে তাকায়।রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলে,
“জানেন না?
রুদ্র নিষ্পলক চেয়ে মাথা নাঁড়ে দুদিকে ‘ সে জানেনা।
সেঁজুতি চোখ নামিয়ে মুচকি হেসে বলল ‘ আপনার।
রুদ্র যেন ঘোরে ছিলো।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল ‘হু?আর,আর আপনার বিয়ে?
‘ ভেঙে দিয়েছি।
রুদ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বলল ‘ শেফালী যে বলল আপনার___
সেঁজুতি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল ‘ শেফালীকে আপনি কী করে চিনলেন?
সেঁজুতি ভ্রু নাঁচায়।সব জেনেও না বোঝার ভান করছে ও।রুদ্র জ্বিভ কাটলো।মুখ ফসকে বলে ফেলেছে নামটা।আমতা-আমতা করলো কিছুক্ষন।সেঁজুতি বলল
‘ থাক! আর বানিয়ে বলার দরকার নেই।আমি সব জানি।
রুদ্র ভঁড়কে বলল ‘ কী জানেন?
‘ সেসব আপনার না জানলেও চলবে।আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।আর শেফালীর ফোন থেকে ওসব আমিই পাঠিয়েছি।বুঝেছেন?
রুদ্র বোঁকা বোঁকা চাউনীতে মাথা দোলালো।তেমনি অবুঝের মত জিজ্ঞেস করলো’ বিয়ে ভেঙেছেন কেন?
সেঁজুতি এবার মহাবিরক্ত।সব কি মুখ ফুঁটে বলতে হবে?মাথামোটা লোকটা বুঝতে পারছেনা?রুদ্র একী প্রশ্ন আবার করলো।
‘কেন ভাঙবে আবার?আপনার জন্যে ভেঙেছে।
রুদ্র চোখ বড় করে বলল,
“আমার জন্যে? কিন্তু আমিতো কিছু করিনি।
” বললেই হলো করেন নি?এই যে আমার মন চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছেন এটা অপরাধ নয়?
রুদ্র বিমুঢ়।
‘মমানে? বিস্ময়ে গলা কেঁপে এলো রুদ্রর।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
মানে জানেন না??
রুদ্র এবারেও মাথা নেড়ে। সে জানেনা।
সেঁজুতি দপায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়।রুদ্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ভালোবাসি।
রুদ্রর গোটা দেহে অদ্ভূত শিহরন হলো।শরীরের রক্তপ্রবাহ থেমে গেলো যেন।ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ করে উঠলো হৃদপিণ্ড টা।ওর বিস্মিত চাউনীতে সেঁজুতি গভীর দৃষ্টি রেখে বলল
“ভালোবাসি।
রুদ্র মূর্তির মত ঠোঁট নেড়ে বলল,
” আবার বলুন..
“ভালোবাসি।
“আরেকবার..
” ভালোবাসি।
‘আরেকবার।
‘ আর পারবনা।
রুদ্র তখনও হা করে তাকিয়ে।ঠিক শুনলো তো?সেঁজুতি ভালোবাসে?সত্যিই বাসে?সেঁজুতি ওড়নার মাথা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,
‘হা করে কি দেখছেন? জড়িয়ে ধরবেন না?
রুদ্র যেন হুশে ফেরে।নিশ্চিত হতে শুধায়,
‘ সত্যিই জড়িয়ে ধরবো.??
‘মিথ্যে মিথ্যে জড়িয়ে ধরা যায়?
রুদ্র ঘাড় চুল্কে বলল,
‘না মানে,ইয়ে…..
সেঁজুতি হেসে বলল,
‘রুদ্র রওশন চৌধুরী ও কিনা তোঁতলাচ্ছে?
রুদ্র আর সময় নষ্ট করলোনা।সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতি কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।এত শক্ত করে ধরলো যে সেঁজুতির শ্বাস আটকে আসার জোগাড়। অথচ টু শব্দ করলোনা।সে ব্যাস্ত রুদ্রর গায়ের ঘ্রানে মিশতে।বুকটা প্রশান্ত হলে রুদ্র নিজেই মৃদূ হাত ঢিলে করলো।আওড়ালো
‘ আমিও ভালোবাসি সেঁজুতি। অনেক বেশি ভালোবাসি।
সেঁজুতি মুখ লোকালো ওর প্রসস্থ বুকে।এত শান্তি কেন এখানে?
সমানে মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে সিটি বাজাচ্ছে অভ্র।আনন্দ বাঁধ মানছেনা।পাশেই হেসে দাঁড়িয়ে আছে রেহান, আবির, এরিকা।ওদের দেখে সেঁজুতি সরে আসতে চাইলেও বাঁধা দিলো রুদ্র।
‘ অলরেডি সবাই দেখে নিয়েছে, সো এখন আর লজ্জ্বা পেয়ে লাভ নেই।
সবার আগে এগিয়ে এলো অভ্র। আমুদে কন্ঠে বলল,
“বাহ ভাই বাহ।কি সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের।বলেছিলাম না ভাই?ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখতে।দেখলে তো অবশেষে সফল হলে?
রুদ্র ভাব নিয়ে বলল
” দিন দিন ভাইয়ের মতোই ট্যালেন্টেড হচ্ছিস। ভেরী ওয়েল।
অভ্র গাল ফোলালো,
‘ওমনি ক্রেডিট নিয়ে নিলে?
সেঁজুতি আর আবিরের চোখাচোখি হতেই আবির চোখ নামিয়ে ফেলল লজ্জ্বায়।ঐদিনের পর সেঁজুতির সামনেও পরেনি।সেঁজুতি আবিরের হাবভাবে হেসে ফেলল,
“আরে আবির , এতো লজ্জ্বা পাচ্ছো কেন? তোমার জন্যেই না আমি বুঝতে পেরেছি আমি স্যার কে ভালোবাসি।তুমি যা করেছো আমাদের জন্যই তো..
আবির খুশি খুশি কন্ঠে বলল
‘তাহলে তুমি রেগে নেই?
‘প্রথমে ছিলাম,,,কিন্তু এখন নেই।
আবির বুকে হাত দিয়ে বলল,
‘যাক বাবা!একটা বড় পাথর নামিয়ে দিলে আমার বুক থেকে।আমিতো ভেবেছিলাম দেখা হলেই ঠাস ঠাস চড় লাগাবে।
সেঁজুতি লজ্জ্বা পেলো।প্রসঙ্গ এড়াতে বলল
‘ওসব বাদ দাও । তোমার ওয়াইফ কিন্তু ভারী মিষ্টি।আলাপ করাবেনা?
-‘ওহ হ্যা হ্যা।সেঁজুতি ও হচ্ছে আমার মিসেস।আর এরিকা ও কে সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলতে হবেনা।
-এরিকা হেসে ইংরেজিতে বলল ‘ একদম না।আমি চিনি ওনাকে।উনিইতো রুদ্র ভাইয়ের প্রান ভোঁমড়া।
সেঁজুতি নুইয়ে পরলো লজ্জ্বায়।
অভ্র তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে।রুদ্রর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। সারা মুখ জুড়ে বিচরন করছে প্রশান্তি।সুখ তারার মত জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো।তার ভাই আজ খুশি। বড্ড খুশি।আর এই খুশিটাই তো দেখতে চেয়েছিলো ও।সত্যিই হয়তো নিজের ভালোবাসাকে আপন করে পাওয়ার মত সুখ,আনন্দ অত্র পৃথিবীর বুকে আর কোনও কিছুতে নেই।
অভ্র দুষ্টুমি করে বলল,
‘ভাই?তোমার না ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে?যাবেনা?
রুদ্র চোখ পাঁকিয়ে তাকাতেই হেসে ফেলল সবাই।রুদ্র ও হাসলো।মাথা চুল্কে বলল,
‘এই দেশ আর ছাড়বনা।
‘ হ্যা এখন তো দেবদাসের পারবতি হাজির।দেশ ছেড়ে লাভ কী?
‘- তুই আর মানুষ হলিনা অভ্র।
অভ্র একটা লম্বা শ্বাস নিলো।দুহাত ওপরে তুলে বলল,
‘ যাক! সব ভালোয় ভালোয় মিটলো, এবার একটা জম্পেস খাওয়া দাওয়া দরকার।ভাই,আজ আমাদের বাড়িতে একটা পার্টি রাখলে কেমন হয়?
সবাই এক যোগে তাল মেলালো অভ্রর কথায়।
‘ চলো তাহলে? আবির, চলুন সবাই মিলে জোগাড় যন্ত করে ফেলি?
‘ হ্যা হ্যা চলুন…
রুদ্র মিনমিন করে বলল ‘ ইয়ে,তোরা যা অভ্র।আমি আসছি…
অভ্র মিটিমিটি হেসে বলল ‘ সেঁজুতি কে তবে নিয়ে যাই?
রুদ্র ভ্রু কোঁচকাতেই অভ্র ব্যাস্ত কন্ঠে বলল ‘ না বাবা আমার অত সাহস নেই।তোমরাই থাকো…
_____
সেঁজুতির আঙুলের ভাঁজে রুদ্রর এক হাতের আঙুল।অন্য হাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
আজ আর বাইরে তাকিয়ে নয়।রুদ্র কে একভাবে,একমনে দেখছে সেঁজুতি। হঠাৎ রুদ্র বলে ওঠে,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে গাড়ি চালাতে যে বড্ড মুশকিলে পরতে হবে ম্যাডাম…
‘হোক।আমি তাকিয়েই থাকবো।
রুদ্র তাকালো,ডান ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ কি দেখছেন তাকিয়ে??
‘ আপনার হেয়ার স্টাইল দেখছি।
রুদ্র শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসি থামিয়ে বলল,
“আমার কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই গেলো।বিয়ে ভাঙলেন কেনো?
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
” আবার? বারবার কি ভালোবাসি এটা শুনতে ইচ্ছে করছে?
রুদ্র গাঢ় স্বরে বলল,
” এটা শোনার জন্যে তো কম ছটফট করিনি।শোনালে মন্দ হয়না।
‘বলব।সারাজীবন বলতেই তো আপনার হাত ধরেছি।
সেঁজুতি রুদ্রর হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল।
রুদ্র মুগ্ধ হাসলো,
” বিয়েটা ভাঙলেন কি করে?এটা বলতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?
‘ না তা নেই।আসলে আমি রাফসান কে বলে দিয়েছি সব সত্যি।
‘ কোন সত্যি?
‘আপনাকে নিয়ে আমার জীবনের সব থেকে বড় আর প্রথম সত্যিটা।
‘ব্যাস? এতেই কাজ হয়ে গেলো?
সেঁজুতি থেমে থেমে বলল,
-‘আমি সেভাবে বলিনি।একটু রং ছড়িয়ে বলেছি সাথে। বলেছি যে আপনার সাথে আমার গত দু বছর ধরে প্রেম চলছে আর আমাদের ফিজিক্যাল ও হয়েছে। আমি জানি কোনও ছেলেই এটা শুনলে বিয়েতে রাজি হবেনা।আমাকে আলাদা করে কিছুই করতে হয়নি।রাফসান নিজেই বিয়ে ভেঙে দিলো এতে।
রুদ্র অবাক হয়ে বলল,
‘যতটা বোঁকা ভাবতাম ততটা নন।
‘ আমি কিন্তু অতটাও চালাক নই।আবিরকেও তো সত্যিটা জানিয়েছি।ওতো কি সুন্দর ভাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো!খুব অবাক হয়েছিলাম।ভেবেছিলাম হয়তো সব ছেলে এক নয়।অবশ্য পরেই না বুঝলাম সব নাটক।আপনার ইশারাতেই চলছিলো ব্যাটা।
রুদ্র সন্দেহী চোখে তাকালো,
“আবিরকে পছন্দ ছিলো অনেক??
‘কখনওই না।আমার শুধু এই রাগী,মেজাজি লোকটাকেই পছন্দ।
রুদ্র মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ তাহলে এতদিন এলেনা কেন?জানো কত কষ্ট পাচ্ছিলাম?
‘ আপনি একাই বুঝি পেয়েছেন?আমি পাইনি?
‘পেয়েছো?
‘ একশবার।
” একটা বিষয় খেয়াল করলে?
‘কী?
‘আমি কিন্তু তোমায় তুমি বললাম।
সেঁজুতি মুচকি হেসে বলল,
‘ তাতে কী হয়েছে?আপনার মুখে তুমিই সুন্দর।
‘তাই?তাহলে তোমার বলা উচিত না?
‘ সময় লাগবে।
‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
‘ হু।
‘ এখন আর ভয় করছেনা?এখন আর মনে হচ্ছেনা আমাকে ভরসা করা ভুল?
সেঁজুতি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘একদম না।আপনাকে খারাপ জেনেই মন দিয়েছিলাম।দেরিতে হলেও আমার সব ভুল ধারনা ভেঙে গিয়েছে। আপনার প্রতি আমার মনে যা খারাপ ভাবনা ছিলো সব মুছে গেছে।আমি জানি, ভালোবেসে আমার হাত আঁকড়ে ধরার মত আপনার মত আর কেউ নেই।
রুদ্র শুভ্র হাসলো।সেঁজুতি মায়া মায়া চোখে চেয়ে বলল,
‘অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা?
রুদ্র সেঁজুতির হাতের উল্টোপঠে চুমু খেলো।সেঁজুতি কেঁপে ওঠে ঈষৎ। রুদ্র শীতল কন্ঠে বলল,
‘সব কষ্টের থেকে আজকের সুখের পরিমান টা যে অনেক বেশি।তাই সব গোল্লায় যাক। অবশেষে ভালো তো বেসেছো এতেই চলবে।
এই এক মিনিট এক মিনিট, তুমি কি করে জানলে যে আবির আমার কথায় কাজ করছিলো??
‘ সে আমি যেভাবেই জেনে থাকি।
সেটাতো বড় কথা নয়।বড় কথা এটাই যে আজ থেকে ‘আমি আপনার আর শুধু আপনারই।
কথাটা শুনেই গাড়িতে ব্রেক কষলো রুদ্র।সেঁজুতি বুঝতে না পেরে বলল
‘ কি হলো?
রুদ্র গভীর চোখে চাইলো,
‘বলেছিলাম না?এই কথাটা একদিন তুমিই বলবে?
সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
“শুধু আজ নয়,এই কথাটা আজ থেকে সারাজীবন বলব আমি।
রুদ্রর চোখে মুখে খেলে গেলো একরাশ মুগ্ধতা। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো। ঘুরে গিয়ে সেঁজুতির পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল
“নামো।
রুদ্রর আচরন কিছুই বুঝছেনা সেঁজুতি। তবুও রুদ্রর কথাতে নামলো।মাটিতে পা ছোঁয়ানোর আগেই হুট করে রুদ্র কোলে তুলে নেয়।সেঁজুতি হকচকায় প্রচন্ড।ভয়ে পেয়ে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরলো।পরমুহূর্তে লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হয়ে বলল,
‘ ককি করছেন?
রুদ্র হাসলো।ওকে কোলে নিয়েই সামনে এগোলো।খোলা মাঠ,চারপাশে গাছ।ছোট ছোট বেঞ্চ।অল্প হেটে রুদ্র সেঁজুতি কে নামালো।তখনি ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।হঠাৎ বৃষ্টির আক্রমনে সেঁজুতি হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করলো।সেঁজুতির দিকে চেয়ে চেয়েই রুদ্র পেছনে এগোচ্ছে।সাদা শার্ট ভিজে দৃশ্যমান চওড়া দেহ।সেঁজুতি বুঝলো রুদ্র ভিজতে চাচ্ছে।তাই আর কথা বললনা।রুদ্র হঠাৎ দুহাত দুদিকে মেলে দিলো।নিরেট কন্ঠে বলল,
“””””আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
মনের আদ্যোপান্ত
তুমি আমার দুরন্ত মনের “”””””
একটু খানি প্রশান্ত
“”””””””তুমি আমার বেঁচে থাকার প্রেরনায়
মোহময়ী আশা
তুমিই আমার এ জীবনে…..”””””””
“””””প্রথম আর শেষ ভালোবাসা””””””
‘ ভালোবাসি সেঁজুতি। অকারনে ভালোবাসি।অজান্তেই ভালোবাসি।সারাজীবন বাসব।এক বিন্দু কমতি হবেনা এই ভালোবাসার।
সেঁজুতির চোখ ছলছল করে ওঠে।বৃষ্টির ঝাপটায় আলাদা ভাবে বোঝা যায়না তাদের।ছুটে গিয়ে রুদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পরলো সেঁজুতি।
‘ ভালোবাসবেন তো এভাবে?
সেজুতির ভেজা চুল সরিয়ে কপালে এক গভীর চুঁমু আঁকলো রুদ্র।হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,
“মরার আগ পর্যন্ত বাসব।
দুজনের দেহ ভিজে চুপচুপে।অথচ ভ্রুক্ষেপহীন দুজনেই।বুকের সাথে সেঁজুতি কে মিশিয়ে ফেলছে রুদ্র।চাইলে ঢুকিয়ে রাখতো ভেতরে।
এই তো শুরু হলো তাদের #প্রনয়ের গল্প।এই বাতাস,সবুজ ঘাস,খোলা মাঠ আর বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটাই না হয় তার সাক্ষী হয়ে থাকুক?
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here