#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব-১৩
অফিসের আজ প্রথম দিন।দিনটি সেঁজুতির পরীক্ষার দিনের মতোই লাগছে।মানসিক প্রস্তুতি,মাথা ভর্তি টেনশন সবটা ঠিক একইরকম।দশটায় অফিস।সেঁজুতি সকাল সকাল উঠে বাড়ির সব কাজ সেড়েছে।বাবাকে সাথে নিয়ে নাস্তাও খেয়েছে।বাবাকে ওষুধ খাইয়ে তৈরী হয়ে এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো সেঁজুতি। দোয়া দুরুদ পাঠ করে দুরুদুরু বুক নিয়ে পা বাড়ালো গন্তব্যে।আজ তার জীবনের একটি স্বপ্ন পূরন হতে যাচ্ছে।ছোট থেকেই নিজেকে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেখার ইচ্ছে সেঁজুতির।পড়ছিলোও সেই লাইনে।এত দ্রুত যে একটা ভালো চাকরি পাবে সে ভাবতেই পারেনি।শুধুমাত্র তোহাকে জানিয়েছে চাকরীর বিষয়ে।তবে কিভাবে সিলেক্ট হয়েছে সেটুকু বলতে চেয়েও বলেনি।ম্যানেজার লোকটি মানা করেছিলেন তাই।রিক্সায় বসে সেঁজুতি লম্বা করে শ্বাস নিলো।উচ্ছ্বল,মুগ্ধ শ্বাস।মন ভীষণ ভালো আজ।
চুল গুলো বেনি করে এক পাশে রাখা।সামনের চুল গুলো কালো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।কানে এক জোড়া পাথরের দুল। পড়নে সবুজ থ্রি পিস, কাঁধে ব্যাগ।এই তার সাজগোজ।
অফিসের সামনে নেমে,ভাঁড়া চুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি। যত এগোচ্ছে বুক তত কাঁপছে চিন্তায়।সে পারবেতো তার দায়িত্ব ঠিকঠাক সামলাতে?ঢুকতেই ম্যানেজারকে দেখতে পেলো।ওকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি।আজ ও একইরকম সাজপোশাক।আশরাফুল হেসে জিজ্ঞেস করলেন ” ভালো আছেন ম্যাডাম?
মধ্যবয়সী লোক।ম্যাডাম ডাকাতে অস্বস্তি লাগলো সেঁজুতির।কাজের দিক থেকে হয়ত সে ওপরের পদে তাই লোকটা ডেকেছে।কিন্তু তারতো অভ্যেসের খাতা শূন্য।ইতস্তত করে বলল ‘ জ্বি।আপনি?
‘ বেশ ভালো আছি।আসুন আপনাকে আপনার ডেস্ক দেখিয়ে দেই।
সেঁজুতির ভালোই হলো।একা একা কোন দিকে যেত সে নিয়েই চিন্তা করছিলো এতক্ষন।উনি আসাতে বেঁচে গেলো অল্পস্বল্প। লোকটি কিছু সময় কুশল বিনিময় করে চলে গেলেন।সেঁজুতি চোখ বুজে দুবার ঘন শ্বাস ফেলল।এভাবে ভয়,কাঁপা-কাঁপি এসবের সময় নেই তার।অনেক দায়িত্ব এখন। অনেক।কনফিডেন্স বাড়াতে হবে ।একটা ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও যেন বস ভুল ধরতে না পারেন সে ব্যাপারে তটস্থ থাকতে হবে সবসময়। সেঁজুতি এদিক ওদিক তাকালো।অভ্রকে খুঁজলো হয়ত।একমাত্র ওই পরিচিত বলতে গেলে।এভাবে বসে থাকবে নাকী কোনো কাজ করবে সে জানেনা।বলাও হয়নি।যেঁচে কী একবার যাবে অভ্রর কেবিনে? ভালো দেখাবে সেটা?
____
রোলিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে রুদ্র।আয়েশী ভঙ্গি তার।একটু পরপর চেয়ার সমেত দুপাশে দোল খাচ্ছে।চোখ দুটো তীক্ষ্ণতা নিয়ে সামনে নিবদ্ধ।তার কেবিনের পুরোটাই কাঁচ দিয়ে তৈরী।বাইরের সব কিছু স্বচ্ছ ভাবে দেখা যায়।অথচ বাইরের কেউ তার টিকিটাও দেখেনা এই কাঁচ গলিয়ে।এমন ভাবেই সে নিজের স্পেস টা তৈরি করেছিলো।কেবিনে বসেই পুরো ডেস্ক দেখা যায়।এই কথা সবাই জানে।তাই রুদ্র অফিসে থাকাকালীন কেউ গল্প করার সাহস করেনা।যন্ত্রের মতো কাজ করে।ঈগলের মতো চোখ দিয়ে রুদ্র সব খবর তার নখদর্পনে রাখে সে ব্যাপারে সবাই জ্ঞাত।জানেনা শুধু সেঁজুতি। জানলে কী বুঝতো,ঠিক এই সময় রুদ্র মন দিয়ে দেখছে তাকে।নিঁখুত ভাবে তার প্রত্যেকটা মুখভঙ্গি পরোখ করছে।মূলত, রুদ্রর এসিস্ট্যান্টের জন্যে অফিসে আলাদা কেবিন থাকে।কিন্তু রুদ্র ইচ্ছে করেই সেঁজুতির ডেস্ক টা তার কেবিনের একদম সামনে দিয়েছে।কেন দিয়েছে? সেটা শুধুমাত্র রহস্য ময় এই লোকটাই জানে।
রুদ্র অনেকক্ষন পর সোজা হয়ে বসলো।চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নীচের দিক তাকালো।একটু পর আবার সেঁজুতির দিকে।সেঁজুতি আঙুলের ফাঁকে কলম নাড়াচ্ছে।
রুদ্র বাঁকা হাসলো একটু,
“এবার তাহলে এই লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটানো যাক?আর ইউ রেডি মিস সে….জু…..তি?”
______
সেঁজুতি বোর হচ্ছিলো ভীষণ। কাউকে চেনেনা, পরিচয় নেই।কী করবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো যখন,তখনি পিওন পদের লোকটি ফিনফিনে কন্ঠে বলে ওঠে,
“ম্যাডাম! আপনাকে বস ডাকছে…
সেঁজুতি লোকটিকে চেনে।কাল একে দেখেছিলো ফাইল এদিক থেকে ওদিক আনা নেয়া করতে।আবার যখন সে অভ্রর কেবিনে ছিলো তখন ইনিই চা, আর দুটো স্যান্ডউইচ দিয়ে গেছিলেন।
হাল্কা ঘাঁড় নেড়ে বলল ‘ যাচ্ছি।
রুদ্রর কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো সেঁজুতি। গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করতে দেখে রুদ্রর হাসি পেলো।মেয়েটি যদি জানতো সে আসা থেকেই রুদ্র তাকে দেখছিলো তখন কী করবে? সেঁজুতি যেই হাত উঁচিয়ে নক করবে দরজায়, তখনি দরজা রিমোর্টের বাটন টিপে খুলে দিলো রুদ্র। সেঁজুতি প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। খানিকটা ভঁড়কায়ও।সেকেন্ড খানিক গবেষণা করে আঁওড়ালো ‘ এটা মনে হয় রিমোর্ট কন্ট্রোল দরজা।
তখনি রুদ্র ভেতর থেকে কঠিন কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হলে বাইরে যান।সেঁজুতি নঁড়বড়ে খুঁটির মতোন কেঁপে উঠলো।মৃদূ মৃদূ কন্ঠে বলল
-আসব স্যার?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো ‘ ইয়েস!
সেঁজুতি দরজা টানবে কি টানবে না ভাবলো।এমনি এমনি খুলেছে যেভাবে সেভাবেই কী লেগে যাবে আবার? দরজা হা করে খুলে রেখে গেলে যদি বস রেগে যান?দু সেকেন্ড ভেবে দরজা টানলো।নরম পায়ে এসে রুদ্রর টেবিলের কোনায় দাঁড়ালো।কেবিন থেকে একাবার বাইরের দিকে তাকাতেই ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে এলো।এখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে? তার মানে তারা যা করবে লোকটা সব দেখবে? কী এক ঝামেলা! সেঁজুতি চোখ সরিয়ে এনে মেঝের দিক রাখলো।বস নামক
লোকটিকে সে চেনে।দুবার দেখা হলো।কথাও হয়েছে।তাও কেমন স্বস্তিবোধ হচ্ছেনা। অজানা আশঙ্কায় বুক ধড়ফড় করছে।উনি কি জানেন আমার কথা? নাকী অভ্রর মতোন অবাক হবেন আমায় দেখে।সেঁজুতি চোখ তুলে তাকায়।রুদ্র চেয়ার নিয়ে উল্টো হয়ে ঘুরে আছে।লোকটাকে চিনলেও মুখ দেখেনি।নাম অব্দি জানেনা।সেঁজুতির মনে পড়লো লোকটির সেদিন তাকে কোলে তোলার মুহুর্তটা।সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি কয়েকশ গুন বাড়লো।ওইদিন গাড়িতে সে লোকটির সাথে একদফা ঝগড়া ও করেছিলো। আজ সেই কীনা এখন তার বস।বারবার উঠতে বসতে স্যার সম্বোধন করতে হবে।সত্যিই পৃথিবী গোল!
সেঁজুতি যখন ভাবনায় মশগুল।রুদ্র তখন ভরাট কন্ঠে বলে,
“তো মিস সেঁজুতি, অফিস কেমন লাগছে আপনার?
সেঁজুতি বুঝলো রুদ্র তার কথা জানে।নাহলে নাম কীভাবে বললেন? ছোট করে উত্তর দিলো,
— গুড স্যার।
— অফিসের সবাইকে?
— গুড স্যার।
— আর আপনার বস কে?
তাৎক্ষণিক চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে ফিরলো রুদ্র।
‘গুড স্যা…….. সেঁজুতি এতক্ষন নিচের দিক চেয়ে ছিলো।রুদ্র ঘুরেছে বুঝতে পেরে চোখ ওঠাতেই কথাটুকু গলায় আটকে পরলো।
সেজুথির মুখের অবস্থা দেখার মতোন মনে হলো রুদ্রর।সূচালো হাসিটা আরও দ্বিগুন বাড়লো যেন।মেয়েটার এই এক্সপ্রেশন টা দেখার জন্যেই তো কাল রাত থেকে তর সইছিলোনা তার।ভাবছিলো কখন সকাল হবে আর সেঁজুতির এই মিশ্র চাউনীটা দেখবে।যেখানে থাকবে, ভয়, বিস্ময় , অস্বস্তি,কৌতুহল, আর লাভার মত ক্রোধ।আর এত কিছু একসাথে মন ভরে উপভোগ করবে রুদ্র।এই যে দেখো..কি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।,এতো টা সারপ্রাইজড হয়তো ও এ জীবনে হয়নি…
সেজুতির মুখ থেকে কোনও কথা বেরোচ্ছেনা।জ্বিভ যেন অসাড় হয়ে পরলো।গোটা শরীরটা পরিনত হয়েছে ফ্রিজে।নড়তেও পারছেনা যেন।এই লোকটা! এই লোকটা তো রুদ্র রওশন চৌধুরী। সে এখানে কেন? কী করে এলো?অনেকক্ষন পরেও যখন সেঁজুতির কোনো শব্দ নেই রুদ্র তখন নিজেই ধৈর্য হারালো। কৌতুক কন্ঠে বলল
“বললেন না তো,বস কে কেমন লাগল?
সেঁজুতি যেন নিজেতে ফিরলো।থেমে থেমে বেগ নিয়ে বলল,
” আপনি! আপনি তো রুদ্র রওশন চৌধুরী? আপনি এখানে কেন?
রুদ্র নিরেট কন্ঠে বলে,
— ইয়েস,আমিই রুদ্র রওশন চৌধুরী। আজ থেকে আপনি যার P. A আই মিন ব্যাক্তিগত সহকারী!
সেঁজুতি মাথা চেপে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল মেঝেতে।পরমুহূর্তে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
— এটা….এটা কি করে স..সম্ভব?আমার বস তো মিঃঅভ্র চৌধুরীর ভাই ছিলেন তাইনা?
রুদ্র একিরকম বাঁকা হাসলো
“আমিইতো অভ্র চৌধুরীর একমাত্র ভাই।
সেঁজুতির গাঢ় বিস্ময় এবার মাত্রা ছাড়ালো।আঙুল উঁচিয়ে মনে করার ভঙ্গি করে বলল
‘তার মানে ওই লোকটা…ওই মাস্ক পরা লোকটা… আপনি ছিলেন?
‘ yeah!
সেঁজুতি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো।
“এই সব কিছু আপনি জেনেবুঝে করেছেন?
এইজন্যেই আপনি ওভাবে মুখ ঢেকে গিয়েছিলেন আমার সামনে?
রুদ্র মাথা নেঁড়ে বলল
-ঠিক ধরেছেন।
” এইসব আপনার প্রিপ্ল্যান্ড?? চাকরী দেয়ার ব্যাপারটা? সেটা মিথ্যে?
রুদ্রর দৃঢ় জবাব, ” অভিয়েস্লি..
সেঁজুতি কতক্ষন শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে চেয়ে থাকলো।পরক্ষনেই তীব্র ক্রোধ এসে বাসা বাঁধলো শরীরে।টেবিলের ওপর দুহাত থাঁপড়ে ঝুঁকে বলল,
“এটা কিছুতেই হতে পারেনা।আপনারা আমাকে এভাবে ঠকাতে পারেন না।আমি এই চাকরী করবোনা।এই মুহুর্তে আমি রিজাইন দেবো।যাস্ট নাও।
রুদ্র জানতো এমন হবে।অবাক হলোনা।কিন্তু সেঁজুতি কে উষ্কাতে ভীষণ ইচ্ছে জাগলো মনে। সহজ কন্ঠে বলল,
কেনো? চাকরির প্রথম দিনেই রিজাইন কেন দেবেন?
সেঁজুতি দাঁত চেপে বলল ‘ দ্যাটস মাই চয়েস।
রুদ্রর ভারি মজা লাগছে।কাউকে ক্ষিপ্ত হতে দেখতে এত আনন্দ? এত?অবুঝের ভান করে বলল
‘ আশ্চর্য! এতো বড় কোম্পানি তে জব পেতে কত মানুষ আহাজারি করছে আপনি জানেন?আর সেখানে আপনি পেয়েও ছেড়ে দিতে চাইছেন??হোয়াই?
সেঁজুতি রুষ্ট চোখে চাইলো।
‘হ্যা চাইছি।আর তার একমাত্র কারন আপনি নিজে।
আপনাকে দেখলেই আমার সেই রাতের…
রুদ্র বুঝেও চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
‘সেই রাতের কী?
সেঁজুতি শান্ত করলো নিজেকে।কাকে রাগ দেখাবে সে? রুদ্র তার কেউ নয়।বিপদে পরে একবার শরীর মিশেছিলো লোকটির সাথে ব্যাস ওইটুকুই।গত একটা সপ্তাহ ধরে যে রাতের জঘন্য স্মৃতি থেকে পালাতে চেয়েছে,ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছে,ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ারের নিঁচে দাঁড়িয়ে গা ভিজিয়েছে শুধুমাত্র অযাচিত স্পর্শ গুলো ধুঁয়ে ফেলতে। স্বয়ং সেই লোকের অফিসের কাজ করা কী আদৌ সম্ভব? তাও তারই সহকারী হয়ে? কোনো মেয়ে পারবে সেটা?
সেঁজুতি ঢোক গিলে ঠান্ডা ভাবে বলল,
‘ কিছুনা।এতো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আমি আসছি।
‘এক সেকেন্ড!
রুদ্রর কথায় সেঁজুতি দাঁড়ালো।ঘুরে তাকালোনা।স্তম্ভের মতো শক্ত করে মাটিতে লাগিয়ে রাখলো পা দুটো।ভীষণ ভাবে টলছে এগুলো।দাঁড়ানোর শক্তি যেন নেই।ভাগ্য কী নির্মম প্রতারণা করলো শেষে।
এতক্ষনে চেয়ার ছেড়ে উঠলো রুদ্র।সেঁজুতির সামনে এসে পা দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁকা রেখে পকেটে দু হাত গুজে দাঁড়ালো।ঘাঁড় কাঁত করে বলল
— আপনি ঠিক ই বলেছেন। সব টাই আমার তৈরী পরিকল্পনা।সব টা।এই যে আপনাকে এখানে চাকরী দেয়া,তার জন্যে ম্যানেজার কে দিয়ে আপনাকে মিথ্যা বলানো, এসব কিছু আগে থেকে সাজানো ছিলো।আর এতটাই নীট এন্ড ক্লিন ভাবে রুদ্র সাজিয়েছে যে তার ফাঁকফোকড় খুঁজে পাওয়া আপনার মতো মেয়ের জন্যে দুঃসাধ্যই নয়,অসম্ভব ও বটে!
সেঁজুতি স্তব্ধ।কী অকপটে নিজের অন্যায় স্বীকার করছে এই লোক!
রুদ্র দুই ভ্রু উঁচালো,
— অবাক হচ্ছেন?এখনি অবাক হবেন না মিস সেঁজুতি। আপনার জন্যে যে এখনও অনেক চমক বাকী।
(একটু থেমে)
আমাকে চেনেন তো?? ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রুদ্র রওশন চৌধুরী।দেশে বিদেশে যাকে নাম্বার ওয়ান বিজনেসম্যান দের মধ্যে একজন হিসেবে এক ডাকে চিনে যায় সবাই।আমার থেকে সব সময় সবাই হাত পেতে নিয়েছে। আর আমিও দুহাত ভরে দিয়েছি।
সেই রুদ্র রওশন কিনা আপনার মত সামান্য একটা মেয়ের দান নিয়ে বেঁচে থাকবে?? ইটস কোয়াইট ইম্পসিবল মিস সেজুতি।আপনাকে টাকা দিতে চেয়েছিলাম আমি।এবং সেটা দুবার,কিন্তু না। আপনি রাখেন নি।নিজের তথাকথিত আত্মসন্মান দেখিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।যেটা আমার ইগো তে লেগেছে(দাঁত চিবিয়ে)
আপনি চাইছিলেন আপনি আমাকে বাঁচিয়ে আমার কাছে সারাটাজীবন ম..হা..ন হয়ে থাকবেন।কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা।আমি বুঝে গিয়েছিলাম টাকা আপনি নেবেন না।অন্য কিছু ভাবতে হবে।আপনি অনেকটা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না টাইপের।তাই এত্তকিছু করতে হলো।আর এই ভাবেই আপনাকে আমি আমার কাছে নত করে রাখলাম।প্রতিনিয়ত এখন আমার অর্ডারে চলতে হবে আপনাকে,আপনার যে কিচ্ছু করার নেই মিস নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি…..
সেঁজুতি থম মেরে শুনছিলো।কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।কি মারাত্মক জঘন্য চিন্তাভাবনা লোকটির।বিস্মিত না হয়ে পারলোনা সে।মানুষকে সাহায্য করার সংগা টা এত বিশ্রী ভাবে ভাবেন উনি? ছি!সেঁজুতি হাসলো,সবাই আসলে সব কিছুর মূল্য দিতে জানেনা।এই লোকের ও হয়েছে তাই।রুদ্রর দিকে তাকালো।রুদ্র ছোট চোখের গভীর দৃষ্টিতে তারই দিক চেয়ে।সেঁজুতি এক পাশে ঠোঁট বাঁকালো,
-কে বললো কিছু করার নেই?আপনি হয়তো আমার কথা শুনতে পাননি। আমি এক্ষুনি রিজাইন দেবো বলেছি।এবার শুনেছেন?আপনার আন্ডারে চাকরী আমি করছিনা।
রুদ্র চোখ সরু করলো
— আমার আন্ডারে কাজ করতে কত মেয়ে লাইন ধরে আছে ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?
‘মেয়েঘটিত ব্যাপার টাতে আপনি অনেক অভিজ্ঞ যে।হয়তো তাই!তাছাড়া আপনার মত লোকের জন্যে লাইন কি আর কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা ধরবে??
কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আসবে আপনার কাছে?আপনি ও যেমন ওরাও ঠিক তেমন।
সেঁজুতির কথায় স্পষ্ট বিদ্রুপ।রুদ্রর ভয়ে যেখানে অফিসের সকলে তটস্থ,সেখানে সটান দাঁড়িয়ে এই মেয়ে পাল্লা দিয়ে তর্কে লিপ্ত।রুদ্র ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
”
আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিস সেঁজুতি, এটা আমার অফিস।আপনার বাড়ি নয়।আর আপনি আমার অফিসের সামান্য একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাই
এখানে আপনার গলার জোর টা ছোট থাকাই শ্রেয়
(ছোট শ্বাস ফেলে)
এনি ওয়ে!কি যেনো বলছিলেন? আমার জন্যে কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা লাইন ধরবেনা,কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আমার কাছে আসবেনা ব্লা ব্লা ব্লা?হু?
রুদ্র ঝুঁকে এসে ডান ভ্রু নাঁচালো।পরমুহূর্তে ফেঁটে পরলো অট্টহাসি তে।যে হাসিতে তাচ্ছিল্য পরিষ্কার।সেঁজুতির যেন গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে রুদ্রর অযৌক্তিক হাসি দেখে।
রুদ্র হাসি থামিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“তবে তো সেই সব অসভ্য মেয়েদের কাতারে আপনিও পরলেন। আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন সেই রাতে…. আমার হোটেল রুমে….আপনি আর আমি..
মনে পড়ছে? কতটা কাছাকাছি ছিলাম আমরা?
সেঁজুতি তাৎক্ষণিক চেঁচিয়ে বলল, ‘ চুপ করুন।চুপ করুন আপনি!
আমি ভুলে যেতে চাই,,মনে করতে চাইনা,,চাইনা মনে করতে…..
সেঁজুতি হাসফাস করলো কতক্ষন।যেন শ্বাস কষ্টে ভুগছে।রুদ্র শান্ত নজরে পরোখ করছে ওর অভিব্যাক্তি।সেঁজুতি সময় নিয়ে ঠান্ডা হলো। ভেজা চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কেনো করছেন আপনি এরকম?আমি তো বললাম আমি আপনার আন্ডারে কাজ করবোনা।তাও কেন এত কথা শোনাচ্ছেন?মানে কি এসবের?আমি যেতে চাচ্ছি আমাকে যেতে দিন!
রুদ্র ভ্রুক্ষেপ হীন।বলল, ” সব সময় যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়? এটা রুদ্রর জায়গা।তার রাজত্ব।এখানে নিজ ইচ্ছায় প্রবেশ হয়তো করা যায়।কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া বের হওয়া যে অসম্ভব।
সেঁজুতি কিছুই বুঝে ওঠেনি।চোখেমুখে তীব্র জিজ্ঞাসা দেখে রুদ্র বলল ‘ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।ওয়েট…
রুদ্র টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুলে সেই নীল রংয়ের ফাইলটা সেঁজুতির দিক ইশারা করে টেবিলের ওপর একরকম ছুড়ে মারলো।মোটা কন্ঠে বলল
‘ পড়ুন এটা।
আগে থেকে দেখে রাখায় চিনতে অসুবিধে হয়নি সেজুতির।এই ফাইলেই সে দস্তখত দিয়েছে কাল।
সেঁজুতি কে ভ্রু কুঁচকে ফাইলের দিক চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র বলল,
— কাল তো না পড়েই সাইন করেছিলেন,আজই কে বরং পড়ে দেখুন।আ বিগ সারপ্রাইজ এ্যাওয়েটস ফর ইউ।
রুদ্রর প্রতিটি কথা রহস্যময়।সব রহস্যের সমাধান কী এই ফাইলে? তাড়াহুড়ো করে ফাইল হাতে নিলো সেঁজুতি। পড়তে পড়তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো।রক্তশূন্য যাকে বলে।হাত দুটো কেঁপে উঠলো যেন।ফাইলটা ঝুপ করে পরলো পায়ের কাছে।সেঁজুতির চোখের কোটর ভরে উঠেছে।ঠান্ডা অশ্রুতে গাল দুটো ভিজে চুপচুপে হয়েছে।তবুও এক চুল নড়লোনা সে।
এতটা প্রতারনা?এতটা!
রুদ্র সেঁজুতির হয়ে মিথ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ভেতরে ভেতরে ভারী মজা পাচ্ছে হয়তো।সেঁজুতি যে সহজে পোষ মানবেনা সে জানত।তাইতো এত জল ঘোলা করতে হয়েছে।একটু না হয় কষ্টই পাক!
রুদ্র গ্লাস ভর্তি পানি সেঁজুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-খেয়ে নিন।আই থিংক ধাক্কা টা সামলে উঠতে পারবেন।
রাগ, ক্রোধ ছুটছে সেঁজুতির সমগ্র শিরায়।তার ওপর রুদ্রর এমন উপহাস করে বলা কথা আগুনে ঘি ঢালার মতোন।সেঁজুতি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
‘ আপনি অত্যন্ত নোংরা, বিদঘুটে মস্তিষ্কের একটা লোক।এত দিন জানতাম,আপনার চরিত্র টাই জঘন্য। এখন দেখছি মন টা তার থেকেও কুচকুচে কালো আপনার। কি সুন্দর ভাবে আমাকে ঠকালেন?আপনি একা কেন, আপনার ভাই অভ্রই বা কম কিসে? উনি নিজেই আমাকে মিথ্যে বলে এখানে সাইন করিয়েছিলো,আর আমিও বোকার….
রুদ্র আটকে দিয়ে বলল,
“আপনিও বোকার মত সাইন করে দিলেন।সত্যিই পড়ে দেখা উচিত ছিলো আপনার।এত মেধাবী স্টুডেন্ট আপনি আর এই ভুল টা আপনার দ্বারা মেনে নেয়া যায়না।আফসোস লাগছে আমার।সত্যি বলছি।এখন যা হবার বা যা করার করা হয়ে গিয়েছে।দেখে নিলেন তো সবটা?আশা করি বুঝতেও পেরেছেন।
আগামী তিন বছরের আগে আপনি এই চাকরী ছাড়তে পারছেন না।এর আগে যদি আপনি রিজাইন দিতেই চান,তবে আমার কোনও অসুবিধে নেই,ডিল অনুযায়ী জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা জমা করলেই আপনিও খুশি আমিও খুশি।
সেজুতি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রাখলো।লোকটা তাকে বিপদে ফেলে কি আনন্দটাই না পাচ্ছে।টেবিলের ওপর দুহাত রেখে
সেজুথির দিকে ঝুকে এলো রুদ্র,বরফ কন্ঠে বলল,
—তো মিস,বেশ ভালোভাবেই ফেসে গিয়েছেন আপনি।বেরোনোর কোনো পথ ই যে খোলা নেই আর।আমি খোলা রাখিওনি।তাই রিজাইন দেয়ার চিন্তা ঝেরে ফেলে কাজে মন দিন.…
নাউ…গেট ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক।
রুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সেঁজুতি। পারলে এই দৃষ্টি দিয়েই ঝলসে দিতো লোকটাকে।
ডেস্কে এসে ধপ করে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো চিন্তায়।
,
মিঃঅভ্র আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলেন ? বাবা ঠিকই বলেন দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা!
এখন এই লোকটার সাথে কি করে কাজ করবো আমি?যতবারই একে দেখবো আমার চোখের সামনে সেই অভিশপ্ত রাত টাই তো ভেসে উঠবে।এত বড় একটা শাস্তি আমাকে কেন দিলে আল্লাহ?
বাম হাতে পেপারওয়েট টেবিলের ওপর রেখে ঘোরাচ্ছে রুদ্র।ঘুরে ঘুরে থেমে যায়, রুদ্র একিভাবে ঘুরিয়ে দেয় আবার।শান্ত চাউনী তখনও কেবিনের মুখোমুখি সেজুথির ডেস্কের ওপর।সেজুতির অসহায় মুখটাও বেশ সুন্দর মনে হলো!
চলবে…..