প্রনয়-পর্ব 18

0
568

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৮
বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। অল্প অল্প মেঘ ও ডাকছে।সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভেঁজেনি।অফিস থেকে বেরিয়ে ডিরেক্ট সি এন জি তে উঠেছে। কিন্তু মন ভীষণ খারাপ।যতটা খারাপ হলে নিজের চুল খামচে ছিড়তে মন চায়,ততটাই খারাপ।এর কারণও ঘুরেফিরে সেই রুদ্র।আজকের গোটা দিনটাকে অপয়া বলে ঘোষণা করেছে সেঁজুতি। সকালবেলা চুল নিয়ে রুদ্রর ঝাড়ি শুনলো।এরপর রুদ্র বলেছিলো এসির পাওয়ার বাড়াতে।সেঁজুতি বেখেয়ালে কোথায় চেপেছে কে জানে! এসিটাই বন্ধ হয়ে গেছিলো।সেঁজুতির তখন রুদ্রর ধমকের ভয়ে প্রান যায় আর আসে।এমন ভুল কেন করলো কিছুতেই বুঝলোনা।সেতো এসি চালাতে জানে।হয়ত নিজেদের বাসায় নেই কিন্তু তবুও জানে।অথচ, রুদ্র ধমকাতে চেয়েও ধমকায়নি।কি মনে করে ধমকায়নি সে-ই জানে।চুপচাপ সার্ভিসিংয়ের লোক এনে ঠিক করিয়েছে।সেঁজুতির মুখটা তখন দেখার মতো ছিলো।চোর চুরি করেছে, ধরাও পরেছে, অথচ বাড়ির লোক না পিটিয়ে চোখের সামনে রেখে বলছে’ দাঁড়িয়ে থাকো।এভাবেই।তারপর সবাই শান্ত,ঠান্ডা। কিছু বলছেওনা , করছেওনা।ওই পরিস্থিতিতে চোর বাবাজির যেমন অবস্থা হবে,সেঁজুতির ও ঠিক তাই হলো।রুদ্রর ধমক শুনে অভ্যস্ত সে কিছুতেই শান্ত রুদ্রকে মেনে নিতে পারলোনা।
তারপর যখন ডেস্কে এলো মন একটু ঝরঝরা হচ্ছিলো আস্তে আস্তে।সারাদিনে রুদ্র আর ডাকেনি কেবিনে।অফিস ছুটির এক ঘন্টা আগে আবার ডাকলো।সেঁজুতি গেছিলো ভালো মনে,ঠিকঠাক মেজাজে।অথচ এরপরের রুদ্রর কথা শুনতেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে এলো তার।কথাই বন্ধ হয়ে গেছিলো অল্প সময়ের জন্যে।রুদ্র মুখের সামনে হাত না নাঁড়লে তো, সম্বিৎই ফিরতো না।
রুদ্র তার নতুন প্রজেক্ট রেখেছে সিলেটে।কয়েকটা কনফারেন্স, মিটিং প্রেজেন্টেশন এখন খুব দরকার।বড় মাপের ডিল সাইন হবে।অতি দ্রুত সেখানে যেতে হবে তাকে।সব সময় রুদ্র আর তার এসিস্ট্যান্ট যায়।আর তখন গোটা অফিসের দায়িত্ব অভ্রর কাঁধে।এবারেও এর হেরফের হবেনা। কিন্তু এসিস্ট্যান্ট যেহেতু মেয়ে, তাই রুদ্র হেজিট্যেট করছিলো।সেঁজুতিকে বলতেও কেমন সঙ্কোচ হচ্ছিলো।অন্য মেয়ে হলে এক কথা,কিন্তু সেঁজুতির সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ তো অত সুমধুর নয়।মেয়েটা রাজী হবেতো? এসব ভেবে ভেবেই অফিসের পুরো দশ ঘন্টা রুদ্র হাসফাস করেছে।কিন্তু কিছু করার ও নেই।অগত্যা কোনো উপায়ন্তর না পেয়েই সেঁজুতি কে সিলেট যাওয়ার কথা জানালো রুদ্র।সেঁজুতি একটা প্রত্যুত্তর ও করেনি।এক পাশে ঘাঁড় হেলে স্বায় দিয়েছে।তার মতে,সে না বললেই কী লোকটা শুনবে? অফিসের কাজ,যেতে তো হবেই।কিন্তু এভাবে রুদ্রর সাথে একা যাওয়াটাও মেনে নিতে পারছেনা।কেমন খচখচ করছে।সেঁজুতির মুখের অন্ধকার রুদ্রর চোখ এড়ালোনা।কিন্তু সে ধরা দেয়নি।সেঁজুতি যেতে রাজী, এটাই অনেক। এই সুযোগে আরেকটু কাছাকাছি থাকা হবে।রুদ্র মনে মনে খুশিই হলো যেন।
বাড়ি ফেরা থেকেই সেঁজুতি মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে।আমির প্রথমে ভয় পেয়েছেন।পরে তার মাথায় এলো এটা সেঁজুতির স্বভাব।একটু কিছু নিয়ে মন খারাপ, বা দুঃখ পেলেই সে স্ট্যাচুতে পরিনত হয়।দুনিয়ার সবাই বুঝতে পারবে মেয়েটির মন ভালো না থাকার খবর। আমির কয়েকবার সেঁজুতি কে ফ্রেশ হতে বললেন।সেঁজুতি নঁড়লোনা।শেফালী এসে চা দিলো।সেঁজুতি খেলোনা।সে থম ধরে আছে।আমির বুঝলেন ব্যাপারটা অত সিরিয়াস কিছু নয়।সিরিয়াস কিছু ঘটলে তার মেয়ে একদম স্বাভাবিক থাকবে।কেউ বুঝতেই পারবেনা ভেতরে কি চলছে?বাড়িতে নাওয়া খাওয়া বাদে আমিরের তিনটি কাজ, পত্রিকা পড়া,টিভি দেখা আর মাঝেমধ্যে সেঁজুতির পছন্দের নাস্তা বানানো।আমির এখনও পত্রিকাই পড়ছিলেন।ঘরবন্দী থাকতে থাকতে দিনের একটা পত্রিকাই দশ বার পড়ে সে।সময় কাটে।ভালোও লাগে।একটা দাঁড়ি কমাও বাদ পরেনা পড়া থেকে।আমির পত্রিকার কাগজটাকে ভাঁজ করে টি টেবিলের নিঁচের তাকে রাখলেন।মেয়ের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সেই কখন থেকে সেঁজুতি একভাবে বসে আছে।যেন বিয়ের গয়না চুরি করেছে কেউ।আমির আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না।প্রশ্ন করেই ফেললেন,
‘ আমার আম্মা!এসে থেকেই মুখ টা ওমন করে রেখেছেন কেন?
সেঁজুতি উত্তর না দিয়ে বাবার দিক ফিরলো।মাথা থেকে হাত নামিয়ে বাবু হয়ে বসলো।পরমুহূর্তে আবার মাথায় হাত দিলো।আমির অধৈর্য কন্ঠে বললেন,’ আহহা! এসবের কোনো মানে হয়? কিছু বলছিস না।ফ্রেশ হচ্ছিস না।চা টাও তো ঠান্ডা হয়ে গেলো।
সেঁজুতি একবার শরবত রুপী চায়ের দিকে তাকালো।আমির হাক পারলেন শেফালীকে।সে তখন রান্নায় ব্যাস্ত।বললেন চা টা আবার একটু গরম করে দিতে।
শেফালী যেতে যেতে বলল ‘ আফার মনে হয় জামাই মরছে।আমির শেফালী কে ছোট্ট করে ধমক দিলেন।এরপর একই প্রশ্ন আবার করলেন।সাথে একটু মিথ্যে মেজাজ নিয়ে বললেন ‘ সেঁজুতি! বাবা কিন্তু এবার রেগে যাচ্ছি।কি হয়েছে বলবি?
সেঁজুতি হা হুতাশ করতে করতে বলল
‘ আমি শেষ বাবা! আমি শেষ!
আমির আর্তনাদ করে বললেন ‘এসব আবার কী কথা?
সেঁজুতি দুঃখী দুঃখী মুখে বাবার দিকে তাকালো। আমির উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন
‘কি হয়েছে?
সেঁজুতি এতক্ষনে বলার জন্যে মুখ খুলল,
“কি হয়নি তাই বলো!অফিসের কাজে আমাকে এখন সিলেট যেতে হবে। তাও ওই বদমেজাজী,বদমাশ, বিভৎস, বেপরোয়া লোকটার সাথে।ভাবতে পারছো?? ওইরকম একটা লোকের সাথে আমি একা কাজে যাবো?ব্যাপার টা অনেকটা বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘের সামনেই ঘুমানোর মতনা?
কখনও কোন কাজে ভুল হলেই আমাকে খপাৎ করে গিলে ফেলবে।
আমির হেসে ফেললেন,
‘এই জন্যে তুই এতো চিন্তায় ছিলি এতক্ষন?
সেঁজুতি দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
‘ তুমি হাসছো? এটা চিন্তার বিষয় নয়??
আমির দুইদিকে মাথা নেঁড়ে বললেন “একদম ই নয়।আরে বাবা অফিসের কাজে বাইরে যাবি এটা আর এমন কি?উল্টে তোর জন্যেই ভালো।নতুন নতুন এক্সপেরিয়েন্স হবে,অনেক কিছু শিখবি,তাছাড়া সিলেট তো কখনও যাসনি একবারে দেখেও আসলি!আর কাজ ঠিক ভাবে করলে কার সাধ্য আছে ভুল ধরার.
(একটু থেমে)তাছাড়া, সেদিন রুদ্র রওশন কে দেখে আমার অনেক অবাক লেগেছে।আমাদের বাড়ি এসে শাসিয়ে যাওয়া সেই লোকের সাথে সেদিনের ওনার কোনও মিল পাইনি।ওইদিন পার্কে ওনাকে আমার একটুও মনে হয়নি আদৌ এই লোকটা এতো টা অহংকারী।কি সুন্দর মিশলেন আমাদের সঙ্গে!ঘুরলেন,কথা বললেন।অহংকারী হলে কেউ অফিসের কর্মচারীর সঙ্গে এভাবে মেশে বলতো?
আমার মনে হয় ওনাকে আমরা যেমন টা ভাবি উনি আসলে তেমন নন।আর বাইরে থেকে একটা মানুষকে দেখলে কি আর বোঝা যায়?বুঝতে হলে তাকে অনেক কাছ থেকে দেখতে হয়। তার পাশে থেকে তাকে চিনতে হয়।তার সাথে মিশে তার ভেতর টা জানতে হয়।তবেই না বোঝা যাবে মানুষ টা কেমন?
সেঁজুতি মন দিয়ে শুনছিলো।মানস্পটে ভাসছিলো রুদ্রর সেদিনের উচ্ছ্বল মুখটা।বোঁকা বোঁকা প্রশ্ন গুলি।আর উত্তর পেয়ে কেমন বাচ্চা বাচ্চা চাউনি।সত্যিই লোকটাকে তার খারাপ লাগেনি ঐদিন।বরং অন্য রকম লেগেছে।একদম আলাদা।কিন্তু সেই লাগা দিয়ে কাজ হবে? কাজের বেলায় রুদ্র ভীষণ স্ট্রিক্ট। কোনো ছাড় দেবেনা।
আমির মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন,
তুই এতো ভাবিস না,আর ভয়ও পাসনা।দেখবি, যা হবে ভালোই হবে।
“কিন্তু সমস্যা তো আরও একটা আছে বাবা।
‘ আবার কী?
সেঁজুতি মায়া মায়া চোখে চেয়ে বলল,
“আমি গেলে তুমি একা কিভাবে কি করবে?
আমির এবারেও হাসলেন,
‘আরেহ পাগলী মেয়ে!শেফালী আছেনা?ওতো সব কাজ ই এগিয়ে দিয়ে যাবে।
” কিন্তু রাতে?
আমির কপাল চাঁপড়ে বললেন,
— উফফ! এই মেয়েটা কে নিয়ে আমি আর পারিনা।একটা পা গিয়েছে বলে কি তোর বাবার সব ক্ষমতাই চলে গিয়েছে নাকি?অন্য পা দিয়ে এগোতে তো পারি নাকি? তাছাড়া তুইতো আমার জন্যে স্ক্র‍্যাচ এনেছিস।আমার একা একা বিছানা থেকে নামতে কোনো অসুবিধাই হয়না এখন।তুই নিশ্চিন্তে যা তো…
আর এখনি আমাকে অভ্যেস করতে হবেনা? তোর বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি তখন তো আমাকে একাই…
সেঁজুতি বাবার হাটু আঁকড়ে ধরলো তৎক্ষনাৎ। মাথা গুঁজে বলল ‘ আমি কখনও বিয়েই করবনা।
আমির মৃদু হাসলেন।কিছু বললেন না।মেয়েকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই বুক ভারী হয়ে আসে।কেন যে দুনিয়ার এই নিয়ম!
___
সেঁজুতি চটপট তৈরি হচ্ছে।রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলো।হাত পায়ে লোশন মাখছে এখন।ভেবেছিলো তাকে বাসে করে যেতে হবে।একা একাই।এরকম হলেই হয়ত বেঁচে যেত।কিন্তু হঠাৎ রুদ্র রাত বারোটার দিকে কল দিলো।প্রথমে তো সেঁজুতি বিশ্বাসই করতে পারেনি। যবে থেকে অফিস জয়েন করলো,রুদ্র কল দিলো এই প্রথম। সেঁজুতি দেরী করেনি।ফটাফট রিসিভ করেছে।রুদ্র তখন কড়া হুকুম জারি করে বলেছে ‘ সেঁজুতি কে তার সাথে গাড়িতে যেতে হবে।ওমনি সেঁজুতির মুখ চুপসে যায়।রুদ্র গাড়ির কাঁচ একদম খুলতে দেয়না।সেঁজুতির আদবকায়দাহীন চুল তার মুখের ওপর পরে নাকী! দ্বিতীয়ত সে এসির বাতাস ছাড়া চলতে পারেনা।তৃতীয়ত, এসিতে সেঁজুতির দম আটকে আসে।রুদ্রর সামনে নঁড়াচড়া করতে গেলেও হিসেব করতে হয়।সে নিশ্চয়ই রুদ্রর সামনে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে পারবেনা?বসের সাথে বেয়াদবি করা হবেতো! সিলেট তো আর বাড়ির কাছে নয়। অতটা রাস্তা কী তাহলে রোবটের মতোন বসে যাবে? ঘুমোতেও পারবেনা।বাই এনি চান্স যদি রুদ্রর কাঁধে মাথা পরে যায়? ভাবতেই সেঁজুতির গা ঠান্ডা হয়ে আসছে।একেতো লজ্জ্বায় দুইয়ে ভয়ে।রুদ্র যদি রাগে তাকে ছুড়ে মারে গাড়ি থেকে? কী হবে?সেঁজুতির অকূল ভাবনার ইতি ঘটলো কানের মিধ্যে উৎকট হর্নের শব্দে।নিশ্চয়ই রুদ্র এসেছে।সেঁজুতি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বাবার ঘরের দিক ছুটলো।

বাসার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু সেজুতি আসার নাম নেই। গাড়ির হর্ন আরো জোরে বাজালো রুদ্র।বিড়বিড় করলো,
“এই মেয়েটা আর শুধরালো না।সব কিছুতে লেট আর লেট! লেটুস পাতা একটা।
তখনি সেঁজুতি দৌড়ে আসতে আসতে বলল,
‘আরে আসছি আসছি, হর্ন বাজিয়ে মাথা খারাপ করে দিলো।
গাড়ির কাছে এসে থামলো সেঁজুতি।কাঁচ নামালো রুদ্র।সেঁজুতি মুখ দেখেই বুঝলো রুদ্র চঁটেছে বেজায়। হাপাতে হাপাতে বলল ‘ স্যরি স্যার।
রুদ্রর জবাব ‘ গাড়িতে উঠুন।
-‘ও হ্যা হ্যা।
সেঁজুতি উঠে বসতেই রুদ্র কিছু বলার জন্যে হা করলো।সেঁজুতি ধড়ফড় করে বলল,
‘ আপনি একদম আমাকে বকবেন না। আমি কিন্তু মাত্র ৪ মিনিট দেরি করেছি।
রুদ্র দাঁত চিবিয়ে বলল’ লিসেন?
( একটু থেমে)
না।আপনাকে কিছু বলে মুখে ব্যাথা বানিয়ে লাভ নেই।আপনি শুধরাবার পাত্রী নন।
রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতেই সেঁজুতি জানলার দিক ফিরে মুখ ব্যাঁকালো।মনে মনে আওড়ালো ‘ নিজে যেন শুধরে উলটে দিয়েছে।
___
সেঁজুতির এখন সত্যিই মাথা ঘুরছে।একেতো সকালে খায়নি।দুইয়ে বন্ধ গাড়ি।এর ষোলকলা পূর্ন হচ্ছে যখন বাইরের দিকে তাকাচ্ছে।অন্যান্য দিনে গাছগুলোর ছোটাছুটি তার ভীষণ ভালো লাগে।অথচ এখন কেমন গা গোলাচ্ছে।বমি আসবে নাকী?ইয়া আল্লাহ! এই লোকের গাড়ি যদি বমি করে ভাসায়,তবেতো বিপদ।মহাবিপদ। লোকটা তাকে ভৎস করে দেবে। রুদ্র হঠাৎ বলে ওঠে,
‘ পেছনের সিটে খাবার আছে। খেয়ে নিন।
সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে তাকালো।তখনও বোঝেনি রুদ্র কী বলল মাত্র।রুদ্র ড্রাইভ করছে মনোযোগ দিয়ে।সেঁজুতি বোঁকার মত চেয়ে আছে দেখে আবার বলল একী কথা।সাথে একটু ঝাঁঝ নিয়ে বলল ‘ কানেও কম শুনছেন। বাহ! আর কি কি গুন আছে আপনার?
সেঁজুতির উত্তর দেয়ার সময় নেই। তার খিদে পেয়েছে।তাও অতিমাত্রায়। চটপট পেছনের সিট থেকে পাউরুটি আর জেলি নিয়ে খেতে শুরু করলো।রুদ্র গাড়িতে ওঠার আগে কিনে ছিলো এসব।সাথে জুস,কলা, আরও অনেক শুকনো খাবারও আছে।মাঝ রাস্তায় তো অতবার গাড়ি থামানো যাবেনা।বিকেল তিনটায় মিটিং আছে।গিয়ে বিশ্রাম ও নিতে হবে।হাল্কা ক্ষুধা লাগলে খাওয়া যাবে। রুদ্র
কিয়ৎ হাসলো।ঠিক বুঝেছে সেঁজুতি খায়নি। সাথে অবাক ও হচ্ছে ‘ মেয়েদের মুখ দেখে মন বোঝার ক্ষমতা কবে হলো তার?
সেঁজুতি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো ‘ আপনি খাবেন না?
রুদ্র ছোট করে বলল ‘ না।
সেঁজুতি আবার বলল
‘একটা কথা বলবো?
‘ হু।
সেঁজুতি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল’ এসি টা বন্ধ করে দিন না।আমি একিটু জানলাটা খুলি?
রুদ্র মুখের ওপর বলল ‘ না।
‘ প্লিইইইইইজ!
‘ No
‘আর কক্ষনও লেট করবোনা।প্রমিস!
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
‘ আপনার মনে হয়,আপনি লেট করে এসেছেন বলে আমি না করছি?
সেঁজুতি অসহায় কন্ঠে শুধালো,
‘তাহলে?
রুদ্র ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলল ‘ জানলা খুললেই আপনার চুল আমার মুখে এসে পরে।আমার যে তখন কী হয়,আপনি কীভাবে বুঝবেন!কোনো রিস্ক আমি নেবনা।
‘ কি ভাবছেন? খুলব জানলা?
‘ না বললাম তো!
সেঁজুতি ঠোঁট উলটে বলল ‘ এমন করছেন কেন? আমিতো বললাম আর দেরী হবেনা।কক্ষনও না।
রুদ্র বিদ্রুপ করে বলল ‘ আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি।টের পাচ্ছি আমি।
সেঁজুতি সন্দিহান কন্ঠে বলল
‘ প্রশংসা করলেন?
‘ এবারতো আরো ক্লিয়ার হলো।বুদ্ধির নমুনা।
সেঁজুতি নাক মুখ ফোলালো।লোকটা তার বুদ্ধি নিয়ে কথা তুলে অপমান করলো?এর একটা জবাব দেয়া উচিত না? ঝগড়ার কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
‘শুনুন আপ…
রুদ্র থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ আপাতত কিছু শুনতে চাইছিনা।আপনার যদি কিছু বলতেই হয় তবে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলবেন।
সেঁজুতির মুখটা এবার থমথমে হয়ে এলো।চোখ কপালে তুলে বলল,
“আবার অপমান? আপনার গাড়িতে উঠেছি বলে আমাকে কথা শোনালেন? এই ছিলো আপনার মনে?আমিতো বলেইছিলাম আমি বাসে চলে যাবো,কেনো এলেন আপনার এই গাড়ি নিয়ে? আমি কী যেঁচে উঠেছি? এর আগেও একবার গাড়ি নিয়ে খোঁটা দিয়েছেন।গাড়িকে কী মনে করেন? পঙ্খিরাজ ঘোড়া?
সেঁজুতি মুখ কুঁচকে বলল ‘ এটা একটা গাড়ি হলো?কি কালো?? দেখলেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে অন্ধকার রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছি।এমন গাড়িতে চড়ার থেকে পায়ে হাটাও ভালো।এক্ষুনি নষ্ট হয়ে যাক এটা।আমাকে খোঁটা দেয়া না?দেখবেন গরীবের অভিশাপ ফল….
পুরোটা শেষ করার আগেই গাড়িটা ঢুলতে ঢুলতে অফ হয়ে গেলো।সেঁজুতির কথা বন্ধ হয়ে গেলো সাথে সাথে।রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে লাভ হচ্ছেনা।সেঁজুতি মিনমিনিয়ে বলল,
‘ কী হলো এটার??আমিতো এমনি এমনি বলেছি,ওকী সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো?সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেলোনাতো?
সেঁজুতি চোখ বড় করে রুদ্রর দিকে তাকালো ওর উত্তরের আশায়।রুদ্র চুপচাপ দরজা খুলে বের হলো।এতটা পথ এই প্রথম ড্রাইভ করছে।সাথে এত গরম।তাও জার্নি টা খারাপ লাগছিলোনা।বরং মনে হচ্ছিলো জীবনের সব থেকে সুন্দর জার্নি এটা।অথচ এখন গাড়িটাই খারাপ হয়ে গেলো? পথ তো আর বেশি নেইও।অলমোস্ট সিলেটে তারা।এতক্ষন সেঁজুতির বকবকে বিরক্ত না হলেও এখন মেজাজ প্রচন্ড তেঁতে আছে।ফোন করে রেহান কে ঝাঁড়লো কিছুক্ষন।কেন সে গাড়ি চেক করে দিলোনা? তাতেও রাগ মিটলোনা যখন,গাড়ির সাইডে সজোরে একটা লাথি মারলো।সেঁজুতিও বেরিয়েছে ততক্ষনে।রুদ্রকে গাড়িতে লাথি মারতে দেখে চুপসে গিয়ে বলল,
‘বেচারা গাড়িতে লাথি মেরে কি লাভ!
রুদ্র চোখ পাঁকাতেই সেঁজুতি নিঁচু কন্ঠে বলল,
— এ..এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো,আমি কি করেছি?
অন্যদিকে মুখ ঘোরালো রুদ্র।সেঁজুতি চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“গাড়িতো খারাপ হয়ে গেলো। এবার কি করবো আমরা?
রুদ্র হঠাৎই চেঁতে বলল,
— নাঁচতে ইচ্ছে করলে নাঁচুন,বাট ডোন্ট ডিস্টার্ভ মি।
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল
— আমি আবার আপনাকে কখন ডিস্টার্ভ করলাম?
‘আপনার এই বকবকানি গুলোই আমার বিরক্তির মূল কারন।
‘ওকে নিন চুপ করলাম।
ঠোটে আঙুল দিয়ে অন্যদিকে তাকালো সেঁজুতি। মুখটা হা হয়ে এলো একটু দূরে চোখ যেতেই।ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ওয়াও!কি সুন্দর!
রুদ্র সেঁজুতির চোখ অনুসরন করে চাইলো। সাড়ি সাড়ি সবুজ চা বাগান, আর পাহাড় ছাড়া তার চোখে কিছুই পরলোনা।এই মেয়ে এত খুশি হলো কীসে?সেজুতির চেহারায় একরাশ উচ্ছ্বাস।দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
এতক্ষনের জমে থাকা বিরক্তিটা নির্নিমেষ কেটে গেল রুদ্রর।সঙ্কুচিত ভ্রু জোড়া সোজা হলো। ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘সিলেটে প্রথম বার?
‘ হু
‘চলুন..
‘ কোথায়?
‘ এলেই বুঝবেন।
রুদ্র লম্বা পা ফেলে এগোলো।কথা না বাড়িয়ে পিছু নিলো সেঁজুতি।
___
দুপাশে চা বাগান।মাঝখানে সরু রাস্তা।অনেকটা ক্ষেতের আঈলের মতো আঁকাবাঁকা, উঁচু নিঁচু।সেই রাস্তা ধরে রুদ্রর পাশে পাশে হাটছে সেজুতি।উৎসুক চোখে এদিকে ওদিক তাকাচ্ছে।মন দিয়ে অবলোকন করছে সিলেটের অন্যতম প্রধান সৌন্দর্য।
রুদ্রর এসবে আগ্রহ কোথায়?সে মহাব্যাস্ত ফোনের নেটওয়ার্ক পেতে।অনবরত কারো নাম্বার ডায়াল করছে।কিন্তু এক দাগ নেটওয়ার্ক যদি উঁকি দিতো ফোনে।
সেঁজুতি যখন সবটা মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে তখনি বাগানের পাশ ঘেষে একটা সাপ বের হলো।মূলত চা বাগানের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে।সেঁজুতি দেখতেই আকাশে উঠে এলো চোখ।গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার ছুড়লো,
“সাপ, সাপ, স্যার সাপ
গলার সব টুকু জোড় কাজে লাগিয়েছে সেঁজুতি। শুধু কী তাই? উত্তেজনায় পাশে হাটতে থাকা রুদ্রর এক বাহু শক্ত করে চেপেও ধরলো।রুদ্রর কানে তালা ঝুলে গিয়েছে সেঁজুতির চিৎকারে।উদগ্রীব হয়ে বলল
‘ কোথায় সাপ?কোথায়?
সেঁজুতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল
‘নেই।
চলে গিয়েছে,ওদিকে।
রুদ্র চিন্তিত কন্ঠে শুধালো, ‘ আপনি ঠিক আছেন?
সেঁজুতি হাসলো। নাকী হাসার চেষ্টা করলো? নিজেকে ভীতু প্রমান করার হাত থেকে রক্ষা করতে বলল,
— আরে সাপ টা তো আমার কাছেই আসেনি।ওদিকে থেকে ওদিকে গিয়েছে( আঙুল দিয়ে দেখালো)হয়তো ভয় পেয়েছে।
রুদ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আসল ভয়টা কে পেয়েছে, সেটা চিৎকার শুনেই বুঝতে পেরেছি।
সেঁজুতি মুখটা ছোট করে ফেলল।
রুদ্রর হঠাৎ খেয়াল পরলো নিজের হাতের দিকে।যেটা সেঁজুতি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এখনও। রুদ্র একবার সেঁজুতির দিকে তাকালো,একবার ওর ধরে রাখা হাতের দিকে। সেঁজুতির ভ্রুক্ষেপ নেই ওদিকে।ভয়ে ভয়ে বাগানের চারপাশে তাকাচ্ছে। এক কথায় সাপ খুজছে সে।রুদ্র আস্তে করে সেঁজুতির হাতটা সরিয়ে দিলো।হঠাৎ ঘটায় চমকে তাকালো সেঁজুতি। পরমুহূর্তে পুরো বিষয়টা মাথায় ঢুকলো তার।এতক্ষন ওনার হাত জড়িয়ে রেখেছিলাম আমি?ছি! কি ভাবলেন উনি? সেঁজুতি লজ্জ্বায় মাথা যে নিচু করলো, তুললোইনা আর।
সেজুতি লজ্জ্বাটা বুঝলো রুদ্র। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা খাঁকারি দিয়ে কেশে নিলো।সেঁজুতির দিকে তাকাচ্ছেনা।সেঁজুতিও তাকিয়ে নেই।রুদ্র সহজ কন্ঠে বলল,
‘আমি একটা কল করে আসছি,এখানে নেটওয়ার্ক এমারজেন্সি হয়ে আছে।আপনি এখানেই দাড়ান।আর হ্যা বেশি নঁড়াচড়া করবেন না।সাপ কিন্তু একটা নেই এখানে, থাকলে অনেক গুলোই আছে।
শেষ কথাটা সেঁজুতি কে ভয় দিতে বলল।সেঁজুতি ভয় পেলোও।চোখ গোল করে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ সস্যতি?
রুদ্র মুখটা গম্ভীর রেখে হাটা ধরলো।উলটোপথে চলতেই মিটিমিটি হাসলো।
___
” স্যার আপনি লোকেশন পাঠান।আমি এক্ষুনি আপনাদের পিক করতে গাড়ি পাঠাচ্ছি।
‘হু।আপনার গাড়ি যেন বিশ মিনিটের মধ্যে আসে।
‘ জ্বী স্যার।একদম লেট হবেনা।
‘ রাখছি।
লাইন কেটে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে রুদ্র আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
সেঁজুতি কোথায়? এদিক ওদিক তাকালো রুদ্র।আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনাতো।গেলেন কোথায়?
একটু সামনে এগিয়ে নাম ধরে ডাকলো রুদ্র।সাঁড়া এলোনা।রুদ্র অনেকবার ডাকলো।গলার সব টুকু জোর দিয়ে।সাড়া নেই।এবার টেনশন হচ্ছে রুদ্রর।অচেনা জায়গা কোথায় গেলো এই মেয়ে?
রীতিমতো ঘাম ছুটলো।বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে।ভয়ে ঢিপঢিপ করছে।কিছু হারিয়ে ফেলল সে।অনেক দামী কিছু।এমন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পরছে গোটা প্রসস্থ দেহ।
‘সেজুতি! সেঁজুতি? কোথায় আপনি?? এট লিস্ট সাড়া তো দিন….
জোরে ডাকাডাকি করেও লাভ হচ্ছেনা।প্রকৃতি নিশ্চুপ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে কটা বুনো পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। রুদ্রর গলা শুকিয়ে এলো।ছুটতে ছুটতে অনেকটা পথ এসেছে।রুদ্র হাপিয়ে গেলো।থেমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চারপাশে তাকালো,
‘কোথায় গেলেন আপনি?কেনো আপনাকে একা রেখে গেলাম!এখন যদি আপনার কোনও ক্ষতি হয় আমি যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।
আচ্ছা আপনি ইচ্ছে করে লুকিয়ে নেইতো? লুকোচুরি খেলছেন আমার সাথে?খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।খুব খারাপ,,
নিজের সাথে বিড়বিড় করলো রুদ্র।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এক হাত কোমড়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে মাথার চুল খাঁমচাতে শুরু করলো চিন্তায়।
কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে আঁওড়ালো,
‘প্লিজ আসুন,,,প্লিজ,প্লি….
বলতে বলতে হাতের ডান দিকে তাকালো রুদ্র। একটু দূরে গাছের আঁড়াল থেকে হলুদ রংয়ের কিছু উড়তে দেখে চোখ আটকালো।হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছূট লাগালো রুদ্র।যা ভেবেছিলো ঠিক তাই।
নীল রঙয়ের একটা প্রজাপতি বসেছে গাছের ডালে।সেঁজুতি পা টিপে টিপে এগোচ্ছে ধরার জন্যে।
রাগে চোখ লাল হয়ে এলো রুদ্রর।
‘এই মেয়েটা তার মাথা খারাপ করে দিয়ে এখানে প্রজাপতি ধরছে?এতটা বাচ্চামো একটা ম্যাচিউরড মেয়ের থেকে রুদ্র আশা করেনি।এত দিনকার সেঁজুতির সঙ্গে যেন এর আকাশ পাতাল তফাৎ। কত বড় সাহস এই মেয়ের!কোনও ধারনা আছে ঠিক কতোটা ইরেসপন্সেবলের মতো কাজ করেছে?
দাঁতে দাঁত খিচিয়ে এগিয়ে গিয়েই সেজুতির এক হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালো রুদ্র। সেঁজুতি কেঁপে উঠলো হঠাৎ কেউ এভাবে ধরায়।এবার তাকে পৃথিবীর সব থেকে বড় চমক উপহার দিয়ে রুদ্র ঠাস করে একটা চঁড় বসালো গালে।সেঁজুতির চোখ ঘোলা হয়ে এলো।মাথা চক্কর দিলো।গাল ঝিমঝিম করে উঠলো।কান গরম হয়ে এলো। পা দুটো টলছে।এক্ষুনি পরে যাবে।মরে যাবে হয়ত,
তারপর নিউজ বের হবে ‘ চঁড় খেয়ে এক অবলা তরুনীর মৃত্যু!
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here