প্রনয়-পর্ব 30

0
785

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব–৩০
মেয়ের সামনে অসহায় মুখ করে বসে আছেন আমির।হাত কঁচলাচ্ছেন সমানে।সেঁজুতি রেগে একাকার।আর সেজুতির রাগ মানেই মুখে কিছু বলবেনা।সারাটাদিন না খেয়ে চুপচাপ বসে থাকবে ঘরে।আমিরের চিন্তায় মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়।
কে জানালো সেঁজুতিকে বিয়ের ব্যাপারে?তারা দুই বন্ধু ভেবেছিলেন ধীরে সুস্থে জানাবেন।ইশ! সব ঘেটে গেলো এখন!আমির মুখ কাচুমাচু করে বললেন,
“আমি আজকেই জানাতাম তোকে।
চোখ উঠিয়ে বাবাকে একবার দেখলো সেঁজুতি। আবারো মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমির ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
” আচ্ছা, এখানে আমার কি দোষ?তোর হোসাইন আঙ্কেল ই তো বললেন তোকে পরে জানাতে।আমি তো তাই___
সেঁজুতি মাঝপথে আটকে দিলো,
-“তাই তুমিও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেনা। বাহ! হোসাইন আংকেল আমার বাবা নাকি তুমি আমার বাবা?তুমি আমার থেকে কি করে লুকাতে পারলে ব্যাপারটা?
আমির বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললেন,
” সময় নিচ্ছিলাম,বিশ্বাস কর!
এখন এসব ছাড় না। অনেকক্ষন না খেয়ে আছিস,খাবার নিয়ে আসি?
” তোমাকে কষ্ট করতে হবেনা।আমি পারবো।এখন থেকে আমি নিজের কাজ নিজে করে নেবো।এমনিতেও আমাকে তাড়ানোর চিন্তা করছো তো, অহেতুক আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?
সেঁজুতি রান্নাঘরে ঢুকে গেলো।আমির মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন,
‘এই মেয়েটা এক্কে বারে ওর দাদির মত হয়েছে। কথা শোনাবে কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।
মায়ের কথা মনে পরতেই মুখ টা কালো হয়ে এলো আমিরের।বাইশ বছর ও বাড়ির দোরগোঁড়ায় পা রাখেনি। কত কিছুই তো বদলে গেলো।শেষ বার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও অভিমানে চাপা পরে গিয়েছে তার ছটফটে মন।প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যারা মুখ তুলেও দেখলোনা,এখনও কি তাকে তারা মনে রাখবে? পৃথিবীতে ভালোবেসে বিয়ে করা এতোই অপরাধের বুঝি?? যা আপন মানুষকেও দূরে ঠেলে দেয়?
সেঁজুতি ভাতের প্লেট এনে সোফার ওপর বসলো।আমির নিজে থেকেই এগিয়ে গেলেন।আদুরে কন্ঠে বললেন ‘ আমি খাইয়ে দেই?
সেঁজুতি মুখ ফোলালো ঠিকই তবে মানা করলোনা।বাবার দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো।আমির হাসলেন।হাত ধুয়ে তরকারিতে ভাত মেখে মেয়ের মুখে দিলেন।সেঁজুতি চুপচাপ খাচ্ছে।আমির ভাবলেন সেঁজুতির মন ভালো হয়েছে হয়ত।সতর্ক কন্ঠে শুধালেন,
“বিয়েতে তোর কোনও আপত্তি নেইতো?
সেঁজুতির খাওয়া থেমে গেলো তাৎক্ষণিক।খাবার গলায় বাঁধলো যেন।চোখের সামনে অকারনেই রুদ্রর মুখটা ভেসে উঠলো।আমির একি কথা আবার জিজ্ঞেস করায় ধ্যান ভাঙলো সেঁজুতির।নিভু কন্ঠে বলল,
“আবিরের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছেনা বাবা।আমি ওকে কখনও এভাবে ভাবিনি।,বন্ধুত্ব টাই ঠিক আছে,সেখানে সম্পর্কের এমন পরিনতি দেয়ার কি দরকার বলো?
‘বন্ধু তো কি হয়েছে? বন্ধুকে কি বিয়ে করা যায়না? একজন ভালো বন্ধুই সব থেকে ভালো লাইফ পার্টনার হতে পারে।
সেঁজুতি আর কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।রুদ্রর নামটা উগড়ে বের হতে চাইলো খুব।কিন্তু বলার মতোন ভরসা পেলোনা।মিহি আপত্তি জানালো,
‘ ভেবে জানাব বাবা।
‘আচ্ছা বেশ! তুই বরং আবিরের সাথে এ নিয়ে একবার আলাদা ভাবে কথা বল।
‘ আবির কি রাজি এই বিয়েতে?
‘ হোসাইন তো তাই জানালো।বাকিটা তুই জেনে নিস না হয়?
সেঁজুতি খেয়াল করলো,বিয়ের কথা বলতে গেলেই আমিরের মুখ চকচক করে উঠছে।বোঝাই যাচ্ছে সে কত খুশি!সেঁজুতি বোজা কন্ঠে বলল
“ঠিক আছে।
___
বিকেল চারটায় আসার কথা আবিরের। অথচ এখন চারটা বিশ।আবিরের ছায়াও পরেনি এখনও।
অনেকক্ষন যাবত বসে আছে সেঁজুতি।আবিরই আসতে বলেছে এখানে।বিয়ের ব্যাপারে আবিরের সাথে সেঁজুতিরও সামনা সামনি কথা বলা দরকার।সেঁজুতির কেমন শ্বাস আটকে আসছে।যতবার ভাবছে আবিরকে বিয়ে করতে হবে,ততবারই কোথাও কান্না পাচ্ছে খুব।রুদ্রর কথা মনে পড়ছে বারবার।সেঁজুতি হাতঘড়ি দেখলো।অপেক্ষা করতে করতে সে বিরক্ত।আচ্ছা,রুদ্রও তো এমন অপেক্ষা করতো সিলেটে।উনিও কী এমন বিরক্ত হতেন?সেঁজুতি উদাস চোখে জানলা গলে বাইরে তাকায়।তখনি আবির এসে
ধড়ফড় করে চেয়ারে বসলো।সেঁজুতি খানিক চমকায়।আবির ঘেমে জুবুথুবু। কপাল বেয়ে টপটপ করে পরছে ঘাম।বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি খেয়ে ফেলল।সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
“কি হয়েছে? এভাবে হাপাচ্ছো কেনো?
আবির হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,
‘আরে তোমার ওই বস আছেনা?উনি আমাকে ধাওয়া করেছিলেন?
সেঁজুতি আঁতকে উঠলো,
— কিহ? কেনো?
‘ কোনও ভাবে খবর পেয়েছেন হয়তো আমরা দেখা করছি। আর তাই আমাকে এখানে আসতে বাঁধা দিচ্ছিলেন।
সেঁজুতির যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা।সন্দেহী চোখে চেয়ে থাকতে দেখে আবির হেসে বলল,
” আরে সিরিয়াস হচ্ছো কেনো? মজা করছিলাম।
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অন্যদিক চেয়ে বলল,
“এসব ব্যাপারে মজা করা ঠিক নয়।
‘আচ্ছা বাবা স্যরি!এখন এসব ছাড়ো। আমি কি ওসবে ভয় পাই নাকি।আপাতত তুমি এটা ভাবো যে..
আমাদের বিয়ে হচ্ছে সেঁজুতি। তুমি ভাবতে পারবেনা হাউ মাচ আ’ম এক্সাইটেড!
কিছুক্ষন চুপ থাকলো সেঁজুতি। তার মানে সত্যিই আবির রাজী। সেঁজুতি নিচের দিক চেয়ে মিহি কন্ঠে বলল ‘ আমি এই বিয়ে করতে চাইনা আবির।
আবির যেন বিস্মিত,
‘কেনো??
সেঁজুতি উপযুক্ত কোনো কারন খুঁজে পেলোনা।আবির নিজেই বলল,
‘ কাউকে ভালোবাসো?
সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো।সিলেটে রুদ্রর খিলখিল করে হাসির দৃশ্য, ওদের কাছাকাছি যাওয়ার দৃশ্য গুলো স্বচ্ছ জলের মতো ভাসতে থাকলো চোখের সামনে।
” কি হলো?কাউকে ভালোবাসো?
সেঁজুতি সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো নঁড়ে ওঠে।আবিরের প্রশ্নে একটা নামই মাথায় আসছে’ রুদ্র! রুদ্র!রুদ্র!আবির পুনরায় ডাকলো,
“সেঁজুতি? এই সেঁজুতি? কোথায় হারিয়ে গেলে?
‘হু?হ্যা বলো..
” কাউকে ভালোবাসো কীনা এখনও বললেনা।
আবিরের মুখে মিটিমিটি হাসি।খুব করে চাইছে সেঁজুতি কাঙ্ক্ষিত নামটি বলুক।অথচ সেঁজুতি টু শব্দ করলোনা।তার দৃষ্টির মত তার মন ও উদাসীন।আবির নিজেই বলল,
‘ বুঝেছি।কেউ নেই তাইতো?তাহলে সমস্যা কোথায়? বিয়ের পর না হয় আমাকেই ভালোবাসবে।খুব সুখে রাখবো তোমাকে।
আবির সেঁজুতির হাতের ওপর হাত ছোঁয়ায়।সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে হাত সরিয়ে নিয়ে কোলের ওপর রাখলো।আবিরের হাসি পেলো ভীষণ।
মেকি সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
‘দেখো সেঁজুতি!আমাদের বিয়েটা নিয়ে তোমার আমার আগ্রহের থেকেও আমাদের পরিবারের আগ্রহ অনেক বেশি।তাদের স্বপ্ন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখতে চায়।এতে ভুল তো কিছু নেই।হ্যা তোমার যদি একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো তবে না হয় মেনে নিতাম,কিন্তু যেখানে পাকাপোক্ত কোনও কারনই দেখাতে পারছোনা, সেখানে বিয়ে তে না করার কোনও মানে হয়?প্লিজ! সেঁজুতি,যেদিন থেকে জেনেছি তোমাকে ঘরের বউ করে আনবে বাবা-মা,সেদিন থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি তোমাকে নিয়ে।তাই আর অমত কোরোনা।প্লিজ!
সেঁজুতি তখনও চুপ করে থাকলো।কন্ঠ বুজে আসছে কথা বলতে।কোনো রকমে মাথা দুলিয় নিরব সম্মতি বোঝায়।মুখে বলল ‘এবার তবে উঠি?
” হ্যা নিশ্চয়ই, তবে আর একটা কথা…
সেঁজুতি তাকালো,আবির বলল,
“তোমাকে আর রুদ্রর অফিসে কাজ করার দরকার নেই।
আবিরের কন্ঠে অধিকারবোধ।সেঁজুতি চাপা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এক কথা বারবার কেনো বলছো আবির?সব তো বলেছিলাম তোমাকে।
আবির নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল,
” এগ্রিমেন্টের কথা তো? জানি।আর তাই আমি জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা ওনার অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সেঁজুতি বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকালো,
“কিহ? আমাকে না জানিয়েই?
“জানালে টাকা তুমি নিতেনা আর তাই এরকম করলাম। এসব নিয়ে ভেবোনা এখন।
দুদিন পরে অর্ধাঙ্গিনি হবে আমার।সেটা নিয়েই ভাবো।ওই রুদ্রর মুখ আর দেখতে হবেনা তোমাকে।
সেঁজুতির হৃদয় থমকে যায় কয়েক মুহুর্তের জন্যে।আবিরের মুখে অর্ধাঙ্গিনী শব্দটি পৃথিবীর সব থেকে কুৎসিত মনে হলো।সাথে অজানা কষ্টে হাহুতাশ করে উঠলো বুক।রুদ্রর থেকে ছাড়া পেলো সে?কিন্তু খুশি হতে পারছেনা কেন?হাসি ফুঁটছেনা কেন মুখে?কেন কান্না পাচ্ছে? এতোদিন যার থেকে নিস্তার পেতে চাইলো, আজ এতো সহজে পেয়ে গিয়েও ভেতরটা অস্থির অস্থির লাগছে কেন?যেন অমূল্য কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।আর সে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। আর কোনও দিন দেখতে পাবেনা সেই রাগী বদমেজাজী রুদ্র রওশন কে?রুদ্রর ঝারি না খেলে যে তার সকালই শুরু হয়না।
সেঁজুতির ভাবনা কাটলো আবিরের কথায়
” চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
” আমি যেতে পারব আবির।অন্তত এ ‘কটা দিন নিজের মত চলতে দাও।
আবির আর বাঁধা দিলোনা।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে এলো।রিক্সা ডেকে উঠে হুড টেনে দিলো।সেই প্রথম দিনের মতো মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো অাজ।কিন্তু শব্দ হলোনা।ওড়নার প্রান্ত মুখে গুঁজে কাঁদলো পুরোটা রাস্তা।পথে কোনো কালো গাড়ি দেখলেই রুদ্রর কথা মনে পড়ছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি কাঁচ গলে বেরিয়ে আসবে রুদ্রর শান্ত মুখ।রাগি কন্ঠে বলবে ‘ এটা কান্নার জায়গা নয় সেঁজুতি! বাসায় গিয়ে কাঁদুন।তখন কান্না আরো বেড়ে আসে সেঁজুতির।
বাড়িতে ঢুকে বাবার সঙ্গে দেখা করলোনা সেজুঁতি।আমির তখন নিজের ঘরে থাকায় মেয়ের ফেরা টের পাননি।দরজা সেঁজুতি চাবি দিয়ে খুলেছে।রুমে ঢুকেই সেঁজুতি সিটকিনি টেনে দিলো।ওয়াশরুমে গিয়ে পানির সব গুলো ট্যাব খুলে রেখে বসে পরলো ভেজা মেঝেতে।হাউমাউ করে কাঁদলো। রুদ্রর কথা যত মাথায় আসছে তত দ্বিগুন হচ্ছে কান্না।সেঁজুতি চিৎকার করে বলল
‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি রুদ্র।ভালোবাসি আপনাকে।পারলাম না,নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রন করতে।পারলাম না তাদের আটকাতে।সেই আপনাকে ভালোবেসেই ফেলল ওরা।কিন্তু, আমি চাইলেও যেতে পারছিনা আপনার কাছে।চাইলেও বলতে পারছিনা মনের কথা।আপনি একটা চরিত্রহীন।যার প্রত্যেকটা রাত কাটে ভিন্ন ভিন্ন মেয়ে নিয়ে, কোন ভরসায় তার কাছে যাব আমি?কোন ভরসায় তাকে জীবন সঙ্গী বানাব?আমি না খেয়ে থাকব,গাছতলায় ঘর বাঁধব,তবুও একজন চরিত্রহীন লোককে কাছে টানবনা।কিছুতেই না।
____
টি টেবিলের ওপর কাঁচের এস্ট্রে। একটু একটু করে হাতের সিগারেট এর পুড়ে যাওয়া অংশ ফেলছে রুদ্র।ছাদের দিক মাথা তুলে ধোয়া ছাড়ছে।কী আয়েশী ভঙ্গি তার!যেন এই মুহুর্তে এমন সুখকর কাজ দ্বিতীয়ও টি নেই।
রুদ্রর বাম দিকে চিন্তিত মুখ করে বসে আছে এরিকা।কিন্তু রুদ্র ভ্রুক্ষেপহীন। এরিকা নিজেকে অনেকক্ষন সংযত রাখলো।শেষে আর না পেরে বলেই ফেলল ‘আপনার কি মনে হয় এতে কাজ হবে??
রুদ্র নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“হবে বলেই করছি। রুদ্র রওশন কখনও অকাজ করেনা।
“কিন্তু হিতে বিপরীত হলে?
রুদ্র ঘাড় কাঁত করে তাকালো,
“আপনার ভালোবাসার ওপর আপনার বিশ্বাস নেই এরিকা?
“থাকবেনা কেনো?
এরিকার দৃঢ় কন্ঠ।রুদ্র সামনে ফিরে বলল,
“তবে এমন প্রশ্ন করার যে কোনও মানেই হয়না।আমাকেও তো দেখতে হবে আমার ভালোবাসার জল কত দূর অব্ধি গড়ায়!
ছাড়ুন ওসব।আমার আতিথেয়তা কেমন লাগছে বলুন।
এরিকা হাসলো,
‘খুব ভালো।
____
দু সপ্তাহ কেটে গেলো।এই মাসের শেষ দিকে আবির-সেঁজুতির বিয়ে। মাঝখানে আংটি পরাতে আসেন আবিরের মা মনোরমা।সাথে আবির- হোসাইন ও আসেন।সেঁজুতি নিরস মুখে শাড়ি পরে তাদের পাশে বসলো।একটা বার মুখ তুলে দেখলোনা সামনে হাসি হাসি মুখ করে বসা আবিরকে।আমির হোসাইন কতবার যে একে অন্যের দিকে চেয়ে তৃপ্তির হাসি দিলেন তার হিসেব ছিলোনা।দুজন ভীষণ খুশি।বন্ধুত্ব এবার আরো জোড়ালো হবে।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো আংটি পরাতে গিয়ে।বাক্স খালি।হীরের আংটিটা হঠাৎই গায়েব দেখে মনোরমা যেন আঁতকে উঠলেন।চিল্লিয়ে বললেন ‘ একী আংটি কই?বাক্স তো খালি।
সবার তখন চোখ বেরিয়ে আসে।মাথায় বাঁজ পরলো প্রত্যেকের।এ আবার কী অলুক্ষনে কথা! আংটি পরাতে এসে আংটিই পাচ্ছেনা?ঠিক হলো আবার একটা আংটি কিনে আনা হবে।এক্ষুনি।কিন্তু বাঁধ সাধলো আবির।আমতা-আমতা করে বলল ” একবার যখন আংটি হারিয়েছে তার মানে বাঁধা পরেছে আম্মু।আংটি বদল বাদ দাও।একবারে বিয়ের দিন পড়িও না হয়?
মনোরমা খুঁতখুঁত করলেন।কিন্তু নিরব সেঁজুতি আগ্রহ দেখালো এবার।জানালো সেও একমত।এমনিতেই আংটি পরা থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচানো যায় সেই কথাই ঘুরছিলো মাথায়।সুযোগ পেয়ে লুফে নিলো। ছেলে মেয়ের দুজনেরই যখন একি মত তখন আর কেউ গাইগুই করলেন না।মেনে নিলেন।তবে মনোরমা গলার চেইনটা খুলে পরিয়ে দিলেন সেঁজুতি কে।মন ভরে দোয়া করলেন দুই স্বামী- স্ত্রী।শেফালি রাতে কাজে এলেও ঐদিন সকাল সকাল চলে এলো।আমির বলেছিলেন,সাথে অন্য একটা কারন।বাটন ফোন চেপে চেপে একটু পরপর রুদ্রকে সব খবরাখবর দিচ্ছে সে।এমনকি কাল রাতে রান্না করার সময় সেঁজুতির কান্নার শব্দ শুনেছে তাও জানালো।তার কাজইতো এটা।সেঁজুতি মাস শেষে বেতন দিলেও রুদ্রর থেকে বাড়তি টাকা পায় শেফালি।তাও সেঁজুতির সব খুঁটিনাটি খবর রুদ্রকে পাঠিয়ে।এই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সেদিন তো রুদ্রই তাকে পাঠালো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আবিররা চলে যায়।আমির মেয়ে জামাইয়ের জন্যে আংটি গড়েছিলেন,কিন্তু ওই কথায় আর পড়াননি।সেঁজুতিও চুপচাপ উঠে রুমে ঢোকে।দরজা আটকেই সাথে সাথে টেনে পড়নের কাপড় খুলে ফেলে।ডুকরে ডুকরে কাঁদে বিছানায় শুয়ে।শেফালী কান সজাগ করে শুনছিলো সে শব্দ।যখন নিশ্চিত হলো সেঁজুতি কাঁদছে তখন চট করে একটা বানান ভুলে ভরা মেসেজ পাঠালো রুদ্রর ফোনে।সেঁজুতি বিছানার চাদর খামছে কাঁদছিলো।রুদ্রকে একটাবার দেখার তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ।কিন্তু রুদ্র তার বিশ্বাসের অযোগ্য বলেই সংবরন করছে নিজেকে।এমন নয় যে রুদ্র লা পাতা।মাঝখানে একদিন গভীর রাতে রুদ্র কল করে সেঁজুতি কে।রুদ্রর কল দেখেই সেঁজুতি ধড়ফড় করে রিসিভ করলো।রুদ্র তখন শীতল কন্ঠে বলল
‘একবার ভালোবাসুন না,সেঁজুতি!
জবাবে সেঁজুতি লাইন কেটে দেয়।ফোনটাকে দেয়ালের ওপর ছুড়ে মারে।ভেঙে টুকরো হয় সেটি।তারপর আর চাইলেও রুদ্র যোগাযোগ করতে পারেনি।আজ পুরো দশ দিন এক সেকেন্ডের জন্যেও রুদ্রর গলা শোনেনি সেঁজুতি। সেঁজুতিদের সব খরচ এক প্রকার জোর করে আবির চালাচ্ছে।অবশ্য আবির নয়,পেছনে মূলহোতা রুদ্র।সেঁজুতি সেসব জানেনা।
অযৌক্তিক অভিমানে তার বুক ভার হয়ে আছে।রুদ্র কেন যোগাযোগ করছেনা?ফোন ভেঙেছে বলে কী যোগাযোগ করা যায়না?উনি আমাকে আদৌ ভালোবাসেন তো?ভালোনা বাসলে আমার মত সাধারন একটা মেয়ের পেছনে কেন এতো সময় নষ্ট করলেন?কম অপমান তো করিনি ওনাকে।মুখে যা এসেছে তাই বলেছি।যে লোক কখনও কারো থেকে দু কথা হজম করতোনা সে আমার সব অপমান মুখ বুজে মানতেন।হাসতেন।তাহলে এখন কেন গায়েব হয়ে গেলেন উনি?একটা বার নিজেকে শুধরে ফিরতে পারেন না?এসে বলতে পারেন না,সেঁজুতি,তুমিই হবে আমার জীবনের শেষ নারী!যদি নাই বলবেন তবে কেন আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলেন রুদ্র?এই বিয়ে কী করে করব আমি? কী করে?সেঁজুতি আবার কান্নায় ভেঙে পরলো।এবার আর শব্দ এলোনা বাইরে।
_____
বিয়ের বাকী মাত্র দুই দিন।সেঁজুতি মরা শরীর টা টেনেটুনে হাটছে। কথা বলছে,হাসছে সবার সাথে।
বিছানার ওপর বিছিয়ে রাখা বিয়ের বাজার।আজই আবিরদের ড্রাইভার দিয়ে গেলেন।বিয়ের জন্যে কনভেনশন হল ও ভাড়া করা শেষ। সেঁজুতিদের আত্মীয় স্বজন নেই।যা লোক সব আবিরদের। এক ধ্যানে বিয়ের শাড়ি,গয়নার দিক চেয়ে আছে সেঁজুতি। হাটুতে থুতনী রাখা।রক্তশূন্য চেহারা।তখন রুমে কারো পায়ের শব্দ পেলো।সেঁজুতি বিদ্যুৎ বেগে চোখ মুছে পেছনে তাকালো।আমির হোসাইন দুজনে একসাথে দরজায় দাঁড়িয়ে।সেঁজুতি মেকি হেসে বলল ‘ আরে তোমরা?এসোনা।
হোসাইন- আমির ভেতরে এলেন।সেঁজুতি বলল,
” কেমন আছো আংকেল?
আজ আর হোসাইন হাসলো না।চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ তীব্র।পাশেই নিশ্চুপ আমির।হোসাইন কোনো রকম জিজ্ঞেস করলো,
” তুই কেমন আছিস?
” ভালো। তোমাদের কিছু হয়েছে?এরকম দেখাচ্ছে কেনো?
“কিছু হয়নি।
হবেওনা। যদি তুই আমাদের কথা রাখিস।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
“কি কথা?
হোসাইন ইতস্তত করলেন,
” কিভাবে যে তোকে কথা টা বলি?
” সিরিয়াস কিছু হয়েছে নাকি?বলোনা?
বাবা তুমি বলোতো কি হয়েছে?
আমির আর্তনাদ করে বললেন ‘ আমি? না না আমি জানিনা,হোসাইন জানে।
হোসাইন রেগেমেগে তাকালেন,
” আমি জানি? আমাকে ফাসিয়ে দিচ্ছিস তাইনা?? বল তুই-ই বল,আমি পারবোনা বাবা।
সেঁজুতি অধৈর্য,
” উফফ কি হয়েছে বলবে তো??
আমির বললেন,
” আসলে হয়েছে কি…
” কি?
হোসাইন মিনমিন করে বললেন,
“আসলে সেঁজুতি তোর সাথে আবিরের বিয়েটা আমি দিতে পারবোনা মা।
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here