হৃদয়ের সুখ আপনি – পর্ব 26

0
313

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২৬
#Nishi_khatun
বর্ষাকালের পর প্রকৃতি যেমন রৌদ্রস্নান করে।
ঠিক সেভাবে নানারকম চড়াই উৎরাই পাড় করে।
রিমশা আর দাইয়ান তাদের অনাগত সন্তানের প্রতিক্ষায় সোনালি দিন গুলো পার করছে।
রেহেনা বেগম বাড়ির দুই বউ কে কোন কাজ করতে দেয় না। একদিকে বড় বউয়ের কোলে দুই বাচ্চা। রাইসা দুই বাচ্চাকে নিয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। অন্যদিকে রিমশা গর্ভবতী তার শারীরিক মানুষিক দুই দিকে পরিবর্তন হচ্ছে।
এ সময় রিমশা কে দিয়ে সংসারের কোন কাজ করানো উচিৎ মনে করে না রেহেনা বেগম।
দেখতে দেখতে রাইসা’র বাচ্চাদের আজ প্রায় চার মাস বয়স।
এদিকে রিমশা’র প্রেগনেন্সির পাঁচ মাস চলছে।
সারাদিন বাড়িতে শুয়ে বসে থাকতে রিমশা’র ভালো লাগে না। ধীরেধীরে রিমশা’র পেট হালকা ফুলে গেছে। এখন তাকে কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় সে গর্ভবতী। রিমশা’র আজকাল বাড়ির বাহিরে যেতে লজ্জাবোধ হয়। কেনো জানি তার মনে হয় সকলে ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে।
হয়তো তাকে নিয়ে অন্যরা কানাঘুষো করে।
দাইয়ান রিমশা’র এই সমস্ত লজ্জা পাওয়া দেখে খুব মজা নেয়।
সে রিমশা কে বলে,
“এই যে আমার বিবিজান! আপনি যে ভাবে রাস্তায় বাহির হলে লজ্জিতবোধ করেন, এতে আপনাকে দেখে আমার খুব হাসি পায় তা জানো?”
রিমশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আপনাকে বাবা ডাক শোনাবো বলে আমি এতো কষ্ট সহ্য করছি। আর আমার সমস্যায় আপনি মজা নিচ্ছেন?”
দাইয়ান বলে,”আরে বাচ্চা বউ এভাবে রেগে যাও কেন?
শুনবে তো আমার কথা! তুমি যেভাবে রিয়াক্ট করো তাতে মনে হয় সমাজে আর কোন নারীর বাচ্চা হয়নি। তুমিই প্রথম! আসলে তোমার এই আনইজি ফিল করার কোন মানে হয় না। প্রকৃতির নিয়ম এটা। একটা মানব সন্তান ১০ মাস তার মাতৃগর্ভে লালিত হয়ে নিদিষ্ট সময় ভূমিষ্ঠ হবে। তাহলে এই দশ মাস কি প্রতিটা গর্ভবতী মহিলা পুরুষদের দেখে লজ্জিত হয়ে ঘরের কোণায় মুখ লুকিয়ে রাখবে? নারীর এই ত্যাগ তো পুরুষদের জন্য। তাহলে তোমরা কেনো বাড়ির বাহিরে যেতে আনইজি ফিল করবে? তোমার দিকে যে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাবে তার উচিৎ লজ্জিত বোধ করা। কোন গর্ভবতীর মহিলার না।”
রিমশা দাইয়ানের কথা শুনে লজ্জায় নুইয়ে পড়ে।
এই লোকটা তার জন্য যে কোন পরিস্থিতি খুব দ্রুত সহজ করে দেয়। আমি কোন কিছু মুখে প্রকাশের আগে সে আমার চেহারা দেখে বুঝে যায়। আচ্ছা, আমি কেনো তার মনের কথা বুঝি না?
দাইয়ান তখন হুট করে হালকা ফুলে ওটা পেটে টুপ করে নিজের ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে। হুটহাট দাইয়ানের করা এসব কর্মকাণ্ডে আজকাল বেশ লজ্জায় পরে রিমশা।
কেন যে মানুষটা তাকে এতো বেশি লজ্জায় ফেলে।
সে জানে তার এমন কাজে আমি খুব লজ্জাবোধ করি।
তবুও এসমস্ত কাজ উনি করবেই।
দাইয়ান তখন রিমশা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এতো লজ্জার কি আছে? আমি তোমার একমাত্র স্বামী।
আমি হুটহাট আদর সোহাগ না করলে কে করবে শুনি?”
রিমশা লজ্জায় আরো নুইয়ে পড়ে।
তখন দাইয়ান বলে,
“আরে শোন, তোমাকে তো বলা হয়নি!
আমি শহরে জবের জন্য একটা কোর্টে এপ্লাই করেছিলাম।
তারা আমাকে ডেকেছে। কয়েকদিনের জন্য তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে হবে। তা-ই তোমার অনুমিত নিতে এসেছি। ”
হঠাৎ করে লজ্জা রাঙা মুখ কালো অন্ধকার ছেঁয়ে যায়।
রিমশা হুট করে বলে,
“আপনি না গেলে হয় না?”
রিমশা কে আলিঙ্গন করে বলে,”ধুর পাগলি। সারাবছর কি এই গ্রামে বেকার বসে থাকবো? নিজেদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করতে হবে না? তাছাড়া ভুলে যাও কেনো আমি একজন ব্যারিস্টার। আমি ইচ্ছা করলেই নিজের পেশাটা কে বিষর্জন দিতে পারি না।”
রিমশা কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,
“আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে।”
দাইয়ান রিমশা’র মাথায় হাত বু্লিয়ে দিয়ে বলে,
“মাত্র কয়েকদিনের বেপার। চাকুরীটা হয়ে গেলে,
আমি সেখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে নিয়ে যাব।
তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি দূরে শান্তিতে
থাকতে পারবো?'”
এরপর রিমশা কে বলে সেদিন বিকালে দাইয়ান বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এদিকে দাইয়ান কে ছাড়া এক মিনিট যেনো এক বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আসলে প্রাণের মানুষ একটু চোখের আড়ালে গেলে সেই দিন গুলো পার করতে খুব কষ্ট হয়। সময় গুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হতে থাকে। আর রাত্রি বেলায় ঘুমেরা লুকোচুরি খেয়াল মেতে ওঠে। দুষ্টু ঘুম গুলো পালিয়ে এটা বোঝাতে চাই, বারংবার তোমার কাছের লোকটা আজ সঙ্গে নাই। সে আছে বহুদূরে তুই ইচ্ছা করলেই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
দাইয়ান যাবার পর রিমশা সময়পার করতে ইলমা আর ঝর্নার সান্নিধ্যে আসে। এই দুইটা মেয়ের সাথে তার সময় ভালোই পার হবে। এদের সাথে আড্ডায় মগ্ন থাকলে কিছুসময় তো তার কথা মনে পড়বে না। এটাই মূলত রিমশা’র উদ্দেশ্য।
ওদের সাথে আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায় রিমশা ইলমা কে প্রশ্ন করে- আচ্ছা গ্রামে যে সমস্ত খুন হয়েছে, সে খুন গুলো কে বা কারা করেছে তার কোন সুরাহ হলো?
ইলমা বলে,
-“শুনেছি পুলিশ তাদের সন্দেহের বশে অনেকে-ই থানাতে তুলে নিয়ে গেছিলো। তবে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তা-ই সকলকে ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো এই খুন গুলোর প্রকৃত আসামী ধরতে পুলিশ ব্যর্থ। শুনেছি এই খুনের মামলা অমীমাংসিত রেখে তারা কেস ক্লোজ করবে।”
তখন ঝর্ণা বলে,
-“আসলে খুনি অনেক চালাক। তা-ই তো এমন ভাবে খুন গুলো করেছে যেনো কেউ তাকে ধরতে না পারে। নয়তো খুনি খু-ন করে ধরা পড়বে না? একটা দুইটা না! পুরো ছয়টার বেশি খু-ন করেছে সে। তবুও আসল অপরাধী লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। শুধু খুনি হবে কেন? এমনিতে কত মানুষ নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে তার কোন হদিস নাই।”
তখন হুট করে রিমশা ঝর্ণা কে প্রশ্ন করে,
“এই তোমার বোন মেরিনা’র কী অবস্থা?
সেদিন তোমার বোনের সব কথা শোনা হয়নি।
তাছাড়া মেয়েটা কে ঐ ভাবে না রেখে ভালো ট্রিটমেন্ট করাতে পারো না?”
মেরিনার কথা শুনে ইলমা আর ঝর্ণা দুজনে চমকে ওঠে।
ওদের মনটাও একটু খারাপ হয়ে যায়।
ইলমা দ্রুত বলে ওঠে,
“ভাবী তোমার দোহাই লাগে মেরিনা আপুর নামটা আর উচ্চারণ করিও না।”
রিমশা প্রশ্ন করে, “কেনে? সমস্যা কী?”
ঝর্ণা তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমার আপু বেঁচে আছে সে কথা গ্রামের কেউ জানে না। এবাড়ির সদস্যরা ছাড়া বাহিরের কাকপক্ষীও জানে না। ”
রিমশা – কেনো তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছ?
তখন ঝর্ণা বলে ওঠে,
–“পতিতালয় থেকে যদি একবার কোন মেয়ে ফিরে আসে।
সে যদি দুধে ধোয়া হয়! তবুও এ সামাজের মানুষেরা তাকে মেনে নিবে না। তার উপরের কতশত পুরুষেরা নির্মম ভাবে মেরিনা আপু কে ভোগ করেছিল তার ঠিক নেই। আপুকে যখন পাওয়া যায় তখন সে অর্ধমৃত। তার সে অবস্থা দেখে দিরহাম ভাই সামাজের লোকেদের কাছে জীবন্ত অবস্থায় তাকে মৃত ঘোষনা করে। এদিকে এসে মিথ্যা দাফনকাজ সম্পন্ন করে। অন্যদিকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। সেখানে আপু হিংস্র আচরণ করত। মেরিনা আপু নিজের সাথে হওয়া মানুষিক, শারীরিক অত্যাচারে খুব হিংস্র মানুষিক রোগীতে পরিণত হয়।”
ডাক্তার বলে, “তাকে পাবনা মানুষিক হাসপাতালে রেখে আসতে। সে উন্মদ পাগল হয়েগেছে। তাকে সুস্থ মানুষের আশেপাশে না রাখা উচিৎ। যদি বাড়িতে রাখতে চান তাহলে সকলের থেকে দূরে রাখবেন। নয়তো কারো সাথে খুব খারাপ কিছু করে বসতে পারে।”
এটুকু বলে নিজের চোখেরজল মুছে ঝর্ণা। তারপর আবারো বলে,
—“ভাবী জীবন্ত মানুষকে মৃত বানিয়ে রাখা এতো সহজ কাজ না। তবুও কিছু করার নাই! এক দিকে আপু পাগল অন্যদিকে আপু ধর্ষিতা। এই সুস্থ সমাজে তার কোন স্থান নেই। যে সমাজ একটা সুস্থ ধর্ষিতা মেয়েকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেয়না। সেখানে আমার আপু তো পাগল। তাকে কীভাবে বাঁচতে দিবে?”
মেরিনার কথা শুনে রিমশা’র চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রিমশা ভাবছে,”আমাদের সামাজের মানুষেরা এমন কেন? তারা পাপ কে ঘৃণা না করে পাপী কে ঘৃণা করে।
যে অন্যায় করে, সে মাথা উঁচু করে বাঁচে। আর যে ভুক্তভোগী হয়, তাকে সারাজীবন সামাজের কটু কথা আর নিজের সাথে হওয়া পাপের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়।”
ইলমা রিমশা’র কাঁধে হাত রেখে বলে,”ভাবী তুমি মেরিনা আপুর কথা ভেবে কষ্ট পেওনা। আপু যেভাবে আছে অনেক ভালোই আছে। সামাজের লোকেদের তিরস্কার শোনার থেকে দূরে নির্ভেজাল আছে। তার জন্য আমাদের ও কারো কোন কটু কথা শুনতে হয় না।”
রিমশা বলে,
–“একটা বাড়ির দুইটা মেয়ের সাথে ওরা অন্যায় করার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে নাই। মেয়েরা বাড়ির সম্মান,
তাদের সম্মান রাস্তায় বিলিন করার মানে হয় না।”
ঝর্ণা বলে,”ওরা অন্যের মান- সম্মান নষ্ট করেছে। তা-ই তো আল্লাহ ওদের পাপের যোগ্য শাস্তি দিতে কাউরে মাধ্যম হিসাবে পাঠিয়েছে। যে পাপ করে তাকে একদিন সে পাপের ফল ভোগ করতেই হয়।”
রিমশা তখন আফসোসের সুরে বলে,”ইশ রে আমি যদি একটিবার ঐ খুনির সাথে দেখা করতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলতাম না। সমাজের এতোবড় উপকার করার জন্য।”
ইলমা বলে,
— “দেখা গেলো তুমি খুশির ঠেলাতে ভালো বুঝে তাকে আলিঙ্গন করতে গেছো। এদিকে সে এতো গুলো খুন করেছে! সে সব খুনের নেশাকাটাতে না পেরে তোমাকে খু-ন করে দিল। তখন তুমি কি করবে? তাছাড়া এখন তুমি একলা না। তা-ই ঐ সব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও।”
রিমশা অট্টট্ট হাসি দিয়ে বলে,
–“আমি শহীদ হয়ে যাব ঐ খুনির হাতে এমনটা ভাবতে যেওনা। তোমার ভাইয়া আছে না। সব সময় আমার প্রটেকশন হয়ে।”
(মন্তব্য করবেন সবাই)



চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here