প্রহর শেষে আলোয় রাঙা – Part 14

0
365

#পর্ব_১৪
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
“চলুন এই পড়ন্ত বিকেলে চা বাগানে চা-বিলাশ করি।”
আলো সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইলে প্রহর আবার বলে,
“ঢাল বেয়ে নিচে নেমেই আমার পরিচিত এক দাদুর চায়ের দোকান আছে। ছোটো পরিসরে কিন্তু দাদু খুব দারুন চা বানায়। একবার খেয়ে স্বাদ ভোলা দায়।”
আলো ভাবুক স্বরে বলে,
“চলুন তাহলে চা টেস্ট করেই আসি। চা বাগানে বসে পড়ন্ত বিকেলে চায়ের অফার মিস দেয়ার মতো বোকামি আমি অন্তত করব না।”
প্রহর নিঃশব্দে হাসে তা দেখে আলোও হাসে অতঃপর চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।
__________
কাপ ভর্তি চায়ের উপর পাতার ফাঁক গলে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদ এসে পরছে। আলো অল্প অল্প করে চায়ের স্বাদ উপভোগ করছে সাথে প্রহরও। আলো মুগ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“দারুন! দারুন! চায়ের স্বাদটা সত্যি অসাধারণ।
প্রহর প্রত্যুত্তর না করে নিরব হাসে। চাওয়ালা দাদু বলেন,
“আমি চল্লিশ বছর আগে আমার বিবিরে নিয়া কুমিল্লার থিকে এখানে বেড়াইতে আইছিলাম। তারপর এই চা-বাগানের মোহে পইরা এখানেই থাইকা গেছি। বিবির শখ পূরণ করতে এখানে আইছিলাম। তারপর কলভার্টের শ্রমিক থিকা হইলাম চাওয়ালা।”
“দাদু আপনার ছেলে-মেয়ে নেই?”
“আছে তো। এক মাইয়া আছে। তারে এহানে আইনা বিয়া দিছি। মাইয়ার ঘরের পুলাপানেরও বিয়া হইয়া গেছে।”
আলো মুচকি হেসে আশেপাশে দেখতে দেখতে চা খেতে থাকে। প্রহর চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে একটা গানের কিছু অংশ গেয়ে ওঠে,
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে।
আমার মনের ঘরে চান্দের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে।
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে।
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে।”
গান শুনে আলোও উঠে আসে। প্রহর ইতোমধ্যে থেমে গেছে। আলো বলে ওঠে,
“থেমে গেলেন কেনো? ভালো লাগছিল তো। কবিতা আবৃতির পাশাপাশি গানও ভালো করেন।”
“(দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে তার কাঁঞ্চাসোনা
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না)২
আমি প্রথম দেখে পা*গল হইলাম মন তো আর মানে না।
কাছে আইসো আইসোরে বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসোরে বন্ধু আমায় যতনে।”
গানের প্রতিটি লিরিক্স প্রহর আলোকে উদ্দেশ্য করেই গেয়েছে। আলোও হুট করে লাজেরাঙা হয়ে ওঠে। উপরন্তু দুজনেই বাকিটা সময় নিরব ভূমিকা পালন করে।
সেদিন বাড়ি ফিরে আলোর মন প্রহরকে নিয়ে দিন-রাত ভাবতে থাকে। পরেরদিনও সকাল ও বিকেলের সময়টা প্রহরের সাথে সুন্দরভাবে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেই আরমান শেখ বলেন,
“আগামীকাল বাদ আসর তোমার বিয়ে। তাই আগামীকাল বিকেলে বের হবে না। পারতপক্ষে সকালেও না।”
তিনি কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে যান। এদিকে আলো পাথরের মতো নিশ্চল ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা বলে যাওয়া কথাগুলো তার মস্তিস্কে প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে দরুণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। একই স্থানে পাঁচ-দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে দোর দেয়। মনকে যতদূর সম্ভব শান্ত করে অতিসত্তর অজু করে মাগরিবের নামাজটা পড়ে নিয়ে বিছানায় বসে। বাবা বিয়ে দিবে এটা ভেবে নিয়েই তো দেশে এসেছিল। তবে কেনো এখন বুকটা খাঁ খাঁ করছে? কেনো মনের মধ্যে এক আকাশ শূণ্যতা অনুভূত হচ্ছে? শূণ্যতার নাম কি তবে প্রহর! না আর সে ভাবতে পারছে না। প্রহরের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায়ও তার জানা নেই। বাড়ির ঠিকানাও জানেনা। ইন্টারনেটে প্রহর শেহমাত নামে সার্চ করে অনেক আইডি আসলেও প্রহরের আইডি আসলো না। বিমর্ষ হয়ে ফোনটা বিছানার উপর ফেলে বসে রইল। যখনি কাউকে হারানোর কথা মনে হয় তখনি আলোর মাথায় চাপ পরে অতঃপর প্রচণ্ড মাথাব্যাথায় ভুগে। সহ্য করা দুরুহ। ঔষুধের বক্স থেকে একটা হালকা পাওয়ারের ঘুমের ঔষুধ ও একটা পে*ইনকি*লা-র খেয়ে নিয়ে ঘর অন্ধকার করে এই সন্ধ্যাবেলাতেই ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে।
পরেরদিন আলো খুব ভোরে নামাজ পড়েই চা বাগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। সেই চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। অস্থিরচিত্তে প্রহরের আসার অপেক্ষারত সে। কখন যে আধাঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তার খেয়ালই নেই। অবশেষে প্রহর আসলো। সাদা শার্টে অপরূপ স্নিগ্ধ লাগছে প্রহরকে। আলোর বুকে কেমন একটা করে ওঠল। হারানোর বেদনা তাকে খুব করে আঁকড়ে ধরেছে। নিজেকেই নিজের কাছে অচেনা লাগছে।
সবসময়কার মতো প্রহর স্নিগ্ধ হেসে আলোর সামনে এসে দাঁড়ায় অতঃপর বলে,
“দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছেন?”
“হ্যাঁ। সময় দেখিনি। শুনুন আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
প্রহর নিঃশব্দে হেসে পকেট থেকে হাত বের করে বেঞ্চিতে বসে বলে,
“শুনব তো। সব শুনব। আগে চা-দাদুকে আসতে দিন। এক কাপে চায়ে আপনার সকল না বলা কথা মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনব।”
আলো যেনো আরও অস্থির হয়ে পরে। ছেলেটার নিঃশব্দের হাসিটাও যেনো ওর অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভাবলেশহীন কথাবার্তাতে হাঁসফাস লাগছে। আলো হড়বড়িয়ে বলল,
“না! না! এখন মানে এখনি শুনতে হবে। আপনি কল্পনাও করতে পারছেন না কতোটা ইম্পরট্যান্ট।”
“আচ্ছা তবে বলুন শুনি।”
প্রহরের বুলিতে ও বাহ্যিক ভাব-সাবে কোনো সিরিয়াসনেস নেই দেখে আলোর কষ্ট লাগল। কষ্ট চেপেই বলল,
“আজ আমার বিয়ে। বাদ আসব বিয়ে।”
প্রহরের ভাবলেশহীন কণ্ঠেও যেনো উচ্ছাসের বহিঃপ্রকাশ!
“কনগ্রেটস! তা দাওয়াত দিবেন না?”
আলোর এবার ভিষণ কান্না পেলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের কোণে জমে উঠা জলবিন্দু অতি সন্তপর্ণে মুছে নেয়। তারপর প্রহরের দিকে ঘুরে দেখে প্রহরের দৃষ্টিতে কেমন উৎসুকতা।
“প্রহর আজ আমার বিয়ে হয়ে যাবে! আপনি বুঝতে পারছেন?”
প্রহর দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,
“আমি তো একটু আগে তাই শুনলাম। আমার কানে কোনো প্রবলেম নেই বিলিভ মি। আমি টোটালি ফিট এন্ড ফাইন।”
আলো এবার চিৎকার করে উঠে প্রহরের নাম নিয়ে। প্রহর এবার অতিশীতল কণ্ঠে বলে,
“বিয়ে করে নিন আলো। যা হয় ভালোর জন্য হয়। আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন।”
প্রহর আর কোনো মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। আলো ভগ্নহৃদয় নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সূর্যের প্রখরতা বাড়ার সাথে সাথে আলো বুঝতে পারলো খনিকের মায়া বাড়ালেই কষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরবে চলে যায়।
_________
হরেক রকম ফুল কিনে বাড়ি ফিরে প্রহর। নিজের বিশাল বাড়িটিতে আজ উৎসব। ফুলদানিতে ফুলগুলো সজ্জিত করে কিছু প্রদীপের ব্যাবস্থা করতে গেলো নিজের রুমে রাখবে বলে।
বাড়ি ফিরে আলো একদম নিরব হয়ে নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসে আছে। আরমান শেখ সকাল থেকে দৌঁড়াদৌঁড়ির উপরেই আছে। এতক্ষণে ফুসরত পেয়ে মেয়ের ঘরের কাছে এসে দেখেন দরজা লক। হালকা শব্দে কয়েকবার টোকা দিলেও কোনো জবাব আসে নাই বিধায় তিনি ডাকেন,
“আলো? ঘুমিয়েছ? না ঘুমালে একটু দরজাটা খোলা যাবে মা?”
মিনিট দুয়েকের মধ্যে আলো দরজা খুলে। আরমান শেখ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছো হয়তো। কিছু বলতাম আরকি।”
“জি বলুন।”
আলোর কণ্ঠের মলিনতা আরমান শেখ বুঝতে পারলেন।
“তোমার কি কোনো পছন্দ আছে? থাকলে বলতে পারো। আমার যদি মনে হয় সে তোমাকে প্রটেক্ট করতে পারবে তবে আমি ভেবে দেখব। তাও নিজেকে কষ্ট দিওনা।”
আলো সকালের ঘটনা চিন্তা করে লম্বাশ্বাস নিয়ে বলল,
“নাহ্! আপনার পছন্দেই বিয়ে করব।”
আরমান শেখ মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“সবসময় সুখী হও মা। দোয়া রইল।”
আরমান শেখ মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে প্রহরকে ফোন করে জানায়,
“তোমার ইচ্ছেমতো আলোর পছন্দ আছে কী-না জিজ্ঞেসা করেছি। ওর কোনো পছন্দ নেই বলেছে। সে আমার পছন্দে খুশি।”
প্রহর বাঁকা হাসে। মেয়েটা যে বড্ড অভিমান করে আছে ঠিক বুঝে গেছে।
“ঠিক আছে স্যার। আপনার মেয়ের কোনো প্রবলেম না থাকলে আমারও প্রবলেম নেই।”
“তাহলে আসরের নামাজ পড়েই চলে এসো। হুজুর ও রেজিস্টারকেও বলা আছে।”
“জি অবশ্যই।”
নিজেদের মধ্যে কথোপকথন শেষে কল কে*টে দেয়। প্রহর স্বগতোক্তি করে,
“আজ তার সারপ্রাইজটা পছন্দ হবে সাথে অভিমানিনী আরও অভিমান করবে।”
বলেই হেসে দেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here