প্রহর শেষে আলোয় রাঙা – Part 13

0
293

#পর্ব_১৩
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
আলো বাড়ি ফিরে বাবার চিন্তিত মুখশ্রী দেখতে পেলো। আরমান শেখ বসার ঘরে পায়চারী করে চলেছেন। সদর দরজা হাট করে খোলা। আলো ভিতরে প্রবেশ করে দরজাটা টেনে দেয়। দরজা টানার শব্দে আরমান শেখ পিছনে ফিরে মেয়েকে দেখে যেনো তার ধরে প্রাণ ফিরে। উৎকন্ঠিত উত্তেজিত হয়ে বলেন,
“তোমাকে বলেছি না? সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরবে? কথা শোনো না কেনো?”
অভিমানী আলোর মন অন্তরীক্ষে অভিমানের পাহাড়ে যেনো আরেক স্তুপ পরল। ভাবলেশহীন জবাব,
“আপনার সামনে সুস্থ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি না? তাহলে এই সামান্য দেড়িতে এতো কথা উঠছে কেনো? আমি এখন আর বাচ্চা নেই তাছাড়া বারোটা বছর আমি এভাবেই চলেছি।”
মেয়ের অভিমান তিনি বুঝেন কিন্তু মেয়ের মেডিকেল কন্ডিশনও তিনি জানেন। ছোটোবেলায় যেই ধাক্কাটা আলো পেয়েছিল তাতে বড়ো দুর্ঘটনা ঘটলে লাইফ রিস্ক হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন,
“বাবার মন তো। তাই একটু বেশিই চিন্তা হয়। তোমার ক্ষতি হোক তা কখনোই চাইব না। যাও নিজের ঘরে যাও।”
আলো কিয়ৎ মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে যায়। আরমান শেখ মেয়ের প্রস্থান দেখে চশমাটা খুলে ধীরশান্তে নিজের ঘরের দিকে যান। পাশাপাশি দুটি রুমে বাবা-মেয়ে একই ব্যাক্তির ছবির পানে বিমুগ্ধ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরমান শেখ স্বগতোক্তি করেন,
“তোমার অভিমানী কন্যা তোমার থেকেও বড্ড বেশি অভিমানী আমার জন্য। তোমার সকল অভীমান দিনশেষে আমার সম্মুখে নিষ্পেষিত হতো কিন্তু আমাদের আলোর ক্ষেত্রে তা পাহাড়সম হয়। কী করে বোঝাই বলো? আমার এই ইহজগতে পরিবার বলতে ওকে ঘিরে কিন্তু সেই পরিবার আমিই ওর সুরক্ষার কথা ভেবে ভেঙেছি। যোগ্যপাত্রে ওকে হস্তান্তর শেষে আমার চিন্তা কমবে।”
এদিকে আলো অক্ষিকোণে জমা জলবিন্দু বাহাত দিয়ে মুছে নিয়ে বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে বলে,
“তোমার হাজবেন্ডকে বলে দিও আলো এখন আর দশ বছরের বাচ্চাটি নেই। অনেক বড়ো হয়েছে নিজেকে সামলাতে ও রক্ষা করতে জানে। যখন তার সঙ্গ, ভালোবাসার জন্য কাঁদতাম তখন তো আসেনি। এখন সে আমায় কেনো ডেকেছে তাও আমি বুঝে গেছি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বলে কথা! বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবে। তার থেকে দূরে থেকেও তার বোঝা তো আমি। দিক বিয়ে। করে নিবো তার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে। তারপর আমার জীবনে তার কর্তৃত্ব আর মেনে নিব না।”
কথাগুলো বলতে বলতে অঝোর ধারা নয়নযুগলে প্রবাহিত হয়ে কখন যে চিবুক বেয়ে গড়াচ্ছে তার খেয়াল নেই।
___________
আরেকটি বৃষ্টিস্নাত ভোর। সদ্য পরিস্ফুটিত রবির নরম রোদ ধরণীর বুকে পরেছে সবে। আলো ফজরের নামাজ পড়েই বেরিয়ে এসেছিল সূর্যদোয় দেখতে। চা-বাগানের কর্মীদের কিছুক্ষণের মধ্যেই আনাগোনা শুরু হবে। আলো দুহাত এলিয়ে চোখ বুজে স্নিগ্ধ সময়টায় ভোরের বিশুদ্ধ মনোরোম আবহাওয়া উপভোগ করছে। হালকা টিয়া রঙের কুর্তিতে মনে হচ্ছে চা বাগানে এক সুন্দরী টিয়াপাখি প্রকৃতিস্নানে ব্যাস্ত। প্রহর খানিকটা দূরে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর আড়াআড়ি দুইহাত গুঁজে চা বাগানের নজরকারা টিয়াপাখিকে নয়ন ভরে দেখছে। হুট করে আলোর চুলের হাতখোঁপাটা খুলে গেল। পাহাড়ি ঝর্ণার ন্যায় লতানো কেশাগ্র ছড়িয়ে পরলো কোমড় ছাঁড়িয়ে। আলোর মুখশ্রীতে ফুটে উঠল চমৎকার হাসি যা প্রহরের কাছে নে’শালো ঠেকল! নয়নজোড়া এখনও মুদিত তার। কিয়ৎবার মাথা দুইপাশে ঝাঁকিয়ে চুলগুলোকে প্রাণবন্ত করে নিলো। এদিকে যে কারও হৃৎপিন্ডের রক্তসঞ্চালন দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে তার তো খেয়াল নেই। প্রহর আচমকা বুকে হাত দিয়ে বলে ওঠে,
“হায় মে মা’রযাবা!”
কথাটা হয়তো একটু জোড়েই হয়ে গিয়েছিল যার দরুন আলো ভ্রুঁকুটি করো আঁখি মেলল। আশেপাশে নজর বুলিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে শুভ্র রঙে রাঙানো এক যুবককে দেখতে পায়। কুঁচকানো ভ্রুঁ যুগল যেনো আরও কুঁচকে গেলো। রোদের তির্যক রশ্নিতে ছেলেটির মুখাবয়ব অস্পষ্ট। কয়েক কদম এগিয়ে গেলে ছেলেটির মুখাবরণ দৃশ্যমান হলে দেখতে পায় কালকের সেই কবিতা আবৃতি করা ছেলেটিই। আলোর মুখমণ্ডলে অন্যরকম দ্যুতির আবির্ভাব ঘটে। শুভ্র রঙে রাঙানো এক শুভ্রাচ্ছাদিত মানব। কাছে গিয়ে উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি গতকালকের সেই ছেলেটা না? যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃতি করছিলেন?”
প্রহর আজও নিরুত্তর নির্নিমেষ আলোর চোখের দিকে চেয়ে আছে। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করে আজও জবাব মিলল না। পরপর দুইদিন প্রশ্নের জবাব না মেলায় অপ্রস্তুত হয় আলো। চলে যেতে ধরলে আচানক প্রহর আলোর ডান হাত ধরে ফেলে বলে,
“প্রহর শেহমাত!”
প্রহরের দিকে ফিরে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়,
“সরি!”
মাথা নুইয়ে আলতো হাসে প্রহর। এক হাত পকেটে গুঁজা আরেকহাতে আলোর হাত।
“আমার পরিচয় আপাততো আমি প্রহর শেহমাত। এখনও কোনো জব করিনা তাই জবের রেফারেন্স দিতে পারলাম না। কোনো কাছের মানুষ আপাততো নেই তাই তাদের পরিচয়টাও অচেনা আপনাকে দিলাম না। আমি আমিই। আমার পরিচয় আমি একান্ত আমি।”
প্রহরের পরিচয় পর্ব বেশ লাগল আলোর কাছে। চমৎকার হেসে বলে,
“লেটস ইন্ট্রুডিউস মাইসেল্ফ এগেইন। আলো শেখ। নাম আলো হলেও নিজেকে আলো মনেই হয় না। এক আকাশ অন্ধকার আমায় ঘিরে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আলোর হঠাৎ মনে হলো সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি এখনও তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। অপ্রতিভ হয়ে প্রহরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। প্রহরের নিষ্কলুষ দৃষ্টিতে আলো থমকে গেলো। চোখে যেনো কতো না বলা আকুল আবদার। না চাইতেও সেই মায়ায় ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে অতলে হারিয়ে ফেলছে। প্রহর আকুল কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি নিজেই এক আলোর দিশারী। কারও আঁধার জীবনে এক টুকরো স্নিগ্ধ আলো নিয়ে হাজির হয়ে তাকে আলোকিত করেন। তাহলে আপনার জীবনে অন্ধকার কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়?”
আলো ভ্রুঁ কুঁচকে হেসে বলে,
“আর ইউ ট্রাইং টু ফ্লাটিং উইথ মি?”
“নোপ। জাস্ট টেলিং ইউ দ্যা ট্রুথ। দ্যা ইউনিভার্সাল ট্রুথ ফর মি।”
আলোর মুখাবরণে হালকা রক্তিম আভা আসে।
“আবৃতির পাশাপাশি ভালোই প্যাম্পারিং করতে পারেন। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি এখনও আমার হাতটা ধরে রেখেছেন।”
তাতেও যেনো প্রহরের ভাবমূর্তির পরিবর্তণ হলো না। তার ভাবলেশহীন প্রশ্ন,
“যদি না ছাড়ি?”
কথাটা আলোর পছন্দ হলো না। প্রহরও বুঝলো তাই হেসে হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। ভালো থাকবেন। আবারও দেখা হবে আশাকরি।”
আলোর জবাবের অপেক্ষা না করে চলে যেতে থাকল। একটিবারও পিছন মুরলো না। পিছনে ঘুরলে দেখতে পেতো আলোর অবাক মুখটা।
_________
এরপর প্রতিদিন আলো চা বাগানে বেড়াতে আসে কিন্তু ওই দিনের ঘটনার পর প্রহরকে পরপর তিনদিন দেখেনি। হুট করে যেনো গায়েব হয়ে গেছে। এতে আলোর মনের আকাশে অজান্তেই বিষণ্ণতা ভর করেছে তা সে নিজেও উপলবধি করতে পারছে না। মন খারাপের কারণটাও জানেনা। বাড়িতে থাকলে ছাদে গিয়ে একাকি বসে থাকে। আগে যেমন বই পড়তো তেমন পড়ছেও না। আরমান শেখ যখনি মেয়ের ঘরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন বা মেয়েকে দেখেন তখনি কেমন ছন্নছাড়া অনুভব করেন। উনি ভাবেন হয়তো পুরোনো স্মৃতি মনে করে এমন ভাবে আছে।
চতুর্থদিন আলো চা বাগানে গিয়ে প্রহরকে দেখে অনেকটা উচ্ছাসিত হয়ে পরে। হালকা নীল শার্ট সাথে সাদা গ্যাভাডিং প্যান্ট পরিহিত প্রহরকে দেখে মনে এক আকাশ প্রেমময় মেঘেরা ডানা মেলেছে। ছুটে যায় সেদিকে। হড়বড়িয়ে বলে,
“এতোদিন কোথায় ছিলেন?”
প্রহরের ঠোঁটকোলে ফুটে ওঠে রম্যতা মিশ্রিত বাঁকা হাসি।
“কেনো? মিস করছিলেন বুঝি?”
অপ্রতিভ হয় আলো। লজ্জাবতী লতার ন্যায় মাথা নুইয়ে যায় তার। ফর্সা গাল দুটো আরক্তিম হয়। কি বলবে বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আমতা আমতা করছে বিধায় প্রহরের মনে মায়া হলো! কথার মোড় ঘুরিয়ে বলে,
“অ্যা*কসি*ডেন্ট করেছিলাম। তিনদিন বেডরেস্টে ছিলাম। আজ একটু ভালো অনুভব করাতে বাড়ির বাহিরে আসলাম।”
অ্যা*কসিডে*ন্টের কথা শুনে আলো প্রচণ্ড বিচলিত হলো। মনের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হলো। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে,
“কীভাবে হয়েছিল? এখন ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
প্রহর হাসলো। মাথা দুলিয়ে প্রসন্নসূচক বুঝালো। আলো ফুঁস করে অস্বস্থিগুলো ত্যাগ করল। হুট করে প্রহর বলে ওঠল,….
চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here