প্রহর শেষে আলোয় রাঙা – Part 11+12

0
369

#পর্ব_১১+১২
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
পথিমধ্যে চয়নিকার অ্যা*ক*সি*ডেন্ট ঘটে! ঠিক তার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বের নির্জন স্থানে এক মাইক্রো এসে ধা*ক্কা দিয়ে যায় চয়নিকাকে। রাস্তার ধারে পাথরের সাথে বা*ড়ি খেয়ে খাদে গিয়ে পরে সে। মাথা থেকে র*ক্তের ধারা গড়িয়ে অক্ষিপল্লভে এসে ঠেকেছে। শেষবারের মতো পিটপিট করে ভেজা অক্ষিযুগলে নিজের স্থান দেখে নিলো উদরে হাত দিয়ে বাড়ন্ত ভ্রুণের উপস্থিতি অনুভব করে নিলো। সে বুঝে গেছে সে যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচেও যায় উদরে বেড়ে উঠা মানব ভ্রুণটি বাঁচবে না। নিভু নিভু নয়নজোড়া মুদিত হলো। জ্ঞান হারাল চয়নিকা।
সন্ধ্যাবেলা, বেসমেন্টের অন্ধকার আলো-বাতাসহীন বদ্ধরুমে অট্টহাসিতে মেতে উঠল চয়নিকার অতিপ্রিয় মানুষটি। ছাদে সোডিয়াম বাতিটি টিমটিম করে কিছুটা অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে চলেছে। রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে লোকটা স্বগতোক্তি করে,
“সরি ডার্লিং। অ্যাই হ্যাড নাথিং টু ডু। প্লিজ ফরগিভ মি। চিন্তা করো না। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। সোজা উপরে চলে গিয়ে নিজের কাজের হিসেব দিতে থাকো। তোমার মনোবল দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে। প্রহরের সন্দেহের তালিকায় তুমি অনেক আগে থেকেই ইনক্লুডেড। আজ সে অবশ্যই তোমার থেকে কথা বের করতে চাইতো তাই তোমাকেই সরিয়ে দিলাম। আমার কাজে সাহায্য করার জন্য তোমাকে আমি সবসময় ভালোবাসব কিন্তু নিজের স্ত্রীর জায়গায় কখনও না। এবার দেখি প্রহর শেহমাত কি করে আমি পর্যন্ত পৌঁছায়!”
___________
হসপিটালের কেবিনে প্রহর আলোর হাত ধরে নিরব হয়ে নিষ্পলক ভাবে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেও চয়নিকার বাড়িতে গিয়ে চয়নিকাকে খুঁজে এসেছে কিন্তু পায়নি। মিসেস রেহমানকে জিজ্ঞেস করলেও তিনি বলতে পারেন না বলে জানিয়েছেন। প্রহর আনমনে বলতে থাকে,
“খালাজানকে রেখে গিয়েও কিছু করতে পারলাম না। আমার ৫০% সন্দেহ ছিল চয়নিকার উপর। চয়নিকার তোমাকে ফাঁসাতে চাওয়া, তোমার সাথে অকারণে রুড হওয়া। আরও কিছু আছে যা আমাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছিল। মিসেস রেহমান আমাকে বলেছিল কেউ একজন আমার ক্ষতি চায় যার জন্য চয়নিকাকে বেছে নিয়েছে কিন্তু বুঝিনি এমন কিছু হবে। ওরা সবাই জানে তুমি আমার দুর্বলতা। কিন্তু তুমি তো আমার দুর্বলতা নও। তাই না? আরমান স্যারের দুর্বলতা তুমি ছিলে ও আছো কিন্তু তুমি আমার শান্তি। আমি ডঃ আরমান শেখ নই। যার সব আপনজন একে একে হারিয়ে যায় তার দুর্বলতা কোনো মানুষ হওয়া সম্ভব না। আমাকে দমাতে পারবে না ওরা। তোমাকে খুব খুব জলদি সুস্থ হতে হবে। প্রহরের আলো স্ট্রং। সে ঠিক কামব্যাক করবে। তোমাকে আমি আমেরিকা পাঠিয়ে দিবো। যে বা যারা তোমাকে আমার থেকে দূরে করে আমার শান্তি কেড়ে নিতে চায় তাদের নাগালের বাহিরে থাকবে তুমি।”
ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করে হালকা শব্দ করলে প্রহর উঠে দাঁড়ায়। রক্তিম আঁখিজোড়া একটু কঁচলে নেয়। ডাক্তার বলেন,
“মিস্টার প্রহর ধৈর্য ধরুন। আপনার ওয়াইফ খুব দ্রুত সুস্থ হবেন বলে আশা রাখি । তার অ্যান্টিডোটের প্রতি রেসপন্স ভালো। পেশেন্ট কোমা থেকে কামব্যাক করে অনেক সময় দীর্ঘসময় লাগে।”
প্রহর লম্বাশ্বাস নিয়ে বলে,
“আমি আলোকে আমেরিকা নিয়ে যেতে চাই ডাক্তার। এখানে ওর লাইফ রিস্ক আছে। রেনডম পিপোলের যাতায়াত হসপিটালে হতেই থাকে। আমি সার্বক্ষণিক থাকতে পারব না। আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যেতে হবেই তখন শ*ত্রুরা আমার অনুপুস্থিতিতে আলোকে মে* রে ফেলতে চাইবে।”
ডাক্তার কিছুক্ষণ ভাবেন অতঃপর বলেন,
“নিয়ে যেতেই পারেন কিন্তু আপনার শত্রুরা কি আমেরিকা যেতে পারবে না? আপনি চাইলে আপনার বাড়িতে হসপিটালের সেটআপ করিয়ে দিতে পারি। সেখানে আপনার বিশ্বস্ত কাউকে দেখাশোনায় রাখবেন।”
প্রহর চিন্তায় পরে যায়। ডাক্তারের কথাটা ফেলেও দিতে পারছে না। শ*ত্রুরা তো আমেরিকাতে ঠিক যেতে পারবে এবং সেখানে দেখাশোনায় প্রহর স্বশরীরে থাকবেও না। প্রহর ডাক্তারকে বলে,
“ঠিক আছে। আপনি সব ব্যাবস্থা করুন। আমি আজকেই ওকে নিয়ে যাব।”
ডাক্তার সম্মতি দিয়ে চলে যায়।
____________
“হ্যাঁ ডার্ক বাটারফ্লাই, আমরা মিস চয়নিকাকে খাদ থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। উনার পালস ছিল কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।”
“সেন্স ফিরবে কি?”
“মনে হচ্ছে না। মাথার ইনজুরিটা গাঢ়ো। ২৪ ঘণ্টায় জ্ঞান না ফিরলে কোমা নিশ্চিত। ডাক্তার একটু আগে দেখে গেছেন।”
“কেউ যেনো চয়নিকার পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি ওর খবর না পায়। ওর থেকে সব জানতে হবে। খেয়াল রেখো।”
ডার্ক বাটারফ্লাই নামক ব্যাক্তিটি কল কেটে দিলো। তার সহচররূপে থাকা অনুচররা চয়নিকাকে রাখা রুমটা আটকিয়ে বেরিয়ে আসে।
_________
আলোকে নিয়ে রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরেছে প্রহর। হসপিটালের নার্সরা সব সেটআপ করে দিয়ে গেছে। সাথে শিতল ও নিয়াজও আছে। নার্সের থেকে কখন কি করতে হবে তা শিতল জেনে নিয়েছে। নিয়াজ প্রহরের সাথে গার্ডেনে বসে আছে।
“আমি ভাবতে পারছি না চয়নিকা এসবে আছে। চয়নিকা তোকে পছন্দ করে বলে জানতাম।”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমিও তাই জানতাম। এখন বিশ্বাস করলি তো? এখন চয়নিকা আমাদের ক্লু দিতে পারত কিন্তু ওকেই পাচ্ছি না।”
নিয়াজ চিন্তিত হয়ে বলে,
“আমার মনে হয় আমাদের আরেকবার চয়নিকার বাড়িতে যাওয়া উচিত। ওর পারসোনাল ল্যাপটপ, মোবাইল, পেনড্রাইভ এসবে কিছু তো পাবো। কোনো হিন্টস।”
প্রহর নিঃশব্দে উঠে যায়। নিয়াজ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারলো না হঠাৎ প্রহর উঠে গেলো কেনো! দুই মিনিটের মধ্যে প্রহর হাতে করে একটা ল্যাপটপ নিয়ে আসে। নিয়াজের সামনে রেখে বলে,
“এতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক!”
নিয়াজ হতাশ হয়ে বলে,
“পেনড্রাইভ পেলে ভালো হতো। ল্যাপটপটা রেখে দে। চয়নিকাকে খুঁজতে হবে।”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।
★★★বহু বছর পর মা-মেয়ের সাক্ষাত তাও এমন এক পরিস্থিতিতে যে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারছে না। রঞ্জনা খালা আলোর কাছেই বসে আছেন আর শিতল রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছে। হালকা কিছু বানিয়ে নিয়াজ ও প্রহরকে ডাকতে এলো।
“তোমরা খেতে এসো। হালকা কিছু খেয়ে নাও।”
প্রহর বলে,
“নিয়াজকে নিয়ে যা। আর খালাজানকে কিছু খাওয়া। উনার ডায়াবেটিস আছে। দুপুরে ঘটনা ঘটার পর কিছু খাননি তাছাড়া রোদে অনেকক্ষণ ছিলেন। সুগার ফল করতে পারে।”
শিতল নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল,
“মা তো আলোর পাশ থেকে সরছেই না। আমার ডাকেও সাড়া দিচ্ছে না।”
“উনি নিজেকে দোষী ভাবছেন। উনি হসপিটালেও কয়েকবার আমার হাত ধরে কান্না করে ক্ষমা চেয়েছেন।”
প্রহরের উদ্দেশ্যে নিয়াজ বলে,
“তুই নিজে খাবার নিয়ে গিয়ে বল। মা নিজেকেই গিল্টি ভেবে চলেছেন যেখানে উনার কোনো দোষ ছিল না। বরং উনি না বললে অ্যান্টিডোট পেতে দেরি হতো আর আলো হয়ত….!”
“হুম। যাচ্ছি। শিতল আমাকে খাবার বেড়ে দে। তোরাও খেয়ে নে।”
শিতল মলিন কণ্ঠে বলে,
“তুই খাবি না?”
“খিদে নেই।”
কথাটা বলেই প্রহর বাড়ির ভেতরে চলে যায়। শিতল ও নিয়াজ প্রহরের যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিয়াজ বলে,
“প্রহরের ইচ্ছে ছিল কয়েকদিনের মধ্যে আলোকে নিয়ে আমেরিকা যাবে তারপর আলোকে সেখানে রেখে এসে নেপাল যাবে। আমিরের ল্যাপটপে নেপালের ম্যাপে হিমালয়ের কাছে ক্রস করা। কিন্তু আমিরকে কঠোরভাবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বলেছে এই ম্যাপটা তার কাছে এক প্রাইভেট মেইল থেকে এসেছে। এই ম্যাপ দেখেই সে দেশ ত্যাগ করে ইন্ডিয়া হয়ে নেপালে যেতে চাচ্ছিল।”
“সেখানে কি তবে আরমান স্যারকে পাওয়া যাবে?”
“জানিনা। কিন্তু আলোর সাথে যা হলো তাতে প্রহর কিভাবে যাবে বুঝতে পারছি না।”
“আমরা আছি তো। আলোর সুরক্ষা আমরা করতে পারব।”
নিয়াজ হতাশস্বরে বলে,
“দেখো প্রহর কি করে। ও যা করবে বুঝেই করবে। আমরা সবসময় ওর পাশে আছি।”
শিতল মুচকি হেসে নিয়াজের কাঁধ জড়িয়ে ধরল।
__________
রঞ্জনা খালাকে জোর করে প্রহর কিছু খাওয়াতে সক্ষম হয়। এখন উনাকে ঘুমানোর জন্য শিতলের সাথে পাঠিয়েছে। প্রহর ব্যালকনির রাতের হীমশিতল হাওয়ায় নিজের হতাশা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। ভাবতে থাকে চার বছর আগের কথা,,
ফ্ল্যাশব্যাক★★★
চার বছর আগে প্রহর সবে মাস্টার্স শেষ করেছে। ওর রিসার্চের ফ্যাকাল্টি হচ্ছেন ডঃ আরমান শেখ। অনার্সে থাকাকালীনই আরমান শেখ প্রহরকে নিজের রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। প্রহরের ডেডিকেশন দেখে তিনি পছন্দ করেছিলেন। প্রহর জানতো ডঃ আরমান শেখও একজন পরিবার ছাড়া নিঃসঙ্গ লোক। তাই প্রহর নিজের একাকিত্ব অনুভব করে ডঃ আরমান শেখের সঙ্গ দিতো। যেদিন প্রহরের মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ, সেদিন ডঃ আরমান শেখ প্রহরের হাতে একটা পেনড্রাইভ দিয়ে বলেন,
“প্রহর, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র তাই তোমাকে বিশ্বাস করে এটা দিলাম। আমার অবর্তমানে এটার রক্ষা করবে। কেউ জেনো না জানে। এমনকি তোমারও খোলার প্রয়োজন নেই।”
প্রহর অবাক হয়ে বলে,
“কিন্তু স্যার এতো গুরুত্বপূর্ণ হলে এটা আমাকেই বা দিচ্ছেন কেনো?”
তখন আরমান শেখ হাসি দিয়ে বলে,
“তুমি ছেলেটা একটু উঁড়ো উঁড়ো স্বভাবের হলেও মনের ও দায়িত্বের দিক দিয়ে সবসময় এগিয়ে। আমার প্রিয় আরেকটা কিছুর দায়িত্বও তোমাকে দিবো। সেটাও তোমার সারাজীবন আগলে রাখতে হবে।”
“কী স্যার?”
“আমার আলো!”
প্রহর তখন হেসে ওঠে অতঃপর বলে,
“আপনার আলো তো আমি কবেই নিজের করে নিয়েছি। আপনার জ্ঞানের আলোতে আজ আমি এই পর্যায়ে।”
আরমান শেখ নিঃশব্দে হাসেন। তিনি প্রহরের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“আমার জ্ঞানের আলো তুমি পেয়েছ ঠিক এখন তোমাকে আমার মেয়ে আলোর দায়িত্ব নিতে হবে। সারাজীবনের জন্য।”
প্রহরের অবস্থা তখন আকাশ থেকে পরার মতো!
“স্যার! আপনার মেয়েও আছে? কই কখনও তো বলেননি তাছাড়া আমি আপনার বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। কখনও দেখিওনি। একটা ছবিও না।”
আরমান শেখ মুচকি হেসে বলেন,
“সব জানতে পারবে। আগে আলোকে নিয়ে আসি।”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#পর্ব_১২
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
“প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
এই সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়,
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস,
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ। ”
বৃষ্টি থামার পর চা-বাগানের ভিতর একটা কাঠ গাছের গুঁড়ির পাশে গিটার রেখে বসে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান পড়ছিল প্রহর। কবিতার এই পঙক্তি গুলো চোখ বন্ধ করে নিজে নিজেই আওড়াচ্ছিল। ঠোঁটকোলে তার মিষ্টি হাসি। সে তো খেয়ালই করেনি কেউ একজন সামনের গাছটার সাথে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতিতে বর্ষাকাল। চা-বাগানের সৌন্দর্য অতুলনীয়। বৃষ্টির ছাঁট লেগে থাকে চা পাতার কুঁড়িতে কুঁড়িতে। স্নিগ্ধ অন্তরীক্ষকে সবুজের সমোরোহে মনে হয় রঙ-তুলির ক্যানভাসের কোনো দৃশ্য। মাটি স্যাঁতস্যাঁতে হলেও জামা-কাপড় নোংরা হওয়ার ভয় নেই প্রহরের। কারণ, বাড়িতে গেলে কেউ তো আর বকবে বলে বসে নেই! একাকিত্বে সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। আফসোস থেকে প্রকৃতির কোনো রূপ নিংড়ানো থেকে দমিয়ে রাখে না নিজেক।
মনে প্রফুল্লতা নিয়ে আঁখিজোড়া খুলে সামনে এক সাদা শাড়ি পরিহিত রমণীর সাক্ষাত পায়। ফুলস্লিভসের ঘটি ব্লাউজের সাথে শিফন শাড়ি। খোলা কোমড় ছাঁড়ানো চুলে কানের পিঠে গুঁজা বুনোফুল ও সিঁথির মধ্যিখানে সাদা পাথরের ব্রোঞ্জ। হাত ভর্তি সাদা কাঁচের চুড়ি, কানে সাদা পাথরের ঝুমকো। প্রহরের অপলক দৃষ্টি সম্মুখে স্থির হয়ে গেছে। শুভ্র কায়ায় শুভ্র রঙ! যেনো ধরিত্রীর বুকে কোনো শুভ্রতার রানী নেমে এসেছে। নিজের চোখের ভ্রম ভেবে দুয়েকবার ভালো করে হাত দিয়ে নয়নযুগল কঁচলে নিয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য! এটা তার ভ্রম না। বাস্তব!
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি প্রহরের অবস্থা বুঝে মিটমিট করে হেসে খানিক এগিয়ে এসে বলে,
“হাই। মাইসেল্ফ আলো শেখ। চা-বাগানে ঘুরতে এসে আপনার কবিতা শুনে থমকে গেলাম তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। খুব সুন্দর আবৃতি করেন আপনি।”
প্রহরের চোখ-মুখ দেখে আলোর মনে হয়না প্রহর ওর কথা শুনেছে বা বুঝেছে। তাও সে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। প্রহরের হুট করে কি হলো নিজেও জানেনা। ফট করে উঠে হনহনিয়ে চলে যেতে লাগল। আলো পিছনে বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কী হলো বুঝতে পারছে না সে। কিছুদূর গিয়ে প্রহর আবার পিছনে ফিরে আসলে আলোর ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয় কিন্তু প্রহর তো ফিরে এসেছে তার বই আর গিটারটা নিতে। এই দুটো নিয়ে আবার সবুজের মাঝে হারিয়ে গেলো। আলো কিছুক্ষণ তার অচেনা ছেলেটির গমনপথে তাকিয়ে থেকে নিজের মতো করে চা-বাগান ঘুরতে লাগল। বৃষ্টির কারণে মাটি নরম ও ভেজা তাই শাড়ি পড়ে হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু তার বহুদিনের শখ ছিল একাকি চা-বাগানের বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় সবুজের মাঝে শাড়ি পড়ে হাঁটবে। ইচ্ছে পূরণ করতে চুপিচুপি দারোয়ানকে অনুরোধ করে বেরিয়ে এসেছে।
________প্রহর আলোর দৃষ্টির আড়াল হলেও আলোকে নিজের নজরের আড়াল করেনি। আলোর নাম শুনেই সন্দেহ হয়েছে এটাই তার প্রফেসর ডাঃ আরমান শেখের মেয়ে। চেহারায় কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তাইতো আড়ালে শুভ্ররানীকে নজরে নজরে রাখছে।
আলোর ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে তাচ্ছিল্য হাসে আলো। এতো বছর তো তার থেকে বহুক্রোশ দূরে ছিল। কই তখন তো এতো তলব ছিল না! এখন না বলে বেরিয়েছে বলে মনে পরছে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আলো ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
“জি ডাঃ আরমান শেখ। হঠাৎ আমার কথা মনে পরলো কেনো?”
আলো ‘বাবা’ সম্বোধন না করায় আরমান সাহেবের খারাপ লাগলেও প্রকাশ করলো না।
“কোথায় তুমি? তোমাকে মানা করা হয়েছিল না? আমাকে না বলে কোথাও বেরোবে না?”
“হয়েছিল কিন্তু আমি তো তার জন্য ঘরে বন্ধি হয়ে থাকতে পারব না। আমার একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়া তো আমি আপনার থেকেই শিখেছি প্রফেসর ডাঃ আরমান শেখ!”
আরমান শেখ মলিন কণ্ঠে বলেন,
“তোমাকে বারবার আমাকে আমার পদবি মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি জানি আমি কি, কেনো করছি।”
“হুম।”
“কোথায় তুমি?”
“চা বাগানে।”
“বিকেলের শেষ সময় এখন আলো। বাড়ি ফিরে এসো। সন্ধ্যাবেলা ওখানে সেফ না।”
আলো আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
“আমার তো চা বাগানের সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে। সূর্যাস্ত দেখেই বাড়ি ফিরব।”
আরমান শেখ হুট করে রেগে গেলেন। ধ*ম*কে ওঠে বলেন,
“তোমার ধারণা আছে তুমি কি বলছ? সিলেটকে তুমি আমেরিকা মনে করছ। ওখানের পরিবেশের সাথে এখানের পরিবেশের বিস্তর ফারাক। এখানে সন্ধ্যা নামলে আতঙ্ক বিরাজ করে।”
“আমি সেল্ফ ডিফেন্স জানি। নিজেকে রক্ষা করতে পারব।”
আরমান শেখ কপালে হাত ঘষে বিচলিত কণ্ঠে বলেন,
“ব্যাপারটা সেল্ফ ডিফেন্সের না। ধা*রা*লো অ*স্ত্রের মোকাবেলা কিভাবে করবে তুমি? দারোয়ান বলল তুমি শাড়ি পড়ে বেরিয়েছ। জলদি ফিরে এসো। বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাথে সূর্যাস্ত দেখো। এখন বাড়িতে ফিরে আসো।”
আলোর একরোখা জবাব,
“ফিরব না আমি। সূর্যাস্ত দেখে তবেই ফিরব।”
খট করে ফোনটা কে*টে দেয় অতঃপর ফ্লাইটমুডে দিয়ে দেয়! প্রহর এতক্ষণ আড়ালে থেকে আলোর সব কথা শুনেছে। নির্জন নিস্তব্ধতায় হালকা শব্দও জোড়ালো শোনায়। প্রহর দেখলো আলো সামনের কিছু জায়গায় পানি জমা সেটা পারি দিতে শাড়ি উুঁচু করেছে। আলোর পায়ে প্লাস্টিকের ওয়াটারপ্রুফ কেডস দেখে ওর হাসি পেলো। মনে মনে বলে,
“বেশ স্মার্ট। আমেরিকায় বেড়ে উঠা মেয়ে স্মার্ট হবে স্বাভাবিক। কিন্তু স্যারের সাথে এতো রুড কেনো? জানতে হবে সব।”
গৌধূলি প্রহর। সূর্য তার রক্তিম আভায় আ*গুনের গোলার ন্যায় আস্তে আস্তে পশ্চিম দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। আলো মুগ্ধচিত্তে ধরণীর দিবাকরের শেষ আলোটা উপভোগ করছে। আলোর সাথে সাথে প্রহরও আড়ালে থেকে সময়টা উপভোগ করছে। তার ইচ্ছে ছিল আলোর সাথে গিয়ে দাঁড়াতে কিন্তু আলো যেহেতু সময়টা একা একা উপভোগ করতে চায় তো করুক। মনের আক্ষেপ রাখতে নেই প্রহরের মতে। সূর্য ডোবার পর আলো বড়ো বড়ো কদম ফেলে চা বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে। অন্ধকার ক্রমশ বাড়ছে তার সাথে সাথে গা ছমছম ভাবটাও বাড়ছে। সামনেই সোডিয়াম বাতির আলোয় রাস্তা দেখা যাচ্ছে বলে মনে বল পাচ্ছে। হঠাৎ কানে এলো একাধিক পদধ্বনি। ভেজা মাটি বলে শুকনো পাতার শব্দ আসছে না কিন্তু জোরে হেঁটে আসার শব্দ ঠিকই কানে আসছে। পিছনে ঘুরে দেখতে নিলে একটা গাছের শিকরের সাথে বেজে পরে যেতে ধরে কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই তিনজন ব্যাক্তিকে দেখতে পায়। পোশাক-আশাকে সভ্য ঘরের বলে মনে হচ্ছে না এমনকি দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে সুস্থ মনে হচ্ছে না। একজন বলে ওঠে,
“খা*-সা মা*-ল মাইরি! আসমান থিকা হুরপরি জমিনে নাইমা আইছে দেখ।”
“আরে মা*-ল টারে তো এইখানে আগে দেখা নাই। তা সুন্দরী কোথায় তোমার বাড়ি? পথ হারাইছো নাকি? যাবা আমাদের সাথে পৌঁছায়ে দিবো।”
আলো দুই কদম পিঁছু হটলো। ওদের অশ্রাব্য সম্বোধনে নাক ছিঁটকালো কিন্তু মনের সাহস হারালো না। লোকগুলো যে নে*শায় বুদ হয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে। আলো হালকা ঝুঁকে হাঁটুর নিচে আটকানো চা*বু*কটা আনার চেষ্টা করল। লোকগুলো তো একনাগাড়ে নানারকম বাজে বকেই চলেছে। আলো লম্বাশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে গায়ের সর্বোচ্চ জোড় দিয়ে চা*বু*কটা দিয়ে সামনের দিকে চালালো। লোকগুলোর বুঝে উঠার আগেই ধ*রাশায়ী। মাটিতে পরে কাঁতরাচ্ছে একেকজন। আলো ওদের কথা চিন্তা না করে দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করে রাস্তায় উঠে গেলো। পেছোনে প্রহরের ঠোঁটকোলে ফুটে উঠে অবাকমিশ্রিত হাসি। আনমনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
“ইমপ্রেসিভ!”
চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here