সে -পর্ব 5

0
231

#সে
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
রুদ্র নিরব এবং নির্জীব হয়ে রয়েছে। কথা নেই আমার মুখেও। চারপাশ থেকে বারবার রিকশার টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। কতক কতক জায়গায়, চায়ের দোকানের সামনে লোকজনের কোলাহল এবং সমাগম। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করব সেই সাহসও কেন জানি পাচ্ছি না। আচমকা পুরো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে রুদ্র বলল,’এখান থেকে বাড়ি খুব কাছেই এখন। হেঁটে যাবে? হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছে।’
তার এই প্রস্তাবে আমি খুশিই হলাম। কারণ রাতেরবেলায় রাস্তায় হাঁটার অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। সাথে পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষ, তাহলে সেই সময়ের বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য বটে। তাই বারণ করার প্রশ্নই আসলো না। আমি বিনাবাক্যেই রাজি হয়ে যাই। রিকশা থেকে নেমে দুজনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটিও করে ফেললাম।
‘কেন সবাই আপনাকে অপশোনাল হিসেবে ব্যবহার করে?’
‘অপশোনালের চেয়েও সেকেন্ড চয়েজ বেশি হয়েছি। কেন হয়েছি সেসব না হয় আরেকদিন বলব। একদিনে সব জেনে ফেললে পরে আর কোনো আগ্রহ থাকবে না।’
আমি হেসে ফেললাম। সে তো আর এটা জানে না যে, তার প্রতি আমার আগ্রহ কোনোদিনই কমবে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে।
বাড়ির গেইটের কাছে আসার পর রুদ্রর কিছু মেয়ে কাজিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এদেরকে আমি ফেসবুকে দেখেছি রুদ্রর আইডিতে। যদিও তারা কাজিন কিন্তু আমার ভীষণ হিংসা হয়। কাঁধে হাত রেখে, হাসি হাসি মুখ করে তোলা যতগুলো ছবি আছে সবকয়টা আমার পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি সহ্য করতে পারি না একদম। রুদ্রকে পেয়ে ওরা একদম জেঁকে ধরেছে। একজন বলছে,’তোর কাছেই যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো দেখা হয়ে গেছে। চল আড্ডা দেবো।’
‘আজ থাক। রিমির বিয়ের অনেক কাজের দায়িত্ব আমার ওপর।’ বলল রুদ্র।
আরেকটা মেয়ে তখন রুদ্রর গাল চেপে ধরে বলল,’তোর নাটক বন্ধ কর। বিয়ে তো আর আজই হচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা আমাদের সাথে আড্ডা দিলে কিচ্ছু হবে না। প্রয়োজনে পরে এসে আমরা সবাই তোকে কাজে হেল্প করব।’
রুদ্র তখন হেসে বলল,’তাহলে ঠিকাছে। চল।’
ওরা একদিকে খুনশুটিময় ঝগড়া করছে। আর আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ড দেখছি। আপনাদের হয়তো আমার এমন কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। খারাপ লাগছে। আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি সুখ ও দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। একটু আগেও যেই আমি সুখের সাগরে ভাসছিলাম সেই আমিই এখন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমি বুঝতে পারি না কিছুতেই মেয়েগুলো এমন ছেচ্রা হয় কী করে? ছেচ্রা হবে ছেলেরা। মেয়েদের পেছনে ঘুরে ঘুরে ছেচ্রামি করবে। মানায় ওদের। কিন্তু মেয়েরা কেন এমন করে? আমি কিন্তু সব মেয়ের কথা বলছি না। এই টাইপ কিছু মেয়ের কথাই বলছি। ছেলে কাজিন আমারও আছে। কিন্তু আমরা ঘন ঘন আড্ডা দিই না। কোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে হলেও সবাই মিলে গল্পগুজব করি না। এভাবে কেউ মিশতে পারি না। ছেলেরা ছেলেরা একসাথে এবং মেয়েরা মেয়েরা একসাথে আড্ডা দিই। তাহলে কি আমরাই ইমম্যাচিউর?
ওদের গল্পগুজব এবং কোথায় আড্ডা দেবে সব প্ল্যান শেষ হলে রুদ্রর নজর আমার দিকে পড়ে। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। উচিৎ ছিল অনেক আগেই বাড়িতে ফিরে আসা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমার পা সেখানেই স্থির ছিল। রুদ্র আমার কাছে এসে বলল,’নবনী তুমি বাসায় যাও। রাত না হলে তোমায়ও সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম।’
‘সমস্যা নেই। আপনি ওদের সঙ্গে যান। ইনজয় করুন।’
এইটুকু বলেই আমি ভেতরে চলে আসি। একবারও পেছনে তাকাইনি। ভেতর থেকে আসা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোণে পানিও নিয়ে এসেছে। বড্ড জেলাসি তো আমি!
.
.
বাড়িতে এসে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার সময় কাটছে না কিছুতেই। আমায় গম্ভীর থাকতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে তোর?’
‘কই? কিছু না তো!’ আনমনেই বললাম আমি।
‘বললেই হলো? কিছু না হলে তুই তো এত চুপচাপ থাকার মেয়ে না।’
‘এগুলো কোনো কথা হলো মা? চুপচাপ আছি এমনিই। কোনো স্পেসিফিক রিজন নেই।’
‘তুই চুপ কর। মিথ্যা কার সঙ্গে বলিস তুই? তুই আমার পেটে হইছিস নাকি আমি তোর পেটে হইছি?’
‘তোমরা মায়েরা কি কমন ডায়লগগুলা দেওয়া এবার অফ করতে পারো না? ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা সব ডায়লগই এখন আমার মুখস্থ।’
‘তুই অনেক বেয়াদব হয়ে গেছিস নবনী।’
‘সরি মা। তুমি এখন যাও। আমি একটু একা থাকব।’
‘আমার পেটের মেয়ে হয়েও তুই এমন করিস। তোর থেকে তো রাজ্জাকই ভালো।’
‘বেশ তো! ওর কাছেই যাও।’
মা কিছুক্ষণ আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুম থেকে চলে গেলেন। আমি ঠায়ভাবে সেখানেই কিছু্ক্ষণ বসে থেকে বারান্দায় চলে আসি। মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি রুদ্র আসছে কী-না! নাহ্। অনেকেই আসে। কিন্তু রুদ্র আসে না। ফেসবুকে লগিন দিয়ে রুদ্রর আইডিতে গেলাম। তাকে একটিভ দেখাচ্ছে। ডে’ও দিয়েছে দেখলাম। একঘণ্টা আগে দেওয়া। ছবিটা ওর মেয়ে কাজিনের সাথে। তার মানে যাওয়ার পর ছবি তুলে সাথে সাথেই ডে তে দিয়েছে। কী যে অসহ্য রকমেই পেইন হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারব না। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ওর পুরনো পোষ্ট, ছবিগুলো দেখছিলাম। হাত শুধু নিশপিশ করছিল নক দেওয়ার জন্য। মনের কথায় সায় দিলাম। নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’বাড়ি ফিরেছেন?’
রিপ্লাই এলো ঠিক দু’মিনিট পর। লিখেছে,’না। আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।’
‘ওহ। আড্ডা দিন। ভালো লাগবে।’
এই ম্যাসেজটা আর সীন হলো না। অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনের স্ক্রিনে চাতকপাখির মতো তাকিয়েই রইলাম। ডাটা অফ করতে যাব তখন টুং করে ম্যাসেঞ্জারে একটা শব্দ হয়। রুদ্রর ম্যাসেজ। দ্রুত আমি ওর ইনবক্সে গেলাম। আসলে ম্যাসেজ নয় ছবি পাঠিয়েছে আর একটা ভিডিও। সবগুলো ছবি ওর ঐ কাজিনগুলোর সাথে। ভিডিওটা মনে হচ্ছে ছবি তুলতে গিয়ে ভুল করে করে ফেলছে। বুঝতে পারার পর রুদ্র হেসে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। ইশ! হাসিটা যেন সোজা বুকে এসে বিঁধেছে। শুধু চোখের কাঁটা লাগছিল ঐ আপুগুলোকেই। আমি ম্যাসেজ লিখলাম,’শুধু মেয়ে কাজিনরাই এসেছে? ছেলেরা আসেনি?’
রুদ্র যদিও লেট করে উত্তর দিচ্ছিল তবুও যে রিপ্লাই করছিল আমি এতেই খুশি ছিলাম। রুদ্র লিখল,’হ্যাঁ, ছেলেও আছে চারজন।’
‘তাহলে ওদের ছবি দেন।’
‘ওদের ছবি ওদের ফোনে।’
‘আশ্চর্য! একটা ছবিও আপনি ছেলেদের সাথে তোলেননি? একটা হলেও নিশ্চয়ই তুলেছেন। দিন দেখি।’
রুদ্র চোখ উল্টানো ইমুজি দিয়ে বলে,’ওদের ছবি দিয়ে কী করবে?’
‘কী আজব! আমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের ছবি দেখে কী করব? ছেলেদের ছবি দিন। চয়েজ করি। দেখি কাকে ভালো লাগে।’
মূলত রুদ্রকে একটু খোঁচা মারতেই আমি এই ম্যাসেজ লিখেছি। রুদ্র এবার সেন্টি ইমুজি পাঠালো। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। আমিও তো নাছোড়বান্দা। তাই আবার বললাম,’কী হলো? দিন?’
রুদ্র বলল,’পরে ওদের থেকে নিয়ে দিবনি।’
‘শিওর?’
‘হুম।’
ব্যস কনভারসেশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ‘হুম’ বলে। এরপর তো আর নতুন করে কিছু বলা যায় না। আমি আর কিছু বললামও না। রাতে ডিনার করে আবার গেলাম ফেসবুকে। ওর আইডি ঘেটে দেখলাম মেয়ে কাজিনদের সাথে ছবি পোষ্ট করেছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখানেও রুদ্র বাদে কোনো ছেলের ছবি নেই। একটা কথা আপনারাই বলুন তো, সবাই একসাথে আড্ডা দিতে গিয়েছে সেখানে সব মেয়েদের ছবি আছে অথচ ছেলেদের কারো ছবি নেই! এটা হতে পারে? আমার কেন জানি এবার মনে হচ্ছে রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছে।
এর পরের কয়েকদিন রুদ্রর বেশ ব্যস্ত সময় কাটল। মোটামুটিভাবে পড়াশোনা নিয়ে আমি নিজেও ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এতটা ব্যস্তও থাকতে পারিনি যে রুদ্রর কথা মনে পড়বে না। সেদিনের পর থেকে আমি আবারও রুদ্রর সামনে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু দূর থেকেই দেখি। কারণ আমি ৯৯% শিওর রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছিল। তার ছেলে কাজিনরা কেউ ছিল না। ছবিও দেয়নি আমায়। আমার কথা হচ্ছে, মিথ্যে বলার কী দরকার? কোনো ফায়দা তো নেই। এই মিথ্যেটাই মূলত রুদ্রর প্রতি চাপা অভিমান তৈরি করেছে।
রিমি আপুর বিয়ে আজ। গতকাল গায়ে হলুদ গিয়েছে। হলুদে আমি যাইনি। রোজ অনেকবার জোর করেছিল আসার জন্য। কিন্তু মিথ্যে বাহানা দিয়ে যাইনি। সত্যি বলতে রুদ্রর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। মায়ার টান আমি বাড়াতে চাচ্ছিলাম না কাছ থেকে। সে আমায় দেখে কিছু আন্দাজ করুক এটাও আমি চাইনি। হলুদে না গেলেও বিয়েতে না এসে পারলাম না। রিমি আপু সকালে ফোন করে বলেছে বিয়েতে না গেলে কান ধরে নিয়ে যাবে। বিয়ের কিছুদিন আগে থেকেই আমি রিমি আপুর সাথে পরিচিত হই। রোজ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আপু ভীষণ মিশুক। অল্প দিনের ব্যবধানেই আমায় একদম নিজের বোন বানিয়ে ফেলেছে। যে কারণে এত অধিকারবোধ তার কথায়। আমিও ভাবলাম, একটা মানুষের জন্য শুধু শুধু আরেকটা মানুষকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। রুদ্রর সামনে না গেলেই তো হয়। তাই রেডি হয়ে রোজের সঙ্গে আগে চলে আসলাম। আব্বু,আম্মু পরে আসবে। ওহ আপনাদের তো এতদিন একটা কথা বলাই হয়নি। রিশানের আপন ভাই হচ্ছে রুদ্র। রিশান সেদিন রুদ্রর কথাই বলেছিল। রাজ্জাকের সাথে রিশানের ভাব জমে গেছে বহু আগেই। ওরা ওদের বন্ধুত্বের নাম দিয়েছে আর টু(R2). এদিকে আমি তো আমার চারপাশে সবই আর(R) দেখি। এই যেমন, রুদ্র, রিশান, রাজ্জাক, রোজ, রিমি। শুধু আমার নামটাই বোধ হয় এন(N) দিয়ে হয়ে গেল। যাক সেসব। আমি ভাবছি এখন যদি রুদ্র সামনে পড়ে যায় তাহলে কী করব?
আমার ভাবনা তার জায়গামতো সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। রুদ্রর সাথে দেখা হয়ে গেল। রুদ্র এক গাল হেসে বলল,’কেমন আছো পিচ্চি?’
আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কালকে নাকি তুমি হলুদে আসোনি?’
আমি এবার অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। সে আমায় জিজ্ঞেস করছে শিওর হওয়ার জন্য আমি এসেছিলাম নাকি! তার মানে সে জানেই না। খেয়ালও করেনি। এমনকি একবার আমার কথা মনেও হয়নি। অবশ্য আগ বাড়িয়ে এতকিছু ভাবা, এত এক্সপেকটেশন রাখা আমার উচিৎ হয়নি। তার সাথে আমার পরিচয়ই বা কয়দিনের? সে কেন আমায় নিয়ে এত মাথা ঘামাবে? শুধু শুধু আমি নিজেই এতসব ভেবে চলেছি। আমায় চুপ থাকতে দেখে রুদ্র বলল,’চুপ হয়ে গেলে যে?’
আমি মৃদু মেকি হেসে বললাম,’হুম আসিনি। আজ সকালে একটা পরীক্ষা ছিল তাই।’
‘এখন আবার কীসের পরীক্ষা? যাই হোক, আজকে কিন্তু তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে। মাশ আল্লাহ্! মনে হচ্ছে আজ রাতের বুকে সুন্দর একটা চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে।’
‘আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।’
রুদ্র হাসলো। তারপর চলে গেল অন্যদিকে। আমি রিমি আপুর কাছে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। আমার ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছিল। অস্থিরতা আরও বেশি বেড়ে যায় যখন দেখলাম রুদ্রর সেই মেয়ে কাজিনগুলা এসেছে। ওর বন্ধু-বান্ধবরাও এসেছে। একটা জিনিস আমায় খুব ভাবায়। মেয়ে বান্ধবীদের গায়ে পড়া স্বভাব রুদ্র পছন্দ করে না অথচ মেয়ে কাজিনগুলোকে কিছু বলে না। যদিও রুদ্র বলেছিল কাজিনগুলো ম্যারিড। কিন্তু আমি ওদের আইডি ঘেঁটে দেখেছি রিলেশনশিপ সিঙ্গেল দেওয়া। একের পর এক রুদ্রর এসব মিথ্যা আমার মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে। আমার মনে হচ্ছে আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারব না। তাই রোজকে বললাম,’আমার ক্ষুধা লেগেছে। চলো খেয়ে আসি।’
রোজ রাজি হলো। খাওয়ার সময় তখন হাজির হলো অন্তু। এমনিতেই খাবার গলা দিয়ে নামছিল না। ভেবেছিলাম রোজের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে পারব। প্রয়োজনে রুদ্রর বিষয়টাও ওকে শেয়ার করব। এতে লাভ কী হবে জানিনা তবে মন হালকা হবে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। অন্তু খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। রোজ-ও লজ্জায় লাল, নীল বর্ণ ধারণ করছে। এই মু্হূর্তে আমার গ্যাং-টাকে খুব মিস করছি। ওরা থাকলে কখনোই আমার এমন একা একা ফিলিংস হতো না। যতই জ্বালাক না কেন, দিনশেষে বিপদে-আপদে খারাপ সময়ে ওরা পাশে থাকলে তখন আর কিছু লাগে না। ভেতর থেকে আমার তখন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই খাবার আর আমার গলা দিয়ে নামবে না। আপনারা বিশ্বাস করবেন কীনা আমি জানিনা, তবে আমার খুব খুব একাবোধ হচ্ছে। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে বললাম,’আমার খাওয়া শেষ। আপনারা খান।’
রোজ বলল,’বসো। আমারও প্রায় শেষ।’
‘আমি রিমি আপুর কাছে যাই। অন্তু ভাইয়া তো এখানে আছেই। খাওয়া শেষ করে চলে এসো।’
মিথ্যে বলেই আসলাম। রিমি আপুর কাছেও যাব না। কারণ সেখানে রুদ্র ও তার গ্যাং রয়েছে। ওদেরকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সবার মাঝখান থেকে রুদ্রর পাঞ্জাবির কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসি। এরপর সামনে বসিয়ে গান শুনি। রুদ্রর গানের গলা অসম্ভব রকমের সুন্দর! না, সে আমায় গান শোনায়নি। তার নিজের ডে ও টাইমলাইনে পোষ্ট করা গানগুলো শুনেই বলছি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে গান-বাজনার আওয়াজ তেমন তীব্রভাবে শোনা যাচ্ছে না। ফোনে কথা বলার জন্য খুব একটা ডিস্টার্ব করবে না এই সাউন্ড। তিথিকে কল লাগালাম। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তিথি কল রিসিভ করে বলল,’কীরে বিয়ে বাড়িতে কেমন ইনজয় করতেছিস? আমি তো ভাবছি দুই দিন তোর খোঁজই পাব না।’
‘ধুর! ফাউল কথা বলিস না তো। ভালো লাগছে না।’
‘কী হয়েছে? মুড অফ নাকি তোর?’
‘লাইনে থাক। বাকিদের কলে আনি।’
‘শোন তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে সমস্যা বিশাল। সবাই একসঙ্গে লাইনে আসলে টাকা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু কথা শেষ হবে না। তার চেয়ে ভালো আমাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আয়। সবাই একসঙ্গে কলে আসি। একটিভই আছে সবাই।’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে এম্বি কিনে আসতেছি।’
‘আয়।’
কল কেটে দিয়ে ফোনে এম্বির অফার দেখছিলাম। বাড়িতে ওয়াইফাই থাকায় এম্বি নেওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না বলে নিইও না। কিন্তু এখন আমার মন সাংঘাতিক লেভেলের খারাপ। ওদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এম্বি কিনে ডাটা অন করব তখন মনে হলো পেছনে কেউ আছে। আমি সাথে সাথে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি একটা ছেলে। ছেলেটি ভয় পেয়ে দু’হাত ওপরে তুলে বলে,’রিল্যাক্স! রিল্যাক্স ভয় পাবেন না।’
ভয় পাবেন না বললেই কি আর হয়? ভয় তো অলরেডি পেয়ে বসে আছি আমি। বুকে থুথু দিয়ে তার দিকে তাকালাম। সাদা শার্টের ওপর কালো স্যুট পরা ছেলেটি।
‘কে আপনি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমি রুদ্রর বন্ধু। আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি নবনী।’
‘জি আপনি সঠিক।’
‘যাক! যেটা বলতে এসেছিলাম। রুদ্র আপনাকে ডাকছে। পেছনের গেইটের দিকে আছে।’
আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি তো চিনি না। তাকে আসতে বলুন।’
‘ও আপনাকেই যেতে বলল।’
বললাম,’ঠিকাছে।’
যাওয়ার পথে সে বলল,’সরি। আমি কিন্তু আপনাকে ভয় দেখাতে চাইনি।’
‘ইট’স ওকে। সমস্যা নেই।’
এখান থেকে গান-বাজনার শব্দ অনেক জোড়ে জোড়ে আসছে। রুদ্র যে কেন আমায় ঐদিকে ডাকল আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রমে ক্রমে পথ নির্জনতার দিকে যাচ্ছিল। এবার আমার ভয় হতে লাগল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি তাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি। এখান থেকে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ আমার গলার আওয়াজ শুনতে পাবে না। ভয়ে হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটির সরলভাবে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে সন্দেহ করাও কষ্টকর। কিন্তু এবার আমি সন্দেহ নয় বরং শিওর হয়ে গেলাম যে রুদ্র আমায় ডাকেনি বরং এটা এই ছেলের একটা ফাঁদ। আর আমিও বিশ্বাস করে সেই ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলেছি। কারণ বক্স থেকে রুদ্রর গান শুনতে পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, এটা রুদ্ররই গলা। রুদ্র যদি ভেতরে গান গেয়ে থাকে তাহলে একই সময়ে সে অন্য জায়গায় আমায় ডাকবে এটা অসম্ভব। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গে এবার ছেলেটিও দাঁড়িয়ে পড়ে। মাটির সাথে আমার পা আঁকড়ে আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমায় পালাতে হবে। আমি যদি নিজে নিজেকে না বাঁচাতে পারি তাহলে অন্য কেউ পারবে না। অন্য কেউ তো জানতেই পারবে না! আমি দৌঁড় দেওয়ার আগেই ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরে বলে,’কী হলো? চলেন।’
আমরা দুজন দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,’আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়েন।আপনি আমায় মিথ্যেও বলেছেন। রুদ্র আমায় ডাকেনি।’
ভয়ে আমার কণ্ঠস্বর থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। এই কথাগুলো বলতেই আমার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এবার ছেলেটির চোখে-মুখে লোভ-লালসার কুৎসিত হাসি দেখতে পাই আমি। মনের সাহস আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। আমার বোধ হয় আর কিছু করার নেই। ছেলেটি আমার হাত ছাড়ল না বরং আরও শক্ত করে ধরল। ছেলেটির হাতে সাহস করে কামড় বসিয়ে দেওয়ার পর তার হাত আলগা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড় দেই আমি। কিন্তু হায়! দৌঁড়ানোর মতো শক্তি আমার একেবারেই ক্ষীণ। ছেলেটি ধরে ফেলে আমায়। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমায় টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে নির্জনতা থেকে আরও নির্জনতার দিকে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল আমার। বারবার বাবা-মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার পরিণতির সমাপ্তি আজ এখানেই। এরপর আর এই সুন্দর ধরণী হয়তো দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। আমার আর্তচিৎকার রুদ্রর গাওয়া গানের আড়ালে তলিয়ে যাচ্ছে। কারো কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। পৌঁছাবে না!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here