-“আপু আজ রাতেই তুমি এ শহর ছেড়ে পালিয়ে যাও। ওই খারাপ লোকটাকে বিয়ে করো না আপু। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি ,তুমি চলে যাও।”
নিজের সতেরো বছর বয়সী ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না রুমঝুম। যেখানে বাড়ির কেউ তার কথা একটিবারের জন্য ভেবে দেখেনি সেখানে তার এই ছোট্ট ভাইটা তার জন্য এতো কিছু ভেবেছে? কান্নাজড়িত গলায় রুমঝুম বললো,
-“আমি চলে গেলে বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না, রুশান।”
-“আপু প্লিজ। ওই মহিলাকে মা ডেকো না তুমি। সে তোমার মতো ফুলের মা হওয়ার যোগ্য না আপু। জঘন্য নোংরা খেলা খেলছে ওরা তোমার সাথে। আপু পালিয়ে যাও তুমি। মরে যাবে ওদের ফাঁদে পা দিলে। প্লিজ আপু পালাও।”
রুশানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো রুমঝুম। সে কোথায় যাবে?কিভাবে যাবে? এই ভাইকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে সে?
রুশান রুমঝুমকে ছেড়ে এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। রুমঝুম অশ্রুসিক্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। মিনিট তিনেকের মধ্যেই আবার ফিরে এলো রুশান। তার টিশার্ট পেটের কাছ থেকে কিছুটা উঁচু করে তার মধ্যেই কিছু এনেছে সে। বিছানায় এসেই টিশার্টের উঁচু করে ধরা স্থানটুকু ছেড়ে দিলো রুশান। সাথে সাথেই বিছানায় পড়লো পাঁচ,দশ,বিশ, পঞ্চাশ, একশো টাকার কয়েকটি নোট সহ বেশ কয়েকটি কয়েন।
রুমঝুম এগুলো দেখে ভাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। রুশান বললো,
-“এই টাকা গুলো ব্যাংকে জমিয়েছিলাম আপু। আমি জানি তোমার কাছে টাকা নেই। এগুলো তুমি রাখো। ভেবো না টাকাগুলো একদম দিয়ে দিচ্ছি। সময়মতো সুদসমেত ফিরিয়ে নিবো , বুঝলে? ”
রুমঝুম চোখ ভর্তি পানি নিয়েও হেঁসে ফেললো। সেদিনের পিচ্চি ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। তার জন্য ভাবছে। সে চলে গেলে ছেলেটার উপর বেশ বড়সড় ঝড় আসবে।তবে রুশানকে ওর মা তেমন কিছু বলবে না , নিজের ছেলে তো। রুমঝুমের ভাবনার মধ্যেই রুশান বললো,
-“আপু,ভোর পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে।”
রুমঝুম কিছু বললো না। চাপা কান্না কাঁদতে থাকলো সে। দ্বিধায় ভুগছে সে। রুশান জবাব না পেয়ে আবার বললো,
-“যাবে তো আপু?”
কি করুন স্বরে কথাটা বললো রুশান। বোনকে বাঁচাতে কত চেষ্টা ছেলেটার। রুমঝুমকে আলোর পথে পাঠানোর জন্য কত আয়োজন করেছে সে।
রুমঝুম ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“যাবো ভাই। আমি যাবো। তুই এতো ভালোবাসিস কেন আমাকে? আমি তো তোর নিজের…
রুশান রুমঝুমের মুখ চেপে ধরলো বাকি কথা বলার আগেই। জোর গলায় বললো,
-“তুমি আমার আপু। আমার নিজের আপু। আমার ঝুম আপু।”
রুমঝুমের মুখে হাসি ফুটলো। তৃপ্তির হাসি। যাক,তারও নিজের কেউ আছে।
দরজার বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে সতর্ক হয়ে উঠলো দুই ভাইবোন। রুমঝুম সব টাকা গুলো গুছিয়ে নিয়েছে। রুশানকে বিছানায় বসিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড় চোপড়, কাগজপত্র নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললো। রুশানের বারবার চোখ ভিজে উঠছে। সে নিজ দায়িত্বে তার আপুকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাঠাচ্ছে। রুশান বিরবির করে বললো,”আমার আপুকে তুমি রক্ষা করো আল্লাহ।ওকে ভালো রেখো।”
অনেক রাত পর্যন্ত দুই ভাইবোন ছাদে বসে গল্প করলো। আবার কবে দুইজন দুইজনকে পাবে কেউই জানে না। মন ভরে গল্প করলো অনেক রাত অবধি। একসময় রুমঝুম বললো,
-“এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড় রুশান। অনেক রাত হয়েছে।”
-“তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আপু।আমি একটু পরে যাচ্ছি।”
রুমঝুম আর কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেলো ছাদ থেকে। রুশান সেদিকে একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আকাশে আজ মস্ত বড় থলের মতো একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে চারপাশ। রুশান চাঁদের পানে তাকিয়ে নিজ মনে বললো,
-“আমার আপুর প্রতিটা দিন যেন এমন চাঁদের মতো আলো ঝলমলে হয়। চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধতায় ঢাকা থাকুক ওর জীবন। ”
…
ভোর চারটা বেজে উনচল্লিশ মিনিট। গুটি গুটি পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রুমঝুম। সামনের গেইটে দারোয়ান থাকে তাই রুশান তাদের বাড়ির পেছন দিকে একটা মই রেখে এসেছে। রুমঝুমকে ওই দিক দিয়েই যেতে বলেছে রুশান।
একদম শেষ মাথায় মই পেয়ে গেলো রুমঝুম। মইটা পাঁচিলের সাথে ভালোভাবে সেট করে আস্তে আস্তে উঠে পড়লো পাঁচিলের উপর। পাঁচিলের ওপারে এই জায়গাটা বেশ উঁচু। লাফ দিলে তেমন ব্যাথা লাগবে না। রুশান সবকিছু আগে থেকেই দেখে নিয়েছে। রুমঝুম আরেকবার তাকালো আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়িটার দিকে। তার জীবনের বিশটি বছর কেটেছে এবাড়িতে। তার শৈশব, কৈশরের সাক্ষী এ বাড়িটি। এ বাড়িতে রেখে যাচ্ছে অনেক কিছু।
রুমঝুম মুখ ফিরিয়ে নিলো। তখনি মনে হলো আবছা আলোর আড়াল থেকে কেউ তাকে দেখছে। আরেকবার চোখ ফেরালো বাড়ির দিকে। আবছা আলোতেই খুঁজে পেলো তাকে। দোতলার কর্নারের ঘর থেকে তাকিয়ে আছে এক জোড়া চোখ। উহু এটা আর কেউ না,তার ছোট্ট ভাই রুশান। রুমঝুমের মনে হলো রুশান চিৎকার করে বলতে চাইছে,
-“আপু, আবার ফিরবে তো?”
রুমঝুমেরও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো,
-“আমি ফিরবো ভাই,তোর জন্য হলেও ফিরবো।”
কিন্তু আফসোস!সেটা বলা হলো না।পাছে কেউ শুনে ফেলে।
রুশান দোতলা থেকে হাত নেড়ে বিদায় দিলো প্রাণপ্রিয় বোনকে। রুমঝুমও কিঞ্চিত হেসে হাত নাড়লো। তারপর লাফ দিয়ে পড়লো দেয়ালের ওপারে। হারিয়ে গেলো রুশানের চোখের সামনে দিয়ে। তবুও রুশান একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। তার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী বিদায় নিলো তার থেকে।
কিছু একটা মনে পড়তেই রুশান চুপচাপ বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। বাড়ির পেছনে এসে সরিয়ে ফেললো মইটা। তার আপুর যাত্রাপথে কোনো বাঁধা না আসুক। বিরবির করে বললো, “তোমার জীবনযাত্রা শুভ হোক,আপু।”
..
শুনশান রাস্তায় প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে হেঁটে চলেছে রুমঝুম। চারপাশে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আলোয় পৃথিবী ভরে উঠলেও সে যেন অন্ধকারেই রয়ে গেছে। কোথায় যাবে সে এখন?
হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাড়ালো রুমঝুম। চারপাশে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। হঠাৎ ওর মনে হলো খালার কাছে যাওয়ার কথা। খালা তো ওকে অনেক ভালোবাসে। সে নিশ্চয়ই ফেলবে না তার কাছে গেলে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাসস্ট্যান্ডের পাশের এক হোটেল থেকে পাউরুটি আর কলা কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়লো সে। গন্তব্য যশোর।
বাসে উঠলে আশেপাশের প্রকৃতিতে মত্ত হয়ে থাকে রুমঝুম। প্রকৃতি যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। গাছপালা, নদীনালা,পাহাড়পর্বত , আকাশবাতাস এগুলোর সাথে রুমঝুমের ভীষণ সখ্যতা।
বাস চলতে আরম্ভ করলে বাতাসের ঝাপটা এসে রুমঝুমকে ছুঁয়ে গেলো। নিজেকে প্রকৃতিকন্যা মনে হচ্ছিলো রুমঝুমের।
বেলা ১২ টার মধ্যে রুমঝুম যশোর এসে পৌঁছালো। প্রায় দুই বছর পর সে যশোরে এসেছে। খালার বাড়িতে পৌঁছাতে তার আরো বিশ মিনিট লাগলো। শুক্রবার হওয়ায় তার খালুও আজ বাড়িতে আছে।
অবেলায় রুমঝুমকে দেখে তার খালা-খালু দুজনেই বেশ অবাক হলো। খালা এগিয়ে গিয়ে রুমঝুমের কাছে দাঁড়াতেই রুমঝুম তার বুকে হামলে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।খালার গায়ে নাকি মা মা গন্ধ পাওয়া যায়। রুমঝুমও খালাকে জড়িয়ে ধরলে মা মা সুবাস পায়। শান্তি লাগে তার।
রুমঝুমের খালা ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। রুমঝুমকে বুক থেকে উঠিয়ে সোফায় বসিয়ে পানি খেতে দিলো। তারপর ওকে এভাবে চলে আসার কারন জিজ্ঞেস করলো। রুমঝুম কাঁদতে কাঁদতে খালাকে সব বললো। খালা ওর মাথায় হাত রেখে বললো,তুই এখানেই থাক মা। ওই নরপিশাচদের কাছে আর যেতে হবে না।
রুমঝুমের খালু কিছু না বলেই রুমে চলে গেলো। সেটা দেখে তার খালাও সেদিকে গেলো। রুমঝুম ব্যাগ নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে যাওয়ার সময় শুনতে পেলো খালা-খালু কিছু নিয়ে তর্ক করছে। কিছুটা শোনার পর সে বুঝলো তাকে নিয়েই তর্কাতর্কি চলছে সেখানে। খালুর স্পষ্ট কন্ঠস্বর শুনলো সে।
-“তোমার বোনের মেয়েকে আমি এবাড়িতে রাখতে পারবো না। যেভাবে মেহমান বেড়াতে আসে সেভাবেই কিছুদিন থেকে যেন চলে যায়।”
-“তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? মেয়েটা কোথায় যাব? ওই বাড়িতে গেলে ওর সাথে কি কি হতে পারে সে ধারনা আছে তোমার?”
-“আমি জানিনা ওর কি হবে,কোথায় যাবে? ওকে আমি এবাড়িতে রাখবো না ব্যাস। তোমার যদি বোনের মেয়ের জন্য এতোই কষ্ট লাগে তাহলে তাকে সাথে নিয়ে তুমিও বেরিয়ে যাও।”
রুমঝুম আর কিছু শুনলো না। চুপচাপ হেঁটে রুমে চলে গেলো। তার জীবনটা যেন হাওয়ায় ভাসছে। কখন কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
রুমঝুম সিদ্ধান্ত নিলো সে এখানে থাকবে না। তার জন্য তার খালার সমস্যা হোক এটা ও কখনোই চায়নি।
বিছানায় বসে রুমঝুম ভাবছে, ও কোথায় যাবে?এ শহর ছেড়ে অনেক দূরে যেতে হবে ওকে। সবার আড়ালে।
হঠাৎ করেই রুমঝুমের মনে পড়লো ওর বান্ধবী মেঘার কথা। মেঘা গতবছর চট্রগ্রামে শিফট হয়েছে। বেস্ট ফ্রেন্ড না হলেও বেস্ট ফ্রেন্ড থেকে কোনো অংশে কম নয় দুজন দুজনার। শেষ কয়েকদিন ধরে পারিবারিক ঝামেলার কারনে মেঘার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি রুমঝুমের।
রুমঝুম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মেঘাকে কল করলো। প্রথমবারেই কল রিসিভ করলো মেঘা।
-“হ্যাঁ ঝুম,বল। কেমন আছিস?”
রুমঝুম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রুমঝুমের কান্নায় থতমত খেয়ে গেলো মেঘা। সে উত্তেজিত হয়ে বললো,
-“কাঁদছিস কেন ঝুম? আমাকে বল। কি হয়েছে তোর?”
রুমঝুম কান্না দমিয়ে ভাঙা গলায় বললো,
-“আমাকে তোর শহরে থাকার একটা জায়গা খুঁজে দিবি মেঘা? এই বিষাক্ত শহর থেকে মুক্তি চাই আমি।”
মেঘা বুঝলো সিরিয়াস কিছু হয়েছে। তাই আর প্রশ্ন করলো না। পরের বাসেই রুমঝুমকে চট্টগ্রাম যেতে বললো মেঘা।
রুমঝুম জানতো এই মেয়েটা তাকে কখনো ফেরাবে না। থাকার জায়গা হয়ে গেলে সেখানে গিয়ে নিজের চলার মতো কাজ ও পেয়ে যাবে ও। দরকার হলে মেঘাকে বলে কয়েকটি টিউশনি ঠিক করে নিবে।
রাত আটটার বাসে চট্টগ্রাম যাত্রা শুরু করলো রুমঝুম। খালার ওখান থেকে আসার সময় খালা কাঁদতে কাঁদতে ওর হাতে হাজার বিশেক টাকা গুঁজে দিয়েছে। আচেনা শহরে কখন কি দরকার পরে বলা তো যায় না। রুমঝুম জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে। আজ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছে সে।
..
-” ওইটা আমার সিট সিন্থিয়া। তুই ওখানে কেন বসলি?”
-“আমি জানালার কাছে বসবো তাই। তুই গিয়ে শান এর সিটে বসে পর,বিথী । ওরটাও তো জানালার কাছে।”
-“আমি এখানেই বসবো ।ওঠ তুই ।”
উচ্চ কন্ঠের মেয়েলি গলায় রুমঝুম তাকালো বাসের সামনের দিকে। পাঁচ সদস্যের একটা দল উঠেছে গাড়িতে। সেখানে দুইটা মেয়ে আর তিনটা ছেলে। মেয়ে দুটোই চেঁচামেচি করছে।
রুমঝুম সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তার মাথায় এখন শুধুই অদূর ভবিষ্যতের চিন্তা।
চলবে………
#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১
#আর্শিয়া_সেহের