#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-13+14
#আর্শিয়া_সেহের
শাফিয়া আক্তার ছেলের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“জোরে লেগে গেছে ,শাফায়াত?”
শান মায়ের কথায় হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। একসময় মারছে,একসময় আদর করছে । হচ্ছেটা কি আসলে?
শান বাচ্চা ছেলের মতো মাথা দুদিকে নাড়ালো মানে সে ব্যাথা পায়নি। শাফিয়া আক্তারের চোখ পানিতে টলমল করছে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
-“ছেলেকে মেরে যদি নিজেই ব্যাথা পাও তো তেমন মাইর দেওয়ার দরকার কি?”
শাফিয়া খাতুন চোখ পাকিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। ইমতিয়াজ মাহমুদ সাথে সাথেই চুপসে গেলেন। এই চুপসে যাওয়া মানে এই নয় যে তিনি ভয় পেয়েছেন বরং এটা করে তিনি মজা পান। স্ত্রীর সামনে বেড়াল সেজে থাকার মজাই আলাদা।
শাফিয়া আক্তার শানকে পাশ কাটিয়ে রুমঝুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রুমঝুম তখন থরথর করে কাঁপছে। শাফিয়া খাতুন মুচকি হেঁসে রুমঝুমের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করলেন। রুমঝুম পিটপিট করে তাকাচ্ছে। পুরোপুরি তাকাতে তার ভয় লাগছে। শাফিয়া খাতুন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা আওয়াজে বললো,
-“মাশাআল্লাহ! আমার ছেলের পছন্দ আছে।”
রুমঝুম চোখ মেললো। এখনো ভয় কাটেনি তার। শাফিয়া আক্তার রুমঝুমকে নিয়ে শানের সামনে এসে দাঁড়ালো। শান একবার তার মা আর একবার হবু বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে। ইশশ মেয়েটার সামনে এমন থাপ্পড় মারলো ওকে। পরে নিশ্চিত এই মেয়ে তার খিল্লি উড়াবে। এসব ভেবে শানের হাত আপনাআপনি আবারও গালে চলে গেলো।
শাফিয়া আক্তার সেটা দেখে গমগমে কন্ঠে বললেন,
-“তোমাকে এজন্য মারিনি যে তুমি বিয়ে করতে এসেছো। তোমাকে মারার কারন হলো তুমি আমাদের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করতে এসেছো।”
শান মাথা নিচু করে ফেললো মায়ের কথায়। শাফিয়া আক্তার শানের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-“তোমার খুশিই আমাদের কাছে সব । তোমার সাথে আমরা অন্যায় করতাম না।”
শান মাথা নিচু রেখেই বললো,
-“আ’ম সরি , আম্মু। এমনটা আর কখনো করবো না।”
সাথে সাথেই ইমতিয়াজ মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
-“আর কখনো করবে না মানে? কতবার আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করতে আসবা?”
শান বেকুব বনে গেলো। সে কি অর্থে কথাটা বলেছিলো আর কথাটার অর্থ কি হয়ে গেলো সেটা ভেবেই দাঁত কেলিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকালো। রুমঝুম শানের দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো। শানকে কেলাতে দেখে চোখ গরম দিলো সে।
মেহেদী বাদে উপস্থিত সবাই হাসাহাসি করছে। মেহেদী চেয়েও হাঁসতে পারছে না। কিভাবে হাসবে ও? ওর হাঁসির কারনটাই তো আজ অন্য কারো দখলে চলে যাবে। ওর হাঁসির কারনটা এখন রোজ অন্য কারো হাঁসির কারন হবে। মেহেদীর বুকের মধ্যে ভাঙচুর চলছে। আজ পুরোপুরি হারিয়ে যাবে রুমঝুম।
কাজী সাহেব একটা বিয়ে পড়াচ্ছে। সেটা শেষ হলে শান আর রুমঝুমের বিয়ে পড়াবে। শান ,রুমঝুম,শানের বাবা-মা,মেঘা,মেঘার মা-ভাই সবাই কাজী অফিসের বাইরে বেঞ্চিতে বসে আছে। মেঘা রুমঝুমের হাত ধরে ওর পাশে বসে আছে। শান মেঘার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“বাবা-মা এসব কি করে জানলো? তোমরা বলেছো তাই না?”
শান ফিসফিস করে বললেও সেটা শাফিয়া আক্তারের কানে ঠিকই পৌঁছে গেলো। তিনি শানকে তাড়া দিয়ে বললেন,
-“কেন আমরা জেনেছি বলে ক্ষতি হয়ে গেলো?”
শানের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এখন। তবুও কাচুমাচু মুখ করে বললো,
-“না আম্মু। আসলে জানতে চাচ্ছিলাম আর কি ।”
শাফিয়া আক্তার বললেন,
-“হ্যাঁ ওরাই বলেছে। আমাকে আর তোমার বাবাকে বলেছে সিন্থিয়া আর প্রান্ত। মেহেদী আর ওর মা কে বলেছে মেঘা।”
রুমঝুম মাহেরা খাতুনের দিকে এগিয়ে গেলো। চুপচাপ তার পাশে বসে বললো,
-“আমার উপর রাগ করো নি তো আন্টি? আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
মাহেরা খাতুন হেঁসে বললেন,
-“পাগলী মেয়ে। আমি রাগ করি নি মোটেও।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।
এতোক্ষণে কথা বললো মেহেদী।সে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-“আমার মনে হয়, তোমার বাবা কে একবার জানানো উচিত। নতুন জীবনে তার দোয়া নিলে সুখী হবা হয়তো।”
রুমঝুমের টনক নড়লো। আসলেই তো,তার বাবাকে আর ভাইকে একবার ফোন করা উচিৎ।
রুমঝুম একটু সাইডে এসে ওর বাবার নাম্বারে কল করলো। মেঘা ওর পিছু পিছু এসে দাঁড়ালো। রুমঝুম মেঘার দিকে একবার তাকিয়ে ফোন কানে ধরলো।
দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। রুমঝুমের বুক দুরুদুরু করছে। নিজের বিয়ের কথা বাবাকে কি করে বলবে ও? মেঘা রুমঝুমের সমস্যা বুঝতে পারলো। তাই ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলো।
-“হ্যালো আংকেল, আমি মেঘা।রুমঝুমের বান্ধবী। চিনতে পেরেছেন?”
রেজাউল তালুকদার বেশ কিছু সময় নিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। একসময় চিনতে পারলো। সে বললো,
-“হ্যাঁ,চিনতে পেরেছি।”
মেঘা রুমঝুমের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে রেজাউল তালুকদারকে সবকিছু খুলে বললেন। রুমঝুমের বিয়ে হচ্ছে তাও তার পছন্দের মানুষের সাথে এটা যেন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। মেঘাকে বললো ,
-“ফোনটা রুমঝুমের কাছে দাও।”
রুমঝুম ফোন কানে নিয়ে কেঁদে ফেললো। ওপাশ থেকে রেজাউল তালুকদার বললেন,
-“পাগলী মেয়ে আমার। কাঁদছিস কেন? বাবা হয়ে কখনো তোর জন্য কিছু করতে পারিনি। তুই নিজেই নিজের জন্য সব করে নে ,মা।”
রুমঝুম কেঁদেই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর রুমঝুম কল কাটলো। আজ অনেক দিন পর বাবার সাথে মন খুলে কথা বললো সে।
এখন তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। কাজী সাহেব ডেকেছেন।রুমঝুম রুশানকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে সেদিকে গেলো। কাজী অফিসে ঢোকার আগে শাফিয়া আক্তার নিজের গলা থেকে মোটা স্বর্ণের চেইনটা খুলে রুমঝুমের গলায় পরিয়ে দিলেন। রুমঝুম ঝুঁকে সালাম করতে গেলো তাকে। তিনি তড়িঘড়ি করে রুমঝুমকে তুলে বুকে নিলেন।এখন কিছু দিতে পারেননি তবে মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে পুতুলের মতো সাজাবেন তিনি।
রুমঝুম যখন মিসেস শাফায়াত হলো তখন বিকেলের শেষ ভাগ। শেষ বিকেলের শীতল বাতাসে তার দূর্বিষহ অতীতের অনেক কিছুই ভেসে চলে গেলো।বেশ হালকা অনুভূত হচ্ছে এখন তার।
মেহেদী একটু দূর থেকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে রুমঝুমের দিকে। এমন অভাগাও মানুষ হয়? যে নিজে স্বাক্ষী হয়ে ভালোবাসার মানুষটির নাম অন্য কারো নামের সাথে জুড়ে দেয়।
…
তিহান আর বিথী বস্তা বোঝাই করে ফুল নিয়ে শানদের বাড়িতে এলো। মেঘাও কাজী অফিস থেকে চলে এসেছে শান-রুমঝুমের বিয়ে শুরুর আগেই। সিন্থিয়া,প্রান্ত আর শিরীন ওদের বাসরঘর সাজাচ্ছে। মেঘা,তিহান,বিথী ড্রয়িং রুম সাজাচ্ছে। শান্ত দৌড়ে দৌড়ে সবকিছুর তদারকি করছে। মনে হচ্ছে ডেকোরেশনের পুরো দায়িত্বটা তার উপরেই।
শিরীন কাজের চেয়ে বেশি প্রান্তকে দেখছে। প্রান্তের কালচে গোলাপি ঠোঁট আর খাড়া নাকটা শিরীনের ভীষণ পছন্দ।
সিন্থিয়া আরো ফুল আনার উদ্দেশ্য নিচে গেলে প্রান্ত শিরীনের দিকে তাকালো। শিরীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিচের দিকে তাকালো। প্রান্ত গম্ভীর গলায় বললো,
-“আর একবার যদি আমার দিকে তাকাও তবে আমি তক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। আগেও বারন করেছি তোমায়।”
শিরীন মাথা নিচু করেই রইলো। কান্না আটকানোর ক্ষমতা ক্রমশই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিন্থিয়ার আসার শব্দ পেয়ে সে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।
একতরফা ভালোবাসা জিনিসটা বড্ড কষ্টের। আর যদি সেটা হয় আবেগের বয়সে তাহলে তো কষ্টের অন্তই থাকে না। শিরীনের প্রান্তের প্রতি এই অনুভূতি আজকের না, আরো দুবছর আগে থেকেই সে প্রান্তকে ভালোবাসে। তবে প্রান্ত তাকে সবসময় ইগনোরই করে গেছে। যে শিরীনের রুপে হাজার ছেলে কুপোকাত হয় সেই শিরীনের দিকে এই ছেলেটা ফিরেও তাকায় না।
শিরীন চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপু আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমি এখন রুমে যাচ্ছি। শান্ত কে পাঠাচ্ছি।”
সিন্থিয়া তড়িঘড়ি করে বললো,
-“ওকে পাঠাতে হবে না। ও কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করে। আমরা শেষ করতে পারবো। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।”
শিরীন মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। প্রান্ত সেদিকে একপলক তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
তিহান কাজ করছে আর মাঝে মাঝে মেঘাকে বেয়াইন,ঝগড়ুটে বেয়াইন এসব বলে রাগাচ্ছে । মেঘা তেড়ে এসে বললো,
-“এসব কি হ্যাঁ? আমাকে এসব বলছেন কেন?”
তিহান দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“এসব বলে আমি জোর বাড়াচ্ছি বেয়াইন। এনার্জি যা লস হচ্ছে তা আপনাকে রাগিয়ে আবার গেইন করতেছি। ”
মেঘা মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আবার।
বিথীর চোখ ছলছল করছে। এই ছেলেটা কারো সাথে কথা বললেও তার কলিজায় আঘাত লাগে। ছেলেটা কি কখনোই তাকে বুঝবে না?
ও জানে তিহানের মনে মেঘার জন্য ভালোবাসা টাইপ কোনো ফিলিংস নেই । তিহান মজা করতে পছন্দ করে ভীষণ। মেঘার সাথেও মজা করে। ছেলেটা যে কোনো পরিস্থিতিতে চিল করতে পারে।
…
সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়েছে । আবছা অন্ধকারে প্রকৃতি নিজেকে আড়াল করছে। রুমঝুম শাশুড়ির হাত ধরে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। পেছনে শান দাঁড়ানো। মেহেদী আর ওর মা’কে ও জোরপূর্বক ধরে এনেছে শাফিয়া আক্তার।
রুমঝুম আশেপাশে তাকাচ্ছে। বাড়িটা রাজপ্রাসাদের মতো। বাম সাইডে গার্ডেন। গার্ডেনের মাঝ বরাবর শেষ দিকে অনেক বড় একটা গাছ তার ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।তবে অন্ধকারের জন্য বোঝা যাচ্ছে না ওটা কি গাছ।
গাছটা দেখে রুমঝুম মুচকি হাসলো। তার এখন ভয়ংকর সুন্দর একটা ইচ্ছা জেগেছে। তবে সেটা পূরণ করার সময় এটা না।
রুমঝুম যখন গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনই দরজা খুলে দিলো তিহান। আলোর ছটায় সেদিকে তাকালো রুমঝুম। সাথে সাথেই চোখ বড় হয়ে গেলো তার। মেইন দরজা থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত গাঁদা আর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাস্তা বানানো। সিঁড়িতেও ছিটানো আছে ফুল।
শানের হাত ধরে ইমতিয়াজ মাহমুদ আগে ঢুকলেন ভেতরে। শানকে দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
-“বউকে ওয়েল কাম করে ভেতরে নিয়ে আয় গাধা। জানিস আমি তোর মা কে …”
আরো কিছু বলার আগে শাফিয়া আক্তার তার মুখ চেপে ধরলেন। ইমতিয়াজ মাহমুদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। তাদের কর্মকাণ্ডে সবাই একদফা হাসলেন। মেহেদী আর ওর মা’কে শিরীন এসে ভেতরে নিয়ে গেলো। শান রুমঝুম ব্যাতীত সবাই ভেতরে চলে গেলো। ওরা লজ্জা পাচ্ছিলো দেখে সবাই ওদের একা ছেড়ে দিলো।
মেহেদী কয়েকবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো রুমঝুমের লজ্জামাখা মুখটা।
সবাই চলে যেতেই শানের সাহস বেড়ে গেলে তরতর করে। সে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে গেলো। তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“ওয়েলকাম। ওয়েলকাম মাই হার্টকুইন।
চন্দ্ররাজ্যে চন্দ্রকন্যাকে স্বাগতম। ”
রুমঝুম মিষ্টি হেঁসে শানের হাত ধরলো। শানের হাত ধরেই ফুল বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে ভেতরে গেলো। সিঁড়ি অবধি যেতেই শাফিয়া আক্তার এসে রুমঝুমকে ধরলেন। শানকে বললো,
-“তুই আপাতত এখানেই সবার সাথে আড্ডা দে। ওকে আমি নিয়ে যাবো।সিন্থিয়া আর শিরীন আমার সাথে যাবি।।”
শানের মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে বেজার হয়ে উল্টো দিকে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসলো।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ছেলের অবস্থা দেখে বেশ দুঃখ পেলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-“দুঃখ পেয়ো না বেটা। বউ তো তোমারই। ওটা কেউ একদম নিয়ে যাচ্ছে নাকি? সারাজীবন তোমাকেই সহ্য..”
এটুকু বলে শাফিয়া আক্তারের দিকে একনজর তাকিয়ে দাঁত বের করে আবার বললেন,
-“মানে বলতে চাচ্ছিলাম যে, সারাজীবন তোমার কাছেই তো থাকবে। তোমাকেই তো আগলে রাখতে হবে। ”
সাথে সাথেই হাঁসির রোল পড়ে গেলো ড্রয়িং রুমে। শান বেশ লজ্জা পেলো বাবার কথায়। প্রান্ত এসে শানের কাঁধ চাপড়ে ওর পাশে বসে পড়লো। শান প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ফোন করে বললাম তোরা আয়। আর তোরা এসে আব্বু-আম্মুকে বললি? ”
-“এটা সিন্থুর বুদ্ধি ছিলো। তবে আই থিংক এটাই ভালো হয়েছে।”
-“ভালো তো হয়েছে তবে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
-“আমি আর সিন্থু ও প্রথমে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। বাট বিলিভ মি শান, আন্টি-আঙ্কেল একদমই রাগ করেননি। উনারা পুরোপুরি কুল ছিলেন।”
-“তোরা কনভেন্স করলি কিভাবে?”
-“আরে আমাদের কিছুই করতে হয় নি। শুধু এসে রুমঝুমের ব্যাপারটা বলেছি। আর তুই এমন ডিসিশন কেন নিলি সেটা বুঝিয়ে বলেছি।”
সিন্থিয়া এগিয়ে এসে বললো,
-” আন্টি তো সাথে সাথেই রুমঝুমের জন্য লেহেঙ্গা আর কিছু জুয়েলারি অর্ডার করে ফেলেছিলো। এখন সেগুলো এলেই রুমঝুমকে নিজ হাতে সাজাবেন তিনি।”
সবার কথার মাঝে শান্ত কোথা থেকে উড়ে এলো। রুমঝুমের হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললো,
-“তুমিই আমার ভাবি তাই না? ওই গোমরামুখোটার বউ।”
রুমঝুম ফিক করে হেসে ফেললো। শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হ্যাঁ আমিই তোমার ভাবি।”
শান্ত জ্বলজ্বল চোখে বললো,
-“তুমি ম্যাথ করতে পারো?”
রুমঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিরীন দৌড়ে এসে বললো,
-“আরে না ভাই। ভাবি একদমই ম্যাথ পারে না। এই দেখ না , লাস্ট পরীক্ষায় ম্যাথে ফেল করেছে বলে তাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো।”
শান্ত রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো এটা সত্যি কি না। রুমঝুম শিরীনের দিকে একবার তাকিয়ে বেচারি লুকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো ।
শান্ত আফসোসের সুরে বললো,
-“ইশশ.. আমি আগে জানলে তোমাকে নিজ দায়িত্বে ম্যাথ শিখাতাম। তাহলে তুমি ফেলও করতে না আর তোমাকে ওই গোমরুটাকেও বিয়ে করতে হতো না। আমি তোমাকে পড়ালেখা করিয়ে আরো বড় করতাম তারপর তোমাকে বিয়ে করে নিতাম। কত্ত কিউট তুমি।”
শান্তর পাঁকা পাঁকা কথায় হাসতে হাসতে সবার অবস্থা কাহিল। ছেলেটা প্রচুর ম্যাথপ্রেমী। যাকে পায় তার কাছেই ম্যাথ করতে বসে যায়। ওর থেকে রুমঝুমকে বাঁচানোর জন্যই আপাতত এমন মিথ্যা বলেছে।
হাসাহাসির মধ্যেই রুমঝুমের জন্য অর্ডার করা ড্রেস আর জুয়েলারি চলে এলো। সবকিছু হাতে পেয়ে রুমঝুমকে নিয়ে শাফিয়া আক্তার,শিরীন আর সিন্থিয়া উপরে চলে গেলো। সিন্থিয়া উপরে উঠার সময় একবার মেহেদীর দিকে তাকালো। মেহেদী তখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুমঝুমের যাওয়ার পথে।
সিন্থিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। মেহেদীর দৃষ্টি স্পষ্ট পড়তে পেরেছে ও। সেই দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
চলবে……..
(কুরবানীর মাংস দিয়েই ওদের বিয়ে সেরে ফেললাম ফ্রেন্ডস। আমার খাবার কম পড়বে বলে তোমাদের দাওয়াত দেই নি, বুঝছো? রাগ করো না।ওদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দিবোনি ওকে?
আর একটা কথা, প্রান্তর সাথে মেঘাকে চাও নাকি শিরীনকে? )
#চদ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৪
#আর্শিয়া_সেহের
রুমঝুম চুপচাপ বসে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়। শরীরে জড়ানো খয়েরী রঙের ভারী লেহেঙ্গা। শাফিয়া আক্তার মোটামুটি ভালোই মেকআপ করিয়েছে তাকে। একদম পুতুলের মতো সাজিয়েছে। শান্ত তো ঘুরে ফিরে রুমঝুমের পাশে এসে বসতেছে।
শানদের কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছে যাদের বাড়ি কাছাকাছি। প্রতিবেশীরাও বেশ কয়েকজন এসেছে বউ দেখতে। এক একজন এসে এক একরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। তবে রুমঝুমের উত্তর দেওয়া লাগছে না। শাফিয়া আক্তারই সব উত্তর দিচ্ছেন। রুমঝুম মাথা নিচু করে বসে আছে।
খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর কিন্তু শ্বাশুড়ির এতো কষ্টে কথানো মেকআপটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে কাঁদতে পারছে না।
শানকে নিয়ে তিহান, প্রান্ত,সিন্থিয়া,মেঘা সবাই ছাদে চলে গেছে। ছাদেও হালকা পাতলা সাজিয়েছে। এখন রাত নয়টার মতো বাজে। রাত বারোটার আগে সবকিছু শান্ত হবে বলে আশা করছে না কেউ।
মেহেদী যদিও বয়সে এদের বড় তবুও ওকে তিহান টেনে টুনে নিয়ে এসেছে। সবাই ছাদের মাঝখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তবে শানের মন পড়ে আছে তার চন্দ্রকন্যার কাছে। কখন যে এসব ফর্মালিটি শেষ হবে?
মেহেদী শানের অস্থিরতা খেয়াল করলো। খুব গোপনে একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। আল্লাহ চাইলে হয়তো এই অস্থিরতাটা আজ তার মধ্যে থাকতো। মেহেদী সেখানে আর বসলো না। উঠে ওদের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ওদের হইহুল্লোড় এর শব্দ কানে আসলেও ওরা এখন মেহেদীর চোখের আড়ালে।
মেহেদীকে চলে আসতে দেখে সিন্থিয়াও উঠে দাঁড়ালো।সাথে সাথেই প্রান্ত বললো,
-“ওয়ে ওয়ে,স্যার উঠে গেছে বলে এখন ম্যামও উঠে পড়লো নাকি?”
সিন্থিয়া কিঞ্চিত রাগ নিয়ে তাকিয়ে বললো,
-“একদম চুপ কর বেয়াদ্দপ। নিজের কাজ কর।”
সিন্থিয়া কিছুটা সরে আসলে সবাই হেঁসে উঠলো। মেঘাও এতদিনে সিন্থিয়াকে বেশ বুঝে গেছে। তাছাড়া প্রান্তও সেদিন সিন্থিয়ার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। মেঘার খুব পছন্দ সিন্থিয়াকে। মেয়েটা তার ভাবি হলে বেশ জমে যাবে।
রুমঝুমের অন্ধকারে দেখা সেই গাছটি ছিলো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। এখন অবশ্য ফুল নেই। মেহেদীর সম্মুখ বরাবর কিছুটা সামনে এসে থেমেছে একটা ডাল। গাছটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে,এটা অনেক পুরোনো। মেহেদী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
-“রুমঝুমকে অনেক ভালোবাসেন তাই না?”
মেহেদী আনমনেই বললো,
-“হু। ভীষণ।”
উত্তর দেওয়ার পর পরই সম্বিত ফিরলো তার। অনেকটা হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। এটা রুমঝুমের শ্বশুরবাড়ি এটা সে কিভাবে ভুলে গেলো?
পেছনে তাকিয়ে সিন্থিয়াকে দেখে স্বস্তি পেলো মেহেদী। সিন্থিয়া শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
-“এতোই ভালোবাসেন তাহলে আগে জানান নি কেন ওকে?”
সিন্থিয়া এগিয়ে এসে মেহেদীর পাশে দাঁড়িয়ে বললো।
মেহেদী পুনরায় কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে তাকালো। কাঁপা গলায় বললো,
-“আমি আসলে বুঝতে পারিনি মেয়েটা অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়বে। ওর মনের অবস্থা বুঝেই ওকে সময় দিয়েছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন যে প্রানপাখির খাঁচা খুলে দিয়েছি বুঝতেই পারিনি।”
সিন্থিয়া মুখ লুকিয়ে কান্না মুছলো। নিজের ভালোবাসার মানুষটির মুখে অন্য কারো নাম শোনা যে কতটা কষ্টের তা যে শোনে সেই বোঝে। সিন্থিয়া চোখ মুছে বললো,
-“ওর স্মৃতিতেই ডুবে থাকবেন নাকি? জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত নয় কি?”
-“জানো সিন্থিয়া? কিছু কষ্ট আড়ালেই অপ্রকাশিত ভাবে থেকে যায়। কিছু কষ্ট একান্তই নিজের থাকে। এই কষ্ট গুলো ভেতরটা ঝাঁঝড়া করে দেয়।”
সিন্থিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো মেহেদীর কথা শুনে। মেহেদী আবারও বললো,
-“তুমি যত সহজে বললে জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়ার কথা ,তত সহজে আসলে দেওয়া যায় না।”
সিন্থিয়া কথা বললো না। মুখ চেপে উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই মেহেদী তার হাত ধরলো। মেহেদী হাত ধরায় সিন্থিয়া যতটা না অবাক হলো তার চেয়ে বেশি লজ্জা পেলো। তার ভেতরকার কান্না এক মূহুর্তে কোথায় হারিয়ে গেলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে সিন্থিয়া মেহেদীর চোখে চোখ রাখলো। মেহেদী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিন্থিয়ার দিকে। সিন্থিয়া দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। মেহেদী সিন্থিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। দম নিয়ে বললো,
-“তুমি তো আমাকে রুমঝুম এখানে আসার দুমাস আগে থেকেই পছন্দ করো। তখন বলোনি কেন, সিন্থিয়া?”
সিন্থিয়া মায়াভরা চোখে তাকালো মেহেদীর দিকে। মেহেদীর মতো একই সুরে উত্তর দিলো,
-“ওই যে,একি কারনে। বুঝতে পারিনি ছেলেটা জড়িয়ে পড়বে কারো সাথে। সময় দিচ্ছিলাম নিজেকে আর নিজের ভালোবাসা কে।”
মেহেদী হাঁসলো। সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমাকে আরেকটু সময় দিবে? কথা দিচ্ছি, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আমার আকাশপরীর কাছেই ফিরবো আমি।”
সিন্থিয়া কেঁপে উঠলো। এই নামটা কি ওর জন্যেই? ও মেহেদীর আকাশপরী?
সিন্থিয়া খুশিতে কেঁদে ফেললো। কান্না মেশানো গলায় বললো,
-“সত্যিই ফিরবেন?”
মেহেদী শব্দ করে হেঁসে ফেললো এবার। সিন্থিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-“ফিরবো না তো কি করবো? এতো ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাধ্য আমার আছে নাকি? আর তাছাড়া আমি চিরকুমার থাকবো নাকি?”
মেহেদীর কথা শুনে সিন্থিয়াও হেঁসে ফেললো। দুজনই খিলখিল করে হাসছে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। রাতের আকাশটাও হাঁসছে তাদের হাঁসিতে।
…
-“আরমান,রুশানকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ওকে ছাড়ো । ওকে ছাড়ো প্লিজ।”
আরমান রুশানকে ড্রয়িং রুমে এনে সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারলো।
শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে পারলো না রুশান। ফ্লোরে পড়ে গেলো। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। আরমান রুশানকে টেনে তুলে আবারও থাপ্পড় মারলো।
হ্যাংলা পাতলা রুশান এই থাপ্পড়গুলো সহ্য করতে পারছে না। তবুও মুখ বুজে রয়েছে।
তাহমিনা বেগম আরমানের পা ধরে বসে পড়লেন। বিলাপ করে করে বললেন,
-“ওকে মেরো না। দয়া করো। ও ছোট মানুষ আরমান।দয়া করো আমাকে।”
আরমান পা ঝাড়া দিয়ে সরে এলো। চিৎকার করে বললো,
-” এই কু*র বাচ্চা আমার সব প্লান শেষ করছে। দুই দুই বার। ওরে জ্যান্ত দাফন করবো আমি।”
বলেই তেড়ে গেলো রুশানের দিকে।
তাহমিনা বেগম রুশানকে আগলে দাঁড়ালো। মিনতি করে বললো,
-“ওকে মেরো না আর। ও মরে যাবে বাবা। ওকে আর মেরো না।”
আরমান রুশানের দিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসে পড়লো। বাঁকা হেঁসে বললো,
-” বোনের বিয়ে হইছে বলে বোন বেঁচে গেছে এমনটা ভাবিস না।তোর বোন রে বউ বানানোর জন্য কিনি নি আমি বুঝছিস?
ক্লান্ত রুশান জ্বলন্ত চোখ মেলে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান রুশানের দিকে তাকিয়ে বিদঘুটে এক হাঁসি দিয়ে বললো,
-” শালীর চেহারা দেখে কিনছি। ওর ছবি দেখে এক লোকে কত দাম দিয়ে কিনতে চাইছে ওরে জানিস? হাহ,তোরা ক্যামনে জানবি ? ওই মাইয়া রে তো আমার লাগবোই।”
আরমান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধপধপ পা ফেলে রুশানের সামনে এসে বসলো। ফিসফিস করে বললো,
-“ওই মেয়েরে আনা আমার বাঁ হাতের খেল। শুধু দেখে যা সামনে কি হয়।”
আরমান বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রুশান সেদিকে তাকিয়ে একদলা থুথু ফেললো মাটিতে। আরমান এভাবে হুট করে এসে সরাসরি তার রুমে গিয়ে তার ফোন চেক করবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি। আগে টের পেলে এসএমএসটা ডিলিট করতে পারতো।
তাহমিনা বেগম রুশানের কাছে এসে বসলো। রুশান তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তাহমিনা বেগমের বুক কেঁপে উঠলো সেই হাঁসি দেখে। ঘৃনা আর তাচ্ছিল্যে ভরা সেই হাঁসি।
রুশান নিজেই কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার পেছনে তাকালো। সেই একই ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
-“নিজের সন্তানের জন্য খুব কষ্ট হয় তাই না, আম্মু? অন্য কারো সন্তানের বেলায় কেন এমন হলো না তোমার?”
রুশান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। তাহমিনা বেগম সেখানেই বসে রইলেন। তার খুব ইচ্ছে করলো নয় বছর আগের সময়টাতে ফিরে যেতে।
…
এগারোটার দিকে সবাই ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। রুমঝুম তখনও সোফায় বসে আছে। ওদের নামার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো। রুমঝুমের অসহায় দৃষ্টি দেখে মেঘা আর সিন্থিয়া মুখ টিপে হাসছে। রুমঝুম ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের হাঁসি দেখে। ওকে বাঁচাবে তা না করে হাসছে ওখানে দাঁড়িয়ে।
ওদিকে শানকেও চ্যাংদোলা করে নিয়ে ঘুরছে তিহান আর প্রান্ত।
শাফিয়া আক্তার ওদের সবাইকে খেতে বসালেন। রুমঝুম শানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ চোখ পড়লো প্রান্তের দিকে। প্রান্ত একধ্যানে কোথাও তাকিয়ে আছে। রুমঝুম সেই দৃষ্টি অনুসরন করে তাকিয়ে দেখলো শিরীন একটা বাচ্চার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। প্রান্ত সেটাই দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
শিরীন বাচ্চাটাকে রেখছ রুমঝুমের কাছে এসে বসলো। রুমঝুমের সাথে গল্প করলেও ওর দৃষ্টি অন্য কোথাও। রুমঝুম এবার সেদিকে তাকিয়ে দেখলো প্রান্ত অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
রুমঝুম কিছু কিছু বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো তবে এটা নিয়ে কিছু বললো না তখন।
..
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। শানদের বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। রুমঝুমকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এসেছে শাফিয়া আক্তার। শিরীন আর মেঘা এসে রুমঝুমকে খাইয়ে দিয়ে গেছে একটু আগে।
শান্তর দেখা নেই অনেকক্ষণ আগে থেকেই। মেহেদী বাড়িতে চলে গেছে সাড়ে এগারোটার দিকেই। মেঘা আর মাহেরা খাতুন সকালে যাবে।
এই রাতে তিহান, প্রান্ত,সিন্থিয়া আর বিথী শানকে আবার ছাদে নিয়ে গেলো। তিহান কোন ফাঁকে যেন অ্যালকোহল নিয়ে এসেছে। এখন সেটাই খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেছে শান কে।
শান একদম মুখ বন্ধ করে পরে আছে। সে কিছুতেই খাবেনা এই অখাদ্য। সবাই চেষ্টা করেও যখন খাওয়াতে পারলো না শান কে।
ওদিকে তিহান ঢকঢক করে খেয়েই যাচ্ছে। বিথী তিহানের হাত থেকে বোতল কেড়ে নিয়ে বললো,
-” আর কত খাবি? রাখ এবার।”
তিহান বিথীর হাত থেকে বোতল ছিনিয়ে নিলো। গমগম করে বললো,
-“তোর কি হ্যাঁ? আমি যত ইচ্ছা খাবো। বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেলো আর আমি সিঙ্গেলই মরতেছি। এই কষ্ট কমানোর জন্য হলেও খাবো। সর তো তুই।”
বিথী কপাল চাপড়ালো। এই ছেলে যে কি করবে আজ রাতে।
এরমধ্যেই মেঘা ছাদে এলো। শাফিয়া খাতুন সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে নিচে। অনেক আড্ডা হয়েছে। এখন ঘুমাতে হবে। সিন্থিয়ে উঠে এসে মেঘার হাত ধরে আগেভাগে নেমে এলো। শানের থেকে টাকা খসাতে হবে এখন।
শিরীন রুমঝুমের কাছে বসে ছিলো। রুমঝুম ছলেবলে জিজ্ঞেস করলো,
-“ডিয়ার ননদিনী। কাউকে ভালোবাসো?”
শিরীন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মিনমিন করে বললো,
-“বাসি তো। কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দেয়না ভাবিজান ।”
-“সে কি প্রান্ত ভাইয়া?”
শিরীন লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখে ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলো,
-“হুম।”
রুমঝুম বেশ অবাক হলো। প্রান্ত শিরীনকে পাত্তা দেয় না এটা কেন বললো শিরীন? তবে কি প্রান্ত ভাইয়া নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখে?
বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজে শিরীন বেরিয়ে গেলো। রুমঝুম যখন বুঝতে পারলো দরজার ওপাশে সবার সাথে শান ও দাঁড়িয়ে আছে তখনই তার বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। হাত-পা ও মৃদুমন্দ কাঁপছে।
সবাই মিলে দশহাজার টাকা নিয়ে তারপর শানকে ছাড়লো। শান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“সব কয়টাকে দেখে নিবো আমি।”
তিহান টলতে টলতে বললো,
-“আব্বে যা যা,দেখিস।”
শান প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ওই মাতালরে ঘরে নিয়ে যা এখনি। কোথায় কি করে ফেলবে আবার।”
প্রান্ত দাঁত কেলিয়ে তিহানকে নিয়ে চলে গেলো। দরজার সামনে থেকে সবাই চলৈ গেলে শান রুমঝুমের দিকে তাকালো। বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে তার চন্দ্রকন্যা। মুচকি হাসলো শান। দরজা আটকাতে যাবে তক্ষুনি হুড়মুড় করে বই-খাতা বগলডাবা করে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো শান্ত।
শান শান্তর দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো। এই ছেলে এখন এখানে আসলো কেন? শান্ত ততক্ষণে বইখাতা নিয়ে বিছানায় বসে পড়েছে। রুমঝুম ঘোমটা তুলে তাকিয়ে আছে ক্ষুদে বাঁদরটার দিকে।
শান এগিয়ে এসে কোমরে দুই হাত রেখে বললো,
-“এই তুই এখন এই ঘরে এলি কেন?”
-“আজকে তোমার বাসর রাত না?”
শান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-“হ.. হ্যাঁ তো?”
শান্ত নিরীহ প্রাণীদের মতো বললো,
-“তুমিই তো সেদিন বলেছিলে,বাসর রাতে নাকি তুমি অনেক খুশি থাকবা। তাই তোমার বাসর রাতে যেন আমি তোমার কাছে ম্যাথ করতে আসি। এজন্যই তো এসেছি।”
রুমঝুম ফিক করে হেঁসে দিলো শান্তর কথা শুনে। আর শান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার ম্যাথপাগলা ভাইয়ের দিকে।
চলবে….