চন্দ্ররঙা প্রেম -Part 11+12

0
330

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-11+12
#আর্শিয়া_সেহের
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। মেঘা আর রুমঝুম বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। রুমঝুম চোখ বন্ধ করে মেঘার ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। মুখে মুচকি হাঁসির ছটা লেগে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক জীবনের সবচেয়ে খুশির দিনটা। শানের চোখে আজ নিজের জন্য ভালোবাসার এক অতল সমুদ্র দেখেছে রুমঝুম। ওই সমুদ্রে একবার ডুবলে শানের ভালোবাসায় তার মৃত্যু নিশ্চিত। রুমঝুম নিজের কল্পনায় অন্য এক ভুবনে শানের সাথে ঘর বাঁধতে ব্যস্ত এখন।
চারপাশে আবছা অন্ধকার‌ নেমে গেছে। বাড়ির গেট খুলে মেঘা আগে আর পিছে পিছে রুমঝুম আসছে। মেইন দরজা খোলা ছিলো। দুজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো সারাবাড়ি অন্ধকার। রুমঝুম একটু এগিয়ে মেঘার হাত ধরে বললো,
-“বাড়ি এমন অন্ধকার হয়ে আছে কেন রে?”
মেঘার উত্তরের আগেই লাইট জ্বলে উঠলো। ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বেলুনের ছড়াছড়ি। দরজার অপজিট দিকে দেয়ালে লাল জারবেরা ফুল দিয়ে লেখা,
* HAPPY BIRTHDAY
RUMJHUM *
রুমঝুম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আজকে তার চমকের উপর চমক পাওয়ার দিন। মাহেরা খাতুন মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেলো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। জন্মের পর কখনোই সে এমাবে জন্মদিন উদযাপন করার সুযোগ পায়নি। তার একটা মা ছিলো যে জন্মদিনের দিন তাকে বাড়িতে আটকে রাখতো। সমস্ত কাজ তাকে দিয়ে করাতো। রুমঝুমের মনে হতো তার প্রতিটি জন্মদিনই তার জন্য বেদনার তবে আজ তার সেই ধারনা ভুল প্রমাণ হলো। আজকের দিনটা তার জন্য অনেক কিছু বয়ে এনেছে।
রুমঝুম নাক টেনে কেঁদে বললো,
-” তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, আন্টি।”
মাহেরা খাতুন রুমঝুমের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-“পাগলী মেয়ে। কাঁদছিস কেন? আর এই সবকিছু মেহেদী করেছে। আমি কিছুই করিনি।”
রুমঝুম মেহেদীর দিকে তাকালো। মেহেদী একটু দূরে দাঁড়ানো। রুমঝুম মুখ খুলতে যাবে তখনই মেহেদী বললো,
-“আমাকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো দরকার নেই। এসে কেকটা কেটে আমাকে উদ্ধার করুন মহারানী।”
রুমঝুম ফিক করে হেঁসে ফেললো। চারজন মিলে কেক কাটলো, অনেক হাসি আনন্দের মধ্যে কিছু সময় কাটালো। কিছু সময় পর মেহেদী রুমঝুম আর মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সারাদিন দু’জন বাইরে ছিলে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”
দুজনই চুপচাপ ফ্রেশ হতে চলে গেলো।রুমঝুম রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ব্যাগের মধ্যে থেকে শানের দেওয়া গাউন টা বের করলো। জামাটা বুকে জড়িয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। জামাটা অতি যত্নে গুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে ঢুকলো ওয়াশ রুমে।
-“ঝুম ,ঝুম দরজা খোল।”
খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আজকের তোলা ছবিগুলো দেখছিলো রুমঝুম। শান হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে ছবিগুলো। মেঘার ডাক শুনে ফোন রেখে দরজা খুললো রুমঝুম। মেঘা হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো। রুমঝুমকে টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে বললো,
-“কি করছিলি রে? জিজু ফোন টোন দেয়নি এখনো?”
-“তার কি আর কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ চিপকে থাকবে আমার সাথে?”
মেঘা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। খানিকক্ষণ পরে সিরিয়াস হয়ে বললো,
-“তুই খুশি তো ঝুম?”
রুমঝুম চুপ রইলো। তার লজ্জা লাগছে খুব। মেঘা টিপ্পনী কেটে বললো,
-“আহা !আবার লজ্জা পাওয়া হচ্ছে? দুই দুইবার জড়িয়ে ধরার সময় লজ্জা লাগেনি হু?”
রুমঝুমের এবার লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো। মেঘাকে মিছিমিছি মারতে লাগলো সে।
..
-“মা ,তুমি এগুলো উঠায় রাখো। আমি রুমঝুমকে ওর গিফটটা দিয়ে আসি।”
-“আচ্ছা যা। আমি এদিকে দেখছি।”
মেহেদী ধূসর পাঞ্জাবির পকেটে নুপুরজোড়া ঢুকিয়ে হাতে একটা চকোলেট বক্স নিয়ে রুমঝুমের ঘরের দিকে গেলো।তবে ভেতরে ঢুকতে পারলো না । তার আগেই কানে এলো রুমঝুমের উচ্ছাসিত কন্ঠ। রুমঝুম আর মেঘার কথপোকথন পুরোটাই তার কানে এলো।
মেহেদীর পুরো দুনিয়াটাই যেন ঘুরে উঠলো। তার বহু প্রতীক্ষিত ভালোবাসার মানুষটি নিজেকে হাসিমুখি অন্য কারো বন্দিনী বানাতে চায় । এর চেয়ে কঠিততম বাক্য এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি কি হতে পারে? মেহেদী শরীরের ভার ধরে রাখতে পারলো না। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। হাত থেকে চকোলেট বক্সটা মেঝেতে পড়ে গেলো। সেই শব্দে মেঘা আর রুমঝুম বাইরে বেরিয়ে এলো।
মেহেদী সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলো। মেঘা আর রুমঝুম বাইরে এসে দেখলো মেহেদী মেঝেতে বসে আছে। মেঘা উচ্চকণ্ঠে বললো,
-“ভাইয়া ,পড়লে কিভাবে?”
মেহেদী আড়চোখে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
-“নিজের পায়ে বেঁধে পড়ে গেছি।”
সাথে সাথেই রুমঝুম উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো। মেহেদী অপলক তাকিয়ে রইলো সেই হাঁসি মাখা মুখটার দিকে। মন থেকে হাসছে মেয়েটা। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। মেহেদী চোখ ফিরিয়ে নিলো । এই হাঁসি দেখার অধিকার বোধহয় সে হারিয়ে ফেলেছে।
মেহেদীর হঠাৎ চোখ পড়লো রুমঝুমের পায়ের দিকে। মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বললো,
-“নুপুর কোথায় পেলে, রুমঝুম?
রুমঝুম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। সে মেহেদীকে কি করে বলবে যে এটা তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে ছিলো। রুমঝুম কোনো মতে বললো,
-“পেয়েছি একজায়গায়,ভাইয়া।”
বলেই রুমঝুম ঘরে ঢুকে গেলো।
আশ্চর্য! রুমঝুমের মুখে ভাইয়া ডাক শুনে এখন আর খারাপ লাগছে না মেহেদীর। মানুষের জীবনে হয়তো একটা মূহুর্তই যথেষ্ট অনেক কিছু পাল্টে দেওয়ার জন্য।
মেঘা হাসতে হাসতে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বুঝলে ভাইয়া, আমাদের রুমঝুম ভয়ংকর প্রেমে পড়েছে।”
মেহেদী হাসলো।‌ সেই হাঁসিতে ফুটে উঠলো একরাশ কষ্ট,বেদনা আর ব্যার্থতা। মেঘা তা দেখতে পেলো না। মেহেদী মেঘার হাতে চকোলেটের বক্সটা দিয়ে বললো ,
-“দু’জনে ভাগ করে খেয়ে নিস।”
মেঘা মাথা হেলিয়ে রুমঝুমের রুমে ঢুকে পড়লো। নুপুরজোড়া আর বের করা হলো না। অবহেলিত ভাবে পড়ে রইলো মেহেদীর পাঞ্জাবির পকেটে।
মেহেদী বহু কষ্টে নিজেকে টেনে আনলো ড্রয়িং রুম পর্যন্ত। মাহেরা খাতুন টেবিল মুছছিলো তখন। ছেলের বিদ্ধস্থ দৃষ্টি তার চোখ এড়ালো না। অনেকটা দৌড়ে এলো মেহেদীর কাছে। মেহেদী মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। মাহেরা খাতুন কিছু একটা আন্দাজ করে মেহেদীকে নিয়ে মেহেদীর ঘরে চলে গেলেন। পাছে মেয়ে দুটো দেখে ফেলে এজন্য।
মেহেদী মায়ের কোলে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বাবার মৃত্যুর পর আজই প্রথম কাদলো মেহেদী। মাহেরা খাতুন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কি হয়েছে বাবা? কাঁদছিস কেন তুই? ”
মেহেদী নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারলো না। কেঁদে কেঁদেই বললো,
-“আমার ঝুমটা অন্য কাউকে ভালোবাসে, মা। ও আমাকে বোঝেনি, মা। আমাকে একটু খানি বুঝলে কি এমন ক্ষতি হতো বলো তো?”
মাহেরা খাতুনের হাত থেমে গেলো। ছেলেকে কি বলে শান্তনা দেবেন তিনি? ধরা গলায় বললেন,
-“ভালোবাসা মানুষের মন থেকে আসে বাবা। কাকে কখন মন ভালোবেসে ফেলে সেটা মানুষ নিজেও জানেনা। তোর কপালে ঝুম ছিলো না। হয়তো অন্য কেউ তোকে চেয়েছে আর আল্লাহ তোকে তার জন্যই কবুল করেছেন।”
মেহেদীর কান্না সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেই আকাশপরী।

-“আমি আজকে ক্লাস করবো না। আমাকে ঘুরতে নিয়ে চলুন না প্লিজ।”
রুমঝুম বাচ্চাদের মতো আবদার করছে শানের কাছে।‌ মেঘা ডিপজল স্যারের ক্লাস করছে। রুমঝুম পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে লুকিয়ে। জানালা দিয়ে শানকে ক্যাম্পাসে দেখেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছিলো।
রুমঝুমের বাচ্চামি আবদারে শান হেঁসে মেললো। বাইকে ভর করে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তা কোথায় ঘুরতে যাবেন ,শুনি?”
রুমঝুম একটু এগিয়ে এসে বললো,
-“যেখানে ঘুরতে নিয়ে যাবেন।”
শান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
-“একদিনেই তোমার মধ্যে প্রেমিকা প্রেমিকা ভাব চলে এসেছে দেখছি।”
রুমঝুম দুই ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“প্রোপার্টি যখন পার্সোনাল,ভাব তো একটু হবেই স্যার।”
রুমঝুমের কথায় শব্দ করে হেঁসে দিলো শান সহ আরো তিনজন। এতো গুলা গলার আওয়াজ পেয়ে রুমঝুম ভড়কে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো সিন্থিয়া, প্রান্ত আর বিথী দাঁড়ানো। সিন্থিয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললো,
-“হেব্বি উত্তর দিয়েছো রুমঝুম।”
রুমঝুম লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। এরা কখন পেছনে এসে দাঁড়ালো? এদের অস্তিত্ব আগে টের পেলে ও কখনোই এমন করে কথা বলতো না। ইশশ কি লজ্জার ব্যাপার।
.
মেঘা ক্লাস থেকে বেরিয়ে চারপাশে রুমঝুমকে খুঁজছিলো। আশেপাশে কোথাও না পেয়ে সোজা চলে গেলো কৃষ্ণচূড়া তলায়। সেখানে সিন্থিয়া, প্রান্ত আর বিথী বসে আছে। প্রান্ত মেঘাকে দেখেই হাতের ইশারায় ডাকলো। মেঘা মুচকি হেঁসে সেদিকে এগিয়ে গেলো।
এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“রুমঝুমকে দেখেছেন,ভাইয়া?”
-“রুমঝুম আর এ জগতে নেই রে বইন। সে তার প্রেমিক পুরুষের সাথে এতক্ষণে কোথায় উড়ে বেড়াচ্ছে কে জানে?”
সিন্থিয়ার উত্তর শুনে মেঘার ভ্রু কুঁচকে গেলো।‌সিন্থিয়া মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বসো এখানে। রুমঝুম আর শান একটু ঘুরতে গেছে। চলে আসবে তাড়াতাড়িই।”
মেঘা ফসস করে একটা দম ফেলে বসে পড়লো সেখানে। তিহানকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তিহান ভাইয়া কই? উনাকে দেখতেছি না।”
মেঘার প্রশ্ন সিন্থিয়া আর প্রান্ত স্বাভাবিক ভাবে নিলেও বিথী স্বাভাবিক ভাবে নিলো না। সে তৎক্ষণাৎ বললো,
-“কেন? তিহানের কাছে কি প্রয়োজন তোমার?”
মেঘা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।কোনো মতে মুখে হাসি টেনে বললো,
-“এমনিতেই জিজ্ঞাসা করেছি আপু। প্রতিদিন আপনাদের সাথে থাকে কিন্তু আজ নেই ,তাই।”
বিথী মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো। সিন্থিয়া বিথীর এহেন আচরণে বেশ রেগে গেলো। বিথীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“এটা কেমন কথার ধরন বিথী? ও একটা প্রশ্ন করেছে, সেটার উত্তর সোজা ভাবে দিয়ে দিলেই তো হয়।”
বিথী মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,
-“তোর হবু ননদের সাথে তুই মিষ্টি করে কথা বল সিন্থু। আমাকে প্লিজ জ্ঞান দিতে আসিস না।”
বিথীর কথায় মেঘার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সিন্থিয়া বিথীকে আর কিছু না বলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘার এমন রিঅ্যাকশন দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো । জোরপূর্বক হেঁসে বললো,
-“আরে ওর কথা সিরিয়াসলি নিও না। মজা করেছে ও।”
তিন নারীর কথপোকথনের মাঝে বসে প্রান্ত‌ হাসতে হাসতে খুন । অবশেষে পেট চেপে বললো,
-“এবার তিনটায় থাম। তোরা কেউ কারো ননদ-ভাবী না, সবগুলা আমার শালী।”

রুমঝুম শানের পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে বাইকের পেছনে। শানের শরীরের কড়া পারফিউমের ঘ্রানে বেশ ভালো লাগছে তার। খোলা আকাশের নিচে ছুটে চলা দু’জন তরুন তরুনীকে দেখছে আকাশে উড়ে বেরানো মেঘগুলোও। দুজনের হৃদয়েই প্রস্ফুটিত হয়ে আছে ভালোবাসার পদ্ম।
রুমঝুম মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
-“নেভাল বীচে।”
-“ওখানে কি আছে?”
শান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি আছে মানে?”
রুমঝুম আমতা আমতা করে বললো,
-“মানে আমি তো এই জায়গার ব্যাপারে কিছু জানি না তাই বলছিলাম আর কি।”
শান হেঁসে ফেললো। রুমঝুম শানের পিঠে গুতা মেরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“হাসছেন কেন? একদম হাসবেন না।”
শান‌ হাঁসি থামিয়ে বললো,
-“আচ্ছা শুনো, কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা চট্টগ্রামে নেভাল বীচ নামে পরিচিত। নদী আর সাগর এখানে একাকার। তোমার প্রিয় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের আগে থেকে হযরত শাহ আমানত (রা:) আন্তার্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের এই স্পটটি চট্টগ্রামবাসীদের কাছে জনপ্রিয়। জাহাজ আর ওপারের শিল্প-কারখানার আলোতে সন্ধ্যায় আরো মায়াবী হয়ে উঠে নেভাল এলাকা।
রাতের বেলা নেভাল একাডেমী সংলগ্ন কর্ণফুলী পাড়ের নেভাল বীচ থেকে কর্ণফুলী এবং বঙ্গোপসাগরের মিলন কেন্দ্র মোহনার সৌন্দর্য উপভোগের মজাই আলাদা। মধ্যরাত পর্যন্ত পর্যটকের কোলাহলে মুখরিত থাকে নেভাল বীচ।”
শানের কথার মাঝেই রুমঝুম গাল ফুলিয়ে বললো,
-“তাহলে তো রাতে গেলেই ভালো হতো। সৌন্দর্য রাতে দেখা যাবে তাহলে এখন গিয়ে কি করবো।”
শান হেঁসে বললো,
-“এখনো তোমাকে রাতে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়নি বুঝোছো?”
-“তা কবে‌ হবে হুহ?”
-“একটা পূর্ণিমা রাতে। সেদিন চারপাশে ঝলমলে জোৎস্না থাকবে। আর আমার পাশে থাকবে আমার চন্দ্রকন্যা।”
রুমঝুম মুগ্ধ হয়ে শুনলো শানের কথা। চোখের পাতায় নিজেই এঁকে নিলো ভবিষ্যতের সেই রাতটির ছবি।

এই ভরদুপুরে আরমান কেন এসেছে সেটা বুঝতে পারছে না রুশান। খেতে নামার সময় উপর থেকে আরমানকে দেখেই আড়ালে চলে গেলো সে। আরমান হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলালো। আসলে সে তাহমিনা বেগমকে খুঁজছে। তাকে কোথাও না দেখে কাজের মেয়েটাকে ডাক দিলো। কাজের মেয়েটাও আরমানকে খুব ভয় পায়। সে আরমানের সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়ালো। আরমান গমগমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-“তোমার ম্যাডাম কোথায়?”
মেয়েটি ছোট করে উত্তর দিলো,
-“উপরে নিজের ঘরে ।”
আরমান ধপধপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। মাঝপথে গিয়ে আবার পেছনে তাকিয়ে বললো,
-“আর ওই বিচ্ছু ছেলেটা কোথায়?”
কাজের মেয়েটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান বুঝতে পেরে বললো,
-“তোমার ছোট স্যার কোথায়?”
-“সে তো সকাল থেকেই নিজের ঘরে।”
-“ওকে।”
আরমান সোজা তাহমিনা বেগমের রুমে চলে গেলেন।
রুশান বুঝতে পারলো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা আছে হয়তো। নাহলে তার ব্যাপারে শুনতো না। রুশান পা টিপে টিপে তার মায়ের ঘরের দরজার সাইডে দাঁড়ালো। তখনি ভেতর থেকে আরমানের কন্ঠ শোনা গেলো।
-“আপনার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি আমি।চট্টগ্রাম গিয়ে রংঢং করে ছেলেদের সাথে জন্মদিন পালন করতেছে সে।ছবি তুলে আবার ফেসবুকেও ছাড়ে। এবার ওকে এনে বোঝাবো যে আরমানের থেকে পালানোর শাস্তি কেমন হতে পারে। এতোগুলো দিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আমায়।
রুশানের পিলে চমকে উঠলো আরমানের কথায়। জানোয়ারটা আবারও তার বোনের খোঁজ পেয়ে গেলো।
চলবে……….
(সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। )
#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১২
#আর্শিয়া_সেহের
-“আরমান,তোমার সব টাকা আমি ফিরিয়ে দেবো। দয়া করে রুমঝুমের পেছনে আর পরে থেকো না।
-“আহা শ্বাশুড়ি আম্মা। এখন এই কথা বললে তো হবে না। এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে গেছেন?”
-“দেখো আরমা..”
-“হুশশশ… হঠাৎ মেয়ের প্রতি দরদ উথলে উঠলো কিভাবে?আমার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার সময় এই দরদ কোথায় ছিলো?”
রুশান কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার আড়ালে। ওদের দুজনের কথা শুনে নড়ার শক্তিটুকুও হারিয়েছে সে। তার বোনকে বিক্রি করে দিয়েছিলো? টাকার প্রতি এতো লোভ এই মহিলার?
-“আমি কাল সকালেই যাচ্ছি রুমঝুমকে আনতে। আর এই কথা যেন আপনার বিচ্ছু ছেলের কানে না‌ যায়।”
আরমানের বের হওয়ার আভাস পেয়ে রুশান দ্রুত লুকিয়ে পড়লো।‌ আরমান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে রুশান তার মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো,
-“বাহ্ আম্মু বাহ্। মা না‌ হও ,একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে করলে এমন? বিবেকে‌ বাঁধলো না তোমার? আমার ঘৃনা হচ্ছে তোমার প্রতি। জানিনা আল্লাহ কেন তোমার মতো মহিলার গর্ভে পাঠালো‌ আমাকে। এতো অন্যায় কিভাবে করো তুমি? তোমাকে মা ডাকতে লজ্জা করছে আমার।”
রুশানের কথায় চমকে উঠে পেছনে তাকালো‌ তাহমিনা বেগম। রুশানকে সে এই কথাটা জানতে দিতে চায়নি। সে জানে রুশান‌ কতটা ভালোবাসে রুমঝুমকে। রুশান কখনো ক্ষমা করবে না তাকে। রুশান তাকে ঘৃণা করে মা ডাকা বন্ধ করে দিবে ভেভেই তার বুক কেঁপে উঠলো।
তাহমিনা বেগম তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলেন রুশানের দিকে। রুশান দু’পা পিছিয়ে গেলো। কড়া কন্ঠে বললে,
-“কখনো‌ আমার আশেপাশে আসবে না তুমি। আমি ঘৃনা করি তোমাকে।”
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলো রুশান।
তাহমিনা বেগম অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন জীবন রেখে কি লাভ যেখানে নিজের সন্তানই তাকে ঘৃনা করে। তাহমিনা বেগম ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লো। মনে মনে জীবনের সবচেয়ে বড় ডিসিশনটাও নিয়ে নিলো। তবে সেটা কার্যকর করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।
রুশান নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। বিছানায় বসে দুহাতে মুখ চেপে বসে রইলো। কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে তার। কষ্টে বুকের মধ্যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে। তার মা ই কেন এমন হলো? মায়ের এই রুপ কোনো সন্তান কিভাবে সহ্য করে? রুশান নিজেকে সামলে নিলো। এখন তার আপুকে বাঁচাতে হবে। ওই স্বার্থপর মহিলার কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে চলবে না।

দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। শান আর রুমঝুম দু’জনই ঘেমে একাকার। কিছুক্ষণ আগেই ওরা নেভাল থেকে ফেরার উদ্দেশ্যে বাইকে বসেছে। বেশ কিছু পথ আসার পর রুমঝুমের ফোন বেজে উঠলো। রুমঝুম ফোন বের করে দেখলো রুশান কল করেছে। রুশানের কল দেখেই রুমঝুমের ভ্রু কুঁচকে এলো।‌ এমন টাইমে তো‌ রুশান কল করে না। রুমঝুম ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন রিসিভ করলো।
-“হ্যালো, রুশান।”
ওপাশ থেকে থেকে কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না রুমঝুম। ছুটে চলা বাইকের শাঁ শাঁ শব্দে কথা শোনা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুমঝুম শানকে বাইকটা একটু সাইড করে দাঁড় করাতে বললো।শান‌ বাইক দাঁড় করালে রুমঝুম কথা শুরু করলো আবার।
-“হ্যালো, হ্যালো, আপু শুনতে পাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ পাচ্ছি, বল এবার।”
-“আপু আরমান শয়তানটা আবার তোমার খোঁজ পেয়ে গেছে। আপু পালাও তুমি।আবার পালাও।”
রুমঝুম বাইক থেকে নেমে গেলো। আচমকা চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। আর কত সহ্য করবে ও?
রুমঝুমের হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো শান। রুমঝুমের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। রুমঝুম শানের বুকে হেলে পড়ে ঝরঝর‌ করে কেঁদে উঠলো। রুশান তখনও লাইনে আপু আপু করে যাচ্ছে।
শান রুমঝুমকে এক হাতে বুকে আগলে ধরে অন্য হাতে ফোন কানে ধরলো। রুশান আবারও আপু বলতেই শান উত্তর দিলো,
-“আমি তোমার আপু নই। তোমার আপুকে কি বললে যার জন্য সে এভাবে ভেঙে পড়লো?”
রুশান থেমে গেলো। কিছুটা সময় নিয়ে বললো ,
-“আপনি কে? আমার আপুর কাছে কি করছেন?”
-“তোমার আপুর শুভাকাঙ্ক্ষী আমি। তার সুরক্ষা বলয়।”
রুশানের বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। যখন বুঝলো তখন মুখে ফুটে উঠলো স্বস্তিময় হাঁসি। যাক ,তার বোনেরও শেষমেশ কেউ একজন হয়েছে।
রুশানের নিরবতা দেখে‌ শান আবারও বললো,
-“হ্যলো, শুনতে পারছো আমার কথা?”
-“জ্বি ভাইয়া শুনতে পাচ্ছি।”
-“কি সমস্যা হয়েছে আমাকে বলো।”
রুশান একে একে আজকের সব কাহিনী বললো। শানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো সব শুনে। রুশানকে আশ্বস্ত করে শান বললো,
-“তুমি চিন্তা করো না। তোমার আপুকে আমি দেখে রাখবো। নিজের খেয়াল রেখো।”
-“আপনারাও আপনাদের খেয়াল রাখুন ভাইয়া।”
ফোন কেটে রুশান‌ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার কেন জানি আর চিন্তা হচ্ছে না আপুর জন্য। হয়তো তার চিন্তা কমানোর জন্য আরেকজন এসে গেছে‌ তাই।
রুমঝুম শানের বুকে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। শানও রুমঝুমকে আগলে ধরে বসে আছে । রুমঝুম দীর্ঘ সময় পর মাথা তুলে বললো,
-“ও আমাকে পেয়ে গেছে। ও আমাকে নিয়ে আঁটকে রাখবে। জোর করে বিয়ে করবে। অনেক বাজে লোক ও। আমি মরে যাবো এবার । বিশ্বাস করুন, আমি মরে যাবো।
শানের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো রুমঝুমের শেষ কথায়। সে রুমঝুমের মাথা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ধরা গলায় বললো,
-“এমন কিচ্ছু হবে না ,চন্দ্রকন্যা। আমি আছি তো।”
আবারও কিছু সময় নিরবতায় কাটলো। হঠাৎ করেই রুমঝুম দাঁড়িয়ে পড়লো। আচমকা এমন হওয়াতে শান কিছুটা ভড়কে গেলো। সেও উঠে রুমঝুমের মুখোমুখি দাঁড়ালো। রুমঝুমের মুখে চোখের পানি শুকানোর দাগ পরে গেছে ইতোমধ্যে। রুমঝুম শানের চোখে চোখ রেখে বললো,
-“বিয়ে করবেন আমাকে? আজই ।”
শান হঠাৎ এমন কথা শুনে খানিক চমকে গেলো। বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে করবে কিভাবে? আবার রুমঝুমের দিকটাও ভাবতে হবে।
তাছাড়া এখানে না করার কোনো অপশন নেই। বাবার অফিসের অর্ধেক দায়িত্ব তার উপরে। এখন বিয়ে করা তার জন্য কঠিন কিছু না। তাছাড়া ভালোবাসাটাও হালাল হবে আর মেয়েটা শান্তিও পাবে। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বললে তারা অবশ্যই বুঝবে।
শান কোনো কথা না বলে প্রান্তর কাছে ফোন করলো। প্রান্ত ,সিন্থিয়া আর মেঘা ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিলো তখন।
শানের কল দেখে প্রান্ত স্পিকার অন করে টেবিলে রেখে কথা বলা শুরু করলো।
-“হ্যাঁ শান‌, বল।”
-“ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কাজী অফিসে পৌঁছাবি। আমি রুমঝুমকে আজই বিয়ে করবো।”
প্রায় সাথে সাথেই মেঘা কেঁশে উঠলো। শান মেয়েলি শব্দ শুনে বললো,
-“তোর পাশে কে?”
প্রান্ত তখনও ঘোরের মধ্যে। শানের হঠাৎ বিয়ের ডিসিশন তার মস্তিষ্ক এখনো মেনে নিতে পারে নি। প্রান্তকে হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে দেখে সিন্থিয়া ফোন তার দিকে টেনে নিলো।
গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-“আমি,মেঘা আর প্রান্ত আছি এখানে। হঠাৎ এমন ডিসিশন কেন‌ নিলি?”
ভেবে চিন্তে নিয়েছিস?”
শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশানের বলা সবকিছুই খুলে বললো। মেঘা, প্রান্ত ,সিন্থিয়া তিনজনই নির্বাক। এই মেয়েটার কপালটা এমন হলো‌ কেন?
প্রান্ত বললো,
-“কিন্তু আঙ্কেল-আন্টি? উনাদের বলবি না? ”
-“আমি ঝুমকে বউ করে নিয়ে উনাদের সামনে যাবো। বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবেন তারা। তোরা প্লিজ কাজী অফিসে চলে আসিস।”
প্রান্ত উত্তর দেওয়ার আগেই শান ফোন কেটে দিলো। রুমঝুম এতক্ষণ হা করে শানের মুখের দিকে চেয়ে ছিলো। সে ভাবতেই পারেনি যে শান এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে। শান ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকানো মাত্রই রুমঝুম মাথা নিচু করে ফেললো। বিয়ে করতে বলার সময় লজ্জা না‌ লাগলেও এখন বেশ লজ্জা লাগছে।
শান মুচকি হেঁসে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে এলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
-“এখনই এতো‌ লজ্জা পেলে কি করে হবে লজ্জাবতী? আজকে রাতের জন্যও কিছু রাখো। ”
রুমঝুমের এবার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। শান রুমঝুমের মুখভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেঁসে ফেললো।
রুমঝুমের হাত ধরে নিয়ে বাইকে উঠে বসলো। রুমঝুম পেছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো শানকে। মনের মধ্যে অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছে এখন।

-“আমি কাজী অফিসে যাবো না। ”
সিন্থিয়ার কথা শুনে মেঘা আর প্রান্ত দু’জনই বেশ‌ অবাক হলো। সবকিছু জেনেও মেয়েটা বেকে বসলো কেন?
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কেন যাবি না? সবকিছু শোনার পরও বলছিস যাবো না?”
সিন্থিয়া উল্টো দিকে ঘুরে ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বললো,
-” হ্যাঁ যাবো না। আমি চাই না ওদের বিয়ে এভাবে হোক।”
মেঘার এবার রাগ হলো। রুমঝুমের এমন বিপদের সময় সিন্থিয়ার এই রুপ ওর মোটেই ভালো লাগছে না। মেঘা ধপধপ করে এগিয়ে গেলো সিন্থিয়ার সামনে। রাগী মুখে সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বেকুব বনে গেলো। মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে কেন?
সিন্থিয়া হা হা করে হেঁসে উঠলো। দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“দু’জন তো দেখছি আমাকে চোখ দিয়েই গিলে খাবি। আরে আমি আসলেই চাই না ওদের বিয়ে এভাবে হোক কিন্তু এটা তো চাই যে ওদের বিয়ে হোক।”
প্রান্তের ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাঁজ পড়লো‌ সিন্থিয়ার কথা শুনে। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“সরাসরি বল যা বলবি। এভাবে ঘুরায় পেঁচায় বলছিস কেন?”
সিন্থিয়া দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“চল ওদের একটা সারপ্রাইজ দেই।”
মেঘা বললো,
-“কি সারপ্রাইজ?”
এরপর সিন্থিয়া ওদের সবটা বুঝিয়ে বললো। সবকিছু শুনে প্রান্ত আর মেঘার মুখেও হাঁসি ফুটে উঠলো। সিন্থিয়া মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি মেঘা? পারবে তো?”
মেঘা ভাব নিয়ে বললো,
-“আলবাত পারবো।”
সিন্থিয়া হেঁসে বললো,
-“তাহলে কাজ সেরে ফেলো।”
মেঘা ওদের দুজনকে বিদায় জানিয়ে দ্রুতপদে বাড়ির রাস্তা ধরলো।
সিন্থিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রান্তের উদ্দেশ্যে বললো,
-“তিহান‌ আর বিথীকে ফোন‌ দে। হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি করতে হবে সবকিছু।”

শান কাজী অফিস থেকে বেশ দূরে একটা শপিং মলে ঢুকেছে রুমঝুমকে নিয়ে। উদ্দেশ্য রুমঝুমকে একটা শাড়ি আর একটা সোনার নাকফুল কিনে দেওয়া। কিছু না দিয়ে বিয়ে করাটা কেমন দেখায়। অ্যাটলিস্ট একটা নতুন শাড়ি তো পড়ুক।
রুমঝুম শানের পিছু পিছু হাঁটছে আর হাত দুইটা মুচড়াচ্ছে নিজেই। শান একবার পিছনে তাকিয়ে রুমঝুমের অবস্থা দেখে নিলো। আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-” এতো বেশি টেনশন‌ করছো কেন?”
রুমঝুম হয়তো এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।‌ সে ধীর গতিতে দৌড়ে শানের পাশাপাশি এসে হাঁটা শুরু করলো। আড়চোখে একবার শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার বাবা-মা,আন্টি, মেহেদী ভাইয়া এদেরকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে। এরা ব্যাপারটা কিভাবে নিবে বুঝতে পারছি না। আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাববে এরা।”
শান হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো। রুমঝুমের হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুলের জায়গা করে নিয়ে শক্ত করে হাতটা ধরলো। রুমঝুমকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“আমি সব্বাইকে ম্যানেজ করে নিবো দেখো। একটুও ভয় পেয়ো না তুমি।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে মাথা দোলালো।
মুখে এমন কথা বললেও মনে মনে শান বেশ ঘাবড়ে আছে। প্রথমে সবাই কেমন রিঅ্যাক্ট করবে সেটা ভেবেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। মনে মনে প্রার্থনা করছে, সবটা যেন ভালোয় ভালোয় মিটে যায়।
রুমঝুম শাড়ি পছন্দ করার দায়িত্ব শানের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তার মতে,শানের পছন্দ অনেক সুন্দর। জন্মদিনের গাউনটা শান নিজের পছন্দে কিনেছে এটা জানার পরই তার এমন ধারনা জন্মেছে।
শান অনেক খুঁজে একটা সিঁদুর লাল রঙের শাড়ি বের করলো। রুমঝুমেরও বেশ পছন্দ হলো সেটা। শান‌ শাড়িটা কিনে রুমঝুমকে ট্রায়াল রুমে পাঠালো চেন্জ করে আসার জন্য। আর সে পাশের একটা জুয়েলারি দোকানে গেলো নাকফুল কিনতে।
রুমঝুম শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এলো প্রায় সতেরো মিনিট পর। বের হয়ে আশেপাশে শান কে কোথাও দেখতে পেলো না সে। কিন্তু একেবারের জন্যও বুক কাঁপেনি তার। রুমঝুমের দৃঢ় বিশ্বাস,শান কখনোই তাকে ঠকাবে না।
প্রায় চার মিনিট পর শান রুমঝুমের পাশে এসে দাঁড়ালো। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে রুমঝুমকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছো?”
রুমঝুম বললো,
-“পাঁচ মিনিটের মতো।”
-“ভয় পেয়েছো?”
রুমঝুম আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-“ভয় পাবো কেন?”
শান হেঁসে বললো,
-“এই যে তোমাকে বিয়ে না করার জন্য যদি ফেলে চলে যেতাম?”
রুমঝুম হাঁসলো । খুবই চমৎকার সেই হাঁসি। হাঁসির মাধ্যমেই হয়তো বুঝিয়ে দিলো যে সে কতখানি বিশ্বাস করে শান কে।
..
প্রায় একঘন্টা যাবৎ শান‌ আর রুমঝুম কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কারোরই পাত্তা নেই। শান এই পর্যন্ত প্রায় একশোবারের মতো কল করেছে ওদের চারজনকে। একজনও ফোন তুলছে না। শানের এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আর রুমঝুমের হচ্ছে ভয়।
কাজী অফিস থেকে বেশ কিছুটা দূরে পার্কিং এরিয়া। শান সেদিকে তাকাতেই হোঁচট খেলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার।
খানিক দূরেই দেখা যাচ্ছে তার বাবা-মা,মেঘা ,মেঘার মা আর ভাই আসছে।
রুমঝুম তাদেরকে দেখে শানের হাত খামচে ধরলো।
শাফিয়া আক্তার শানের সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ শানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাসস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার বাম গালে।
রুমঝুম কেঁপে উঠলো থাপ্পড়ের শব্দে। শান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার মায়ের দিকে।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here