#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_14+15+16+17+18
ডিসেম্বরের শেষ সাপ্তাহ।চারিদিকে শীতের প্রবলতা বেড়েছে।গ্রামের মানুষগুলোর জন জীবন নির্জিত অবস্থা।সেদিনের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন।আফীফ সম্পূর্ণ পালটে গেছে।তার মাঝে দেখা দিয়েছে গুরুগম্ভীর ভাব।সেহেরিশের সাথেও সামনা-সামনি কথা হয় না বেশ কয়েকদিন।অবশ্য সেহেরিশ নিজেই আফীফের সামনে ধরা দেয় না।নিজেকে পালিয়ে বেঁচেই সুখ পায় সে।গত কয়েকদিন আগের আফীফের সাথে বর্তমান সময়ের আফীফের কোন মিল পায় না সে।এ যেন আট বছর আগের গুরুগম্ভীর স্বার্থপর আফীফ।তার প্রতি আফীফের কেয়ারিং গুলো আরো ভয়ের সঞ্চার করছে।ঠিক আট বছর আগেও আফীফ তাকে আগলে আগলে রাখতো।তাই এই ছেলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব পালিয়ে বাচঁতে হবে।
কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে পাইচারি করছে আফীফ।ব্লাক হাউজের ছাদে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে ঠিকি সেহেরিশকে দেখতে পাচ্ছে সে।তুন্দ্র, কেইন,মৌ,সামী সবাই মিলে গোল মিটিংয়ে বসেছে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় জ্যাকেটের পকেট থেকে আফীফ দ্রুত ফোন বের করে,
– হ্যা জিউ বলো,
– কেমন আছো?কোন খবর নেই তোমার।তাকিয়াকে পেয়ে বুঝি ভুলে গেছো আমায়?
– না ভুলি নি।তবে সমস্যায় আছি।বাড়িতে যে সাম্প্রতিক একটা তুফান বয়ে গেছে তুমি তো জানো না।সেহেরিশকে নিয়ে আমায় হুমকি বার্তা পাঠানো হয়েছে!
– মানে কি?কী বলছো এইসব।সেহেরিশের কিছু হয় নি তো?
– না সে ঠিক আছে।তবে কেউ বা কারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ আমার দূর্বলতা।তাই তাকে দিয়েই তীর ছুড়েছে।
– তোমার এইসব শত্রু,যুদ্ধ,হামলা যাই হোক।আমার জানার দরকার নেই তবে সেহেরিশের যেন কিছু না হয় মাথায় রাখবে।সেহেরিশের সকল তথ্য টাইম টু টাইম আমি তোমায় দিয়েছি।একমাত্র তোমার ভালোর জন্য তোমার সুস্থতার জন্য এখন তোমার স্বার্থ উদ্ধারে মেয়েটির যেন কোন ক্ষতি না হয়।
– হুম,মাথায় আছে আমার।চলো রাখছি পরে কথা হবে।
– গুড বায়।
মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন থাকার পরেও সৌদি থেকে তার আসার কোন নাম গন্ধ নেই।বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে খুরশীদকে।আদৌ কি তিনি জমি পাবেন?এদিকে আর কত দিন পড়ে থাকবে এই বাড়িতে।দেওয়ান বাড়ির লোক তাদের আপন হিসেবে গ্রহণ করলেও লোক লজ্জার ভয় আছে।তাই খুরশীদ সিধান্ত নিয়েছেন কাল পরসূর মধ্যেই ঢাকায় ফিরে যাবেন।
– কেমন কাটছে দিন খুরশীদ সাহেব?
আহনাফ দেওয়ানের প্রশ্নে ঈষৎ হাসেন খুরশীদ।গলাটা ঝেরে কেশে সন্তর্পণে বলেন,
– ভাবছি অনেকদিন হয়ে গেছে এবার আমাদের ফেরা উচিত।আমাদের বরং এবার যাওয়ার অনুমতিটা দিয়ে দিন আপনি।
– যাবেন মানে?কোথায় যাবেন?
– ঢাকায় ফিরতে চাইছি আমরা।এইভাবে আর কতদিন থাকবো এখানে?আপনাদের বাড়তি ঝামেলা হিসেবে পড়ে আছি।
– ছি! এইসব বলে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না আপনি।আমি ভালো করেই জানি আপনারা আরো বেশ কিছু মাস বাংলাদেশে থাকবেন বাংলাদেশে যতদিন আছেন ততদিন এখানেই থাকবেন।ঢাকা যান সিলেট যান যেখানেই যান আপনার নির্দিষ্ট বাসস্তান হবে এই দেওয়ান মঞ্জিল।
– মাফ করবে আমায়!আপনাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ আমি এবার আমার ফেরা দরকার।
খুরশীদ আনওয়ারের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আহনাফ।তিনি ভালো করেই যানেন আফীফ জানতে পারলে বেশ রেগে যাবে তাই খুরশীদ আনওয়ারের উদ্দেশ্য অনুনয় সুরে কিছু বলার আগেই আফীফের আগমন লক্ষ্য করা যায়।
– শুভ সকাল আঙ্কেল।শুভ সকাল দাদাজনা।
– তোমার আঙ্কেল কি বলছে যানো তুমি?সে নাকি চলে যেতে চাইছে এখানে তার কাছে বেশি দিন থাকতে অস্বস্তি লাগছে।
আহনাফ দেওয়ানের কথায় চোখ বন্ধ করে নিলো আফীফ।গাঢ় করে শ্বাস টেনে গমগম সুরে বলেন,
– আজকের মতো শেষ বার বলছি আপনাদের এখানেই থাকতে হবে।যদি কোন দিক দিয়ে কারো ব্যবহারে মনে কষ্ট পান তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আপনাদের সুবিধার জন্য সকল ব্যবস্থা করা হবে তবুও এখানে থাকতে হবে।
আফীফের গমগম সুরের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান খুরশীদ।
____
দুপুরের খাওয়ার বাড়ির সকলেই শেষ করে যে যার কাজে চলে গেলেও সেহেরিশ ঘুমিয়ে থাকার কারনে আজ দেরিতে খেতে বসেছে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো সামনে আফীফকে দেখে।বাইরের কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আফীফ তার বরাবর চেয়ারটায় খেতে বসে।তারপর থেকেই সেহেরিশের দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সামনে বসে থাকা গুরু গম্ভীর মানুষটার দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো সেহেরিশ।এই মানুষটাকে দেখলে কেন যে তার ভয়ে আত্না কেঁপে উঠে কে জানে?হয়তো অতীতের ভয়,নয় তো বা মনের ভ্রম!লোকটার ভাব গম্ভীর দেখে সেহেরিশের হাত কাঁপতে থাকার কারনে, হাতে থাকা কাটা চামচটা প্লেটের সাথে ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। এমন শব্দে সেহেরিশ নিজেও ভড়কে যায়।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে দ্রুত খাওয়ার থালাটা রেখে উঠে যায় কিচেনের দিকে।
এই মূহুর্তে এখানে থাকা বিপদজনক।শুধু বিপদজনক নয় মহা বিপদজনক।
বেসিনের পানিতে হাত ধৌত করার সময় সে অনুভব করে তার গলায় ঘাড়ে কারো উত্তপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস আছড়ে পড়ছে।হঠাৎ সেহেরিশের অনুভূতি গুলো জেনো ভাঁতা হয়ে গেছে।ডানে-বামে না তাকিয়ে দ্রুত পেছনে ঘুরতেই আফীফকে তার সামনে দেখতে পায়।ছেলেটি একদম তার সামনে কিঞ্চিৎ দূরত্বে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে।
– খাওয়ার নষ্ট করে চলে এলে কেন?
আফীফের গুরুগম্ভীর ধারালো তীক্ষ্ম কন্ঠে হুশ ফিরে তার।
– আমার খিদে ছিল না!
সেহেরিশ দ্রুত তার চোখ নামিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই সে অনুভব করে তার গালে ঠান্ডা ধারালো কিছুর আঁচড়।চমকে তাকাতেই আফীফের হাতে একটি ছুরি দেখতে পায়।যে টি আফীফ সেহেরিশের গালে স্লাইড করছে।
– কী করছেন কি আপনি?
– কৃষকের কষ্টের পরিশ্রমের খাদ্য নষ্ট আমি মোটেও পছন্দ করি না সেহেরিশ আনওয়ার।আমার নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্যে কারো নেই।এই বাড়িতে এক চিমটে অন্ন ও এঁটো হয় না সেখানে তুমি অর্ধ-থালা ভাত… থাক,আজকের জন্য মাফ!কিন্তু আগামী দিন গুলোতে আর নয়।
সেহেরিশ মাথা নুইয়ে নেয়।কিছুক্ষণেই তার কপালে ঘামের রেশ দেখতে পাওয়া গেছে।সেদিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।হাতে থাকা ছুরিটি আলতো করে সেহেরিশের গলায় চেপে ধরে।মেয়েটি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চমকে তাকালে,আফীফ আরেকটু ঝুঁকে বলে,
– রমণীর ভয়ার্ত চোখে এ’কোন জাদু আছে, যে সমীপে টানছে আমায়?ভয় পাচ্ছো কেন?আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ!কখনো বকেছি তোমায়?রাগ দেখিয়েছি?তবে ভয় কিসের?
সেহেরিশ মূঢ়তা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কী বলবে সে?কী করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
আফীফ তার হাতের ছুরিটা আরেকটু জোরে ধরতেই সেহেরিশ চোখ বন্ধ করে নেয়।ভয়ে কাঁপাকাঁপা দুই হাতে আফীফের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়।তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরিটি হাত ফসকে আফীফের পায়ে পড়ে যার ফলে পায়ের পাতার উপর কোপের মতো ছুরিটি দাঁড়িয়ে যায়।লাহমায় রক্তে আফীফের পা ভেসে যায়।সেদিকে তাকিয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।
ভয়ে তার দু-চোখের পানি টলমল করছে।কিছু বলতে গিয়েও বার বার থেমে যাচ্ছে।
– খুন! খুন করতে চাইছো আমায় সেহেরিশ?খুনের শাস্তি কী জানো?মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।সাদৃশ্য খুন আমায় তুমি না করলেও অদৃশ্য খুন তুমি করেছো।তাই তো তোমার যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থায় আছি।উহু’হ,ভয় পেয়ো না আমার শাস্তিটা ভিন্ন মাত্রার। অন্তরিন,অন্তরিন…..
থাক বাকিটা পরে জানতে পারবে।
আফীফ সেহেরিশের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।তার নাক এবং ঘামাক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
– বাঙালিরা কি যেন বলে?নাক ঘামালে বর বেশি ভালোবাসে,বেশি আদর করে?তোমার নাক তো দেখি নোনা সমুদ্র হয়ে গেছে।বরের এত আদর, ভালোবাসা সহ্য হবে তো তোমার?
আফীফের ঠোঁট কাটা কথায় সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।লাহমায় কিছু বলতে নিলেই আফীফ খুড়ে খুড়ে সেখান থেকে চলে যায়।সেহেরিশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো।এই মানুষটাকে সে বুঝে না।কেমন কেমন কুটিলতা তার মাঝে।
—
লজ্জায় আড়ষ্টতায় সেহেরিশকে মুড়িয়ে দিয়েছে আজ।আফীফের ব্যবহার তবে সত্যি পাল্টেছে।আগের মতো হাসে না আগের মতো ভয় দেখায় না কেমন যেন কথার মারপ্যাঁচে বার বার ফেলছে তাকে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার।মারুফার রুমে বসে চিন্তায় মগ্ন সে।
– কি রে সেহেরিশ তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– কেমন ফুফি?
– তুই কী কোন বিষয়ে ভয় পেয়েছিস?তোকে আতংক গ্রস্ত দেখাচ্ছে।
সেহেরিশ থামে চুপচাপ মারুফার কোলে সটান করে শুয়ে তার দু হাত টেনে নেয়।
– ফুফি আফীফ কেমন যেন হয়ে গেছে।
– কেমন?
– ঠিক আগের মতো।এক চোখে রাগ অন্য চোখে ভালোবাসা,যত্ন।
– এইসব তোর মনের ভ্রম। যত তাড়াতাড়ি এই বাড়ি থেকে যেতে পারবো তত তাড়াতাড়ি মুক্তি।
– হুম তাই যেন হয়!
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৫
আফীফের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছে সেহেরিশ।দুপুরের পর আফীফের আর দেখা মিলেনি কোথায় আছে কে জানে।তখন পা’য়ে এমন ভাবে ছুরিটা কোপ পড়ছে ভাবতেই সেহেরিশের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।মানবিক কারনে হলেও আফীফকে এই মূহুর্তে একবার দেখা জরুরি।কিন্তু আফীফের দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া কোথায় আছে কোন খোঁজ পাচ্ছে না সেহেরিশ।বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলে এখন বিষয়টি কেমন যেন দেখায় তাই আফীফের রুমের সামনেই পায়চারি করছে সে।
কিছুক্ষণ পর আমানকে দেখে সেহেরিশ এক ছুটে তার কাছে যায়।
– আমান!আমান!
– হ্যা আপু বলো।
– তোমার ভাইয়া কই?আই মিন আফীফ।
– ভাইয়া তো মনে হয় ছাদে গেছে।
– আজ তো প্রচুর শীত,শৈত্যপ্রবাহ। এমন ঠান্ডায় ছাদে কি করছে?
– তা তো আমি জানি না আপু।ভাইয়া আমাকে বলেছিল তার জন্য কফি নিয়ে যেতে আর ছাদের দিকে যেন কেউ না আসে।ভাই একা থাকতে চায়।
– আমি গেলে কি কিছু হবে আমান?
সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে ঠোঁট চেপে হাসে আমান।
– কি বা হবে তুমি বলো?
– যদি ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় আমায়?তখন কি করবো?
– তবে আবার ভাইয়া তুলে নেবে সমস্যা নাই তুমি যাও বাকিটা তোমার দেওর সামলে নেবে?
– মানে?
– না না না না কিছু না কিছু না তুমি যাও আপু।সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
সিড়ি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছাদে প্রবেশ করবে কি করবে না বলে দ্বিধা সংশয়ে ভুগছে সেহেরিশ।আড়াল থেকে আফীফের অস্তিত্বর দেখা মিললো না।সংশয়কে দূরে ঠেলে দ্রুত ছাদে প্রবেশ করে সে।চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা ভিড়ানো দেখে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসে।
আফীফ পুরোনো একটি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।পায়ের রক্তে ভিজে আছে ব্যান্ডেজটা।শার্টের হাতা ফোল্ড করে বাম হাত কপালের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে।তাকে দেখে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে সে কোন কারনে বেশ চিন্তিত।কিন্তু রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ দেখে সেহেরিশের গা শিউরে উঠে।
– একি আপনি এখনো এই পা নিয়ে বসে আছেন?ডাক্তারের কাছে কে যাবে?
বেগবান গতিতে সেহেরিশের কথায় তড়াক করে তাকায় আফীফ।কপালে ছুঁয়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।
– এখানে কেন এসেছো তুমি?
– আপনার পায়ের এই অবস্থা আর আপনি নরমাল ভাবে ব্যান্ডেজ করে বসে আছেন?আপনার কুইকলি স্টেচ করা প্রয়োজন।তা না হলে ইনফ্যাকশন হবে।
– হলে হবে আমার কোন সমস্যা নেই।
– আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন।বিশ্বাস করেন আমি জানতাম না ছুরিটা এইভাবে আপনার পায়ে লাগবে।
– ইট’স ওকে।সমস্যা নেই।
– তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন?
– মাঝে মাঝে নিজের শরীরে আঘাত দিয়ে মনের চাপা রাগ মেটানো যায়।আর মনের চাপা রাগ কেটে গেলে প্রফুল্ল লাগে।যানো তো মেঘ কেটে গেলে আকাশটা কেমন পরিষ্কার শুভ্র লাগে!
আফীফের এমন উওরে ফস করে শ্বাস ছাড়লো সেহেরিশ।সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আফীফ এখন তর্কে লেগেছে সহজে এই তর্ক ছাড়বেনা।
– আপনি উঠুন প্লিজ।ব্যান্ডেজ করা স্বত্তেও এখনো রক্ত ঝরছে।আম সরি আসলে বিষটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে গেছে।
সেহেরিশের কথায় পাত্তা দিলো না আফীফ।বরং পায়ে থাকা ব্যান্ডেজটা সহসা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আফীফের রক্তাক্ত ক্ষত স্থান দেখে আর্তনাদ করে উঠে মেয়েটি।
– প্লিজ প্লিজ এমন করবেন না।দ্রুত পা ঢাকুন আমার রক্ত সহ্য হয় না মাথা ঘুরায় এক কথায় রক্তে আমার ফোবিয়া আছে প্লিজ আপনি এসব পাগলামি করবেন না।
সেহেরিশ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো শেষ করে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে।মনে মনে আফসোস সুরে বলে,
– এখনো তবে রক্ত ভয় পাও।
– মি.আফীফ আপনার সমস্যাটা কি বলবেন আমায়?কাটা পা নিয়ে এভাবে বসে থাকার মানে কি প্লিজ আপনি ডাক্তারের কাছে যান।
সেহেরিশের ধমকের সুরে কথায় সৎবিৎ ফিরে আফীফের।গায়ের চাদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে আরাম করে গা এলিয়ে বসে।আফীফের এমন অঙ্গ ভঙ্গিতে বেশ রাগ লাগে সেহেরিশের।বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে আবারো বলে উঠে,
– ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে আপনি করুন আমি মুনিফ ভাইকে ডাকছি তিনি আপনার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করবেন।
সেহেরিশ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আফীফ দ্রুত উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে হেচঁকা টান দিয়ে সোফায় ছুড়ে মারে।পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজায় দ্রুত তালা মেরে দেয়।আফীফের কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে যায় সেহেরিশ।এদিকে পায়ে চাপ লাগায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিচে নেয় আফীফ।
– এইসবের মানে কি মি.আফীফ?
– কোন মানে নেই।
– তাহলে দরজা বন্ধ করলেন কেন?
আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।সেহেরিশের পাশে আবারো আয়েশ ভঙ্গিতে বসে যায়।কিন্তু পায়ের ব্যথায় মুষড়ে উঠছে সে।চোখে মুখে লালভাব ছড়িয়ে আছে।সেহেরিশ আহাম্মক বনে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।আফীফ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়।
– জানো সেহেরিশ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে পায়ের ব্যাথায় পা নাড়াতেও পারছি না।
– আগেই বলেছিলাম এইসব নাটকের কোন মানে নেই ডাক্তারকে খবর দিন।সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমার শীত করছে তাছাড়া রুমটাও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমি বাইরে যাবো চাবি দিন।মুনিফ ভাইয়ে পাঠিয়ে দেবো।
– আমার কিন্তু খুব কষ্ট সেহেরিশ তুমি এমন না করলেও পারতে।
আফীফের ঠোঁট খিচে আসা কথায় সেহেরিশ ভয় পেয়ে যায়।আফীফের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো ভয়ে কুঁকড়ে উঠে।
– প্লিজ আপনি চাবিটা দিন আপনার পায়ের অবস্থা মারাত্মক খারাপ।আমার উপরে রেগে আছেন আপনি তা আমি বুঝতে পারছি তাই বলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।
– আমি বাইরে যাবো তবে একটা শর্ত আছে।
সিরিয়াস মুডে আফীফের এমন কথা কিছুতেই সহ্য হয়নি সেহেরিশের।ধুপ করে মাথায় চেপে যাওয়া রাগটা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে তার।যার দরুনে আফীফের কলার টেনে ধরতেও দ্বিধা করে নি সে।
– তোর সমস্যা কি?পায়ের এমন বেহাল দশা করে আমার উপরে দোষ ফেলতে চাস?একা আছিস মেরে তক্তা করে দিতেও দু’বার ভাববো না।
– বাহ বাহ সাহস দেখি তাল গাছে উঠে গেছে।আমাকে তুই করে বলা হচ্ছে।এই মেয়ে এই আমাকে তুমি চিনো কলার ছাড়ো দ্রুত!
আফীফের ধমকে সেহেরিশের সৎবিৎ ফিরে আসে।তার আচরণে সে নিজেই লজ্জিত।হাটুতে হাত রেখে মাথা নুইয়ে বিড়বিড় করে আফীফকে বকতে থাকে।আফীফ তার মাথায় হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমার একটা শর্ত আছে মিস সেহেরিশ তবেই আমার পায়ের আঘাতের বিষয়ে আপনাকে দোষ দেবো না আর আমি ডাক্তার দেখাবো।
– বলুন আপনার কি শর্ত?
– আমাকে আলিঙ্গন করে দুইটা শব্দ বলবেন।
– ছিহহহ এই ছিল আপনার মনে?আপনাকে আমি আলিঙ্গন করবো কোন দুঃখে?
– কেন কেইন, তুন্দ্রকে হুট হাট যে জড়িয়ে ধরো তখন বুঝি ছিহহ লাগেনা?
– ওরা আমার বন্ধু।বোকার মতো কথা বলবেন না।
– আমিও তোমার বন্ধু, বিশেষ বন্ধু। নাও জড়িয়ে ধরো।না হলে আজ পায়ের চিকিৎসা করাবো না।দায় তোমার আর আমার পরিবার আমার প্রতি ভিষণ ইউক এবার যদি আমার কিছু হয়ে যায় তুমি ফাসবে।
সেহেরিশ গোমড়া মুখে আফীফের দিকে তাকায় আফীফের তার দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে।
– আপনার শর্তটা চেঞ্জ করুন আফীফ দেওয়ান।এটা ছাড়া বাকি সব শর্ত মেনে নেবো।
– সত্যিত?
-পাক্কা সত্যি।
– ঠিক আছে।এবার থেকে আমার সব কথা শুনে চলবে যাও চাবিটা নিয়ে দরজা খুলো।
সেহেরিশ হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়।আটকে আসা শ্বাসটা ছেড়ে চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আবার হঠাৎ হেঁচকা টান খায়।তৎক্ষনাৎ আফীফ তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।আফীফের মুখে সেহেরিশের পড়ে থাকা চুল গুলোতে গাঢ় করে শ্বাস নেয়।কানের কাছে ফিসফিস করে আবেগী সুরে বলে
– মিস সেহেরিশ ইয়া তেবয়া লিউব্লিউ!
– এহহহ
– হ্যা।
—–
সকাল সাতটায় আফীফের নির্দেশে ঘুম ভাঙ্গে সেহেরিশের।আফীফের পরিবারের কিছু সংখ্যাক সদস্য ঘুম থেকে উঠে গেলেও সেহেরিশের পরিবারের কেউ এখনো উঠে নি।আর তাই সেই সুযোগটা কাজে লাগায় আফীফ।সেহেরিশ ফ্রেশ হয়ে আসলে তাকে পাঠিয়ে দেয় কিচেনে চা তৈরির জন্য কিন্তু বেচারি সেহেরিশ এই জীবনে প্রথম চা বানানোর উদ্দেশ্য রান্না ঘরে প্রবেশ করে।দরজায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে সেহেরিশের কান্ড দেখছে আফীফ।
– আজকে সকালের চা টা কি আমি সত্যি পাবো নাকি না?
আফীফের কথায় আড় চোখে তাকায় সেহেরিশ।
– এত কথা বলছেন কেন?আপনি জানে না আমি চায়ের “চ” পারি না আর আপনি আমায় সাত সকালে চায়ের জন্য কিচেনে পাঠিয়ে দিলেন।অদ্ভুত লোক আপনি কোন জনমের শত্রু ছিলাম আপনার বলুন তো?
– কোন জনমের শক্র ছিলে জানি না তবে এই জনমের প্রিয়তমা হয়ে থেকো।
আফীফের ফিসফিসে কন্ঠের কথা সেহেরিশের কর্ণকুহরে পৌছালো না।
দুজনে দুইকাপ চা হাতে পুকুর পাড়ের সিড়িতে বসে।আফীফ নিরিবিলি সেহেরিশের তৈরি পানসে চা টা আনন্দের সাথে গিলছে কিন্তু সেহেরিশ একবার মুখ কুচকে চায়ের দিকে তাকায় অন্য বার আফীফের দিকে তাকায়।
– পুকুর পাড়ে শীত বেশি চলুন আমরা বাগানের দিকটায় যাই।
– চলো তবে।
সেহেরিশ এবং আফীফ দুজনে বাগানের দিকটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় হঠাৎ মাঝারি আকারের একটি ইটের টুকরো দেয়ালের বাইরে থেকে কেউ সেহেরিশের মাথায় ছুড়ে মারে।সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার চোখ নাক ভাসিয়ে দিচ্ছে আর সেদিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে যায় আফীফ।সেহেরিশের মাথাটা দ্রুত চেপে ধরতেই তার পায়ের সামনে একটি কাগজের দলা পড়ে।
আফীফ দ্রুত কাগজটি তুলে পড়া শুরু করে,
” খুব শীঘ্রই প্রিয় মানুষ হারানোর আর্তনাদে ছড়িয়ে যাবে বাতাসের বেগে!”
আফীফ চিঠিটার মানে বুঝতে পেরে দ্রুত সেহেরিশকে আঁকড়ে ধরে।এদিকে রক্তের ফোয়ারা দেখে সেন্সলেস হয়ে যায় সেহেরিশ।
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৬
দীর্ঘ দিন পর আজ রোদের দেখা মিলেছে।সেহেরিশ বিছানায় হেলান দিয়ে আফীফের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।তার মুখের উপর আছড়ে পড়ছে সকালের সেই মিষ্টি রোদ।কেইন তুন্দ্র তার পাশে বসে আছে দুজনেই সমান তালে সেহেরিশকে জিজ্ঞাসাবাদে ব্যস্ত।
– হোয়াটি’স দিস সেহেরিশ?
কেইনের রাগান্বিত স্বরের কথায় হাসি থামিয়ে দেয় সেহেরিশ।কেইনের উপর পূর্ণ দৃষ্টি রেখে সহসা জবাব দেয়,
– কি হয়েছে হঠাৎ রেগে গেলি কেন?
– তোকে তখন থেকে বার বার একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি এন্সার দিচ্ছিস না কেন?আর এত হাসির কি হলো?
– ক…কি জানতে চাইছিস আবার বল।
সেহেরিশের এমন হেলাফেলা কথায় ফস করে শ্বাস ছাড়লো তুন্দ্র।সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত সেহেরিশের পাশে বসে তার হাতে হাত রাখলো।
– তোর মাথার এই বেহাল দশা কি করে হলো? তুই বলেছিস পা পিছলে পুকুর পাড়ে পড়েছিস কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।আর এত সকাল সকাল ঘুম থেকে তোকে আমি উঠতে খুব কম দেখেছি তবে আজ কেন উঠলি?
– এমনি আমার ঘুম আসছিল না তাই উঠে গিয়ে একটু বাইরে পাইচারি করছিলাম।আমি ঠিক আছি তোরা চিন্তা করিস না।
সেহেরিশের কথা শেষ হতেই ক্ষিপ্র গতিতে তার পাশে এসে দাঁড়ালো কেইন।রাগে ফসফস করতে করতে সেহেরিশের দিকে আরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
– চিন্তা করবো না মানে কি?তোর কতখানি লেগেছে তুই জানিস?আঙ্কেল-আন্টি ফুফি অলরেডি কান্না করতে করতে বেহুশ হওয়ার উপক্রম আর তুই হাসছিস?তুই জানিস তোর জন্য আমাদের কতটা চিন্তা হচ্ছে।
– তুই ঠিক বলেছিস কেইন। সামান্য হাতে চোট পেলে আমাদের কান গরম করে ছাড়ে আর এই মেয়ের আজ মাথা এতটা ফেটে গেছে অথচ সে মিটিমিটি হাসছে।ইচ্ছে করছে থাপড়ে গাল লাল করে দিতে।
তুন্দ্রের ধমকে নিজেকে শুধরে নেয় সেহেরিশ।আফীফ সোফায় হেলান দিয়ে এতক্ষণ সেহেরিশের ওষুধ গুলো চেক করছিল।সেহেরিশের মুখের হাসিটা মোটেও তার কাছে স্বস্তির লাগে নি বরং বিষদিগ্ধ লেগেছিল।আফীফ উঠে দাঁড়ায় খুড়ে খুড়ে সেহেরিশের সামনে দাঁড়িয়ে আদেশ বাণী ছুড়ে দেয়,
– আপনার মেডিসিন গুলো আমি চেক করে নিয়েছি।টাইম টু টাইম মেডিসিন নেবেন।আর মর্জিনা খালাকে বলছি আপনার জন্য স্যুপ করে পাঠাবে।
আফীফ আবারো খুড়ে খুড়ে হাটতে শুরু করে তার হাটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে যায় তুন্দ্রের।তার মাথার ভেতরে সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠেছে।
– এক সেকেন্ড ব্রো।
তুন্দ্রের কথায় পেছনে ঘুরে তাকায় আফীফ।তৎক্ষনাৎ তুন্দ্র তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
– কাল তোমার পায়ের এই অবস্থা আর আজ সেহেরিশের।ওইদিন বাড়ির কুকুর গুলোর এমন অবস্থা মানে আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।এই বাড়িতে এত বিপদ এক সঙ্গে কেন?তাছাড়া তোমার পায়ের ক্ষতটা কি করে হলো, কাউকে বললে না তো?
আফীফ ঘুরে সেহেরিশের দিকে তাকায়।তারপর আবার তুন্দ্রের দিকে চোখ ছোট করে গমগম সুরে বলে,
– পায়ের ক্ষতটা করেছে একটা জংলী বিল্লি।
আফীফ খুড়ে খুড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এদিকে সেহেরিশ,কেইন,তুন্দ্র হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।
—-
ভরদুপুর আফীফ গ্রামের খুটিনাটি কাজ শেষে বাড়ি ফিরেছে।ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই কাকাতুয়ার ডাক তার কানে আসে,
– রাজা তোমার ফুলপরি।রাজা তোমার ফুলপরি।
কাকাতুয়ার কথায় তড়াক করে উঠে বসে
আফীফ।কাকাতুয়া পাখিটি জানলার রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে সমান তালে কথা বলছে।
– কিরে কি বলছিস তুই?ফুলপরি কোথায়?
– রাজা তোমার ফুলপরি বাগানে।
– কি?এই মেয়ের সাহস কম না এখন বাগানে কি করে সকালেই হামলা হয়েছে আর এখন..উফফ কাকে বোঝাই আমি দুঃখের কথা।
আফীফ উঠে যায়।তখনি পাখিটি উড়ে এসে আফীফের কাধে চড়ে বসে।
– এই তুই যাবি না কি আমার সঙ্গে?
– যাবো যাবো ফুলপরির কাছে যাবো।
– চুপ খবরদার সেহেরিশের সামনে তাকে ফুলপরি বলবি না তাহলে তার অতীত মনে পড়ে যাবে সে বুঝে যাবে আমি তাকে চিনে ফেলেছি।
– তবে তাই হবে তাই হবে।
– হুম চল।
আফীফের কাধে চড়ে পাখিটি এই প্রথমবার সেহেরিশের মুখোমুখি হবে।গত কয়েকবছর আফীফ পাখিটিকে সেহেরিশের সম্পর্কে সব বুলি ফুটিয়ে নিয়েছে।অতীতে সেহেরিশের কাকাতুয়া পাখিটি মেরে আফীফ যে ভুল করেছে তা নিয়ে একটুও আফসোস হয় না তার।কেননা আফীফের ভুলের মাধ্যেমেই সে কুলে ফিরেছে।সেহেরিশকে তার জীবনে পেয়েছে।
সেহেরিশ আর মৌ বাগানের দোলনায় দুলছে।বাড়ির দৌবারিকদের কঠোর পাহারা থাকায় নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে আসে আফীফ।
– এই মেয়ে এখানে কি?তোমার বিশ্রাম নেওয়ার কথা ছিল।
আফীফের কন্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সেহেরিশ। আফীফ মৌয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই এক দৌড়ে মৌ সেখান থেকে চলে যায়।
– মৌ চলে গেল কেন?
সেহেরিশের ঝাঝালো কন্ঠে আফীফ এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে।
– বড়দের কথার মাঝে বাচ্চাদের উপস্থিত আমি পছন্দ করি না।
“ঠিক বলেছো রাজা ঠিক বলেছো!
আফীফের কথায় তাল মেলায় পাখিটি আর সেদিকে তাকিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশ।সেহেরিশ উঠে দাঁড়াতেই পাখিটি উড়ে সেহেরিশের কাধে চড়ে বসে।
– ওয়াও! কি কিউট।
– তোমার নাম বলো তাকে দেখবে সে তোমার সাথে কথা বলবে।
সেহেরিশ তার নামটা কাকাতুয়ার উদ্দেশ্য বলতেই কাকাতুয়া সেহেরিশের নাম ডেকে প্রত্যুত্তর করলো।সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠলো সেহেরিশ।পাখিটির সাথে এতটাই খুনশুটিতে মেতে ছিল সে যে মুখ ফসকে আফীফকে অতীতের কথা বলে বসে,
– জানেন আমার একটা পাখি ছিল কিন্তু পাখিটিকে একটা….
সেহেরিশ থেমে গেলো।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে আছে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে।
– একটা?
– না কিছু না।
– সকালে তখন হাসছিলে কেন?
– হাসছিলাম কারন গতকাল আমাকে খুনি বলেছেন কারন আপনার পায়ে ছুরিটা পড়ায় কিন্তু আজ সকালে আমাকে এখানে ডেকে এনে এইভাবে ইট দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিলেন।রিভেঞ্জ নিয়েছেন বুঝি এখন কি আমি আপনাকে খুনি বলবো?
– কি সব যা তা বলছো তুমি?তোমার মাথা ফাটাবো কেন আমি?
– কাল যে আপনার পায়ে আমি ভুলবশত ছুরির কোপ দিয়েছিলাম হয়তো সেই রিভেঞ্জ নিলেন।
সেহেরিশের এমন যুক্তিহীন কথায় বেশ রাগ হলো আফীফের।রাগান্বিত হয়ে সেহেরিশের সামনে দু পা এগিয়ে ঘাড় নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ইচ্ছে করছে কষিয়ে দুইটা চড় দিতে।
আফীফের ধমকে সেহেরিশ হকচকিয়ে উঠে।আফীফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সেহেরিশের কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে,
– এখন তো আমার অধিকার নেই যদি কখনো অধিকার থাকেও তবে ভুলেও তোমার গায়ে হাত তোলার সাহস করবো না।যদি অতিরিক্ত মাত্রায় সীমা লঙ্ঘন করো তবে আমার কিচ্ছু করার নেই। নিজের অজান্তে হলেও দু-চারটা চড় তোমার গালে পড়তে পারে।আফীফ দেওয়ানের দৈর্য্য সম্পর্কে তুমি জানো না আমাকে দৈর্য্যহীন করার জন্য তোমার এই বোকা বোকা কথা গুলাই যথেষ্ট।আর আমার দৈর্য্যর বাদ ভেঙ্গে গেলে কি হয় তুমি নিজেও জানো না।
আফীফের এমন কথায় কোন প্রত্যুত্তর করতে পারলো না সেহেরিশ।শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
___
চন্দনপুরে সেহেরিশের আরো বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে এদিকে অনন্তপুরের রমিজ মিয়ার আসার কোন নাম নেই তার অপেক্ষায় দিন গুনছে মুরশীদ আনওয়ার।আফীফ আর সেহেরিশের সম্পর্কটা এখন কিছুটা স্বাভাবিক।আড়াল থেকে সেহেরিশ নিজেই এখন আফীফকে অনুসরণ করে।আফীফের ধমক, বারণ,গম্ভীরতা,হাসি,খেয়াল রাখা, সব কিছুই সেহেরিশের মাঝে অন্যরকম অনুভূতির জানান দেয়।এদিকে কেইন সেহেরিশের বেখেয়ালি আচরণ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে কিন্তু কেন এমন হচ্ছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
কিন্তু মারুফা সবটাই বেশ সুক্ষ্ম নজরে খেয়াল করেছেন তাই তিনি আজ সেহেরিশকে আলাদা করে বাড়ির বাইরে নিয়ে যান। গ্রামের রাস্তায় হাটতে হাটতে প্রথমেই কথা শুরু করে সেহেরিশ।
– এই গ্রামটা আসলেও সুন্দর তাই না ফুফু?
– হুম।জানিস সেহেরিশ আমাদের পাশের গ্রামটাই ছিল অন্ততপুর।সেখানেই আমি বড় হয়েছি তোর বাবা বড় হয়েছে।তারপর তোর বাবার বিয়ে হয় কয়েক বছর পর আমাদের ঘর আলো করে তুই এলি এর মাঝে আমার বিয়েটা হয়ে যায় তোর ফুফার সঙ্গে।আমাদের কোন দিক দিয়েই অভাব ছিল না।আমরা সে সময়ে ছিলাম সমৃদ্ধশালী পরিবার।হুট করেই বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় আমাদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করে।তুই,ভাবি আর ভাইজান তখন তোর নানার বাড়ি ছিলি।আমি আর আব্বা,আম্মা তোর ফুফা মিলে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।শহরের কাছাকাছি হাসপাতাল।। আসতে যেতে সময় লাগতো বেশ। বাসের জার্নি আম্মার সহ্য হতো না। যেহেতু আম্মা অপারেশনের রোগী ছিলেন তাই আমরা মাইক্রোবাস ভাড়া করি।নিয়তির বিচারে আসার পথেই এক্সিডেন করি আমি বেঁচে গেলেও বাকিরা বেঁচে ফিরে নি।সেইসব কথা মনে পড়লে এখনো আমার আসমান জমিন ভাগ হয়ে যায়।এই জীবনে মাত্র আল্প কয়েক বছর সংসার করেছি তারপরেই আমার জীবনটা হয়ে গেলো সাদা কাপড়ে বন্ধি।
মারুফা থামলো তার চোখের কোনে জল চিকচিক করলেও চোখের কার্নিশ বেয়ে তা বের হলো না।পুরনো কথা মনে পড়ায় সেহেরিশের বেশ মন খারাপ হলো।
– ফুফি আবার এইসব ভেবে কষ্ট কেন পাচ্ছো তুমি?
– সেহেরিশ আমি তোর আর আফীফের ঘনিষ্টতা লক্ষ্য করেছি।আমায় যদি মূল্য দিয়ে থাকিস তবে আল্লাহর দোহায় তুই এই ছেলের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দে।আফীফ দেওয়ান যে তোকে চিনে ফেলেছে তুই কি তা বুঝতে পারছিস না?
– ক.কি বলছো এইসব?
– ঠিক বলছি আমি।একবার ভেবে দেখ যেই পুরো গ্রাম দখলে রেখে পরিচালনা করে।সে তোকে চিনবে না এতই সোজা নাকি।তোকে দেখার দুইদিনের মাথায় এত আদর সোহাগ ভাব সেই ছেলের কি কোন সাধারণ মতলব আছে।যে ছেলে এতটা সূক্ষ্ম মস্তিষ্কের অধিকারী সেই ছেলে বুঝি তোকে ভুলে গেছে মাত্র আট বছরে?তোকে ফেস টু ফেস দেখে হলেও চেনার কথা
ভুলে গেছিস পারভিনের কথা?পারভিন আমায় বলেছিল যাকে আফীফ দেওয়ান শাস্তির কাঠগড়ায় দাড় করায় তাকে শাস্তি দিয়েই ছাড়ে কিন্তু তোকে মাফ করার কারন কী?তোর সাথে খারাপ কিছু করেনি বরং নিজের কাছে রাখতে চেয়েছে।এই ছেলে যে তোকে চিনতে পেরেছে আমি ভালো করেই জানি।
– এইসবের মানে কি ফুফি তুমি আমায় আগে বলো নি কেন?
– আমি জানি তোকে জানালে তুই তখনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য প্রতিক্রিয়া করবি।এতে আফীফ আমাদের উপর রেগে যাবে।সে যে আমাদের কৌশলে ওই বাড়িতে বন্ধি করে রেখেছে আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি।একটা কথা বলি আফীফের সঙ্গ ছেড়ে দে।আমি তোকে ছোট থেকে মানুষ করেছি।আমি জানি তুই কেমন মেয়ে। তুই যে ভালোবাসার কাঙাল সেটা আমি বুঝি।তাই আফীফের যত্নগুলো তোর মাঝে ভালোবাসার রূপ নিতে চাইছে।
এই দেওয়ান বাড়ির শত্রুর অভাব নেই।তুই সেদিন দেখলি না কি কান্ড হলো।বাড়ির কুকুর গুলোকে কে মারলো?আমি ভাইজানের সঙ্গে কথা বলেছি এই বাড়ি থেকে খুব শীঘ্রই বিদায় নেবো।দেখ এই গ্রাম দেখলে আমার যেমন অতীতের আনন্দময় দিন মনে পড়ে ঠিক ততটা বিস্বাদ,তিক্ত স্মৃতি মনে পড়ে।আমি চাইনা তোর উছিলায় হলেও এই দেশে,এই গ্রামেগুলোতে আমাদের আসতে হয়।আগে যদি জানতাম সত্যি সত্যি আমাদের গ্রামে আসতে হবে তবে কখনোই তোকে জোর করতাম না।
সেহেরিশকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবারো মুখ খুললেন মারুফা।
– তুই আমাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে।যেহেতু আমরা ইতালিতে থাকি সেহেতু এত দুরে ভাইজান কখনোই তোর বিয়ে দেবেন না।আর এই বাড়ির শত্রুর অভাব নেই কখন জানি আফীফের আপনজন হিসেবে তোর উপর বিপদ ভর করে কে জানে।আমার তো সন্দেহ লাগছে এই ছেলে যা চতুর।তোর ভাষ্য মতে বাড়ির সব লোক আগের মতো থাকলেও তবে পারভিন কোথায়?তার খোঁজ নেই কেন?তোকে পালাতে সাহায্য করার দায়ে যদি ধরা পড়ে সে, আফীফ তাকে তবে এমনি এমনি ছাড়বেনা।তাই ভালোই ভালোই বলছি তোকে, আফীফের প্রতি অনুভূতি শেষ করে দে আর এমন ভাবে দিন কাটাবি আফীফ যেন তোর প্রতি আসক্ত না হয়।
– তুমি ঠিক বলেছো ফুফি আমি নিজ হাতে বিপদ আনার কোন মানে নেই।খুব শীঘ্রই আমি ফিরে যেতে চাই ইতালি।
-ভাইজান বলেছে অনন্তপুরের জমি গুলোর মালিকানা পেয়ে গেলে শীঘ্রই চলে যাবে।তুই সাবধানে থাকিস।
– হুম।
.
সারা বাড়ি জুড়ে সেহেরিশের দেখা না পেয়ে ভ্রু কুচকে যায় আফীফের।কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই ফাহমিদাকে দেখে রাস্তা আটকে ধরে,
– আম্মা কোথায় যাচ্ছো?
– কি প্রয়োজন সেটা বল।
– সেহেরিশ কোথায় আম্মা?
– তার ফুফুর সাথে বেরিয়েছে।
– কোথায়?
– তা জানি না।
আফীফ সরে আসে কিচেনের সামনে থেকে।মনে মনে বেশ রাগ লাগছে তার নিরাপত্তা ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাহস করলো কি করে?যদি কিছু হয়ে যায়।
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৭
গুরুগম্ভীর চিন্তিত মুখ নিয়ে ফাতেমার রুমে বসে আছেন বাড়ির সকলেই।ফাতেমার অসুস্থতা আজ আবার বেড়েছে।আফীফ ডাক্তারকে পৌছে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো।আহনাফ দেওয়ান চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন সোফায়।সেহেরিশ মৌকে নিয়ে সবার পেছনে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে।আফীফ তার কাজ সেরে রুমে ডুকতেই সেহেরিশের দিকে আড় চোখে তাকালো।সেহেরিশ আফীফের দৃষ্টি বুঝতে পেরে নিজেকে আড়াল করে নেয়।গত কয়েকদিন সেহেরিশ আফীফের থেকে বেশ দূরত্ব নিয়ে চলেছে আগের মতো হুট হাট তর্ক বির্তকে জড়ায়নি।নিজেকে মানিয়ে নিতে সম্পূন্ন চেষ্টা করেছে সে।
– দাদুভাইরে আমার পাশে একটু আয়।তুই আমার মরণ চাস।কোন দিন আমার কোন কথাই রাখস না।যেদিন মরমু সেদিন বুঝবি।
ফাতেমার এমন যুক্তিহীন কথায় রাগ লাগলো আফীফের কিন্তু রাগটা প্রকাশ না করে দ্রুত তার দাদীজানের পাশে বসে যায়।
– এইসব কি কথা দাদী?তোমার কোন কথা আমি না রেখেছি একটু বলবে।
– তুই বিয়ে-শাদী কর।আমি আমার নাতির ঘরে ছেলে-মেয়ে দেখে যেতে চাই।আমার কথা এবার শুন তুই আর কত থাকবি এমন।
ফাতেমার কথা শেষ হতেই সবার আড়ালে আফীফ আড় চোখে একবার সেহেরিশের দিকে তাকালো।বিষটি মারুফার চোখে তৎক্ষনাৎ ধরা পড়ে।সহসা তিনি বুঝে নেন আফীফ খুব করেই সেহেরিশকে চাইছে।
.
খুরশীদ আনওয়ারের রুমে আজ আলোচনায় বসেছেন মারুফা,খুরশীদ এবং ফাহমিদা।মারুফা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে হলেও এই বাড়িতে সেহেরিশের বিয়ে আটকাবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন।
– ভাইজান তোমায় কিছু কথা বলার ছিল।ভাবী জানে আমি ভাবীকে বলেছি।
– কী কথা বল।
– দেওয়ান বাড়ির সদস্যরা চাইবে আফীফের বউ হিসেবে সেহেরিশ এই বাড়িতে আসুক।কিন্তু তুমি কিছুতেই তাদের প্রস্তাবে রাজি হবে না।
– কি বলছিল এইসব?তোর কেন মনে হলো যে তারা আমাদের সেহেরিশকে চাইবে?
– এত প্রশ্ন কেন করছো ভাইজান যেটা বলছি সেটা শুনো।আমরা সেহেরিশকে এই বাড়ির বউ করবো না।কিছুতেই না।
– আফীফ পাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভালো।ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও ছেলেটাকে পছন্দ করি আমার মেয়ে তার হাতে তুলে দিতে আমি দ্বিধাবোধ করবো কেন?
খুরশীদ আনওয়ারের কথায় ফস করে শ্বাস ছাড়লো মারুফা।উত্তেজিত হয়ে টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে দ্রুত গিলে বিছানায় বসে যায়।
– দেখো ভাইজান যা বলছি মন দিয়ে শুনো। বিয়ে ছেলে খেলা না।এতে সারাটা জীবন জড়িত।সুবিধা-অসুবিধা,মানানসই অবস্থান প্রয়োজন।তাই তোমার ব্যক্তিগত পছন্দ আর চোখের দেখায় মেয়েটাকে এইভাবে বিয়ে দিতে সম্মোতি জানাবে না আশা করি।
– মারুফা তুই যা বলছিস বুঝিয়ে বল।তোর কথার যুক্তি আমি বুঝতে পারছি না।
– সেহেরিশ আমাদের একমাত্র মেয়ে।তুমি কখনো চাইবে তোমার মেয়েকে বিপদবহুল জায়গায় বিয়ে দিতে?দেখো এটা জমিদার বাড়ি তাদের শত্রুর অভাব নেই।আহনাফ দেওয়ানের পর জমিদারিতে হাত লাগাবে আফীফ দেওয়ান।কিন্তু আফীফের বাবা এইসব জমিদারিতে গা লাগায়নি।আমি যতদূর শুনেছি ঝামেলা বিবাদ তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ।বাড়ির ব্যবসায় তিনি ভূমিকা রাখছেন।কিন্তু আফীফ তো শত্রু পক্ষ নিয়ে খেলছে।তার শত্রুর অভাব নেই।মনে আছে ভাইজান আম্মা-আব্বা বলেছিলো।পাশের গ্রামের আহনাফ দেওয়ানের বাবাও কিন্তু তার শত্রুদের হাতে মারা যান।
তাই এই বাড়ির শত্রুর অভাব নেই।সেদিন দেখলে না কুকুরগুলোকে কিভাবে মেরে চলে গেছে।আফীফকে দমন করতে আগে কিন্তু তার দূর্বল জায়গা গুলো খুজবে শত্রুরা।তাই বলি কি যা করবে ভেবে চিন্তে করবে।
মারুফা থামে।তার কথায় সায় দিয়ে মাথা দুলালেন
খুরশীদ।ফাহমিদা এগিয়ে এসে গমগম সুরে বলেন,
– দেখো এত শত কারন দরকার নেই আমি আমার মেয়েকে কিছুতেই এতদূরে বিয়ে দেবো না।আমরা থাকবো দেশের বাইরে আর মেয়ে আমার এখানে পড়ে থাকবে কিছুতেই না।আমার একমাত্র মেয়ে আমার কলিজার টুকরা।তাছাড়া গ্রামের বউদের নিয়মকানুনের কথা তুমি ভালো করেই জানো।এখন হয়তো অতিথি হিসেবে আমার মেয়েটাকে আদর-যত্ন করছে কিন্তু বাড়ির বউ হিসেবে তখন একশ একটা দোষ খুঁজবে বিচারের পর বিচার আসবে।আমার সাদাসিধা মেয়ে পড়াশোনা ছাড়া কোন কিছুতেই মন বসায় নি।তাই তারা প্রস্তাব পাঠালেও তুমি বারণ করবে।প্রয়োজনে মিথ্যা বলবে।তুমি বলে দিও আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক।যা বলেছি তাই এই বাড়িতে আমার মেয়ের বিয়ে আমি দেবো না।
ফাহমিদার কথায় মাথা নাড়িয়ে ঈষৎ হাসলেন খুরশীদ।
– বেশ তবে তাই হবে। তোমাদের কথার অমান্য আমি কখনো করিনি এখনো করবো না।
.
কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে আফীফ।তার পাশে একের পর এক গুনগান শুনিয়ে যাচ্ছেন সেজুঁতি।কিন্তু আফীফ সেদিকে কোন পাত্তাই দিচ্ছেন না।মায়ের উপর রাগ দেখাতে না পেরে চুপচাপ সবটা শ্রবণ করছে সে।
– দেখ বাবা আর কত দিন এইভাবে চলবে?তোর দাদীজান যে আজ রেগে গেলো সেই খবর কি আছে তোর?তোর তাকিয়া যখন দেশে এসেছে তুই সবটা মিটমাট করে বিয়ের প্রস্তাব দে।তোকে কিচ্ছু করতে হবে না তোর আব্বা আর দাদাজান মিলে সবটা সামলে নেবে।
– এত কথা কিসের।তাকিয়ার এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি তার বাবা মা এখন তার বিয়ে দেবেন না।সব কিছু ভেবে প্রস্তাব দেওয়া উচিত আমাদের।
– পড়াশোনা শেষ হয়নি তো কি হয়েছে বিয়ের পর পড়বে এতটা চাপ নেওয়ার কিছুই নেই।
– আমি এই দেশে আর তোমার ছেলের বউ ওই দেশে থাকবে?এইসব ধ্যান ধারনা নিয়ে তুমি চলো।দেখো মা বিয়ের সাব্জেক্ট পরে। এখন দাদীজানের সুস্থতা কামনা করো।
আফীফের গুরুগম্ভীর প্রত্যুত্তরে থামলো সেজুঁতি।কিন্তু মনের মাঝে এখনো খচখচ করছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা পড়িয়ে দায়মুক্ত হতে চান তিনি।আহনাফ দেওয়ানকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ান সেজুঁতি।
– বাবা কিছু বলবেন?
– আফীফের সঙ্গে কথা ছিল।তুমি যাওয়ার দরকার নেই এখানেই থাকো।
আহনাফ দেওয়ানের সম্মোতিতে সরে দাঁড়ালেন সেজুঁতি।আফীফ এখনো একই ভাবেই বসে আছে।তার পিঠ চাপড়ে আহনাফ দেওয়ান হাস্যোদ্দীপক হয়ে বলেন,
– ব্যাটা বিয়ে করবি কবে?এত নাটক করছিস কেন?মেয়ে মানুষের অভাব তোর জন্য নেই আমি জানি। কিন্তু মনের মানুষের অভাব ছিল তা এতদিন বুঝেছিলাম তবে এখন কেন বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিস না?সেহেরিশ তো দেশেই ফিরেছে।
– সেহেরিশ তো আর আমাকে বিয়ে করতে দেশে ফিরে আসে নি।তার এখনো পড়া বাকি।আঙ্কেল আন্টি যে কিছুতেই তার বিয়ের মত দিবেন না আমি জানি।
– এত চিন্তা করছিস কেন?তোর দাদাজান আছে না। তারা রাজি না হলে তুলে এনে বাপ মেয়েকে বিয়ের আসরে বসাবো।দেখি বিয়ে কি করে না হয়।
– দাদাজান বিয়ে আমি জোর জবরদস্তির করে করতে পারবো না।দুজনের এটলিস্ট মনের মিলটা থাকা প্রয়োজন।
– তুই ঠিক বলেছিস।তবে এটা আমি ভালো করেই জানি যে আফীফ আট বছর একটি মেয়ের আশায় থাকতে পারে সেই মেয়েকে আফীফ বউ না বানিয়ে ছাড়বে না।যাই হোক আমি চাইছি তোর বাবা আর আমি তাদের কাছে প্রস্তাবটা পেশ করতে।
– এখন না দাদাজান আমি…
আফীফের কথা শেষ হওয়ার আগেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সেজুঁতি।
– দেখলেন আব্বা দেখলেন এই ছেলে কি চাইছে আমি কিছুই বুঝিনা।
– আহ আম্মা আমাকে একটু সময় দাও।
– বেশ দাদু ভাই তোমাকে সময় দিলাম তার আগেই আমি যেন পজিটিভ নিউজ পাই।
– ইনশাআল্লাহ দাদাজান।
.
পুকুর পাড়ে বসে জুহির সাথে কল আড্ডায় মেতে আছে তিন বন্ধু তাদের টপিক আজ বাঙালী সাজ।গ্রাম্য ছবির ফটোগ্রাফি শেষে এবার তুন্দ্রের মাথায় বুদ্ধি এসেছে গ্রামবাংলার বউ সাজে সেহেরিশকে দিয়ে ফটোশ্যুট করাবে কিন্তু এইসব কিছুতে ফেসাদে পড়েছে সে।এদিকে জুহি তাদের সবার সঙ্গে ভিডিও কলে তর্ক বির্তকে লেগে আছে।
– দেখ সেহেরিশ শাড়ি,চুড়ি,কাজল পড়লে তোকে সুন্দর লাগবে এত নাক উচু করছিস কেন?
– নারে জুহি শাড়ির সাথে লম্বা চুল মানানসই। আর কাজলতো আমি জ্ঞান হওয়ার পর কখনো লাগাই নি।শাড়ি পড়তে অসহ্য লাগে আমি পারবো না তুই তুন্দ্রকে বল এইসব টপিক যেন বাদ দেয়।
সেহেরিশের তিক্ত মুখের কথায় রাগ লাগলো তুন্দ্রের।গলায় ঝুলে থাকা ক্যামরাটা রাগ দেখিয়ে ছুড়ে মারলো কেইনের দিকে।হনহন করে পুকুর পাড় ছেড়ে উঠে গিয়ে বাড়ির ভেতরে ডুকে যায়।কেইন আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে সেহেরিশের দিকে।
– এই সেহেরিশ তুন্দ্র তো ক্ষেপেছে।
– ধর তুই জুহির সাথে কথা বলা আমি ওর রাগ ভাঙাই।
সেহেরিশ এক ছুটে তুন্দ্রের পেছনে দৌড় লাগায়।দোতলায় উঠার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে তুন্দ্রের জ্যাকেট টেনে ধরে সেহেরিশ।
– প্লিজ তুন্দ্র আমি ফটোশ্যুট করবো।তুই যেভাবে বলবি সেই ভাবেই সাজবো রাগিস না তুই।
– ছাড় আমায় সেহেরিশ তোকে আমার কথা শুনতে হবে না।
– না না না শুনবো আমি প্লিজ তুই রাগ করিস না।আমি চন্দনা আন্টির কাছে এখনি যাবো তিনি আমায় সাজিয়ে দেবেন।প্রয়োজনে যা যা লাগবে বাজার থেকে নিয়ে আসবে তবুও রাগ করিস না। আমি জানি তুই রাগলে সহজে থামবি না।
তুন্দ্র সেহেরিশের কথা কানে নিলো না বরং সেহেরিশকে ছাড়িয়ে উপরে উঠতে চাইলো।তুন্দ্রের কান্ডে বেশ রাগ লাগলো সেহেরিশের। রাগ ভাঙাতে এসে উল্টো নিজেই রেগে গেলো সেহেরিশ যার দরুনে তুন্দ্রের হাত ছোড়াছুড়ি দেখে বাম হাতে কামড় বসায় সে।
– আহহ সেহেরিশ কি করছিস কি তুই?
– যা করছি বেশ করছি এতবার বলার পরেও কেন আমার কথা শুনছিস না?
– তাই বলে কামড়াবি?
– হ্যা কামড়াবো।এবার বল রাগ থেমেছে?
– বিকেলে রেডি থাকিস।
দুপুরের পরেই সেহেরিশ নিজের অনিচ্ছা স্বত্তেও টুকটুকে লাল শাড়ি।হাত ভর্তি চুড়ি চোখে কাজল পায়ে পায়েল,আলতা, টিপ,চুলে গাজরা পড়ে তৈরি হয়ে নেয়।চন্দনার সাহায্য পুরো সাজটাই শেষ করে সে।
সেহেরিশ নিজের রুমে বসে আবারো সবটা সাজ দেখছি তখনি তার রুমে প্রবেশ করে কেইন, তুন্দ্র, মুনিফ।
– এটা কে রে? আমাদের সেহেরিশ তো নয়।এটাতো হুরপরী।
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসে সেহেরিশ।তুন্দ্র, কেইন সেহেরিশকে নিয়ে কথায় ব্যস্ত থাকলেও মুনিফ দুচোখ ভরে দেখছে তাকে।আজ যেন মেয়েটার মাঝে অন্য রকম সৌন্দর্য ভর করেছে।একদম নব বধূ!
– সেহেরিশ তুই ছাদে আয় আমরা বরং যাই।
তুন্দ্র সবাইকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় এদিকে সেহেরিশ তার সব কিছু ঠিক ঠাক করে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে ছাদের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।কিছু দূর যাওয়ার পর তার হাতে টান পড়তেই অন্ধকার একটি রুমে ছিটকে পড়ে।
– কে কে ওখানে?
– তোমার হবু বর!
গুরুগম্ভীর কারো কন্ঠে শিউরে উঠে সেহেরিশ।এই কন্ঠের মালিক কে সে চেনে।খুব ভালো করেই চেনে।এটা তো আফীফ।
– আপনি এমন করলেন কেন?আমাকে এই অন্ধকার রুমে আনার মানে টা কী?
– খুব সোজা এই রুমের বাইরে যেতে পারবে না ঠিক ততক্ষণ যতক্ষন তোমার এই সাজ পোশাকে থাকবে।
– আরে আজব আমার ইচ্ছা আমি সেজেছি আপনার জ্বলছে কেন?আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
– সমস্যা নেই রুম সাউন্ড প্রুফ।
সেহেরিশ বিরক্ত হয়ে যায়।অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলতে গিয়ে থমকে যায়।আফীফ তার দুই হাত আকড়ে ধরে নিয়েছে।
– এইসব কেন করছেন আফীফ দেওয়ান।
সেহেরিশের দাতে দাত চেপে কথায় হালকা করে তার মুখে ফু দিলো আফীফ।
– এই সাজে তোমায় কেমন লাগছে যানো?না তোমার জেনে কাজ নেই।
– আপনি পাগল হয়ে গেছেন যেতে দিন আমাকে।
সেহেরিশ আফীফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই আফীফ আবারো সেহেরিশকে আকড়ে ধরে।
– ছুটাছুটি একদম করবেনা বলে দিচ্ছি।
সেহেরিশ শুনলো না বরং আফীফের হাতে কামড় বসিয়ে তাকে থু থু ছুড়ে মারে।আফীফের বেশ রাগলো।অন্ধকারেও সেহেরিশের অবস্থান বুঝতে পেরে এক পা দু পা তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– অতীতের অব্যক্ত প্রণয় তবে আবার শুরু হোক!
#চলবে….
বিঃদ্রঃ গল্পের প্রথম পর্ব থেকে অতীত শুরু হয়েছিল।কাল বর্তমান থেকে শুরু করা হবে।
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৮
দেয়ালের সাথে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরিশ তার সামনে আফীফ তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।আফীফ কি রেগে আছে নাকি তাকে মারবে কিছুই বুঝলো না সেহেরিশ।শাড়ির আচঁলটা দু-আঙুলে পেচিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে তখনি শান্ত,নিবিড় রুমটায় সেহেরিশের ফোন ভাইব্রেট করতে থাকে।স্কিনের দিকে তাকিয়ে তুন্দ্রের নাম্বার দেখে বিরক্তে মুখ কুচকে যায়।নিশ্চই তার দেরি দেখে ফোন করছে।তুন্দ্রের কল কেটে সেহেরিশ আফীফের দিকে একবার তাকায়।আফীফ এখনো তার দিকে একই অঙ্গ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।সেহেরিশ সাহস সঞ্চার করে দু-হাতে শাড়ি তুলে দরজার দিকে হাটা শুরু করে।
দরজার নব ঘুরাতে গেলেই আফীফ তার হাত আকড়ে ধরে।
– সমস্যা কি আপনার?হাতটা ছাড়ুন।
– কথা আছে দাঁড়াও।
– আমার নেই আপনি আমার হাত ছাড়ুন।
– আফীফ দেওয়ান ভদ্র ভাবে কথা একবার বলে।দ্বিতীয় বার একই কথা বলতে ভদ্রতা রাখেনা।
– তো?
সেহেরিশের ত্যাড়া জবাবে আফীফ ক্রুদ্ধ হলো।কিন্তু প্রকাশ করলো না।তখনি সেহেরিশের ফোনে আবারো কেইনের কল এলো।মোবাইল হাতে নিয়ে কেইনের নাম দেখে আফীফ ভ্রু কুচকালো।সেহেরিশ আফীফকে সরিয়ে যেতে নিলেই আফীফ তার দু-হাত আকড়ে ধরে চেয়ারের সাথে বেঁধে দেয়।
– রুম থেকে বাইরে যেতে পারবে তবে এই সাজে না।সোজা রুমে গিয়ে সাজ পোষাক চেঞ্জ করবে।
– আপনার আদেশ মেনে চলবো না কি আমি?এতটা অধিকার দেখানো মোটেও পছন্দের না আমার।
– ওহ আচ্ছা তবে কেইন, তুন্দ্রের কথায় নাচতে নাচতে রেডি হয়ে গেলে বাহ্!
– ওরা আমার বন্ধু আপনি কে?
– তাদের থেকেও বেশি কিছু।যা বলছি ত..
আফীফের কথার মাঝে আবারো কেইনের কল এলো।সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট হলো আফীফ।সেহেরিশ দ্রুত ফোন কাটতেই আবারো কথা শুরু করে আফীফ।
– তুমি বড় হয়েছো কিন্তু যথেষ্ট ম্যাচিউর হওনি।এবার একটু ম্যাচি….
আবারো কেইন কল করায় বিকট শব্দে ভাইব্রেট হতে থাকে সেহেরিশের ফোন।কথার মাঝে এমন বার বার বাধা পাওয়ায় নিজের রাগ দমাতে পারলো না আফীফ।সেহেরিশের হাত থেকে এক টানে ফোনটি কেড়ে নিয়ে দেয়ালের সাথে ছুড়ে মারে।রাগের মাথায় আফীফ দেয়ালের সঙ্গে ফোনটা আছাড় মারতেই বিকশ শব্দে কেঁপে সেহেরিশ।দু-চোখ খিঁচে ভয়ার্ত চোখে আফীফের দিকে তাকাতেই আবার তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জানালার সামনে দাঁড়ায়।তখনি তার কানে আসে সেহেরিশের তীক্ষ্ম কন্ঠ,
– আমায় বেধে রেখেছেন কেন?জমিদারের নাতি বলে কী গ্রামটাকে কিনে রেখেছেন? আপনার কথায় মানুষ কী উঠবে আর বসবে ?
মেয়েটির তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আফীফ।
– পাখি যখন অন্যর বাস গৃহে এসে ডানা ঝাপটায় তখন তাকে বেঁধে রাখাই শ্রেয়!
আফীফের কথা শুনে শুকনো কয়েকটি ঢোক গিলে সেহেরিশ কিন্তু তবুও দমে যায় নি বরং আরো বেশি রাগ নিয়ে চেচিয়ে বলে,
– আমি এত শত জানতে চাই না আমাকে বেঁধে রাখার কারন টা কী?
আফীফ পিলপিল পায়ে এগিয়ে আসে সেহেরিশের দিকে।ডান হাতটা দিয়ে সেহেরিশের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
– মনে করে দেখো ফুলপরি আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা।অতীতের কথা,এই গ্রামে আসার কথা আমার কথা।আমি যানি তুমি ভুলে যাওনি সব মনে আছে।শুধু ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো। ঠিক আমাদের মতো একই অঙ্গভঙ্গিতে।
আফীফের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সেহেরিশ। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস দিগুন বেড়ে গেছে।লোকটি আবারো তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মেয়েটি কয়েক বার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে তার চিরচেনা অতীত।যে অতীতে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আজ এতটা বছর…
বর্তমান…
কোমল দুইহাতে আফীফের ঠোঁটের স্পর্শে সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।অতীত ভাবলেই তার ভয় করে কান্না পায়।সব কিছু তিক্ত মনে হয়।তবে ফুফির কথাই ঠিক ছিল আফীফ তাকে চিনতে পেরেছে।এতদিন সেহেরিশের মতো আফীফ নিজেও নাটক করেছে সাথে তার পরিবারের সকলে।ইসস বোকা সেহেরিশ বুঝতে পারলো না আফীফের কূটকৌশল।
– কান্না করছো কেন ফুলপরি কান্না তোমায় মানায় না।তুমি হাসবে আগের মত সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলবে।
আফীফের শান্ত কন্ঠ মোটেও সেহেরিশের কাছে ভালো লাগছে না।নিজের করা কারসাজিতে অনুতপ্ত সেহেরিশ।তাই নিজেকে মুক্তি করতে আফীফের উদ্দেশ্য বলে,
– আমায় মাফ করে দিন।অতীতের ভুলে আমি অনুতপ্ত।আপনার সঙ্গে তর্ক কিংবা কাদাছোড়া কোনটাই করা আমার উচিত হয়নি।আপনি চাইলে আমি পা ছুঁয়ে মাফ চাইবো।তবুও আমার জীবনটা বিষিত করবেন না।আর হ্যা আমি আমার পরিবারকে নিয়ে চলে যাবো।আপনি আমায় মাফ করে দিন।অন্তত অতীতের রেশ ধরে আমার বর্তমানটা নষ্ট করতে চাই না।
সেহেরিশের নত মুখের কথায় ঠোঁট টিপে হাসে আফীফ।সেহেরিশের মুখোমুখি অন্য চেয়ারে বসে গলা খেকিয়ে বলে,
– মাফ আমি তোমায় কোন দিন করবো না তাকিয়া আনওয়ার সেহেরিশ।অন্তত সেই দিনের জন্য যেদিন আমাকে না জানিয়ে বাড়ির বাইরে কেন গেলে?জানো আজ এই দিনের সম্মুখে আমরা কোন দিন হতাম না যদি তুমি আমায় ছেড়ে যেতে।
– তবে আমি কি করবো?বন্ধি থাকবো আপনার কাছে সারাজীবন।আমার কি পরিবার নেই ভালোলাগা মন্দ লাগা স্বাধীনতা নেই?”
আফীফের কথা শেষ হতেই সেহেরিশ ধমকের সুরে রাগ দেখিয়ে কথাটি বলে আবার থেমে যায়।চোখ খিচে বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে কাদতে থাকে।বার বার এই ভুল কেন করছে সে?নিজের রাগ কিছুতেই বশে আনতে পারছে না।
তার অবস্থা বুঝতে পেরে আফীফ ঈষৎ হাসে।
– বিস্তারিত কোন কিছু না জেনে সিধান্ত নেওয়া কিংবা বলা উচিত না।আমি তোমার কোন দিন খারাপ চায় নি আর প্রতিশোধ?মায়াময়ী সেই ছোট্ট তাকিয়ার কাছে প্রতিশোধ আমি নেবো কি করে?আমার তো সেই সাধ্য নেই।তোমাকে বন্ধী করেছি আমার বর্শে আনার জন্য।রাগের মাথায় আমি ঠিকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তুমি আমার কাছে থাকবে কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম এভাবে তোমায় বন্ধি করা উচিত নয়।তোমার বাকিটা জীবন পড়ে আছে।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তোমায় তোমার বাড়িতে ফিরিয়ে দেবো।তোমার ফুফুর সাথে আমার দেখা করার কথা ছিল কিন্তু তিনি দেখা করেন নি বরং শহরে তোমায় ছেড়ে চলে যান। আমি অপেক্ষায় ছিলাম তার।কিন্তু গ্রামে তিনি আসেন নি।ওইদিন বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত থাকলেও আমি ব্যস্ত ছিলাম তোমার পরিচয়ের খোঁজে।ছলে বলে কৌশলে তোমার অবস্থান পরিবার সম্পর্কে জানতে পারি।এবং এটাও জানতে পারি তোমার ফুফি গ্রামে ফিরছেন।কিন্তু আমি বাড়ি দেখলাম তুমি নেই।সেদিনের সেই রাগ তিক্ত অনুভূতি তুমি কখনো বুঝবে না ফুলপরি। বেইমানি করা হয়েছে আমার সাথে।তুমি চলে যাওয়ার পর তিনটে মাস যে কত ভয়ংকর ছিল আমার জন্য তুমি নিজেও জানো না।অবশ্য জানার দরকার নেই।শুধু এটা জেনে রাখো আমি তোমাতে আসক্ত।
সেহেরিশ চমকায়।কিছু বলতে গেলেও থেমে যায়।তপ্ত শ্বাস ছড়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আল্লাহ পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি।এখন কি হবে!
– হ্যা পাগল আমি অন্য কিছুতে নয় তোমাতে।যাই হোক রুমে যাও চেঞ্জ করে তারপর রুম থেকে বের হবে।কেইন তুন্দ্রের সাথে মেলামেশা করবে ঠিকি তবে এতটাও ঘনিষ্ট হবে না যতটা দেখলে আমার রাগ লাগে।
সেহেরিশ চুপচাপ অন্যদিকে মুখ করে বসে আছে।আফীফ তার হাতের বাধন খুলতে গেলেই চমকে যায়।সেহেরিশের দু-হাত মাত্র অতিরিক্ত গরম হয়ে আছে।দ্রুত আফীফ তার হাত মেয়েটির কপালে ঠেকাতেই বিস্ময় হয়।
– হঠাৎ জ্বর এলো কেন?
– হাতের বাধন ছাড়ুন আমার অসহ্য লাগছে।
আফীফ ছেড়ে দিলো।সেহেরিশ শাড়ি তুলে হাটতে শুরু করে হেলেদুলে।গলার পাশটায় বেশ খানিকটা শাড়ি সরে আছে।দরজার নব ঘুরিয়ে ঘাড় কাত হয়ে তাকায় সে।
– আফীফ দেওয়ান পাগলা গারদে যান।আমার প্রতি পাগল হয়ে লাভ নেই।বিকজ আই ডোন্ট লাইক ইউ।
– তুমি ও পাগলী হয়ে যাবে এই পাগলের প্রতি।
– তার আগে আমার মৃত্যু হোক।
সেহেরিশের কথা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু আফীফের প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেরি হলো না।হেচকা টানে সেহেরিশকে নিজের কাছে এনে দু হাতের মুঠোয় বন্ধি করলো।
– বাজে কথা ছাড়ো।তৈরি থেকো খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে।
– কোন দিন না।কে রাজি থাকুক আর না থাকুক আমি অন্তত রাজি হবো না।আমার সাথে আপনার কোন দিক দিয়ে যায় না।
– ওহ আচ্ছা তাই নাকি।তা কেমন ছেলে চাই তোমার।
– আমার যে বর হবে তাকে হাসি-খুশী স্বভাবের হতে হবে। আপনার মতো গোমড়া মুখো ছেলে না।আর আমায় শ্রদ্ধা, সম্মান এবং অফুরন্ত ভালোবাসবে।
– হুম,আসলে আমার দাদীজান কি বলে জানো আমার হাসিটা বড্ড বেহায়া স্বভাবের।যে কোন মেয়েকে সহজে বেহায়া করে তুলে কিন্তু আমার সেদিকে তাকিয়ে লাভ নেই আমি তো একজনে আসক্ত।এবার থেকে আমি হাসবো দেখি তুমি নিজেকে সামলাও কী করে।দেখবে তুমি নিজেই ফেসে যাবে।আর ভালোবাসা!যাকে কাছে না পেয়ে আট বছর যাবৎ ভালোবেসেছি আর তাকে কাছে থেকে ভালোবাসতে পারবো না।এই যে দেখো প্রচন্ড শীতেও তোমার নাম ঘামছে বাঙালিরা বলে নাক ঘামলে বরের আদর বেশি পায়।তবে প্রমান হলো তো?
আফীফের কথায় তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের হাত নাকে চলে যায়।হঠাৎ জ্বর আসায় তার সারা শরীরে কাপুনি শুরু হয়ে গেছে।আফীফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সে।সেহেরিশের কাপড়টা পেটের দিকটায় কিঞ্চিৎ সরে যাওয়ায় আফীফের চোখে সহসা সেহেরিশের কাঁটা দাগ সাদৃশ্য হয়।
– একি এতটা কাটলো কি করে তোমার?
– ক..কিছু না।ছেড়ে দিন আমায় আমি চলে যাবো।
– আবার মিথ্যা, সত্যিটা বলো সেহেরিশ।
– ছাড়ুন আমায়।
সেহেরিশ রাগ দেখাতে নিলেই আফীফ তার পেটের কাটা দাগটায় চেপে ধরে।সহসা চাপা আর্তনাদ করে উঠে সে।আফীফ তার কানের সামনে মুখ বিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– আমায় মিথ্যা বলবে না সেহেরিশ।মিথ্যা আমার দুশমন।
নিয়ন বাতির আলোয় আফীফের দিকে সেহেরিশ তাকিয়ে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।তখন অন্ধকার রুমটায় আফীফ নিয়ন বাতির আলো জ্বালিয়ে দেয় কিন্তু পুরো রুমটা জুড়ে আফীফের এত লুকোচুরি কিসের সেহেরিশ বুঝতে পারছেনা।স্পষ্ট আলোর ছোয়া এখনো সে পায় নি।
আফীফ সেহেরিশের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
– এবার যাও।কেউ যেনো অতীত সম্পর্কে কিচ্ছু না জানে আর মারুফা ফুফির সাথে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে লাভ নেই তিনি যদি আজকের এই ঘটনা সম্পর্কে বিন্দু পরিমান জানে তবে বিপদ তোমার বাড়বে।সো বি কেয়ার ফুল।
—–
সন্ধ্যা পর সেহেরিশের জ্বরের তাপ কিছুটা কমেছে।চুপচাপ নিরিবিলি নিজের রুমে মেঝেতে বসে আছে সে।এখনো লাল শাড়িটি গায়ে তার।মুখের সাজসজ্জা কিছুই ধৌত করেনি।তুন্দ্র আর কেইনের মাঝে চাপা দ্বন্দের সৃষ্টি।সেহেরিশকে চুপ থাকতে দেখে তুন্দ্র এগিয়ে আসে।
– তোর ফোন কই সেহেরিশ আমি কতবার কল করেছিলাম।তোকে রুমেও খুজেছি ছিলি না তুই।আর হঠাৎ জ্বর আসলো কেন?
তুন্দ্রের প্রশ্নে রাগ দেখায় কেইন।
– সে বলেছিল শাড়ি চুড়িতে সে অভস্ত নয় তুই কেন জোর করলি?এখন অসুস্থতা দায় তুই নিবি।বাড়াবাড়ি করা মোটেও ঠিক না তুন্দ্র।তোর শখের কারনে সেহেরিশের ক্ষতি মানতে পারবো না।
দুজনের তর্কে রাগ লাগলো সেহেরিশের মাথা তুলে তাকাতেই দরজার আড়ালে আফীফকে দেখে রাগটা যেন দিগুন বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের চুড়ি ভর্তি দুই হাত মেঝেতে আছাড় দেয়।ঝনঝন করে লাল চুড়ি গুলো ভেঙ্গে সেহেরিশের হাতে বিঁধে যায়।রক্তমাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে ছুটে আসে কেইন তুন্দ্র।দূর থেকে তার কার্যকলাপ দেখে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিড়বিড় বিড়বিড় করে আফীফ বলে,
– তোমার মাঝে রাগ,ক্ষোভ বড্ড বেমানান!
#চলবে….