অন্তরিন প্রণয় -Part 30+32

0
401

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩০+32
সেহেরিশ এবং আফীফ দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। একজনের চোখে রাগের আভাস অন্য জনের মাঝে হতাশার।
– সেহেরিশ?
আফীফ সেহেরিশকে ডাকছে কিন্তু তার হুশ নেই সে তার ভাবনায় মশগুল।
– সেহেরিশ?
এবারো সেহেরিশের রেস্পপন্স নেই।আফীফ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।সারা রুম জুড়ে পাইচারি করে আবার তার সামনে বসে।এবার সেহেরিশের দু’হাতে ঝাকিয়ে ডাকতে থাকে,
– সেহেরিশ?
– হাহ।
– কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?আমি ডাকছিলাম তোমায়।
– ওওওও।
– ওও কি?তোমার মাঝে এত উদাস ভাব কেন?আর বাচ্চাটার সমস্যা কি?দুনিয়াতে আসার নাম নিতেই তুমি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাইছ।এটা তো একটা মায়ের বৈশিষ্ট্য নয়।
সেহেরিশ শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।আফীফের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,
– আমি মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখেছি।বাচ্চাটার কোন প্রয়োজন নেই।আমায় হাসপাতালে নিয়ে চলুন বাড়ির মুরব্বিরা জানার আগেই বাচ্চাটার চিহ্ন বিলীন করে দি।
সেহেরিশের কথা শেষ করতে দেরি হলো কিন্তু তার গালের চড়টা পড়তে মোটেও দেরি হয়নি।আফীফ ক্ষেপেছে তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার মাঝে ঘুমন্ত রাগান্বিত সত্তাটা আবার জেগে উঠেছে।হঠাৎ আক্রমণে সেহেরিশের মাথাটা যেন হ্যাং হয়ে গেছে।দীর্ঘ আড়াই বছর বিবাহিত জীবনে আফীফ তার ভুলের জন্য নানান ভাবে শাস্তি দিয়েছে কিন্তু কখনো চড়/থাপ্পড় মারে নি আর আজ সেটাও করে দেখালো।বোঝায় যাচ্ছে বাচ্চাটার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে আফীফ।
ফর্সা গালটায় তিন আঙুলের ছাপ স্পষ্ট।লালভাব ফোলা গালটার দিকে তাকিয়ে ‘ফস’ করে শ্বাস ছাড়ে আফীফ।নিজেকে স্থির করে সেহেরিশের দু-হাত নিজের মুঠোয় নেয়।
– তোমার সমস্যাটা কি বলবে আমায়?হঠাৎ এমন বিহেভিয়ারের মানে কি?
– আ..আমি যা বলছি ভেবে চিনতে বলছি।বাচ্চার প্রয়োজন নেই আমার।অন্তত এই বন্দি জীবনে একটা বাচ্চা সুস্থ ভাবে মানুষ হতে পারবেনা।
– তোমার কি ধারনা বাচ্চা আমার এখানে থাকবে?
– মানে?
আফীফ উওর দিল না। দাঁড়িয়ে রুমের চারিপাশে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলে,
– মনে আছে সেদিন রাতের কথা,মারুফা ফুফুর কারনে বাড়ির সবাই ঘুমে তলিয়ে যায়।যার কারনে শক্রু পক্ষ হামলা করতে সুযোগ পায়।পুলিশ কেসেও যানতে চেয়েছিল ঘুমের ওষুধের প্রয়োগ কে করেছিল?আমি সেদিন সবার মুখ বন্ধ করে বলেছিলাম কাজটা শক্রু পক্ষের লোক করেছিল।ভাবতে পারছো?পুলিশদের যদি আমি সত্যিটা জানিয়ে দিতাম বর্তমানে তোমার বাবার যেটুকু সম্মান আছে তাও মাটিতে মিশে যেত।পুলিশ আগে তাদের হ্যারেসম্যান্ট করতো।এখন যদি আমি আবার পুলিশকে সত্যিটা বলি বিষয়টাকি ভালো হবে?
সেহেরিশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আফীফ তাকে ব্লাকমেইল করছে।তাই সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।
আফীফ এবার তার পাশে বসে।সেহেরিশের কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– ব্লাক হাউজে আসার খুব শখ ছিল তোমার।আর তোমার শখ আমি অপূর্ণ রাখিনি।এবার বলো এই ব্লাক হাউজে থাকার দেড় বছরের অনুভূতি কী?
সেহেরিশ উওর দিল না মাথাটা নুইয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।আফীফ সেহেরিশের উওর না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ মনে মনে বলে,
– আপনি পাশে থাকলে এই ব্লাক হাউজে সারাজীবন পার করতে পারবো।
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেহেরিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়।ঘুমন্ত অবস্থায় সে অনুভব করে সে ভাসছে।অল্প সময়ে চোখ খুলে তাকাতেই আফীফের কোলে নিজেকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
– আরে কি করছেন কি?
– ইসসস।কথা নয়।চোখ বন্দ করো ফুলপরী।
– কিন্তু কেন?
– চোখ বন্ধ করতে বলেছি চোখটা বন্ধ করো।এত প্রশ্ন করবে না।
সেহেরিশ চোখ বন্ধ করলো না উলটো আফীফের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে।তার আচরণে আফীফ বিরক্ত হয়ে কোল থেকে নামিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়।আফীফের কর্মকান্ড সেহেরিশের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– কি করছেন আপনি বলবেন আমায়?
– তোমায় এই ব্লাক হাউজের সবচেয়ে ভয়ংকর রুমটায় নিয়ে যাবো।যেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
সেহেরিশ ভয়ে আফীফের কলার চেপে ধরে।ভীতু কন্ঠে বলে,
– প্লিজ আফীফ আপনি এমনটা করবেন না।প্লিজ আমি আপনাকে ছাড়া আর কোথাও থাকবো না।
– চুপ থাকো তুমি।
আফীফের ধমকে চুপসে যায় সেহেরিশ।আফীফ সেহেরিশকে নিয়ে দেওয়ান বাড়ির বাসগৃহে প্রবেশ করে।সেখানে সেহেরিশের অপেক্ষায় সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে।দরজার সামনে সেহেরিশকে নামিয়ে দিতেই আমান সেহেরিশের গায়ে ফুল ছুড়তে থাকে।আফীফ সেহেরিশের চোখের বাধন খুলে দিতেই বাড়ির সবাইকে দেখে চমকে যায় ।তার কাছে এটি লোমহর্ষক ঘটনা।আমান সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে,
– ভাবী আগের বার আমি বরন করেছিলাম এবারো আমি করলাম।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।সে সবকিছু তাকিয়ে দেখছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।আফীফ তার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আজ থেকে তবে এই বাড়িতেই সংসার শুরু হোক!
সেহেরিশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।তার আগমনে জুহি খুশী হয়ে জড়িয়ে ধরে।একে একে বাড়ির সবাই তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।হারানো দিন গুলো ফিরে পেয়ে সেহেরিশের চোখের কোনে পানি জমে গেছে।
.
আফীফের রুমে ফিরে আসতেই কাকাতুয়া পাখিটি সেহেরিশের ঘাড়ে চড়ে বসে।এতদিন আফীফের অনুপস্থিতিতে পাখিটি জুহির সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে।
– ফুলপরী ফুলপরী।
– হাহ!এতদিন তুমি তোমার ফুলপরীর খোঁজ নিয়েছিলে?
– রাজা ভালো নেই।রাজা ভালো নেই।
পাখিটি একমনে কথা গুলো বলতে বলতে আবারো উড়ে যায় সেহেরিশ পাখিটার কথার মানে বুঝলো না।আফীফ সেহেরিশের পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং গমগম সুরে বলে,
– আজ থেকে আমরা এখানেই থাকছি।
– সত্যি?
– হুম।এই পুরো ঘরে তোমার চলাচলের অনুমতি দিলাম।তবে ঘরের বাইরে গেলে একমাত্র আমার সঙ্গে যাবে।ছাদে,বাগানে আমায় ছাড়া যেতে পারবেনা।
– ঠিক আছে তবে তাই হোক।
– এবার যাও রেস্ট নাও।কাঁচা ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিলাম তোমায়।
সেহেরিশ বিছানার কোনায় বসে যায়।পুরো রুমে চোখ বোলাচ্ছে এখানো সব আগের মতো আছে।আফীফ সেহেরিশের চিন্তিত মুখটা দেখে তারপাশে বসে যায়।কাধের উপর হাত তুলে দিয়ে ডানগালটা দিয়ে কাছে টেনে বাম গালে গাঢ় করে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।আফীফের চড়ের ব্যাথাটা এখনো রয়ে গেছে তার উপর এমন ছোঁয়ায় সেহেরিশ কুঁকড়ে উঠে।
– আহ্।আফীফ কি করছেন।
আফীফ ছাড়লো না।শেষ পর্যায়ে সেহেরিশ চুপচাপ আফীফের স্পর্শ অনুভব করতে থাকে।আফীফ মুখ তুলে তাকায় সেহেরিশের দিকে।
– চড় টা দেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইবো না।যা বলেছো তার জন্য আরেকটা চড় তোর প্রাপ্য।তবুও নিজের মাঝে খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়েছে তাই আদর করে দিলাম।
_
চালের আড়তে আফীফ সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কি না দেখতে এসেছে।তখনি দোকানের একজন ছেলে এসে আফীফকে বলে,
– ভাইজান আপনার শশুড় আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।
– আসতে বল।
খুরশীদ আনওয়ার বর্তমানে চন্দনপুরেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন।এদিকে অনন্তপুরের জমিগুলোর কাগজ যে আফীফের দখলে ছিল তা জানতে পেরে আফীফের কূটকৌশল সম্পর্কে প্রশ্নংসা না করে পারলেন না।
– আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিচ্ছিস না কেন?
– আরে আব্বা আসসালামু আলাইকুম!
– রসের আলাপ করতে আসিনি।আমার মেয়েকে ফেরত দে।
– আরে আজব আপনার মেয়েকে আপনি কী আমার কাছে বন্ধক রেখেছেন?যে বললেন আর আমি দিয়ে দেবো।সে আমার বিবাহিত স্ত্রী।
– শুনো ছেলে অনেক জ্বালিয়েছো আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।তোমার এইসব খেলা এবার বন্ধ করো।
– আসলেই জানেন আব্বা আমারো আর ভাল্লাগছে না এমন।কিন্তু আমার যে পুরোনো হিসাব বাকি।আমার সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে কেন এত পায়ঁতারা তা কিন্তু আমি জানি।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।যদি সবটা স্বাভাবিক ভাবে হতে দিতেন আমার শশুড় হিসেবে আপনার মানসম্মান রক্ষার্থে আমি নিয়োজিত থাকতাম যেহেতু আসল দোষটাই আপনি করেছেন তাই আমি আজ হাত পা বন্দি।
– তোমার কাছে আমি জ্ঞান নিতে আসিনি।আমি আমার মেয়ের খোঁজে এসেছি।
– আলহামদুলিল্লাহ আপনার মেয়ে ভালো আছে।আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি নানাভাই হতে চলেছেন।সেহেরিশ প্রেগন্যান্ট।
আফীফের শেষ বাক্যটা খুরশীদ আনওয়ারের কানে বজ্রের ধ্বনির মতো লাগলো।
– কি বলছো এইসব?
– আরে বাপ ব্যাটি দেখি এক স্বভাবের সু সংবাদ শুনলে আগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে হয় আর এদের মাথায় যেন বজ্র পড়ে।
– এটা কোন সু সংবাদ নয়।আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাবো।ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবো।
খুরশীদ আনওয়ারের কথা শুনে স্থির থাকতে পারলো না আফীফ।দু’পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাত চেপে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
– যদি সেহেরিশকে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেন তবে আমার লাশের উপর দিয়ে নিতে পারবেন তার আগে নয়।
খুরশীদ আনওয়ার আর কিছু বললেন না। চুপচাপ চলে গেলেন নিজ গন্তব্য।
.
কেটে গেলো পাঁচ মাস।সেহেরিশের পাগলামো দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। আফীফ সারাক্ষণ তার খোঁজ খবর রাখতে ব্যস্ত।কিন্তু যখনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় জুহির আমানতে রেখে যায় তাকে।সেহেরিশের একটাই কথা সে বাচ্চাটা রাখবে না।আফীফের ভাবতেই কলিজা ফেটে যাচ্ছে সেহেরিশের জন্য কোন সুযোগ সুবিধার সে কমতি রাখেনি,ভালোবাসার কমতি রাখেনি, এই বাড়ির কোন সদস্য তাকে অনাদর করছে না।তবে সে এমন বিহেভিয়ার করার কারনটা কি?
– সেহেরিশ তুমি এমন করার কারন কি?তুমি যা চাইবে তাই দেবো তুমি শুধু আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে অবহেলা করবে না প্লিজ।
– এইসব ন্যাকাবোকা কথা রাখুন আপনার কাছে। বাচ্চা আমার প্রয়োজন নেই।যদি একান্ত আমাকে আপনার প্রয়োজন হয় তবে একান্ত আমি আপনার জীবনে থাকবো বাচ্চার কি প্রয়োজন?
সেহেরিশের অর্থহীন কথায় আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।ইচ্ছে করছে কষে একটা চড় মারতে কিন্তু সে পারবেনা।ভুলেও না।
– সেহেরিশ তোমার জীবনে আমি সব কিছু ফিরিয়ে দেবো তুমি শুধু বাচ্চাটার খেয়াল রেখো।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলোনা।ভারী শরীরটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে শুয়ে যায় আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
সকালের আলো ফুটেছে অনেক আগেই।এখন দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়।আফীফের অনেক আগে ঘুম ভাঙ্গলেও সেহেরিশের ঘুম ভাঙ্গেনি।আফীফ তার কপালে চুমু এঁকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।বেলা এগারোটা যখন পার হয়ে যাচ্ছে তখনি সেহেরিশের ঘুম ভাঙ্গে।আড়মোড়া কাটিয়ে উঠতে নিলেই মুখের উপর তপ্ত শ্বাসে নড়ে উঠে।তার দিকে ঘোরে তাকিয়ে আছে আফীফ।
– কি হয়েছে এমন তাকিয়ে আছেন কেন?
– মাতৃত্বকালীন নাকি মেয়েদের রূপ বেড়ে যায়?সৌন্দর্য দিগুন বাড়ে তাদের মাঝে ভর করে কোমলতা পবিত্রতা।আমার সেহেরিশকেও এখন দেখতে তেমন লাগছে।ইসস আমার কোমল মতি।
– সাত সকালে আপনার বকবক শুরু হয়ে গেলো।
– হুম।আল্লাহ আমার প্রতিটি দিন যেন, আমার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে শুরু করার তৌফিক দান করেন!
চুপচাপ সেহেরিশ আফীফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আফীফ তাকে একটানে তুলে বসায়।চিরুনিটা হাতে নিয়ে সেহেরিশের চুল আছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,
– আরেহ কি করছেন কি?সকাল সকাল চুল নিয়ে পড়লেন কেন?
– পাগলীর মতো লাগছে তোমায়।দেখলে তুমি দেড় বছরে আমার যত্নে তোমার চুল এখন কোমড় ছুঁয়ে গেছে।
– হুহ।আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বেলু হয়ে যাই।অসহ্য লাগে।
– চড় তবে একটাও ডানে বামে যাবে না।নিশানা ঠিক ঠাক থাকবে।
দুপুরের খাওয়ার শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বারান্দায় যেতেই সেহেরিশের কানে আসে পরিচিত কারো কন্ঠ।ঘুরে তাকাতে নিজের মাকে দেখে দু’চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না সে।ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে আছে সে স্থির দৃষ্টিতে তার চোখ দেখে মনে সে যেন অবাস্তব কিছু বাস্তবে পরিনত হতে দেখেছে।
– মামনি?
– তোর মাকে জড়িয়ে ধরবি না?
– তুমি সত্যি এসেছো?
– আমরা সবাই এসেছি।
সেহেরিশ দেরি করলো না ঝাপিয়ে পড়লো তার মায়ের বুকে।জোরে জোরে কাদঁতে কাদঁতে একটা সময় স্থির হয়ে হয়ে গেলো।চোখ তুলে মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।ফর্সা কোমল ঘেরা মায়ের মুখটা কেমন যেন তার কাছে ফ্যাকাশে লাগছে।মা হাসতে চেষ্টা করলেও মনে হচ্ছে বেশ কয়েকবছর মা হাসেন নি।
– মামনি তুমি ভালো আছো?
সেহেরিশের এমন প্রশ্ন ফাহমিদার কাছে হাস্যকর লাগলো।মেয়ে ছাড়া ভালো থাকবেন কি করে তিনি?
– ভালো।তুই?
– হুম ভালো।বাবা, ফুফু,সামী কই?
– তারা আছে নিচে চল।
সেহেরিশকে নিয়ে নিচে চলে গেলো ফাহমিদা।আফীফ সবার সাথে হাসিখুশি কথা বলছে কিন্তু খুরশীদের সাথে মোটেও কথা বলেনি।বাড়ির সবার মাঝে আবারো আত্নীয়তা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।সেহেরিশের পরিবার সন্ধ্যার পরেই চলে যায়।এই পুরো সময়টাতে সেহেরিশের আশেপাশে নানান উচিলায় থেকেছে আফীফ।
সেহেরিশের হাসিখুশি মুখটা দেখে আফীফের মাঝে প্রশান্তি সঞ্চার ঘটে।
– আমি জানতাম তোমার পরিবারের জন্য তুমি এতটা ভেঙ্গে ছিলে তাই তাদের আবার ফিরিয়ে এনেছি।তোমাকে খুশি করতে সব করতে পারি শুধু তোমায় ছাড়তে পারবো না।
অন্যদিকে আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে আর তা বুঝতে পেরে সেহেরিশ মনে মনে বলে,
– জানতাম এমনটাই হবে।বাচ্চার জন্য যে আপনি কতটা পাগল তা আমি আগেই বুঝেছিলাম।সেদিন আমার প্রেগন্যান্সির শিওর হয়ে আমি খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলাম।কিন্তু আপনাকে আমার খুশি মুখটা দেখাই নি।অভিনয় করে গেছি।বলেছি বাচ্চা আমার চাইনা।আমি জানি আমার দেখা শোনার জন্য আপনি আমায় দেওয়ান বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন কিন্তু আমার বাবা-মাকে না।বাচ্চা রাখবো না বলে ফোর্স করতে করতে একটা সময় যখন আমি মনমরা হয়ে যাই তখনি বাবা-মাকে হাজির করে আমাকে খু্শি করার ব্যবস্থা করলেন।আমি যেমন আপনাকে ভালোবাসি তেমন আমার পরিবারকে তাই অতীতের সমাপ্তির জন্য হলেও নাটক আমায় চালিয়ে যেতে হবে।
সেহেরিশ শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।দিন দিন ক্লান্তিটা বেড়েই যাচ্ছে।
_
সেহেরিশকে রুমে রেখে আফীফ বাড়ির সকলের সঙ্গে একসাথে রাতের খাওয়ার খেতে বসে।আহনাফ দেওয়ান সহ বাড়ির সবাই সেহেরিশের পরিবার সম্পর্কে আলাপচারিতা করতে ব্যস্ত।সবার কথার মাঝে মুনিফ আফীফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– দেখ আফীফ ভাই যাই করেছিস তোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সেহেরিশকে ভালোবাসা।এই মেয়েটা অভিশাপ তোর জীবনে আশার পর থেকেই একের পর এক ধ্বংস লিলা শুরু হয়েছে।
মুনিফের কথায় ধমকে উঠে আহনাফ দেওয়ান।কিন্তু তাতে পাত্তা দিলো না সে।আফীফ চুপচাপ ভাত মাখছে আর মুনিফের কথা হজম করছে।
– সেহেরিশের বাবা মাকে আবার এই বাড়িতে এনে মোটেও ভালো করিস নি।সব বেইমানের দল।যত্তসব ফালতু লোক।
মুনিফ থামে এবারেও আফীফ কিছু বলেনি।চন্দনা নিজের ছেলের দিকে কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।তিনি জানেন আফীফের নিরবতা মানে ঝড়ের পূর্বাভাস।মুনিফ আবার বলে,
– আফীফ ছোট হলেও তোকে একটা এডভাইস দিচ্ছি সেহেরিশকে ছেড়ে দে এইজীবনে তোর জন্য মেয়ের অভাব হবেনা।তুই তো সেহেরিশের পরিবারকে শাস্তি দিতে চাস তাই না?তাহলে এখনি উপযুক্ত সময় সেহেরিশকে ডিভোর্স দে।সে না পারবে বাচ্চাটাকে মার‍তে আর না পারবে কলঙ্ক দূর করতে।
মুনিফের কথা শেষ কর‍তে দেরি হলো কিন্তু তার উপর আফীফের আক্রমণ করতে দেরি হলোনা।মুনিফের কলার চেপে আফীফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,
– অনেক সহ্য করেছি তোর লুকোচুরি নাটক।সেহেরিশের গায়ে কলঙ্ক লাগবে কেন?সে আমার বিবাহিত স্ত্রী আর আমার বৈধ সন্তান তার পেটে।তোর খেলা আর নয় এবার সমাপ্তি। আসল কালপিট যে তুই আমি ভালো করেই জানি শুধু চুপ ছিলাম।তবে এবার আমার কলিজায় আঘাত দিলি তুই এবার শেষ।
আফীফ টানতে টানতে মুনিফকে নিয়ে ব্লাক হাউকে যায়।অন্ধকার একটি রুমের দিকে তাকে ছুড়ে মেরে বাকা হেসে বলে,
– ওয়েলকাম টু মাই ব্লাক হাউজ!
#চলবে
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩১
ঘুমন্ত সেহেরিশের পাশে বসে আছে জুহি।দরজা খোলা থাকায় বাড়ির সবার একসঙ্গে কান্নার শোরগোলের কারন বুঝলো না সে।এদিকে সেহেরিশকে রেখেও যেতে পারবেনা।তবুও মনের সংশয় কাটাতে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।চন্দনা মুনিফের জন্য মুখে হাত দিয়ে বেশ শব্দ করে কাদঁছে।অন্যদিকে সেঁজুতি সহ বাড়ির সকলেই আহাম্মক বনে গেছে হঠাৎ কি হয়ে গেলো বুঝতে পারলো না কেউ।আফীফের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে মুনিফ সবসময় তার সাথে ছিল কিন্তু আজ হঠাৎ কি হলো?মুনিফ বা সেহেরিশের সাথে কি করেছে সব প্রশ্নের উওর খুঁজতে দৈর্য্যহারা হয়ে উঠছে সবাই।
.
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় ফ্লাশ অন করে মুনিফের দিকে তাক করতেই সহসা চোখ,মুখ কুচকে নেয় সে।
– কিরে মুনিফ আমার সাথে বেইমানি করলি কেন?নিজের ভাইয়ের মতো মূল্য দিয়েছি তোকে।
– আমি কি করেছি? মিথ্যা অভিযোগ একদম তুলবি না আফীফ ভাই।
– বাহ!এখনো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছিস?এই আফীফ যে প্রমাণ ছাড়া কথা বলেনা তুই ভালো করে জানিস।
মুনিফ উওর দিলো না বরং আফীফের দিকে তাকিয়ে রইলো বিরক্ত হয়ে।আফীফ বিদ্রুপ হেসে বলে,
– তুই জানতি আমি সেহেরিশের প্রতি দূর্বল কিন্তু সব জেনে শুনে সেহেরিশের প্রতি তোর উতলে ওঠা ভালোবাসা মোটেও মানায় না।
– কি বলছিস আফীফ,মাথা ঠিক আছে তোর?
– চুপ!সব ঠিক ঠাক আছে।শুধু তোকে ধরার যোগ্য সময় পাইনি আমি।সেহেরিশ এই বাড়িয়ে আসার পর রাতে আমি ছাড়াও তুই সেহেরিশের রুমে যেতি।রাতে আমান স্পষ্ট দেখেছে তোকে সেহেরিশের রুমে প্রবেশ করতে।আমি এর পরেও চুপচাপ ছিলাম।সেহেরিশের প্রতি কড়া নজর বাড়িয়ে দিলাম।মারুফা ফুফি সহ খুরশীদ আনওয়ারকে তুই পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিস এবং পারভিনের দলের সদস্যদের সঙ্গেও তোর যোগাযোগ আছে।সেদিন তুই তাদের খবর দিয়েছিলি পারভিনকে ব্লাক হাউজ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।ব্লাক হাউজে অনন্য দরজার পিনের সাথে পারভিনের দরজার পিন কোডের মিল নেই। সেই দরজার পিন একমাত্র আমি আর তুই জানতাম তাহলে বল তোকে ছাড়া পারভিনের দরজা অক্ষত অবস্থায় খোলে কি করে?সবটা তুই আগে থেকেই প্লানিং করে রেখেছিস।
– তোর সমস্যা কি আফীফ?শুধু শুধু আমার ঘাড়ে দোষ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু।
– তাই নাকি?তোদের এইসব প্লানিং কিছুটা হলেও আমার শাশুড়ী জানেন।আজ তিনি আমার কাছে সবটা খুলে বলেছেন এবং দাবী করেছেন দুই পরিবারের সম্পর্ক যেন আগের মতো করে তুলি।
– তার মানে….
– এত চিন্তা করিস না মাথা ফেটে যাবে তোর।আমাকে আমার কাজটা করতে দে।
আফীফ উঠে দাঁড়ায়।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সাতজন কর্মচারীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– যে করেই হোক পারভীন-পারু কোথায় আছে মুনিফের পেট থেকে বের কর।প্রয়োজনে মারবি,গায়ে গরম পানি ঢালবি তবুও যেন সত্যটা বের করে। অনেক হয়েছে নাটক আর না।
রাতে আফীফ বাড়ি ফিরতেই সবাই যখন জানতে চায় মুনিফের দোষটা কি?তখন আফীফ সবাইকে এড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়।মন,শরীর দুইটাই বড্ড ক্লান্ত।সেহেরিশের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকে পাশে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
কেটে যায় দুইদিন এতদিনেও মুনিফের মুখ থেকে সত্য কথা বের হয়নি।কিন্তু আজ আফীফের অত্যাচারে পারভিন এবং পারুর ঠিকানা বলে দেয় সে।সবাইকে না জানিয়ে আফীফ লোক পাঠিয়ে তাদের খুঁজতে পাঠায়।অবশেষে পেয়েও যায়।বর্তমানে আফীফ পারু,পারভিন মুখোমুখি।
– আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন আপনারা?
আফীফের সালামের জবাব দিলো না পারভিন, পারু বরং তারা দুজনে দুজনের মুখ দেখাদেখি করছে।কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির দারপ্রান্তে প্রবেশ করে সেহেরিশের পুরো পরিবার।
ব্লাক হাউজ বাড়ির উঠানে সবাই মিলে উৎসুক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে।সেহেরিশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুহির হাত ধরে।তার দিকে আফীফ পূর্ণ দৃষ্টি রেখে আফীফ গমগমে সুরে বলে,
– ঘরে যাও সেহেরিশ তুমি ক্লান্ত।
– না বাড়ির সবাই এখানে আছে আমি এখানেই থাকবো।
সেহেরিশকে ঘাড় ত্যাড়ামি করবে আফীফ ভালো করেই জানে তাই জুহিকে ইশারা করে তাকে নিয়ে যেতে কিন্তু নাছোড়বান্দা সেহেরিশ তাতেও রাজি হলো না।কোন উপায় না পেয়ে আফীফ সেহেরিশের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।আহনাফ দেওয়ান চিন্তিত গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন তার দিকে তাকিয়ে আফীফ বলে,
– দাদাজান আমি কোথা থেকে শুরু করবো?পারু নাকি পারভিন থেকে?নাকি খুরশীদ আনওয়ার থেকে?
‘খুরশীদ আনওয়ার’ নামটা বলতেই সেহেরিশ সহ বাড়ির বাকিরা চমকে তাকায়।আহনাফ দেওয়ান কিঞ্চিৎ হেসে বিদ্রুপ সুরে বলে,
– অতীরের ক্ষত বর্তমানে এসে দাগ লেগেছে তবে অতীত থেকেই শুরু হোক।
আফীফ স্থির হেসে মারুফার দিকে তাকায়।
– ফুফি আপনার বাবা- মা,হাজবেন্ড মারা যান রোড এক্সিডেন্টে আপনি আমাদের এটা বলেছিলেন রাইট?
– হ্যা।
– কিন্তু আপনার তাদের যে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে এটা কি জানেন?
আফীফের কথায় সবাই ঝলকানিতে তাকালেও আহনাফ স্থির ভাবে বসে আছেন।
– আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছি।
– আপনার বাবা মানে সেহেরিশের দাদা দুই বিয়ে করেন।আপনি এবং খুরশীদ আনওয়ার প্রথম পক্ষের সন্তান আর পারভিন, পারু দ্বিতীয় পক্ষের এটাও আপনারা জানেন?
সেহেরিশ চকিতে তাকায় সবার দিকে।তার দাদার মৃত্যুটা পর্যন্ত সে জানলেও বিয়ের বিষয়টি মোটেও জানেনা।
– আমাদের ব্যাক্তিগত কথাগুলো সবার সম্মুখে তোলা কি ঠিক হচ্ছে আফীফ?
মারুফার কথায় ঠাট্টা স্বরে হাসে আফীফ।
– আপনাদের ব্যাক্তিগত কথাগুলো আর ব্যাক্তিগত নেই।সেটা ১২/১৩ বছর আগেই আমার দাদার কানে বারি খাচ্ছিলো।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ এবং সুযোগের অভাবে দাদাজান কিছুই করতে পারেনি।
– আফীফ এত সময় আমাদের নেই।খুব দ্রুত সবটা বলে দে।
আহনাফ দেওয়ান শেষ কথাটা বলে খুরশীদ আনওয়ারের দিকে একবার তাকান।
আফীফ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– সেহেরিশের দাদার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী জান্নাত।তাদের ঘরে যখন দুই জমজ মেয়ে পারু এবং পারভিন হলো তার কিছুদিন পরেই প্রথম পক্ষের বউ সেটা যানতে পারে।তখনো সেহেরিশ বাবা এবং ফুফি বেশ বড় হয়ে গেছে।ঝগড়া বিবাদে কেটে যায় বছর।পারু,পারভিন বেশ বড় হয়ে যায়।তারা যখন বাস্তবতা বুঝতে শেখে তখন সংসারে একমাত্র মায়ের আদর ছাড়া বাবার আদর ছিলনা।ছোট থেকেই রাগী ছিলো পারু।তার যখন উনিশ বছর বয়স তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সৎ মায়ের কোন ক্ষতি করবে।কেননা ভালোবাসায় সমৃদ্ধ ছিল মারুফার পরিবার কিন্তু তাদের পরিবারে অভাব ছিল পিতার,সুখের। ঠিক তাই করলো।আমাদের বাড়ির ড্রাইভারের ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল পারুর আর তাকে হাত করে গাড়ি এক্সিডেন্ট করালো। সেদিন মারুফা বাদে গাড়িতে থাকা সবাই মারা যান।
সবাই যখন জানতে পারে এটি এক্সিডেন তখন আমাদের ড্রাইভারের তার ভাইয়ের সাথে গোপন আলাপে জানতে পারে এটি পরিকল্পিত।ঠিক তখন আমার দাদাজান সেহেরিশ এবং তাদের পরিবারকে নতুন করে চিনতে পারে।এবং পারুকে খুঁজতে লোক লাগায়।কিন্তু বিষয়টি জানতে পেরে পারু নিখোঁজ।
এদিকে বাবা মায়ের মৃত্যুতে শোকাহত থাকার পরিবর্তে মারুফা এবং খুরশীদ আনওয়ার সম্পত্তি ভাগাভাগিতে ঝগড়া লেগে যান।কেননা সম্পত্তির দাবিদার ছিলেন প্রথম স্ত্রী জান্নাত। নানান ভাবে ফোর্স করেও জান্নাত তার অংশ ছাড়তে রাজি হননি।তাই খুরশীদ আনওয়ার এবং মারুফা সবচেয়ে নিম্ন মানের কাজটা করেন।তারা জান্নাতকে মারার জন্য লোক ভাড়া করেন।কিন্তু তিনি পালিয়ে যান।চারিদিকে জান্নাতের খোঁজ না পাওয়ায় সবাই খুরশীদ আনওয়ারের দিকেই আঙুল তুলে তাই তিনি সব ফেলে দ্রুত বিদেশ পাড়ি জমায়।এদিকে মা, বোন বিহীন একা হয়ে যায় পারভিন তাই আমার দাদী নিজের সহযোগিতা হিসেবে তাকে দেওয়ান মঞ্জিলে নিয়ে আসেন।
কিন্তু বছরের পর বছর পারভিন আন্টি আমাদের কাছে থেকেও মারুফার কাছে টাকার বিনিময়ে সেহেরিশকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।
আফীফ কথা শেষ করার আগেই আহনাফ দেওয়ান বলে,
– একদম ঠিক করেছে।তুমি আমার মেয়েকে বন্দি করেছো নিজের স্বার্থে ঠিক তেমন টাকার স্বার্থে পারভিন আমার মেয়েকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
খুরশীদের গমগমে সুরের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো আফীফ।
– তাই নাকি, আপনার মেয়ে কি বাজারের পণ্য?মাত্র ৫০/৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে সেহেরিশকে দেওয়া হয়েছিল।
আফীফের কথায় মাথা নিচু করে নেয় খুরশীদ।বিষয়টি সেহেরিশের সম্মানে লাগে।
– যাই হোক পারভিন সেহেরিশকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পর সে নিজেও পালিয়ে যায়।কিন্তু তার উপর আমার এতটাই জেদ চেপে যায় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেদিন সেহেরিশকে পাবো সেদিন পারভিন মুক্ত হবে।এত বছর তাকে বন্দি রেখে কয়েকদিন আগে আমি জানতে পারি যাকে বন্দি করেছি সে পারভিন নয় পারু।যাকে আমার দাদাজান এক যুগ থেকে খুঁজে চলেছে অথচ সে আমাদের কাছেই ছিল।অদ্ভুত!
আফীফ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা নিয়ে সেহেরিশের সামনে রাখে আর সেহেরিশকে ইশারা করে চেয়ারে বসতে বলে।কিন্তু সেহেরিশ মাথা ইশারায় না করতেই আফীফ দাঁত কিড়মিড় করে ফিসফিসিয়ে বলে,
– কোলে ওঠার শখ করে লাভ নেই চুপচাপ বসে যাও।কোন সাউন্ড যেন না হয়।
– আরে….
– আবার সাউন্ড।
সেহেরিশ তর্ক করলো না এই মূহুর্তে তর্ক করা তার সাধ্যি নেই।তাই চুপচাপ বসে যায়।
আফীফ আহনাফ দেওয়ানকে ইশারা করে বাকি কথাটা শেষ করতে তাই আহনাফ দেওয়ান পারুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বন্দি করেছিল পারভিনকে অথচ তুমি সেখানে কি করে এলে?
পারু চুপ করে আছে তাকে চুপ থাকতে দেখে আফীফ দুইহাতে তালি দিয়ে তাড়া সুরে বলে,
– দ্রুত,দ্রুত বলুন আমার হাতে সময় নেই।আজকেই সবটা সমাধান করতে হবে।যত চুপ থাকবেন বিপদ তত বাড়বে।
– আসলে….
– নকল জানতে চাইনি আমি আসলটাই জানতে চেয়েছি।আর উলটা পালটা চালাকি করে লাভ নেই আজ সব পথ বন্ধ।
– আমার সৎ মা এবং বাবাকে মারার দায়ে আড়ালে আমাকে যখন সবাই খুঁজতে থাকে তখন আমি পালিয়ে যাই।কেননা আমি জানি একবার আহনাফ দেওয়ানের খপ্পরে পড়া মানে ভয়াবহ শাস্তি।এদিকে কয়েকমাস পর পারভিনের সাথে যোগাযোগ করলে সে আমাকে সেহেরিশকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করার বিষয়টি বলে তখন আমার মাথায় বুদ্ধি আসে।পারভিনের দেওয়া শাস্তি হবে সীমিত কেননা সেহেরিশকে একদিন না একদিন আফীফ খুঁজে পাবে আর আমার শাস্তি সারাজীবনের জন্য তাই ইচ্ছে করে পারভিন সেজে আফীফের লোকের হাতে ধরা পড়ার নাটক করি।আর আমি হয়ে যাই বন্দি।অন্যদিকে পারভিন লুকিয়ে বাচঁতে থাকে।আমার থেকেও তখন তার বিপদ বেশি ছিল। কেননা সবাই যানে পারভিন আফীফের কাছে বন্দি আর পারু পলাতক তাই তাকে যে কেউ দেখলে বলে ফেলবে সে পারু।দুই বোনের চেহারা মিল হওয়ায় কেউ সহজে বুঝতে পারবেনা।
– তাহলে বাড়িতে নিরবে হামলা সেহেরিশকে কিডন্যাপ,আমাকে চিরকুট দিয়ে ভয় দেখানো তা কে করেছে?
– পারভিন করেছে একমাত্র সেহেরিশের উপর জেদ করে।কেননা সেহেরিশের বাবার কারনে আমাদের মাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অন্যদিকে দু-বোন দুই দিকে।যা হয়েছিল সবটাই আড়ালে মিটে যেত কিন্তু অনন্তপুরের ঝামেলা চন্দনপুরে এসে সবটা এলোমেলো হয়ে যায় তাই লোক নিয়ে এমনটা করেছে পারভিন।
– তবে মুনিফ কার সাথে হাত মেলায়?
– সে সেহেরিশের প্রতি দূর্বল হয়ে ব্লাক হাউজে আমার সাথে সব প্লানিং করে।অন্যদিকে মারুফার সাথে মিলে সবাইকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।দেওয়ান বাড়ির সব আপডেট আমারা মুনিফের কাছ থেকে পেতাম।
আফীফ ঘড় ঘুরিয়ে তাকায় মুনিফের দিকে।মুনিফ তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অন্যদিকে।আফীফ একজন লোককে কিছু একটা ইশারা করে তখনি লোকটি ব্লাক হাউজ থেকে হুইল চেয়ারে করে একজন মহিলাকে নিয়ে আসে।আর তাকে দেখে পারু এবং পারভিন একসঙ্গে বলে,
– মা!
খুরশীদ, মারুফার চিনতে বেশ একটা সময় লাগে নি।সামনের মহিলাটি তাদের সৎ মা জান্নাত।
– আমাদের কাছে ছিলেন তিনি এতদিন।রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসেন।তিনি চিকিৎসা অবস্থায় প্যারালাইজড হয়ে যান।পরবর্তীতে আমরা তার নিরাপত্তার জন্য সব কিছু ব্যাবস্থা করে ব্লাক হাউজে রাখি।ব্লাক হাউজের ডানের গলির রুমে ছিল পারু রূপি পারভিন আর বামে ছিল উনি।
সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।আফীফ এগিয়ে আসে খুরশীদ আনওয়ারের কাছে।
– আব্বা আপনি জানতেন আমি আপনার এইসব কার্যকলাপ সম্পর্কে জানি।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছিলেন এবং সেহেরিশকেও বিয়ে দিতে অসম্মতি জানান।কিন্তু শেষ জিৎটা আমার হয়েছে।যান আপনার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চান।
– কি বলছো তুমি?তোমার কথা শুনতে বাধ্য আমি নই।
– অবশ্যই বাধ্য আপনি আর মারুফা ফুফু পা ধরে ক্ষমা চাইবেন।আপনাদের এই জঘন্য কাজের জন্য দুইটা অপশন দিলাম প্রথমত,ব্লাক হাউজে বন্ধি থাকবেন কয়েক বছর আর দ্বিতীয়ত,পা ধরে মাফ চাইবেন আপনার মায়ের কাছ থেকে।
.
কেটে গেছে বেশ কয়েক সাপ্তাহ।সেদিন খুরশীদ এবং মারুফা অবশেষ মাফ চায় তাদের মায়ের কাছ থেকে।পারভিনকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং আলাদা একটি বাড়িতে তার মাকে নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় আফীফ।পারুকে আবারো ব্লাক হাউজে বন্দি করা হয়।মুনিফকে কয়েক মাসের জন্য ব্লাক হাউজে বন্ধ করে রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় আফীফ।তাতে তাল মিলিয়েছে মুনিফের মা চন্দনা কেননা যার বাড়িতে থাকছে তার সাথেই বেইমানি বিষয়টা হাস্যকর।
খুরশীদ আনওয়ার সহ বাকিরা আগের মতোই আছেন।সেহেরিশ এবং আফীফের সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক।
.
বিছানার সাথে হেলান দিয়ে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে সেহেরিশ।আফীফ ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে আছে ভ্রু কুচকে।
– আফীফ শুনছেন?
– বলো।
– আমার সাথে আপনার দেখা না হলেও পারতো তবে আর এতটা ঝামেলা হতো না।মুনিফের সাথে আপনার বিবাদ থাকতো না।আসলে আমি অভিশপ্ত!
সেহেরিশের কথায় আফীফ শব্দ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে তার দিকে ঘুরে তাকায়।
– যার যে শাস্তি সে তা পাবে এতে তোমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই।
– তবুও….
সেহেরিশ কথাটা প্যাচাতে নিলেই, ঠাসস করে শব্দ হয়।সেহেরিশ চমকে তাকাতেই দেখে আফীফ নিচে কফির মগটা ছুড়ে ফেলেছে।
– আরে কি করছেন?
– বুঝলে সেহেরিশ হাতটা বড্ড আনচান করছে।তাই কফির মগটা ছুড় মেরেছি।আনচান এখনো কমছে না কি করি বলতো?
ব্যস আফীফের কথায় সেহেরিশ শটান হয়ে শুয়ে যায় অন্য দিকে পাশ ফিরে। গায়ের কাথাটা মুড়িয়ে দোয়া – কালাম পড়তে থাকে।
কেননা সে ভালো করেই জানে আফীফ তার কথায় ক্ষেপেছে এবার চড় তার গালে পড়তে সময় নেবেনা।
– লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্ জালিমীন।’
– কি পড়ছো সেহেরিশ?
– দোয়া কালাম পড়ছি।এই সময় দোয়া-কালাম পড়া ভালো।
– হ্যা বেশি বেশি পড় তোমার মাথা থেকে যেন উদ্ভট,বস্তাপঁচা চিন্তা গুলো চলে যায়।
– লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্ জালিমীন।’আল্লাহ এবারের মতো বাঁচাও!
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩২ [শেষ]
হাসপাতালের করিডোরে চুপচাপ মুখে হাত দিয়ে বসে আছে আফীফ।তার পাশে বাড়ির বাকি সদস্যরা।জুহি সেহেরিশের ঘুম ভাঙ্গতে তার কাছে যায়।সেহেরিশ স্মিত হেসে বলে
– আমার ছেলেটা কোথায়?
– জানিনা।
জুহির এমন নির্লিপ্ত কথায় পিলে চমকায় সে।জানি না মানে কি?বাচ্চাটা তো তাদের কাছেই ছিল।সেহেরিশ কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে থাকে।
– জানি না মানে কি?আমার বাচ্চাটাকে এনে দে।
– বাচ্চা তো নেই।
– নেই মানে?
সেহেরিশ এবার বেশ চিৎকার করেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল।কিন্তু শান্ত ভাবে তাকিয়ে আছে জুহি।
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?তোর ভাইয়া কই?
– বাইরে।
– তাকে ডাক আমার ছেলে কই?
জুহি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এবং আফীফকে ডেকে আনে।আফীফ তার পাশে বসে রাগি কন্ঠে বলে,
– এত লাফালাফি করছো কেন সেহেরিশ, তুমি এখনো সুস্থ হওনি।
– আমি ঠিক আছি কিন্তু আমার বাচ্চা কোথায়।
– সে যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।
– মানে কি?কোথায় আছে?
– নিরাপদ স্থানে আছে।আমার পরিচিত একজন বন্ধুর বাচ্চা হয়নি বেশ কয়েক বছর।তাই আমার ছেলেকে তাদের আমানতে দিয়ে এসেছি।
সেহেরিশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আফীফের মুখের দিকে।কি বলছে এইসব সে।যে বাচ্চার জন্য আফীফ পাগল হয়ে গেছিলো।সেহেরিশের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেনি সেই আফীফ নিজের সন্তানকে অন্য আরেকজনের কাছে রেখে এসেছে।এটা যেন অবিশ্বাস্য বাক্য সেহেরিশের মস্তিকে বিশ্বাস করানোর জন্য ঠেসে ঢোকানো হচ্ছে।
– আফীফ আপনি ভেবে চিনতে বলছেন তো?আমাদের ছেলে কোথায়?
– কয়বার বলবো আমি?তাকে সারাজীবনের জন্য রেখে এসেছি তাদের কাছে।আজ থেকে তারাই ওর মা-বাবা।
সেহেরিশ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলোনা।যেহেতু নরমাল ডেলিভারি তাই সহজে সেহেরিশ উঠে বসে আফীফের সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
– আমার বাচ্চা এনে দাও।তোমার বন্ধুত্বের খাতির তোমার কাছে রাখো আমি আমার বাচ্চাকে চাই।
সেহেরিশের বাঘিনী রূপটা দেখে নির্বোধ হয়ে যায় আফীফ।ঠিক দশমাস আগের সেহেরিশের সাথে দশমাস পরের এই সেহেরিশের কোন মিল নেই।দশমাস আগের সেহেরিশ নিজের বাচ্চাকে মারতে উঠে পড়ে লাগে আর দশমাস পরের বর্তমান সেহেরিশ নিজের বাচ্চাকে দেখতে আফীফের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে গেছে।
– সেহেরিশ তুমি এভাবে উঠে গেলে কেন?সেলাইনের সুই হাতে বিধঁবে।
– আমার যা ইচ্ছে হোক আমার শুধু আমার ছেলেকে চাই।
– আর সম্ভব না তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনা।সে যেখানে আছে ভালো আছে এই টুকু আমি বলতে পারি।
আফীফের কথায় নিজেকে স্থির থাকতে পারলো না সেহেরিশ।একটানে স্যালাইনের হাতটি খুলে আফীফের কলার চেপে ধরে।ফর্সা হাতে সুই বিঁধে যাওয়ার ফলে গলগল করে রক্ত ঝরছে।সেই রক্ত কিছুটা আফীফের শার্টেও লেগে আছে।
– আরে ফুলপরী কি করছো তুমি?তোমার হাত….
– চুপ, কথা প্যাচাবেনা আমার ছেলেকে এনে দাও।
– সম্ভব না।
– কেন সম্ভব নয়?
– দশমাস আগে বলেছিলে বাচ্চাটা তোমার চাই না।এবোরশন করাবে এখন বাচ্চাটার কোন প্রয়োজন নেই তাই যা করার আমি করে নিয়েছি।
– পাগল হয়ে গেছেন আপনি?তখন যা বলার বলেছি এখন আমার বাচ্চা চাই।আমার ছেলেকে এনে দিন।
আফীফ উওর দিল না বরং চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সেহেরিশের চোখের দিকে।আফীফের নীরবতা সেহেরিশ মোটেও সহ্য কর‍তে পারলো না তাই রাগ দেখিয়ে আশে পাশে নিজের ক্ষতি করার মতো কিছু খুঁজতে লাগলো।আফীফ প্রথমে সেহেরিশের কান্ড বুঝতে পারেনি কিন্তু পরে বুঝতে পেরে সেহেরিশকে কাছে টেনে নেয়।
– কি করছো তুমি।
সেহেরিশ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।আফীফের বুকে লাগাতার কিল ঘুষি মেরে হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে যায়।তার হাত থেকে এখনো রক্ত ঝরছে।আফীফের কোলে ঢলে পড়তেই আফীফ তাকে দ্রুত বিছানায় শুইয়ে দেয়।এতক্ষণ সেহেরিশের চিৎকারে বাড়ির সবাই হাসপাতালের রুমে জড়ো হয়ে গেছে।আফীফ জুহিকে ইশারা করতেই সে ডাক্তারকে ডেকে আনে।মহিলা ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করেই আফীফের দিকে চাপা রাগ ঝারে।
– আগেই বলেছি এমন মজা করবেন না।পেসেন্টের এই মূহুর্তে মানসিক চাপ দেওয়া মানে হেরফের হয়ে যাবে।
– সরি মিসেস।আমাকে এটা করতেই হতো আপনি ট্রিটমেন্ট শুরু করুন।
.
পারভিন,পারুর সমস্যা সমাধানের পর কেটে যায় বেশ কিছু মাস।আজ দুপুরে সেহেরিশকে হাসপাতালে আনা হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তান।জন্মের একঘন্টা পর বাচ্চাকে ফিডিং করাতে নিলে তখন সেহেরিশ দুচোখ ভরে বাচ্চাটাকে দেখে।তার কিছুক্ষণ
পরেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে যায়।ঘুম থেকে উঠে বাচ্চার কথা জানতে চাইলে জুহি এড়িয়ে যায়।শেষে আফীফের কথায় বিস্ময় হয়ে যায় সেহেরিশ।
.
নিভু নিভু চোখ নিয়ে আলতো তাকায় সেহেরিশ।সামনে আফীফকে দেখে আবারো চোখ বন্ধ করে নেয়।আবার চোখ খুলতেই আফীফের কোলে তোয়ালে প্যাচানো বাচ্চা দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।
– আমার বাবু?
– না আমার নয় বলবে আমাদের বাবু।
আফীফের কথায় সহসা হেসে দেয় সেহেরিশ।তার ঠোঁটে হাসি হলেও চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।সেহেরিশ উঠে বসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়।
– আমায় তুমি মিথ্যা বলেছিলে আফীফ?
– আমার আর উপায় ছিল না তোমায় একটা শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
– কিসের শিক্ষা?
– মনে আছে দশমাস আগের কথা?বাচ্চাটা তুমি চাও নি আমি চেয়েছি।আর তাকে মারার জন্য কত পাঁয়তারা করেছো।
সেহেরিশ নিঃশব্দে হাসে।
– আমি তোমাকে কবজা করার জন্য এমন করেছি আফীফ।আমি এতটাও নির্বোধ নই যে আফীফের ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারবো আর তার সন্তানকে পারবো না।
– তার মানে?
– কিছু না।
সেহেরিশ আফীফ দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠে।
তাদের হাসিতে অম্লান হাসে সেঁজুতি সহ বাড়ির মুরব্বিরা।এই দুটো জীবন এক সুতায় বাঁধার জন্য কত বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল।আফীফের পাগলামো সহ্য করে গেছে তার পরিবার।অন্যদিকে সেহেরিশের জন্য আফীফের ভালোবাসা খুরশীদ আনওয়ারের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ পাগলামি মনে হয়েছিল কিন্তু এই কয়েক মাসে তিনি বুঝে নিয়েছেন তার মেয়ের জন্য তিনি ছাড়া যদি কোন ভরসার স্থান থাকে আর সেটা হলো আফীফ।এখন তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতেও বাধা নেই সেহেরিশের জন্য আফীফ একমাত্র যোগ্য
___
দেওয়ান বাড়ি জুড়ে আজ হইচই লোক সমাগমে ভরপুর।পারভিন,সহ সবাই হাতে হাত লেগে কাজ করছে কেননা আজ সেহেরিশ এবং আফীফ দেওয়ানের ছেলের চারবছর পূর্ণ হয়েছে।সুখ-দুঃখের মাঝে কেটে গেছে চারটি বছর।এই চার বছরে সবার জীবনেই টুকটাক পরিবর্তন এসেছে।খুরশীদ আনওয়ার সহ তাদের পরিবার ইতালি থেকে শিফট করে সবাই এখন অনন্তপুরে নিজ ভিটেমাটিতে ফিরে এসেছে।মুনিফকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তার মাঝে এখন সেহেরিশ এবং আফীফের জন্য শ্রদ্ধা ভালোবাসা থাকলেও মনের মাঝে হুটহাট হিংসার আগুন জ্বলে উঠে।পারুর বন্দি জীবনের সমাপ্তি আর ফিরে আসেনি।মৌ,সামী,আমান বেশ খানিকটা বড় হয়েছে।জুহির পারিবারিক ভাবে এংগেজমেন্ট কমপ্লিট।
আজ আফীফ এবং সেহেরিশের একমাত্র পুত্র সন্তান আরিয়ানের জন্মদিন।সূদুর বিদেশ থেকে এই প্র‍থম আরিয়ানকে দেখতে আসছে কেইন এবং তুন্দ্র।তারা বর্তমানে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত কর‍তে ব্যস্ত।সকাল দশটা বেজে গেছে কিন্তু এখনো আরিয়ানের ঘুম ভাঙ্গনি তাকে ওঠানোর জন্য আফীফ রুমে ঢুকতেই বিস্ময় হয়ে যায়।কেননা বিছানার মেঝেতে চারিপাশে কোলবালিশ গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আরিয়ান যে ঘুমের তোড়ে সব ফেলে দিয়েছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে আফীফ।
– এই ছেলেটা সম্পূর্ণ তার মায়ের মতো হয়েছে।সারাক্ষণ ছোটাছুটি।তার মায়ের ঘুমের মাঝেও তিলার্ধেক শান্তি নেই।আমি জড়িয়ে ধরলে তার মাঝে দু’চারটা লাথি অবশ্যই আমাকে সহ্য কর‍তে হবে।মা ছেলে এক কিসিমের।
আফীফের বিড়বিড় করে বলতে থাকা কথা গুলো যে সেহেরিশ তার পেছন থেকে শুনে নিয়েছে তা বুঝতে পারেনি আফীফ।তাই আবার পেছনে ঘুরতেই সেহেরিশের সাথে সামান্য ধাক্কা লাগে।সেহেরিশের রাগান্বিত মুখটা দেখে আফীফ ভড়কে যায়।
– ত..তুমি?
– তো আর কাকে আশা করেছিলে?
– বাহ ইদানীং ফুলপরী তুমি বেশি চালাক হয়ে গেছো আমার কথা দিয়ে আমাকেই শাশাও।আগে এই সেম ডায়ালগ দিয়ে তোমায় কুপকাত করতাম।
আফীফের ঠোঁটের কোনে চকচকে হাসি।সেহেরিশ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে
– যার সাথে সংসার করছি তাকে কপি করতে পারবো না কেন?যাই হোক আমার আর আমার ছেলের সম্পর্কে এত বাজে কথা বলার সাহস কোথায় পেলে তুমি?
– আরে আজব বাজে কথা কি বললাম।সব সত্যটা বলেছি।প্রমাণ চাই তোমার?
আফীফ একটানে সেহেরিশকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে।তৎক্ষনাৎ ছুটোছুটি শুরু করে সে।আফীফ সামলাতে না পেরে তাকে নিয়ে বিছানায় ঠাসস করে পড়ে যায়।কিন্তু তবুও ছাড়েনা সেহেরিশকে।তাদের কান্ডে কিছুটা নড়েচড়ে উঠে আরিয়ান।সেহেরিশের ছোটাছুটি এখনো থামেনি।
– আরে ছাড়ুন।
– দেখলে তো প্রামাণ করে দিলাম।কতটা লাফালাফি করো তুমি।যাই হোক রোমাঞ্চে বাঁধা দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তোমায় কঠোর ভাবে শাস্তি দি।
– এখন রোমাঞ্চের টাইম নয় ছাড়ুন আমায়।
সেহেরিশ উঠতে নিলেই তার গলার বাইটের দাগে চোখ পড়ে আফীফের।
– আরে বাহ দেখলে আমার সিলমোহর লেগে আছে।
আফীফ সেহেরিশের দাগের দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই সেহেরিশ চিৎকার দিয়ে বলে,
– আপনার এইসব কুত্তা মার্কা অভ্যস রাখুন।
– হোয়াট?কুত্তা মার্কা মানে?
– মানে বুঝেন না?
সেহেরিশ ধাক্কা দিয়ে আফীফকে সরিয়ে উঠে বসে এবং আরিয়ানকে ঘুম থেকে তোলার জন্য ডাকতে থাকে।আফীফ এখনো ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ কাকাতুয়া পাখিটি উড়ে এসে আফীফের ঘাড়ে বসে।
– তাকিয়া তুমি ইদানিং আমায় সহ্য করো না ব্যাপার টা কি?
সেহেরিশ উওর দেওয়ার আগেই কাকাতুয়া বলে উঠে ,
– রাজা রেগে গেছে, রাজা রেগে গেছে।
– হ্যা তোমার রাজাকে বলে দাও তাকে ইদানীং সহ্য করি না কারন আমার পুরোনো প্রেমিক আসছে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছি।
সেহেরিশ আরিয়ানকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়।এদিকে আফীফ আগুন মুখি হয়ে বসে।আছে।আজ তো ‘কেইন’ আসছে।
.
সন্ধ্যায় বাড়ির সকলেই উপস্থিত।কেইন এবং তুন্দ্র বিকালে এসে পৌছে গেছে।কেইনের সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই খাতির জমেছে আফীফের।পুরোনো সব ভুলে আবার নতুন উদ্যমে পথ চলা।কিন্তু আফীফের মনের কোনে হিংসা রয়ে গেছে সেহেরিশ কেইনের সাথে কথা বললেই সেখানে উপস্থিত হয় আফীফ।সেহেরিশকে চোখে চোখে রাখাটাই যেন তার একান্ত কাজ।
আরিয়ান সবার মাঝে হইচই করছে।হঠাৎ তুন্দ্রের একটি কাজ আরিয়ানের চোখে পড়ে সহসা ভ্রু কুচকে দৌড়ে যায় সেহেরিশের কাছে।
– মাম্মি মাম্মি তোমাল বন্ধু পঁচা।
– আমার বন্ধু?কিন্তু কে?
– তুন্দল মমা।
– আব্বু তুন্দল মমা নয়, তুন্দ্র মামা।কি করেছে সে?
– মিষ্টি চুরি করে খাচ্চে।
– কই দেখিতো চলো আমার সাথে।
সেহেরিশ আরিয়ানকে নিয়ে তুন্দ্রের কাছে যায় সত্যি তুন্দ্র মিষ্টি চবনে ব্যস্ত।
– এই তুন্দ্র তোর ভাগীনা আমায় বিচার দিয়েছে তুই নাকি মিষ্টি খেয়ে নিচ্ছিস আমাদের।
– আরে বাহ বাপের মতো চার চোখ নিয়ে ঘুরে দেখছি সব দিকেই খেয়াল।
তুন্দ্রের কথায় হেসে দেয় সেহেরিশ।তুন্দ্র হাত বাড়িয়ে আরিয়ানকে কোলে তুলে নেয়।
– সেহেরিশ তুই কাজে যা আমাদের কাছে থাকুক সে।
সেহেরিশ চলে যায়।আরিয়ান কেইন এবং তুন্দ্রের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে যায়।কেইন আরিয়ানকে একবার কাছে নেয় আবার দুরে সরায় এতে খিলখিল করে হেসে উঠে আরিয়ান।তুন্দ্র ঠোঁট কামড়ে হেসে আরিয়ানের উদ্দেশ্য বলে,
– পিচ্চু যাও তোমার না হওয়া বাবা কোলে।
তুন্দ্রের কথায় চোখ গরম করে তাকায় কেইন
– হোয়াটিস দিস তুন্দ্র?এগুলো কি ধরনের কথা?
– মিথ্যা কি বললাম
– স্টুপিড,ডাফার।
তুন্দ্রকে বকতে বকতে আরিয়ানকে কোলে নিয়ে চলে যায় কেইন।এদিকে তুন্দ্র ঠোঁট বাকিয়ে আরেকটি মিষ্টি মুখে পুরে বলে,
– আজ কাল সত্যর দাম নাই।বললেই ছ্যাঁত করে উঠে সবাই।
.
রাতের অনুষ্ঠান শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে যে যার রুমে চলে যায়।কিন্তু সেহেরিশের কাছে একটু সময় চায় কেইন। তাই তাকে নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়ায় সেহেরিশ।আরিয়ানকে জুহির কাছে দিয়ে এসেছে আজ তার সাথেই ঘুমাবে।এদিকে আফীফ বাড়ির মুরব্বিদের সাথে কথা বলছে আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় সেহেরিশ।যদি যানে কেইনের সাথে আলাদা কথা বলেছে তবে আজ আর রক্ষে নেই।
– দিন কাল কেমন যাচ্ছে সেহেরিশ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো রে।তোর?
– হুম ভালো।আগের মতো আড্ডা হয় না তুই জুহি সবাই এখানে আমি তার তুন্দ্র একা একা খুব একটা জমে না।
– তোদের মিস করি রে।জীবনটা ছন্নছাড়া ছিল সবার সাথে আড্ডা মাস্তি,লেট নাইট পার্টি কিন্তু এখন ভালোবাসায় কাঙ্গাল হয়ে নিজের জীবনটা নিয়মমাফিকে সাজিয়ে নিয়েছি।আসলে আমি আমার দুটো জীবনকেই ভালোবাসি।
– আফীফের সাথে সুখী তো তুই?
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসে সেহেরিশ।
– কি মনে হয়?
– আমি জানি ভাইয়া তোকে ভালো রেখেছে যাই হোক একটা প্রশ্ন আছে সেহেরিশ।
– বল।
– সেদিন আমরা ইতালি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে তুই সেদিন নিজের সম্মতি পালটে ফেলিস ঠিক একঘন্টা আগে তুই বলেছিলি আফীফকে ঘৃণা করিস তার এক ঘন্টা পর তোর ভালোবাসা উতলে উঠে।তোর বাবাকে তুই অগ্রাহ্য করে আফীফের কাছে ফিরে যাস এর কারন কি ছিল সেহেরিশ?
কেইনের প্রশ্নে চকিতে তাকায় সেহেরিশ।তার শরীরের লোমকূপে হঠাৎ ঘামের সঞ্চার অনুভব করছে।
– কি রে বল।
– সেদিন আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে।সেখানে লেখা ছিল,আমি যদি ইতালি ফিরে যাই তবে ব্লাক হাউজ থেকে পারভিন আন্টিকে কে বাচাঁবে?আর আমার কারনে সে বন্দি।যদি আমি না বাঁচাই তবে…
– তবে?
– আমাদের ক্ষতি করবে।গাড়ি এক্সিডেন্ট করানোর সব ব্যবস্থা করা আছে।
– কিন্তু এই মেসেজ কে দিয়েছে?
– ওই যে যারা আমায় কিডন্যাপ করে ছেড়ে দিয়েছিল।
– তোকে কিডন্যাপ কে করে?
– পারভিন আন্টি।সবাই যানতো পারভিন আন্টি বন্দি আছে আসলে সে পারু।আর মুক্ত ছিল পারভিন আন্টি।তোকে তা আগেই বলেছিলাম।পারুকে বাঁচাতে এবং আফীফকে ভয় দেখিয়ে দূর্বল করতে আমাকে কিডন্যাপ করে পারভিন আন্টি।আর মেসেজটা সে দিয়েছিল।তাই আমি ভালোবাসার নাটক কর‍তে যাই আফীফের সঙ্গে।তাকে দূর্বল করে ব্লাক হাউজে ঢোকার ব্যবস্থা করবো।আসলে কি বলতো যাকে আমি দূর্বল করতে গেলাম তার উপর যে আমি নিজেই দূর্বল ছিলাম তা আমি ভুলে গেছিলাম।তাই আফীফের পাগলামোতে সেদিন আফীফের ভালোবাসায় সমর্থন করি।
কেইন গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।সেহেরিশকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– তুই নিচে যা অনেক রাত হয়েছে। বাকি কথা কাল হবে।
– গুড নাইট।
সেহেরিশ নিচে চলে গেলো।অন্যদিকে কেইনের চোখের কোনে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে।দুরন্তপনার মেয়েটা এখন সাংসারিক হয়ে গেছে।যে কি না কেইন নামক বন্ধু বলতে আসক্ত ছিল সেই সেহেরিশ আজ পালটে গেছে।
আসলে মানুষের, ইচ্ছে বদলায়,চাহিদা বদলায়,রঙ পালটায় সবার আগে নিজের সার্থটাকেই প্রাধান্য দেয়।
সার্থের তাগিদেই সেহেরিশ আজ আফীফের সঙ্গে আছে।অন্যকোন সার্থ নয় নিজেকে ভালো রাখার সার্থ,ভালোবাসার মানুষটির স্পর্শ পাওয়ার সার্থ।তবুও তারা ভালো থাকুক।মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা মানুষ গুলোর জন্য কখনো অভিশাপ কাজ করেনা সবসময় দোয়া বর্ষণ করে।ভালো থাকুক তারা সবসময়। ভালো থাকুক আমার ভালোবাসার মানুষগুলো।
কেইনের চোখের পানি মুছে হাটু মুড়ে বসে যায়।ইচ্ছে করছে একটু চিৎকার দিয়ে কাদঁতে।
– ভালোবাসি সেহেরিশ তোকে অনেকটা।তুই আমার না পাওয়া এক অমূল্য রত্ন।
.
সেহেরিশ নিজের রুমে প্রবেশ কর‍তেই চমকে যায়।পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন।হঠাৎ হেঁচকা টানে দেয়ালের সঙ্গে বারি খায় সে।তার দু-হাত মূহুর্তে কেউ আবব্ধ করে নেয়।কানের সামনে কারো তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে।লোকটা যে ক্ষেপে আছে তা তার শ্বাস উঠা নামার গতিতেই বুঝতে পারলো সেহেরিশ।
– তাকিয়া?
– ব..বলুন।
আফীফ সেহেরিশকে এখনো আগের মতো বন্দি করে রেখেছে কিন্তু কোন উওর দিলো না।বেশ কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর বলে,
– কেইনের সঙ্গে একা ছাদে কার অনুমতিতে গেলে?
সেহেরিশ এতক্ষণ যা ভয় পেয়েছে ঠিক তাই হলো।এই লোকটা জেনে গেলো সর্বনাশ।
– আ…
– সেহেরিশ?
– বলুন।
– আমার প্রশ্নের উওর দাও।
– রেগে যাবেন না প্লিজ।কেইনের কিছু প্রশ্ন ছিল তাই গেছিলাম।
– ওওঅঅ।ফুলপরী?
– আরে আজব একেকবার একেক নামে ডাকছেন কেন?
– একটু পরে ডাকবো “কেইনের এক্স” বলে।
সেহেরিশের এবার রাগ লাগলো নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারলোনা।
– আপনি এবার বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু। আমি রেগে বিপরিত কিছু হয়ে যাবে।
– তাই নাকি কি করবে?
– পালিয়ে যাবো ছেড়ে চলে যাবো আপনাকে ছেড়ে।
সেহেরিশ রাগ দেখিয়ে কথাটা বললেও সহসা মনে পড়ে যায় কাকে সে কি বলছে।হঠাৎ গলার কাছে কামড়ের স্পর্শ পেতেই ছুটাছুটি শুরু করে দেয় সেহেরিশ।
– ভুল চিন্তা ধারা তোমার সেহেরিশ।তুমি আফীফের অন্তরিন প্রণয় কখনো তোমার মুক্তি নেই।ঠিক ছোট থেকেই তোমায় বন্দি করে রেখেছি।কখনো নিজের সাথে আবার কখনো অদৃশ্য ভাবে।
– আমি কি কখনো মুক্তি পাবো আফীফ দেওয়ান?
– না অন্তত আমার মৃত্যুর আগে না।
– আমি মুক্তি চাই না। প্রয়োজন নেই আমার। আপনি আমায় আপনার কাছে আগলে রাখুন জড়িয়ে রাখুন সব সময়।
সেহেরিশের আবেগী সুরের কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসে আফীফ।তার কানে ফিসফিস করে বলে,
– কেন পালিয়ে যাবে না তুমি?
আফীফের প্রশ্নে সেহেরিশ নিজেও হেসে উঠে।আফীফের কানে ফিসফিস করে বলে,
– এই আমিতে এখন আর আগের আমিতে নাই,এখন শুধু তোমার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।।
– সত্যি ফুলপরী?
– তিন সত্যি।আমি তো বন্দিনি আফীফ দেওয়ানের অন্তরিন প্রণয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি।এখন না আমায় সে মুক্তি করবে আর না আমি মুক্তি হতে চাইবো।
– তবে কি আমি সার্থক প্রেমিক পুরুষ?যার জন্য এত আয়োজন তাকে পেয়েছি।
– আপনি সেই সার্থক প্রেমিক পুরুষ আর আমি সেই ভাগ্যবান নারী।
আফীফ সেহেরিশের কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়।কিছুক্ষণ পর দুজনে আবার খিলখিল করে হেসে উঠে।অন্ধকারের মাঝেও বাইরের নিয়ন বাতির আলোতে সেহেরিশের মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে।আর তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফীফ।তার চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল।সেই চোখের জল সেহেরিশ দেখলো কি না কে জানে?
[সমাপ্ত]
🌺শুরু থেকে যারা গল্পটি পড়েছেন সবার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা।নিয়মিত গঠনমূলক মন্তব্য যারা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।সাইলেন্ড রিডার সবাই আজকে সাড়া দেবেন।সবার গঠন মূলক মন্তব্য পড়ার অপেক্ষায়।
সবার জন্য দোয়া এবং ভালোবাসা❤️
হ্যাপি রিডিং❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here