#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২
ঘুমন্ত সেহেরিশ হঠাৎ অনুভব করে তার পায়ের কাছ কেউ যেন খোঁচাখুঁচি করছে।তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের দুচোখ কুঁচকে দ্রুত খলবলিয়ে উঠে বসে।সামনের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রাখতেই আফীফকে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।কিছু বলতে নিলেই গায়ের মধ্যে অসংখ্যা ফুলের অবস্থান উপলব্ধি করে চমকে যায়।রুমটি ফুলের সুভাসে মম করছে।
– শুভ রজনী ফুলপরি!
– র..রজনী?
আফীফ সযত্নে সেহেরিশের পায়ে চুমু খায়।সঙ্গে সঙ্গে শিহরণ বয়ে যায় সেহেরিশের মাঝে। কিছু বলতে নিলেও গলায় তার কথা আটকে আসছে।
আফীফ সেহেরিশের মুখোমুখি বসে নির্মল দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।সেহেরিশের ঘাড় ছুঁয়ে থাকা চুলে অসংখ্যা গোলাপের পাপড়ি ভাসমান।চুলে গোজা আছে বেশ কয়েকটি তাজা গোলাপ ফুল ।আর সেই ফুল গুলো দিয়ে আফীফ নিজে সেহেরিশকে সাজিয়ে দিয়েছে।
– তোমায় বড্ড মিষ্টি লাগছে ফুলপরি!চুল গুলো এত ছোট কেন?ছোট চুল আমার মোটেও পছন্দ না।
– আমার চুল ছোট কী বড় তাতে আপনার কী? আমাকে এখানে বন্দি রাখার মানে কী?যেতে দিন আমায়।একে তো আমার কাকাতুয়াকে মেরে অন্যয় করেছেন তার উপর আবার আমায় বন্দি করেছেন।থাকবো না আমি এখানে।
আফীফকে উপেক্ষা করে সেহেরিশ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে যায়।গায়ে থাকা কমলা রঙের স্কার্টটা ঠিক করে আশে পাশে দরজা খুঁজতে থাকে কিন্তু একি? কোন দরজা নেই।একটি জানালা ছাড়া পুরো রুমে কোন দরজা নেই। কিন্তু জানালার শার্সিটা বাইরে থেকে দেওয়া পুরো রুমটাই অদ্ভুদ রকমের।
সেহেরিশের বুঝতে বাকি নেই কেন তখন আফীফ এই রুমটাকে গোপন কক্ষ বলেছিল।
সেহেরিশকে চিন্তা মগ্ন দেখে আফীফ একপা দুইপা করে এগিয়ে আসে তার দিকে।
– ফুলপরি পালিয়ে যাওয়ার রাস্ত খুঁজছো বুঝি?
– আমায় যেতে দিন বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না বলে দিচ্ছি।
আফীফ মৃদ্যু মাথা দুলিয়ে হাসে। তার ডানহাতটা দিয়ে সেহেরিশের মাথায় হাত বুলাতে থাকে মুখটা চুলের সামনে নিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। তৎক্ষণাৎ সুযোগ বুঝে সেহেরিশ আফীফের হাতে কামড়ে দেয়।কামড়টা এতটাই জোরে ছিল যে চামড়া ছিলে আফীফের ফর্সা হাতে রক্ত ভাসমান। চাপা আর্তনাদে আফীফ কেঁপে উঠতেই সেহেরিশ ছুটে পালিয়ে যেতে নেয়।কিন্তু চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করেও চার দেয়ালের কক্ষে কোন দরজা খুঁজে পেলনা সেহেরিশ।
জানালার শার্সি ধাক্কা দিয়ে জানলা খুলতে চেষ্টা করতেই আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নেয়।তার সামনে ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমায় সামান্যতম একটা কামড়ে কুপ কাত করবে ভেবেছো?আমায় চিনতে পারো নি তুমি ফুলপরি।আমি সেই ছেলে যে ছেলের ভয়ে সারা গ্রাম তটস্থ থাকে।আমার দাদাজানের শক্র পক্ষের বিনাশ করে আমি আমার তেষ্টা মিটাই।আর তুমি আমায় দূর্বল ভাবছো।
সেহেরিশের ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।সকালে তখন বৃদ্ধার কথা আবারো মনে পড়ে গেলো।সেই বৃদ্ধা বলেছিল আফীফ বড্ড রাগী।
– আ..আমাকে কেন ছাড়ছেন না আপ..আপনি?
আমি ফুফির কাছে যাবো!
– ইসসস, আজকের পর থেকে তোমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।মনে করো তোমার শাস্তি এটাই আমার কাছে থাকবে আর সারাজীবন আমার পাশেই থাকবে।আমার কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করার সাধ্যে এই বাড়িতে কারো নেই।
সেহেরিশ ধাক্কা দিয়ে আফীফকে সরিয়ে দেয়।দেয়ালে বাম হাতটা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। সব কেমন উলট পালট লাগছে তার।
আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।মাটির দিকে তার দৃষ্টি নিমজ্জিত করে দু কদম পিছিয়ে গেলো।সেহেরিশের দিকে একপলক তাকিয়ে রুমে থাকা বিশাল আলমারির পেছনে গিয়ে দরজা খুলে নিজের ব্যাক্তিগত রুমে প্রবেশ করলো।দ্রুত বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে এগিয়ে এসে জানলা খুলে দিল।তার রুমের জানলা দিয়ে স্পষ্ট সেহেরিশের সম্পূর্ণ রুম দেখতে পাওয়া যায়।
এতক্ষণ যাবৎ আফীফের কান্ড মোটেও খেয়াল করেনি মেয়েটি।
– তাকিয়া!
নিরিবিলি রুমটায় আফীফের শান্ত কন্ঠ শুনতেই ঘুরে তাকালো সেহেরিশ।কিন্তু জানালার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো।তার রুমের বাইরে আরেকটি রুম আর জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আফীফ।মানে কী?আফীফ কি করে রুম থেকে বের হলো?দরজা কোথায়?
সেহেরিশের প্রশ্ন মাখা মুখটি দেখে আফীফ মুচকি হাসলো,
– মাথায় এত চাপ দিওনা,এত কিছু না ভাবলেও তোমার চলবে।এই বাড়িতে থাকবে অতিথি হিসেবে নয়,আপনজন হিসেবে!যেহেতু আমার জীবনে এবং আমার পরিবারে তুমি নতুন তাই স্বাগত চিরকুট তোমার বালিশের পাশেই রাখা আছে।আল্লাহ হাফেজ!
আফীফ সেহেরিশকে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত জানলাটা বন্ধ করে দেয়।
সেহেরিশ এক ছুটে বালিশের পাশ থেকে লাল রঙের একটি কাগজের চিরকুটটা বের করে,সেই চিরকুটের দিকে তাকিয়ে শুধালো সেহেরিশ,
“নতুন মুখ নতুন হাসি,
অল্পত্বেই পাশাপাশি!
আবার হয়তো হবে দেখা,
সামান্য সময়ের প্রতীক্ষা!
লাইন গুলো পড়ে সেহেরিশের বেশ রাগ লাগলো যার ফলে চিরকুটটি কুচিকুচি করে উড়িয়ে দেয়।
– দেখা হবে না!দেখা হবে না আমাদের!
শীতের প্রকপে সেহেরিশ ঠান্ডায় জমে গেছে। এতক্ষণ মেঝেতে বসে কান্নার ফলে বিছানায় মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তার হুশ নেই।ভোরের আলো ফুটতেই আফীফ তার কক্ষে আরেকবার প্রবেশ করে।সেহেরিশকে বিছানায় তুলে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে আবারো রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ফজরের নামায’টা আফীফ তার দাদাজানের সাথেই মসজিদে আদায় করে।তাই দুজনে তীব্র কুয়াশার মাঝে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে মসজিদের উদ্দেশ্য হাটতে শুরু করে,
– তুমি কাজটা ঠিক করছো না আফীফ! তোমার সব সিধান্তে আমি হা তে হা মিলালেও আমি এই সিধান্তে মেলাতে পারছি না।তুমি তাকিয়াকে যেতে দাও!
আহনাফ দেওয়ানের প্রতিবাদী কন্ঠেও টনক নড়লো না আফীফের।সে তার মতো করে হেঁটে যাচ্ছে।
– দাদাজান তোমার সব কথা আমি মানলেও এই কথাটা মানতে পারছি না। দুঃখিত!
আহনাফ চমকে তাকায় আফীফের দিকে।আফীফের চোয়াল শক্ত মুখটা দেখে তিনি দমে যান। সন্তপনে তিনি হেটে যান কুয়াশা ভেদ করে।
—
চন্দনপুর গ্রামের জমিদার আহনাফ দেওয়ান।পুরো গ্রাম জুড়ে চলে দেওয়ান বংশের রাজত্ব।আর সেই বংশের বর্তমান সাহসী সবচেয়ে তেজি পুত্র আফীফ দেওয়ান।তার দাদাজানের সাথে সমান তালে পুরো গ্রামের মানুষের সাহায্য সহযোগীতায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।
তার পাশের গ্রামের নাম অনন্তপুর।সেই অনন্তপুরে সেহেরিশের গ্রামের বাড়ি।সেহেরিশের বাবা মা তার দাদা দাদীর মৃত্যুর পর দেশের বাইরে বসবাস শুরু করেন।সেহেরিশের ফুফু মারুফার স্বামী মারা যান প্রায় তিন বছর আগেই এক দূর্ঘটনায়।এই বছর স্বামীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে সুদূর বিদেশ থেকে একা সেহেরিশকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।এরপর কেটে যায় আরো এক সাপ্তাহ আর গতকাল সকালেই অনন্তপুর গ্রামের সীমানা পেরিয়ে সেহেরিশের কাকাতুয়া যখন চন্দনপুরে প্রবেশ করে তখন কৌতূহলজনক সেহেরিশো এই গ্রামে চলে আসে।
গ্রামের মেঠোপথ হাটতে হাটতে হঠাৎ লক্ষ করে তার কাকাতুয়া পাখিটি তীর বিধেঁ মাটিতে লুটিয়ে আছে।পেছনে ঘুরে তাকাতেই আফীফকে চোখে পরে যার হাতে ধনুক সাদৃশ্যমান।রাগ মেটাতে না পেরে সেহেরিশ ভেজামাটির কাঁদা ছুড়ে মারে আফীফের দিকে যার দরুনে আজ আফীফের কবজায় বন্ধী সেহেরিশ।
কুয়াশা ভেদ করে সূয্যিমামা ফিক করে হেসে উঠেছে।গ্রামের মানুষজন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত প্রায়।আফীফ তার বাবা মাসুমের সঙ্গে সেহেরিশের ব্যাপারে অনেক্ষন যাবৎ তর্কবির্তকে জড়িয়ে আছে।সহসা একজন দৌবারিক ছুটে আসে আফীফের কাছে।
– আফীফ ভাই একজন মহিলা অনেক্ষন যাবৎ এই বাড়িতে প্রবেশ করতে উঠেপড়ে লাগেছেন। তিনি অনন্তপুর থেকেই এসেছেন।তার ভাই’জি নাকি এখানে বন্ধী!
দৌবারিকের কথা আফীফ বুঝতে পেরে মাথা নুইয়ে নেয়।চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে ফিসফিস করে জবাব দেন,
– তাকে বলো অন্ততপুরে ফিরে যেতে। আমি অবসর হয়ে তার সাথে দেখা করবো কিন্তু তার আগে নয়।
দৌবারিক মাথা দুলিয়ে চলে যায়। আফীফ তার বাবা মাসুমের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– আব্বা আমায় চন্দনপুর গ্রামের চাচাজানের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।খুব শীঘ্রই!
মাসুম আড়চোখে আফীফের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।এদিকে আফীফ বাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
কনকনে ঠান্ডায় কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে সেহেরিশের।প্রায় এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ কাঁথা মুড়িয়ে বসে আছে।এদিকে ক্ষিদের জ্বালায় ক্ষুদার্ত বাঘীনির মতো অবস্থা তার।সামনে যা আছে তা গোগ্রাস করে খেতে মন চাইছে।
চোখ বন্ধ করে কাঁথা মুড়িয়ে কাদতে শুরু করে সেহেরিশ।ছোট থেকেই তার ক্ষিদের জ্বালা সহ্য হয় না।আর গতকাল থেকেই সে অনাহারী।
– কি হয়েছে কাদছো কেন তুমি?
পুরুষের কন্ঠে চমকে তাকায় সেহেরিশ।আফীফকে দেখতে পেয়ে সুপ্ত রাগটা আরো মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে।
– কি হলো কথা বলছো না কেন?
– আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি বলছি না।
আফীফ চুপচাপ কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের দিকে।রাগে ফোসফোস করতে থাকা সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমার খিদে লেগেছে তাকিয়া?
আফীফের কথায় চমকে তাকায় সে!এই লোকটা বুঝলো কী করে?
– আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি তোমার ক্ষিদে পেয়েছে।কিন্তু তোমায় খাওয়ার দেওয়া হবে না তাকিয়া!
– কিন্তু কেন?আপনাদের বাড়ির আসামিকে বুঝি খাওয়ার দেওয়া হয় না?
– উহু’হ খাওয়ার দেওয়া হয় তবে তাদের দেওয়া হয়না যারা খাওয়ার দেখলে নাক ছিটকায় অবমূল্যায়ন করে।
– মানে কী? আমি কী করেছিলাম?
– কাল মর্জিনা যখন তোমায় জানলা দিয়ে খাওয়ার দিয়ে গেছিলো তুমি খাওয়ার টা ছুড়ে মারলে কেন তাকিয়া?আমি নেহাত বাড়ি ছিলাম না তাই তবে তুমি কিচ্ছু টের পাওনি।খাওয়ার নষ্ট করা আমি মোটেও পছন্দ করিনা।
সেহেরিশ মাথাটা নুইয়ে নেয়।এই মূহুর্তে তার ঝাগড়া করার সাধ্যের বাইরে।শরীরটা বার বার অসার হয়ে আসছে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের হাতে থালা সাজিয়ে আনে।
– নাও এবার খেয়ে নাও!
– খাবো না আমি।খাবার নিয়ে আপনি আমায় খোটা দিয়েছেন।আমার পাপার কুকুর গুলোকেও আরো যত্ন করা হয় কিন্তু কাল সকাল থেকে আপনি আমার সাথে অবিচার করছেন।
সেহেরিশের কথায় আফীফের ভীষন রাগ লাগলো তবুও নিজেকে দমিয়ে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
– আমার হাতে একদম সময় নেই।যা বলেছি তাই করো খাওয়ারটা খেয়ে নাও।শাস্তি তোমায় এখনো দেওয়া হয় নি তাকিয়া।একশত ঘা চাবুকে বারি তোমায় শাস্তি সরূপ দেওয়া হলে তখন কি বলতে তুমি?আমায় উগ্র করে না তুলে চুপচাপ খাওয়ারটা শেষ করো।
আফীফের কথায় সেহেরিশ দ্রুত খাওয়ারের থালা হাতে তুলে নেয় আর গোগ্রাসে খেতে থাকে।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে আরক্ত নয়নে বলে,
– মেয়ে মানুষের রাগ আমার মোটেও পছন্দ না।তোমরা মেয়ে জাতী কোমল থাকবে, এইসব রাগ জেদ তোমাদের জন্য না।ভালো ব্যবহার করছি তোমার সাথে এটাই অনেক।ইঁচড়েপাকা মেয়ের এত রাগ কিসের?
শেষ কথাটি আফীফ ধমকের সুরে বলে উঠলে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় মেয়েটি।এই মূহুর্তে তর্ক করার মোটেও ইচ্ছে নেই তার, আগে পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।
#চলবে….