#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_23+24
বসার ঘরে দেওয়ান বাড়ির সকলের আজ হইচই জমে গেছে।আফীফ অবশেষে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বিয়ে বাড়ির দাওয়াতটা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে।তারপর থেকেই মৌ,আমানের মাঝে হইচই বিরাজমান।কিন্তু মুখ গোমড়া করে বসে আছে সেহেরিশ।কি পরবে সে বিয়ে বাড়িতে!হাতে তিনটে জামা।তিনটাই ভারী কাজের গর্জিয়াস ফ্লোর টার্চ গাউন।কিন্তু কোনটা পড়বে?জামা গুলো হাতে নিয়ে দম করে চন্দনার সামনে বসে যায়।এতক্ষন যাবৎ আফীফ চুপচাপ ল্যাপটপে মুখ গুজে সেহেরিশের কান্ড দেখছে।
– আন্টি প্লিজ হেল্প মি আমি কোন জামাটা পড়বো?
– সবগুলো জামা সুন্দর।এবার আমি কি বলি বলতো? আচ্ছা তুমি মিষ্টি রঙের জামাটা পড়ো।
– হাহ এটাই তো আমি ভাবছিলাম।এই জামাটা পড়লে আসলেই আমাকে কিউট লাগে।
সেহেরিশ জামাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।গায়ের সাথে মাপ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেই কানে আসে আফীফের গমগমে সুরের কথা,
– এখানে বিয়ে খেতে যাওয়া হবে ঝাড়ু দিতে নয়।গ্রামের রাস্তায় কাদামাটি,থাকবেই এইসব ঝাড়ু ওয়ালা জামা না পরাই বেটার।
আফীফ ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে উঠে চলে যায়।এদিকে আফীফের এমন কথায় ঠোঁট টিপে হাসে চন্দনা,আমান। সেহেরিশ রাগ দেখিয়ে জামাটা ছুড়ে মারে মেঝেতে,
– আন্টি আপনি বলুন এই জামাটা খারাপের কি হলো?
– না মানে এটা তো গ্রাম সেহেরিশ।বিয়ে বাড়িতে এই জামাটা পড়ে তুমি আরাম পাবেনা।
– থাক আমি বিয়েতেই যাবো না তোমরা সবাই যাও।
সেহেরিশ জামা গুলো রেখেই নিজের রুমের উদ্দেশ্য চলে গেলো।
রাতের খাওয়ার শেষে আফীফের রুমে প্রবেশ করে সেজুঁতি।তার মুখটা গম্ভীর নিরবতা বিরাজ মান।
– আমায় কেন ডেকেছিস?
– আম্মা তুমি এইভাবে মুখ ভার করে রেখেছো কেন?
– না কিছু না।
– আব্বার সাথে ঝগড়া করেছো?
– না।
– তবে?
– বললাম তো কিছুনা।
আফীফ নিজের মায়ের রেগে থাকাটা বুঝতে পারে কিন্তু কেন রেগে আছে তার মোটেও আন্দাজ করতে পারছে না।
– আমার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে না আম্মা।এমন ত্যাড়ামো আমার মোটেও ভালোলাগে না।
– তোর ভালোলাগেটা কি?
সেঁজুতির ঝাঝালো কন্ঠে আফীফ চমকে যায়।মায়ের দুবাহু জড়িতে ধরে অনুনয় সুরে বলে
– আম্মা কি হয়েছে তোমার।কেউ কিছু বলেছে?
সেজুঁতি এবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলেন।তার চোখের নোনাজল আফীফের
শাল ভিজিয়ে দিচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট হলো আফীফ।
প্রিয় মানুষ গুলোর চোখের জল মোটেও সহ্য হয় না।তাদের একএকটা চোখের নোনাজল আমাদের বিষ গেলার মতো অবস্থা হয়।
সেখানে আফীফ তার মায়ের চোখের জল সহ্য করবে কি করে?তার তো ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে।
– আম্মা কি হয়েছে বলো আমায়। তোমার চোখে পানি কেন?
– তোর দাদী আজো আমার সাথে রাগারাগি করেছেন।
– কিন্তু কেন?
– তোর বিয়ে নিয়ে।তোর কারনে সে তার সন্তানকে কাছে পাচ্ছে না।এদিকে তোর বয়সটাও কম হয়নি।বিয়ের উপযুক্ত সময় বিয়ে দেওয়াটাই উচিত।
– দাদীজানের কি আর কাজ নেই সুযোগ পেলেই এইসব বিষয় নিয়ে তামাশা শুরু করেন।দেখো আম্মা তুমি কেঁদে কেঁদে আবার বেহুশ হইয়ো না।আমাকে আমার প্লানিং মাফিক কাজ করতে দাও।
আর প্যাকেট গুলো নাও।সেহেরিশকে জামা গুলো দেবে।বেচারিকে রাগিয়ে দিয়েছি তাই বিয়েতে যাবে না বলেছে।
সেজুঁতি প্রত্যুত্তর করলো না পেকেট গুলো হাতে নিয়ে সহসা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বাবরি চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা সাজসজ্জায় তৈরি হয়ে নিলো সেহেরিশ।তার চোখে মুখে আজ আনন্দের আভাস।কাঁচা হলুদ রঙের জামাটায় তাকে অপূর্ব লাগছে।এক রাশ মুগ্ধতায় গ্রাস করছে তাকে বারংবার।দুপুর শেষে বিকেলের ঠান্ডা শীতল আবহাওয়ায় জানান দিচ্ছে অন্যরকম অনুভূতির।রুম থেকে বের হতেই আফীফকে সামনে দেখে ভড়কে যায় সে।
– কি হলো এখানে কি করছেন?
– তোমায় দেখতে এসেছি ফুলপরী।
– দেখা হয়েছে এবার যান।
– উহুহ।আমি গেলে থাকবে কে?বাই দা ওয়ে তোমার লং গাউন থেকেও এই থ্রি-পিস টা বেশ মানানসই।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।সোজা করিডোর পেরিয়ে নিচে নেমে গেলো।
বিয়ে বাড়িতে আজ গায়ে হলুদের হই হুল্লোড়ে চমকে আছে কেইন,তুন্দ্র,সেহেরি।ভরা মজলিশে সবাই তাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।সবার ভাব গম্ভীর এমন যেন চিরিয়াখানার তিনটে প্রাণী বিয়ে বাড়িতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাই সবাই অবাক হয়ে শুধু দেখছে।কেইন তুন্দ্রের হাত টেনে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
– হোয়াটিস দিস ব্রো?আমার ভালো লাগছে না।এখানে মানুষ গুলো এত অদ্ভুত কেন?এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?
– আহ কেইন এটা গ্রাম।প্রত্যাকটা অঞ্চলের মানুষের ব্যবহার একই হবে এটা আশা করা মোটেও ঠিক না।
সেহেরিশ, তুন্দ্র, এবং কেইন এক সাইডে এসে চিপকে দাঁড়িয়ে আছে।নানান বাচ্চারা রঙ ছোড়াছুড়ি করছে।কিছু ছেলে সেহেরিশের দিকে আছে আড় দৃষ্টিতে।কেউ সরাসরি তাকানোর
সাহস ভুলেও করছে না।কেননা ইতিমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে মেয়েটি দেওয়ান বাড়ির অতিথি।
হঠাৎ দুইজন মহিলার কানাঘুষা সেহেরিশের কানে এলো।
– মাইডার চুলডি এত ছোড কিল্লাইগা।এরুম হইলে কেরুম লাগে?
– হ ঠিক কইছো। হুনছি বিদেশে থাহে।বিদেশী মাইয়া গুলার চুল এমনেও ছুড হয়।
সেহেরিশ হতভম্ব হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিমজ্জিত করে সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে তার কাছে।অদ্ভুত সবার আচরণ।সন্ধ্যার পর সবদিকে লাইটিং ব্যবস্থা।সাউন্ড বক্সের জোরে জোরে গানের তালে পরিবেশটা জমজমাট।তুন্দ্র সুযোগ পেলেই সবার ছবি তুলতে ব্যস্ত কিন্তু কেইন আর সেহেরিশ মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়।আমান, মৌ, সামী সবাই এদিক থেকে সেদিক ছোটাছুটি করছে।সেহেরিশ ভেবেছিল বিয়ে বাড়িটায় হইচই আনন্দ করবে কিন্তু তার ভাবনার মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে সব অনুভূতি সাদামাটা হয়ে গেছে।আফীফ দূর থেকে সেহেরিশকে ভালোভাবে পরখ করছে। সেহেরিশের মনমরা অবস্থা দেখে তার ভ্রু কুচকে যায়। যে মেয়েটি বিয়ে বাড়িতে আসতে এতটা এক্সাইটেড ছিল হঠাৎ তার কি হলো?
আফীফ ইশারায় আমানকে কাছে ডাকে।আমান ভাইয়ের ইশারা বুঝতে পেরে ছুটে চলে আসে,
– এই তোর ভাবীর সঙ্গে দেখা করবো নিরিবিলি জায়গা খুজে দে।
– এখানে নিরিবিলি জায়গা কোথায় পাবো আমি? সব দিকেই মানুষজন।
– আরে ব্যবস্থা কর।তুই না তোর ভাবীর একমাত্র দেওর।
– ব্লাকমেইল করছো?
– আরে না রে ভাই দ্রুত ব্যবস্থা কর।
– ওকে ঘরের পেছনটায় চলে আসো।
– গুড বয়।
আমান এক ছুটে সেহেরিশের সামনে দাঁড়ায়।ফসফস করে শ্বাস ছেড়ে একগাল হাসি দিয়ে বলে,
– আপু তোমার কি হয়েছে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
– আমার ভালো লাগছে না আমান।বাড়ি যেতে চাই।
– এই ভাবে চিপায় চিপকে থাকলে ভালো লাগবে কি করে?এসো আমার সাথে এসো।
আমান সেহেরিশের হাত টেনে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়।
– সেহেরিশ আপু দাঁড়াও তুন্দ্র ভাইয়াকে নিয়ে আসি এখানে নিরিবিলি লাইটিং ব্যবস্থা ছবি ভালো আসবে।
– ওকে যাও।
আমান দ্রুত চলে যায়।সেহেরিশ একা চারিপাশটা পরখ করছে।নিয়ন বাতির হালকা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারিদিক।অন্ধকারের মাঝে লম্বা লম্বা তাল গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো সেহেরিশ।মনের মাঝে কেমন কু ডাকছে।পেছনে ঘুরতে দম করে ধাক্কা লাগে কারো সাথে।
– আরে’হ
– এই মেয়ে এখানে একা কি করছো তুমি?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে চমকে তাকায় সেহেরিশ।আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।মিহি বাতাসে সারা শরীর চনমনিয়ে উঠছে তার।
– মুখে কি তালা এঁটে দিয়েছো নাকি?আমি কিছু প্রশ্ন করছি।
– আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই দাঁড়িয়ে আছি।
– বাহ ভালো উওর।বিয়ে বাড়িতে আসার জন্য এত দৌড় ঝাপ দিলে অথচ এখানে এসে থেমে গেলে কেন?
– কিছু না।
সেহেরিশের ত্যাড়া জবাবে রুষ্ট হয় আফীফ।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আলতো করে সেহেরিশকে কাছে টেনে আনে।
– কাজি রেডি চলো বিয়ে করে ফেলি।
– আপনার ইচ্ছে হলে করে ফেলুন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
– তুমি রাজি থাকলে এখনি কবুল।
সেহেরিশ মুখ ভেংচালো কিন্তু কোন জবাব দিলো না।আফীফ ডান হাতটা উপরে তুলে এক থাবা রঙ সেহেরিশের গালে লেপ্টে দিলো। অন্ধকার মিশ্রিত হালকা আলোতে টকটকে লাল রঙ সেহেরিশের মাঝে অন্য রকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
– বাহ!
– গালে রঙ লেপ্টে দিলেন কেন?আমার এত সুন্দর স্কিনটা এবার নষ্ট হয়ে যাবে।
– উহুহ কিচ্ছু হবে না ফুলপরী।খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।
– কখনো না। আপনি জেগে জেগে সপ্ন দেখুন।
সেহেরিশ গাল মুছতে মুছতে দ্রুত চলে যায়।আফীফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তেই তার কানে আসে খচখচে কাগজের মাঝে কারো হাটার শব্দ।আফীফ চমকে যায়।এতক্ষণ সেহেরিশের কাছ থেকে নিজেকে দূরে দূরে রেখেছে একমাত্র কেউ যেন সন্দেহ না করে আফীফ আর সেহেরিশের গভীর সম্পর্কের কথা।আশেপাশে হাসিখুশি ভালো মুখোশধারী অনেকেই আছে।যারা আড়ালে দিন শেষে আফীফের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগে আছে।
______
কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠছে দেওয়ান বাড়ি।অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভারী মাথাটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো আফীফ।দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে সেহেরিশের ছবি গুলোর দিকে।তার চোখের কোনে পানি।এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় দেয়ালের সামনে।সেহেরিশের ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– গত দুইদিন থেকে তুমি নিখোঁজ ফুলপরী।কোথায় আছো?তোমার অভাবে এই বাড়ির মানুষ গুলো যন্ত্র মানব হয়ে গেছে।দেখো তোমার ভাষ্যমতে নিষ্ঠুর স্বার্থপর আফীফ দেওয়ানের চোখে আজ জল।এই চোখের জল আজ থেকে আট বছর আগে ঝরেছে একমাত্র তোমার কারনে আর আজ আবার!আমি আর পারছি না।আমার সকল চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে।
আফীফের চোখের পানি টপটপ করে ঝরে পড়ছে। সেহেরিশের ছবিগুলোয়ে হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সেন্টার টেবিলের সামনে লালচে কাগজটা হাতে তুলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সেদিন পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই আফীফ কাগজটা পায় যেখানে লেখা ছিল,
” প্রিয় মানুষটা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট বড্ড ভয়াবহ!”
আফীফ তখনি থমকে যায়।তার মস্তিষ্কে বার বার জানান দেয় সেহেরিশের কিছু হলো না তো।তার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে আজ দুইদিন সেহেরিশ নিখোঁজ। দরজায় কারো করাঘাতে চোখ মুছে দরজা খুলতে এগিয়ে যায় আফীফ।দরজা খুলতেই অস্থির মুনিফকে দেখে থমকে যায়।অস্থির মুনিফ হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
– ভাই তাড়াতাড়ি আয়।সেহেরিশের আব্বা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে।ভীষণ রক্ত ঝরছে। কি করবো এখন আমার মাথায় আসছে না।
#চলবে…..
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৪
পিনপতন নীরবতা মাঝে কুকুর গুলোর কান্না দেওয়ান বাড়িটাকে আরো ভীতগ্রস্ত করে তুলছে।ফাহমিদার হেচঁকি তোলা কান্নায় হুট করেই আবার নীরবতা লুপ্ত হয়।তার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে খুরশীদ আনওয়ার।মাথায় ব্যান্ডেজ।আফীফ নিজের মাথায় হাত দিয়ে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো, রাতের দুইটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি।ফাতেমা আফীফের পাশেই বসা ছিলেন।কুকুর গুলোর কান্নায় তিনি বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়তে শুরু করেন।
আফীফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে সুউচ্চ স্বরে বলেন,
– জানো নি দাদুভাই কুকুর কাদঁলে বিপদ আসে।
ফাতেমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সহসা জবাব দিলেন ফাহমিদা।
– আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?একমাত্র মেয়ের খোঁজ নেই।আজ আবার স্বামী মাথা ফাটিয়ে এই অবস্থা।এরা ছাড়া ব্যাক্তিগত জীবনে আমার আর কেউ নেই।তবে আমার আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?
ফাহমিদার হতাশ কন্ঠ।আফীফ ঘাড় ঘুরিয়ে ফাতেমাকে ইশারা করে চুপ থাকতে।হুট করেই যেন দুই তিনটা কুকুরের ডাক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
– ওই দেখ দেখ তোরা বিপদ আশেপাশে খালি ঘুরতাছে।
– দাদী তুমি থামবে।তোমার কুসংস্কার কথাবার্তা তা তুমি তোমার কাছে রাখো।
আফীফের রুষ্ট কন্ঠ।সহসা সবার মাঝ থেকে উঠে চলে আসে।বাড়ির বাইরে দৌবারিকদের ইশারায় ডেকে প্রশ্ন করে,
– সমস্যা কি?কুকুর গুলোকে দূর করছো না কেন?
– দূর করেছি ভাইজান কিন্তু ঘুরে ফিরে এদিকেই আসছে।
আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।বাগানের দিকটায় হাটা শুরু করে ভাবতে থাকে সেহেরিশের কথা।কে এমনটা করেছে, কী উদ্দেশ্য করেছে? যদি আফীফের কোন শত্রু হতো তবে কোন না কোন বার্তা ঠিকি প্রেরণ করা হতো কিন্তু আফীফের কাছে কোন বার্তা পৌঁছেনি।একরাশ চিন্তা নিয়ে আফীফ ব্লাক হাউজের দিকে রওনা হলো।পুরো বাড়িটি কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।বাড়ির পেছনের দিকটায় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো সে।
দরজা খোলার শব্দে ব্লাক হাউজে বন্দি থাকা মানবটি সহসা চোখ খুলে নিলো।গায়ে থাকা কাঁথাটা ভালোভাবে মুড়িয়ে উঠে বসতেই আফীফকে দেখে তিলার্ধেক হাসে।আফীফ একটি চেয়ারে বসে তাকে সহসা প্রশ্ন করে,
– কেমন আছেন আপনি?
– যেমন রেখেছো।
আফীফ ফস করে শ্বাস ছাড়লো।পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে ধরে গম্ভীর স্বরে বলে,
– চিনতে পারছেন আশা করি?
– হ্যা এটা তো সেই পুতুলটা তাকিয়া।তোমাদের বিয়ে হবে কবে?
– সে নিখোঁজ!
– ন…ন…নিখোঁজ? তবে কি বিয়ে হবে না?
– হাহ!মানুষের রঙ কত পালটে।স্বার্থের রঙ পালটে।নিজ স্বার্থে মানুষ কি না করতে পারে।এখন তাকিয়া আর আমার বিয়ে চাইছেন?এই কথাটা আগে কেন ভাবেন নি?
– আমি কিছু জানি না।আমি কিছু জানি না।
মানবটি কাঁথা মুডিয়ে শুয়ে পড়ে।আফীফ ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে উঠে যায়।এবং সহসা সেখান থেকে বের হতেই দৌবারিকদের কলহ শুনতে পায়।আফীফ এক ছুটে বাগান পেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
– কি হয়েছে এখানে এত শোরগোল কিসের?
– ভাইজান কে আইছে একবার দেহেন।
আফীফ মাথা উচু কথা তাকায়।হাটু মুড়িয়ে বসে থাকা সেহেরিশকে দেখে এক মূহুর্তের জন্য তার অনুভূতিরা থমকে যায়।মস্তিষ্ক তার অচল হয়ে গেছে এই মূহুর্তে কী করতে হবে?কি করতে হবে তার?হুট করেই কানে আসে সেহেরিশের চাপা কান্নার আওয়াজ।আফীফের যেন সৎবিৎ ফিরে এসেছে।সহসা সেহেরিশের সামনে হাটু মুড়ে বসে।সেদিনের সাজ আজ এলোমেলো।গালের লাল রঙটা রক্তিম আভায় ছড়িয়ে আছে।মেয়েটাকে দেখতে একদম বিদস্ত লাগছে।
– স..সেহেরিশ!
সেহেরিশ মাথা তুলে আফীফের দিকে তাকায়।আফীফের ডান হাতটা আকড়ে ধরে আরেকটু শব্দ করে কেঁদে দেয়।আফীফ দেরি না করে ঝটপট সেহেরিশকে কোলে তুলে নেয় এবং বাড়ির ভিতরে হাটা শুরু করে।
.
– মারে তুই কোথায় ছিলি?
ফাহমিদার প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।তুন্দ্র,কেইন,মারুফা সহ বাকি সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে।আফীফ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পরখ করছে।পায়ে, হাতে শক্ত কোন মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধার ফলে চামড়া ছিড়ে রক্ত শুকিয়ে দাগ লেগে আছে।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে ফস করে শ্বাস ছাড়লো।
– আমি রুমে যাবো মামনি আমাকে নিয়ে যাও আমি হাটতে পারছি না।
সেহেরিশের কথায় কেইন তুন্দ্র এগিয়ে এসে সেহেরিশকে তুলে দাড় করায়।কিন্তু এক কদম এগোতেই পায়ের ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে।আফীফ ডানে বায়ে না তাকিয়ে কাউকে পরোয়া না করে আবারো সেহেরিশকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।এবং সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে সেহেরিশের রুমে নিয়ে যায়।লজ্জা, সংশয়, ভয়ে নুইয়ে আছে সেহেরিশ।বার বার ঠোঁট কামড়ে কান্না দমন করছে।আফীফের চিন্তা মগ্ন চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ তাকে বিছানায় বসাতেই বালিশ টেনে সহসা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।সেহেরিশের কান্ডে অবাক না হয়ে পারলো না আফীফ।
– কোথায় ছিলে তুমি সেহেরিশ?
– আমি জানি না।
– কে নিয়ে গেছিলো তোমায়?
– আমি জানি না।
আফীফ মাথা নত করে সেহেরিশের হাত কাছে টেনে নেয়।ফর্সা হাত যুগলে রক্তের ছাপ লেগে আছে।চোখের কোনে কান্নার ফলে গালেও দাগ লেগে আছে।
– তুমি জানো পাগলের মতো খুঁজে ছিলাম তোমায় কিন্তু তোমার কোন হদিস পাইনি।প্লিজ সেহেরিশ কি হয়েছিল আমাকে খুলে বলো।
– আমি জানি না কিছু। আমার হাতে পায়ে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।মুখে কাপড়।নিরিবিলি একটা রুমেই বন্দি ছিলাম।মাঝে মাঝে এক দুইজন পুরুষের কন্ঠ পেতার আর হ্যা একজন মহিলা!
– মহিলা?
– হ..হ্যা সে এই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেত।ছেড়ে দেওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলেছিল “দুইপক্ষের কারনে রেষারেষি আজ এতদূর।” কিন্তু কি বললো আমি তার অর্থ খুঁজে পেলাম না।আমাকে গাড়ি করে পুকুর পাড়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় আর বাকিটা আমি নিজেই চলে আসি।
সেহেরিশ থামে।অনবরত তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।আফীফ উঠে যায় দরজা খুলে বের হতে নিলেই বাড়ির সবাইকে এক সঙ্গে দেখতে পেয়ে মুনিফকে ইশারা করে তার সাথে যেতে।
– কি রে সেহেরিশ কি বলেছে?
– এই বাড়ির কারো সাথে আততায়ীদের যোগাযোগ রয়েছে।
– ম..মানে ক..কি বলছিস।
– হুম ঠিক বলছি।আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।তা না হলে প্রত্যেক টা টোপ কি করে এত সুক্ষ্ম ভাবে সফল হয়।এই সব কিছুর পেছনে মেইন লিডারশীপ একজন মহিলা।
– কি সব অদ্ভুত কথা বলছিস তুই?
– যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি।তোর দায়িত্ব বাড়ির সকল কর্মচারীদের মোবাইল চেক করা।
– এখন রাত সাড়ে তিনটা বাজে এতরাতে এইসব করার কি মানে?
– আমি করতে বলেছি করবি।এত প্রশ্ন করবি না।সব কিছুর ডিটেইলস আমি চাই।
মুনিফ মাথা নামিয়ে চলে যায়।আফীফ মাথা নুইয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে।
____
কেটে গেছে প্রায় তিন দিন।সেহেরিশ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছে।খুরশীদ আনওয়ার এখন মোটামুটি সুস্থ।মারুফা এবং ফাহমিদার সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে তারা সিধান্ত নেন আজকের মধ্যেই এই গ্রাম ছড়ে চলে যাবেন।প্রয়োজন নেই তাদের জমি। যেখানে জানের ভয়,জীবন মরণের প্রশ্ন আসে সেখানে আর এক মূহুর্তেও থাকা যায় না।আহনাফ দেওয়ান বসার ঘরে কপালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন।তৎক্ষণাৎ খুরশীদ আনওয়ারের উপস্থিতি টের পেয়ে নড়ে নড়ে বসেন।
– কিছু বলবেন?
– জি।আমরা সিধান্ত নিয়েছি আজি এই গ্রাম ছেড়ে যাবো
– সে কি কথা আপনাদের জমি….
– যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে জমি জামার আমার প্রয়োজন নেই।
খুরশীদ আনওয়ারের কথার মাঝে আফীফ তাদের সামনে দাঁড়ায়।ততৎক্ষনাৎ আহনাফ দেওয়ান উস্খুস করে খুরশীদ আনওয়ারের হাত জড়িয়ে ধরেন।
– আমার একটা প্রস্তাব আছে যদি রাখতেন।
– প্রস্তাব!বেশ বলুন।
– আপনার মেয়ে সেহেরিশকে আমরা এই বাড়ির বউ হিসেবে চাই।আপনি এভাবে যাবেন না।অন্তত…
– মাফ করবেন আমায়।আমি আপনার এই প্রস্তাবটি রাখতে পারলাম না।আমার মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে আছে আশা করি বুঝতে পারছেন।
খুরশীদের কথায় চমকে তাকায় আফীফ এবং আহনাফ।
– ক… কি বলছেন আপনি?
– আমি ঠিকি বলছি।আমরা বরং আজ ফিরে যাবো।
খুরশীদ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়।আফীফ আহনাফ দেওয়ানের দিকে কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সহসা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।
– আরে দাদুভাই শুন আমার কথা।
আহনাফ দেওয়ানের কথা শেষ হতেই তার কানে আসে দরজা বন্ধ করার বিকট শব্দ।এই শব্দ শেষ বার শুনেছিল আট বছর আগে যখন সেহেরিশ পালিয়ে যায় এই বাড়ি ছেড়ে।
#চলবে…