অন্তরিন প্রণয় -Part 5-8

0
259

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৫ থেকে 08
সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়ে শুরু হলো আরেকটি দিন।আড়মোড়া ভেঙ্গে সেহেরিশ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে তার বারান্দার ছাদ বাগানের দিকে যায়।ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখা হয় তার ফুফু মারুফার সাথে।
– ফুফি দেখো দেখো আমার সব ফুল গাছে আজ ফুল ফুটেছে।ইয়েয়য়য় আজ পার্টি হবে পার্টি।
– আজব! সেহেরিশ তোর পাগলামী গুলো এখনো গেলো না।ফুল ফুটেছে বলে তুই পার্টি দিবি।যাই হোক ভাইজান আর ভাবী তোর অপেক্ষায় বসে আছে নিচে চল।
– আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ফুফি।তুমি যাও।
মারুফা রুম থেকে চলে গেলে সেহেরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ড্রেস নিতে আলমারি খুলে।ভার্সিটিতে যাওয়াত উদ্দেশ্য তাকের শেষ সীমানা থেকে একটি কুর্তি টেনে বের করতেই তার পায়ের কাছে ঝনঝন শব্দ করে একটি নুপুর গড়িয়ে পড়ে।
সেহেরিশ দু পা পিছিয়ে গিয়ে মেঝেতে তাকাতেই সেই নুপুরটি চোখে পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে শান্ত মেজাজের সেহেরিশের রাগ তড়াক করে বেড়ে যায়।মেঝে থেকে নুপুরটি হাতে তুলে একমনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।না চাইতেও বার বার কেন মনে পড়ে যায় আফীফ দেওয়ানের কথা!
– আমি তোকে ঘৃণা করি আফীফ।তবুও তুই আমার মন থেকে কেন যাচ্ছিস না।তোর আর আমার দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তবুও কেন ভুলিনি তোকে।
সেহেরিশ হাতের নুপুরটা আবারো ছুড়ে মারে আলমারিতে।ড্রেসটা হাতে তুলে ওয়াশরুমে ডুকে বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশের বেহায়া মন আনমনেই ভাবতে থাকে আবারো আফীফের কথা।
সেদিনের পর কেটে গেছে আট বছর!দূরত্ব বেড়েছে সমান তালে সেহেরিশের বর্তমান অবস্থান ইতালির বলুনিয়া শহরে।সেদিন ফুফু মারুফার হাতে হাত রেখে চন্দনপুর গ্রাম ছেড়েছিল সেহেরিশ।তারপর শহর থেকে সোজা ইতালি।এর মাঝে আর কোন খোঁজ পায়নি চন্দনপুরের, পায়নি আফীফের।তার বন্ধি দশা জীবনের ঘটে যাওয়া দশটি দিনের কথা জানে না তার মা বাবা।শুধু মাত্র ফুফি মারুফা ছাড়া।এই আটটি বছর একটি মূহুর্তের জন্য সেহেরিশ তার অতীতের কথা ভুলে গেলেও হুট হাট আবারো মনে পড়ে যায় আফীফ নামের কোন এক রাগী ছেলের কথা।যে কী না নিজের স্বার্থকে মূল্যায়ন করতো।
—–
ফ্রেশ হয়ে সেহেরিশ নিচে নামতেই সবাই একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে।সেহেরিশের বাবা খুরশীদ আনোয়ার তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– গুড মর্নিং মামনি।
– গুড মর্নিং পাপা।
– তোমার এক্সাম কবে শেষ হবে?
– এইতো আর মাত্র দুটো দিন আছে তার পরেই আমি ফ্রি।এবার কিন্তু আমরা লং ট্যুরে যাবো পাপা।ফ্যামিলি ইউথ ফ্রেন্ড’স।
-ওকে। আগে তোমার এক্সামটা শেষ করো।
সেহেরিশ খাওয়া দাওয়া সেরে বাসা থেকে বের হতেই তার মা ফাহমিদা তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠে।
– সেহেরিশ শোন..
– বলো মাম্মী
– তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– সারপ্রাইজ?
– ইয়াহ।এবার এক্সাম দিতে যাও।পরে কথা হবে।
সেহেরিশ দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।তার জন্য রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছে তার বন্ধু কেইন।কেইন একজন খ্রিস্টান ধর্মের ছেলে।তার সাথে সেহেরিশের বন্ধুত্ব প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকেই।
– হেই কেইন হোয়াটস’আপ?
– ফাইন।ইউ?
– অল সো গুড।কেইন তোমার জন্য একটা ভালো নিউজ আছে।ইভেন তোমার না আমর ফ্রেন্ড সার্কেল সকলের জন্য।
– কি সেই নিউস সেহেরিশ?
– আমরা সকলে মিলে ট্যুরে যাবো কেইন।সাথে তোমারাও।
– ওয়াও ইট’স আল সো গুড নিউজ।
– ইয়াহ।
সেহেরিশ অনন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়।এদিকে কেইন সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।পকেট থেকে একটি ফুল বের করে আবারো ছুটে আসে সেহেরিশের কাছে।
– হেই সেহেরিশ স্টপ!
কেইনের কথায় সেহেরিশ দাঁড়িয়ে যায়।তখনি কেইন হাতে থাকা সাদা ফুলটি নিয়ে সেহেরিশের কানে গুজে দেয়।কেইন তার দুহাতে সেহেরিশের মুখদ্বয় আবব্ধ করে আবেগী সুরে বলে,
– সেহেরিশ ইউ আর সো ফ্লাফি।
– থাংকু মাই কিউটি ফ্রেন্ড।
সেহেরিশের মজার কথায় হেসে দেয় কেইন।দুজনেই আবার তাদের গন্তব্যের যাত্রা শুরু করে।
প্রায় দু-বছর আগে থেকেই কেইন সেহেরিশের প্রতি দূর্বল কিন্তু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে “ভালোবাসি” নামক শব্দটি ভুলেও মুখ থেকে বের করে নি সে।
—–
একজন রমণীর হাজার’টা ছবি দিয়ে একটি দেয়াল সুসজ্জিত করে রেখেছেন একজন যুবক।
গুটিয়ে রাখা শার্টের হাত পকেটে ঢুকিয়ে
সেই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন আরক্ত দৃষ্টিতে।ক্ষণিকেই চোখ বন্ধ করে গাঢ় করে নিশ্বাস ছাড়েন।দু-ঠোঁট চেপে ধরে আবারো চোখ খুললেন। ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি অভিপ্রায় হাসেন।
তৎক্ষণাৎ তার কানে আসে বাড়ির কোলাহল। দ্রুত পর্দা সরিয়ে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্মিত হলে আবারো ঘুরে তাকায় সেই দেয়ালের দিকে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি রেখা টেনে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
দু কদম এগিয়ে যেতেই সামনে তার দাদাজানের চনমনে অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে যান।
– দাদাজান এত শোরগোল কিসের?
– তোমার দাদীমা আবার অসুস্থ হয়ে গেছে আফীফ!এইভাবে আর কত দিন শুধুমাত্র তোমার উদ্দেশ্য পূরণে আমার ছেলে, ছেলের বউ’কে দেশের বাইরে থাকতে হচ্ছে।তোমার দাদীমা যে দু-চোখে দেখে যেতে চায় তাদের। শেষ কবে সামনা সামনি দেখা হয়েছে তাদের মনে আছে তোমার?
আফীফ গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লেন।নিজেকে ধাতস্ত করে দাদাজানের দিকে নিরুদ্যম চোখে তাকালেন।তার দাদাজান আহনাফ ভয়ার্ত কন্ঠে আক্ষেপ সুরে বলেন,
– ছোট্ট মেয়েটাকে মাফ করে দিলে হয়না আফীফ?বাচ্চা মেয়ে ভুল করেছিল সেই ভুলের শাস্তি, শোধ কি তুমি এই প্রাপ্ত বয়সে তুলবে?
– কে বলেছে আমি প্রতিশোধ নেবো।আফীফের শাস্তি অন্তত ভয়ানক! আর আফীফ কখনো তার হৃদয়বতী’কে শাস্তি দেয় না বরং অন্তরিন ভাবে ভালোবেসে যায়।এত সব আয়োজন মোটেও তার বিষাক্ত শাস্তির নয়! তবে হ্যা অন্যরকম শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে।তার শাস্তিটা হবে অন্তত সুমিষ্ট।
আফীফ তার গমগম সুরের বাক্য শেষ করেই বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু বৃদ্ধ আহনাফ ঘামছে, কি চলছে এই ছেলের মাথায় এত বছর ধরে?এই ছেলের কান্ডকীর্তিতে বাধা দেওয়ার সাধ্যে কারো নেই। সে যে অন্তত ভয়ানক একজন সুপুরুষ!
আফীফ দ্রুত তার দাদীজানের কক্ষে প্রবেশ করে।অচেতন ফাতেমার মুখটা দেখে তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠে।দাদীজানকে তো সে ভালোবাসে।আর ভালোবাসার মানুষ গুলোর কষ্ট আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা।আবারো রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য রওনা হয়।যাওয়ার আগে হাত দিয়ে ইশারা করে মুনিফকে ছাদের দিকে যেতে বলে।
মুনিফ আফীফের একমাত্র ফুফুর ছেলে।গত কয়েক বছর তারা সবাই এই বাড়িতেই আছে।মুনিফ আর আফীফ সমান বয়সের তাদের বন্ধুত্বের অবস্থাটাও বেশ দৃঢ়।
– মুনিফ দাদীজানের জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা কর।বাড়িতে থেকেই সেই নার্স দাদীজানের সেবা করবে।
– কিন্তু নানীজান মামা মামীকে দেখতে চেয়েছে আফীফ।তাদের দেশে আসতে বল।এভাবে আর কতদিন চলবে?
– উতলা হচ্ছিস কেন তোরা?আমি যদি আমার প্রাণ পাখির জন্য দেখা হীন কথা হীন দৈর্য্যর সাথে থাকতে পারি তবে তোদের এত সমস্যা কিসের?চাচাজন,চাচিআম্মার সাথে তো সবার ভিডিও কলে কথা হচ্ছেই।আর দাদীজানের এইসব মনের ভুল একটু অসুস্থ হলেই মরে যাবো মরে যাবো যতসব জাস্ট বিরক্তকর।তিনি একবার ভাবেন না আমরা তার কথায় কতটা কষ্ট পাই।
– আচ্ছা বাদ দে।তোর তাকিয়ার খবর কী?
– উহুহ সে তাকিয়া নয় সে তো এখন সেহেরিশ!
– যাই হোক। কী খবর তার?
– সে তো মুক্ত আকাশে উড়ছে।উড়তে থাকুক।পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।
কথাটি শেষ করেই গাঢ় করে শ্বাস ছাড়ে আফীফ।তার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে মুনিফ বলে,
– এত কিপটামি করছিস কেন আফীফ?আমি তোকে কতবার বলেছি সেহেরিশকে আমায় একটু দেখা কি এমন মেয়ে যার জন্য আফীফ দেওয়ান, দেওয়ানা হয়ে গেছে।
মুনিফের কথায় বাকা হাসে আফীফ।
– আফীফের পছন্দের জিনিসের দিকে তাকাস না। ভুলেও না,তাহলে চোখ দিয়ে আর তোর এই সুন্দর পৃথিবী দেখা হবে না। সো বি কেয়ারফুল।
গত আট বছরে পাল্টে গেছে আফীফের জীবন।সেদিন রাগ দেখিয়ে দরজা বন্ধ করলে শত চেষ্টার পরেও আফীফ দরজা খুলেনি।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আহনাফ দেওয়ান দরজা ভাঙলে আরো উগ্র হয়ে যায় আফীফ।একে একে পুরো বাড়িতে তান্ডব চালায়।তার হিংস্রতা ঠিক দু-মাসেও কমে নি।চাপা রাগ থেকে থেকে এখনো মনের ভেতর জ্বলে উঠছে।
মুনিফ চলে গেলে আফীফ মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায় নি সেহেরিশ বরং উদ্দীপ্ত হয়ে আরো বাড়ছে।তাকে পাওয়ার তৃষ্ণা জাগছে মনে।
– তাকিয়া আনওয়ার সেহেরিশ!নিজেকে খুব চালাক ভাবো?অবশ্য আমিও মানি তুমি চালাক।খুব চালাক।তবে আমার থেকেও নয়।তুমি কী ভেবেছো আট বছর আগের কাহিনি আট বছর আগেই শেষ?উহু’হ ভুল।সেই আট বছর আগের কাহিনি এখনো চলছে তোমার অন্তরালে।আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে নতুন আঙ্গিকে নতুন পরিচয়ে।
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৬
ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আড্ডায় মেতে আছে চার বন্ধু।ধৌয়া উঠা গরম গরম কফির মগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে সেহেরিশ।তার পাশেই বসে আছে জুহি।সেহেরিশের বেস্ট ফ্রেন্ড জুহি।গত সাত বছর থেকে তাদের সম্পর্ক।জুহির বাড়ি বাংলাদেশে।সেহেরিশের মুখোমুখি কেইন এবং তুন্দ্র।তুন্দ্র একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ছেলে তার বাড়ি ইন্ডিয়ায়।ইতালি শহরে চাচার সঙ্গেই তার বসবাস। সেহেরিশের সাথে বেশ কয়েক বছর থেকেই পরিচিত।নিরবতা ছেদ করে কথা তুললো কেইন,
– সেহেরিশ আজ তো আমাদের এক্সাম শেষ তোমার গুড নিউজটা দিয়ে দাও সবাইকে।
– ইয়াহ!আমরা এবার লং ট্যুরে যাবো ফ্রেন্ড উইথ ফ্যামিলি।
সেহেরিশের কথা শেষ করতেই জুহি আড় চোখে তাকায় তার দিকে।
– আমরা ট্যুরে যাবো এটা নতুন কী?এটা নিয়ে আলোচনা করার কিচ্ছু নেই বরং শপিং করতে নেমে পড়ি এটাই ভালো।
জুহির কথা তাল মেলালো তুন্দ্র,
– ইয়েস,জুহি ঠিক বলেছে।
– শপিং তো আমরা করবোই আচ্ছা যাই হোক।মেন্টালি প্রিপেইড থাক এটাই বড় কথা।
সেহেরিশ কথা শেষ করে উঠতে নিলেই তার ফোন বেজে উঠে।হাতে মোবাইল নিয়ে চেক করতেই খুরশীদের নাম্বার দেখে চোখে মুখে হাসির ঝলক ভেসে উঠে,
– হ্যা পাপা বলো,
– তুমি কোথায় মামনি?
– ভার্সিটিতেই আছি।
– তোমার বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে চলে আসো।বাকি কথা পরেই হবে।
– ওকে পাপা।
সেহেরিশ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে দ্রুত সবাইকে তার সাথে যেতে বললো।বাকিরাও দ্বিমত পোষণ না করেই সেহেরিশের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো।
তুন্দ্র,কেইন,জুহি সেহেরিশদের বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মারুফার সাথে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলো।মারুফার জীবনে ভাই ভাবী আর ভাই’ঝি ছাড়া কেউ নেই।স্বামী মারা গেলেন বেশ কয়েক বছর আছে।অন্যদিকে সেহেরিশের বন্ধুগুলো যেন তাদের পরিবারের আরেক দল সদস্য তাই প্রতিটা ইভেন্টে তুন্দ্র, কেইন,জুহি এই বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।মারুফার সাথেও তাদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব।
– ফুপ্পি আমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ আছে বলনা?
কেইনের কথায় সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মারুফার দিকে।মারুফা কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন সেহেরিশের মা ফাহমিদা।
– তোমাদের পাশাপাশি সেহেরিশের জন্য ও বিষয়টি সারপ্রাইজ তাই আগে তার পাপা আসুক তবেই বলবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় খুরশীদ আনোয়ার।মেয়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বলতো কী সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্য?
– আঙ্কেল আমরা যেহেতু ঘুরতে যাবো নিশ্চই ভালো কোন জায়গায় যাবো?
কেইনের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন মুরশীদ।
– আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি!
মুরশীদের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে সেহেরিশ। তার অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত তার হাত চেপে ধরে মারুফা।
– বাংলাদেশ!বাংলাদেশ কেন বাবা?বাংলাদেশে কেন যেতে হবে আমাদের?এই ছাড়া কি আর কোন প্লেস নেই?
– আজব! তুমি এত রাগ দেখাচ্ছো কেন?ভুলে যেওনা তোমার জন্মস্থান বাংলাদেশেই।আগামী মাসে তোমার ফুফা এবং দাদা-দাদীর মৃত্যু বার্ষিক।গত কয়েকবছর আমাদের বিডিতে যাওয়া হয় নি এখন যেহেতু তুমি ফ্রি আছো তবে যেতে সমস্যা কোথায়?
– বাবা আমার শেষ কথা আমি যাবো না ,মানে যাবো না। নো নেভার।
সেহেরিশ রাগ দেখে মারুফা চোখ ইশারা দেন।তাতে আরো রেগে যায় সেহেরিশ,
– ফুফু তুমি জানতে বাবা-মা বিডিতে যাওয়ার প্লানিং করছে?তুমি জানো না আমি বিডিতে যেতে চাই না।তবে কেন নিষিধ করো নি তাদের?
সেহেরিশের রাগ দেখে বন্ধুরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে।শান্ত মেজাজের সেহেরিশের এমন রাগ আগে কখনো দেখেনি তারা।বাংলাদেশ নিয়ে রেগে যাওয়ার কোন কারন বুঝতে পারলো না তারা।মুরশীদ মেয়ের উগ্রতা দেখে রেগে যান আর তা বুঝতে পেরে ফাহমিদা সেহেরিশের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকায়।
– সমস্যা কি তোর সেহেরিশ?বিডিতে গেলে কি সমস্যা হবে তোর?
– আমি যাবো না মানে যাবো না।তোমাদের যেতে ইচ্ছা তো যাও।আমি একাই থাকবো বাড়িতে।
সেহেরিশের এমন হঠকারিতা দেখে দ্রুত নিচে নেমে আসে তার একমাত্র ভাই সামী।
– আপু তুমি রেগে গেলে কেন?
পনেরো বছরের দুরন্ত ছেলে সামী।সামী সেহেরিশের একমাত্র ছোট ভাই।বোনের এমন রাগ দেখে কিছুতেই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না।
– সামী তোমায় বলেছিনা বড়রা কথা বললে তুমি তার মাঝে আসবে না।তবে কেন এলে?
মুরশীদের কথায় মাথা নামিয়ে চলে যায় সামী।
সেহেরিশ তার বাবার রাগ বুঝতে পেরে নিজেকে ধাতস্ত করে নেয়।
– লিসেন পাপা আমি যাবো না তোমাদের ইচ্ছে হলে তোমরা যাও।কিন্তু আমি না।
সেহেরিশ নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।রাগে তার সারা শরীর কাপছে।আবার সেই অনন্তপুর আবার সেই চন্দনপুরের স্মৃতি তাকে মুষড়ে দিচ্ছে।মাত্র দশটা দিনের দেখায় একটা মানুষের সাথে, সারাজীবন যে তাকে ভুক্তে করতে হবে কে জানতো?
এতক্ষণ হাতে ধরে রাখা আপেলটি ঝুড়িতে রেখে সোফায় বসে পড়লো কেইন।
– হোয়াটি’স দ্যা রিজন ফর সেহেরিশ এংরি?
কেইনের প্রশ্নে তার পাশে বসে যায় জুহি।গালের নিচে হাত দিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
– আই ডোন্ট নো কেইন।
খুরশীদ লজ্জিত ভাব নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য বলে,
– সেহেরিশের আচরণে তোমরা কিছু মনে করো না।তোমরা কী বিডিতে যেতে চাও?
– ইয়েস আই ওয়ান্ট টু গো আঙ্কেল।
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন খুরশীদ।বাকি সবাই যাওয়ার জন্য মত পোষণ করলে ফাহমিদা আর খুরশীদ তাদের তৈরি থাকতে বলেন।এদিকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন মারুফা।

বাড়ির সব কিছু আবারো তকতকে ঝকঝকে করতে উঠে পড়ে লাগলো আফীফ।সেই ভোর থেকেই বাড়ির বাগান,ছাদ পুরো ঘরটাই আবারো নতুন করে সাজানো হয়েছে।আফীফের রুমের পাশের সেই গোপন কক্ষটাকে আবারো অন্যভাবে সাজানো হয়েছে।বর্তমানে এটি গোপন কক্ষ নেই বললেই চলে,তবে সবার চক্ষু আড়ালে গোপনীয়তা এখনো বজায় আছে।চারিদিকে ফুল,পুতুল,তারা,ঝার বাতি,পেইনটিং, সাদা রঙের পর্দায় সাজানো পুরো কক্ষটি দেখলে যে কারো তাক লেগে যাবে।
পুরো দেওয়ান মঞ্জিল জুড়ে এমন নিটোল রুম শুধু মাত্র দুটি আছে একটি আফীফের রুম এবং অন্যটি আফীফের গোপন কক্ষ।আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই মর্জিনাকে চোখে পরে,
– মর্জিনা খালা আপনাকে বলেছিলাম মায়ের কাছে যেতে এখানে কী আপনার?
– বড় আম্মা পাঠাইছে তোমার কাছে।আম্মার কি যানি কথা আছে।
-ঠিক আছে দাদীজানকে বলে দাও আমি আসছি।
আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায়।গায়ে থাকা ধূলো জমা শাটটা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আলমারি থেকে অন্য একটি শার্ট নিয়ে গায়ে জড়াতেই দেয়ালের দিকে লক্ষ্য যায়।সেহেরিসের হাস্যউজ্জ্বল ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন সৎবিৎ হারিয়ে ফেলে আফীফ।ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ছবিগুলোতে হাত বুলায়।
– আমার ছোট্ট তাকিয়া এখন তুমি সেহেরিশ!আমি অধীর আগ্রহে, তোমায় কখন এই দেওয়ান মঞ্জিলে আবারো স্বাগতম করবো।যত রাগ আছে সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো।আর বন্ধী করবো না আর বকবো না।তবুও ফিরে এসো…তুমি জানো গত আট বছর আমার কি অবস্থায় পার হয়েছে?উহুহ যানো না।তোমার উপর রাগ দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।দিনের পর দিনে ওষুয় সেবনে আমি যে মৃত্যুর পথ যাত্রী হয়ে গেছিলাম তা কি তুমি জানো?উহু’হ যানো না।তবে যানবে ধীরে ধীরে আগের মতো তাড়াহুড়ো নয়।একটু সবুর করো।
সেহেরিশের ছবিতে হাত বুলিয়ে আফীফ সেখান থেকে চলে যায়।খুব শীঘ্রই তার জীবনে নতুন দিনের সূচনা হবে।

গভীর রাতে মনমরা হয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার সব সুখ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।ফুল গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে কানে গুজে গালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন সে।তখনি তার রুমে প্রবেশ করেন মারুফা।
– তুমি কেন আমার ঘরে এসেছো ফুফু?
– রেগে যাচ্ছিস কেন তুই?
– তুমি জানো আমি ফিরতে চাই না বিডিতে তবে কেন পাপার সাথে তালে মেলালে?
– তোকে কিছু কথা বলি শোন!আমরা ঢাকায় যাবো সেখানে হোটেল বুক করে কয়েকদিন থেকে অনন্তপুরে যাবো।তোর ফুফা দাদাভাই দাদীর কবর জিয়ারত করে আবার ফিরে আসবো। এতে চন্দনপুরের ভয় আসছে কেন?আর আট বছর আগের ঘটনা আট বছর পর ফিরে আসবে না।গিয়ে দেখ গ্রামের জমিদারের নাতি এতদিন বিয়ে শাদী করে সংসার সামলাচ্ছে।এটাও তো হতে পারে চন্দনপুরের সেই জমিদারের সব রাজস্ব হারিয়ে ফেলেছে।তুই চিন্তা নিচ্ছিস কেন?তাকিয়া নামের কোন মেয়ের কথা হয়তো বা তাদের মনেও নেই।সব ভুলে গেছে।এই আট বছরে তুই পাল্টেছিস তোর জীবন পাল্টেছে ঠিক তাদেরো।তাই তোর ভালোর জন্য বলছি ভাইজানের মনে কষ্ট না দিয়ে বিডিতে চল।
– যদি আবারো ফিরে আসে আফীফ দেওয়ান?আর আমায় বন্ধী করে নেয় গোপন কক্ষে?
– দূর বোকা মেয়ে!তখন তুই ছিলি একা এখন তোর সাথে আমরা আছি।সেদিন যদি পারভিন না থাকতো তবে যে কি হতো?আমি হয় তো তোকে ফিরেই পেতাম না।টাকা কি না করতে পারে।টাকার লোভে দেওয়ান বংশের সাথে পাল্লা দিয়ে পারভিন তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।টাকাই সব!
– তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমি যাবো?
– কেন নয়?তোর সাথে কেইন,জুহি,তুন্দ্র যাবে তবে তুই কেন যাবি না?
– ঠিক আছে আমি পাপার সাথে কথা বলে নেবো।
– তাহলে আমাদের লং ট্যুর বিডি?
– ইয়েস!
সেহেরিশ হাসি মুখে সবটা সমাধান করলেও মনের ভেতরটায় জমে থাকা ভয় টা এখনো কাটে নি।
#চলবে…
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৭
– এইসব কোন ধরনের কথা জুহি?তুই বলেছিলি আমাদের সঙ্গে যাবি তবে এখন কেন যাবি না?
– দেখ সেহেরিশ আমারো যাওয়ার ইচ্ছা ছিল বিডিতে,কিন্তু বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছেন আমি যেতে পারবো না।তুই কেইন, আর তুন্দ্রকে নিয়ে যা। আমার জন্য মন খারাপ করে থাকতে হবে না।
জুহির আশ্বাসে শান্ত হলো না সেহেরিশ।বরং রাগ দেখিয়ে আলমারির সব জামা ছুড়ে মারলো।সেহেরিশের রাগ দেখে জুহি প্রত্যুত্তর করলো না।বরং সব জামা গুলো তুলে ট্রলিতে একে একে সব ভাজ করে রাখলো।
– এমন রাগ দেখিয়ে লাভ নেই।আমি সত্যি যেতে পারবো না।যেহেতু লং ট্যুরে যাচ্ছিস চিন্তা করিস না বাবা সুস্থ হলে আমি একাই চলে যেতে পারবো।
আর তুই…
জুহি কথার মাঝেই থেমে যায়।আলমারির কর্ণার থেকে একটি নুপুর বের করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,
– ওয়াও! এই গোল্ডের নুপুরটা কখন কিনলে সেহেরিশ?দেখে মনে হচ্ছে তোর পায়ে ঠাসা হয়?
বিরস মুখ নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েই সেহেরিশ চমকে যায়।
– এই নুপুর বাইরে ছুড়ে মার।অসহ্য লাগে আমার।
– আজব!এত সুন্দর একটা নুপুর তোর অপছন্দ মানতে পারলাম না।যাই হোক তোর জামা কাপড় প্যাকিং করা শেষ।আর এইভাবে গোমড়া মুখে থাকিস না প্লিজ।
সেহেরিশ এখনো মুখ ভার করে বসে আছে তার অবস্থা দেখে জুহি মিহি হাসে।পেছন থেকে সেহেরিশকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
– কথা দিচ্ছি আমি যাবো বিডিতে তবে এখন না।আমি ছাড়া বাবা মায়ের কে আছে বল তাদের দেখার দায়িত্ব আমার। তাই এখন যেতে পারছি না তবে আমি খুব শীঘ্রই যাবো।এবার অন্তত হাস প্লিজ!
জুহির হাতে হাত রেখে হেসে উঠলো সেহেরিশ।সেহেরিশ ভালো করেই যানে জুহি কখনো তার কথা ফেলতে পারে না।
—–
অবশেষে কেইন,তুন্দ্র,সামী,মারুফা,সেহেরিশ,ফাহমিদা এবং খুরশীদ আনোয়ার বাংলাদেশে পৌছে যায়।ঢাকায় এসে বিলাসবহুল একটি হোটেল বুকিং করে সবাই সেখানেই উঠে।কেইন সহ সবার মুখে আনন্দের আভাস থাকলেও আনন্দ নেই সেহেরিশের চোখে মুখে।এখনো আতঙ্কগ্রস্ত সে।বেশ কিছুক্ষণ তুন্দ্র আর কেইন ছবি তুলে সেহেরিশের কাছে ফিরে আসে।সেহেরিশের ভার মুখ দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কেইন,
– হোয়াটি’স ইউর প্রব্লেম সেহেরিশ?
– নাথিং।
– তবে এইভাবে মনমরা হয়ে বসে আছো কেন?আমরা বাংলাদেশে এসেছি বলে কি তুমি খুশি নয়?
কেইনের প্রশ্নে সহসা জবাব দিলো তুন্দ্র,
– আমারো তাই মনে হচ্ছে কেইন।আমি ভাবছি ফিরে যাবো।তুই চাইলে আমার সাথে ইন্ডিয়া যেতে পারিস।সেখানে তোকে কাশ্মীর,দার্জিলিং,যগ ফলস,দিল্লি, সিকিমে নিয়ে যাবো আশা করি তোর ভালো লাগবে।
তুন্দ্রের কথায় চোখ ছোট করে তাকায় সেহেরিশ।গমগম সুরে রাগ দেখিয়ে বলে,
– সমস্যা কি তোদের?এমন নাটক করার মানে কী?
– নাটক তো আমরা করছিনা। নাটক করছিস তুই।আসার পর থেকেই মুখটা পেঁচার মতো করে রেখেছিস তবে আমরা নিশ্চয়ই ভেবে নেবো আমরা আসাতে তোর এমন রিয়েকশন।
– দূর তা না।আসলে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো।
সেহেরিশ কথা শেষ করতেই তাড়াহুড়ো করে রুমে ডুকে সামী।তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ।তা দেখেই তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সেহেরিশ।
– কি হয়েছে সামু?তোকে এমন লাগছে কেন?
– বাবার কি যেন হয়েছে আপুনি।বাবা কার সাথে কথা বলেই চিন্তায় ডুবে যান। ফুফু,মামনির একই অবস্থা আমায় কেউ কিছু বলছে না।আমার কোন কিছুই স্বাভাবিক লাগছেনা।
সামীর প্রশ্নে তুন্দ্র আর কেইন একে অপরের দিকে ইশারা দিলো।সেহেরিশ দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে মারুফার রুমে প্রবেশ করে,
– ফুফি কি হয়েছে তোমার চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– দ্রুত রেডি হয়ে নাও সেহেরিশ।আমাদের এখনি অনন্তপুর যেতে হবে।
– অনন্তপুর কিন্তু কেন?
– আমাদের সব জায়গা জমি অনন্তপুরের মতাব্বরের ছেলে দখলে নিয়ে গেছে।এখন তারা অস্বীকার করছে।তুমি দ্রুত রেডি হয়ে আসো।
– কিন্তু ফুফি…
– কোন কথা শুনতে চাই না সেহেরিশ।এখন তোমার ছিঁচকাঁদুনে কথা শোনার টাইম আমার নেই।তোমার পাপার ভালো চাও তো সবাইকে বলো তৈরি হয়ে আসতে।
মারুফার কড়া নির্দেশে দ্বিমত পোষণ করলো না সেহেরিশ।বরং সবাইকে নিয়ে তৈরি হতে নিজ নিজ রুমে চলে যায়।সবাই যখন সেহেরিশের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন সেহেরিশ ফিরে আসে, আর তাকে দেখেই রেগে যান ফাহামিদা।
– এইসব কী সেহেরিশ?তুমি কি ড্রেস পড়ছো এইসব?
– কেন?জিন্স টপ্স,সমস্যা কোথায়?
– বিদেশের কালচার তুমি বিদেশে দেখাবে এখন আমরা গ্রামে যাবো দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে এসে শালীন পোষাক পরো।
– আমি পারবো না। যা পরেছি তাই আমার কাছে ঠিক লাগছে।
সেহেরিশের তর্ক দেখে বিরক্ত হয়ে যান ফাহমিদা।এদিকে প্রায় দুপুর শেষ হতে চললো।অনন্তপুর গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে তিন ঘন্টা সময় লাগবে।আজকে খোজে খবর নিয়ে আজকেই তাদের ফিরতে হবে তাই খুরশীদ আনোয়ার মা মেয়ের তর্ক থামিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বললো।

দেওয়ান মঞ্জিল আজ সাজ সাজ রব রব।রান্না-বান্না থেকে শুরু করে পুরো বাড়িতেই ছড়িয়ে আছে নব্যতা।মুনিফকে বাকি সব দায়িত্ব দিয়ে আজ আফীফ অধীর আগ্রহে বসে আছে তার ফুলপরীকে দেখার ইচ্ছায়।বাড়ির সাতটি কুকুর একে একে মৃতবরণ করায় আফীফ আবারো বাড়ির জন্য কুকুরের ব্যবস্থা করে।বর্তমানে তার তরতাজা অন্যদেশীয় কুকুর পাচঁটি এছাড়াও গ্রামের এলাকার কুকুর গুলো বেশির ভাগ সময় দেওয়ান মঞ্জিলের আশেপাশে পাহারাদার হিসেবে দেখা যায়।
আফীফের ভাষ্যে মতে, ” যে মানু্ষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সে মানুষটাও একটা সময়ে বেইমানি করে কিন্তু এই কুকুর গুলোর মুখে এক পিস পাউরুটি তুলে দিলেই সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকে”
তার দৃষ্টান্ত আফীফ নিজে পেয়েছে তাই বর্তমানে মানুষ নামের প্রানী গুলোকে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
বাগানে থাকা বেঞ্চিতে বসে কুকুর গুলোর দিকে পাউরুটি ছুড়ে মারছে আফীফ আর সেই পাউরুটি মুখে তুলে নিচ্ছে কুকুর গুলো।সব কুকুরকে একসঙ্গে দেখে আফীফের সেহেরিশের কথা মনে পড়ে যায়।বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার শর্ত দিয়ে কুকুর গুলোর হাতে কিভাবে যে শায়েস্তা করেছিল তাকে ভাবলে এখনো হাসি পায়।
– ভাইয়া আমার আর মৌ’য়ের সব ফুলের পাপড়ি ছেড়ে শেষ কিন্তু কাজটা করবো কখন?সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তুমি যানো না সন্ধ্যায় আমার ছাদে যেতে ভয় করে।
আমানের কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো আফীফের।আমান আফীফের ছোট ভাই।এবার ক্লাই নাইনে পড়াশোনা করছে।আফীফ যেমন রাগী,তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আমান তার উলটো।সহযে যে কাউকে বিশ্বাস করে নেওয়া আমানের বাজে স্বভাব।যার কারনে আফীফ তাকে বার বার শাস্তির কাঠগড়ায় দাড় করায়।
অন্যদিকে মৌ,মুনিফের একমাত্র ছোট বোন।বয়স মাত্র সাত বছর।কিন্তু বাড়ির সবাইকে নিজের মায়ায় বেধে রেখেছে।বাড়ির সবাই তাকে পাকা বুড়ি বলেই ডাকে।
– এই ভাইয়া কি ভাবছো তুমি?
– দেখ আমান এত উতলা হচ্ছিস কেন?তোর ভাবী আসবে তার এইটুকু কাজ করতে পারবি না?আসলে তুই আমায় ভালোই বাসিস না।
– কি যে বলনা তুমি।যাই হোক নো টেনশন।ভাবীরা নাকি চন্দনপুরে পৌছে গেছে তবে এইগ্রামে কখন আসবে?
– অপেক্ষা কর আমান।অপেক্ষা কর।আমি যদি আট বছর পারি তুই পারবি না কেন?এমন ব্যবস্থা করেছি এই গ্রামে না এসে থাকতে পারবেনা।
—-
অনন্তপুরে মতাব্বরের ছেলে আজ দুপুরে সৌদি চলে গেছেন।তাই জায়গা জমির বিষয়ে আজ কোন আলচনা সভা বসবে না।এদিকে গ্রামের মুরব্বিদের নানান জনের নানান মত।সবার এক কথা চনন্দপুরের জমিদারের কথায় একটা সমাধান হতে পারে তাই তারা যেন চন্দনপুরে যায়।সব আশার আলো যখন নিভে গেছে তখন জমিদার আহনাফ দেওয়ানের উদ্দেশ্য সবাইকে নিয়ে পৌছে যায় দেওয়ান মঞ্জিলে খুরশীদ আনওয়ার।
সেহেরিশ এবং তার বন্ধুরা অন্য গাড়িয়ে রওনা দিয়েছে।সেহেরিশের আতঙ্কিত মুখ দেখে কেইন,সামী আর তুন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
– মাই কিউটি সিস তোমায় এমন লাগছে কেন?
সামীর কথায় গলা খেঁকিয়ে উঠে সেহেরিশ। “কিছু না” বলে কথা ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।কেইন আর তুন্দ্র দুজন দুজনকে ইশারা করে চুপ হয়ে যায়।দেওয়ান মঞ্জিলে সেহেরিশের গাড়ি থামতেই একে একে নেমে আসে সামী,কেইন তুন্দ্র।
– ওয়াও,এই গ্রামে এমন বাড়ি!মাই গুড নেস।
তুন্দ্রের কথায় তাল মেলালো কেইন।
– ইয়েস ব্রো।বাই দা ওয়ে তোর ফটোগ্রাফির জন্য গ্রামটা পারফেক্ট,এই বাড়িটাও পারফেক্ট।
– হুম ঠিক বলেছিস।
সবাই যখন বলা বলি করছিল কিন্তু তখনো সেহেরিশ গাড়িতে বসে ঘামাচ্ছিল।
– কিরে আপু গাড়ি থেকে নাম। পাপা তো আগেই চলে গেছে।আমরা যাবো না?
সেহেরিশের কান্ডে সবাই হতবিহ্বল!চঞ্চল সেহেরিশের এমন চনমনে অবস্থা কিছুতেই মানায় না।
সবার বিমূঢ় অবস্থা বুঝতে পেরে সেহেরিশ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং কেইন, সামী তুন্দ্রের পেছনে হাটতে থাকে।
বাড়ির দারপ্রান্তে প্রবেশ করতেই সেহেরিশসের সারা শরীরে অনামিক শিহরণ বয়ে যায়।এই তো আট বছর আগেই এই দারে সে থুথু ছুড়ে চলে যায়।আজ আবার সে ফিরে এসেছে আফীফ দেওয়ানের দারপ্রান্তে।
সেহেরিশ গেটে প্রবেশ করতেই সবাই তড়াক করে তাকায় তার দিকে।মাঝ উঠনে দাঁড়িয়ে আছে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা।কেইনের সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে সেহেরিশ মাঝ উঠনে দাঁড়িয়ে যায়।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।তাই গ্রামে শীতের প্রকপটাও বেশি বেড়ে গেছে।চারিদিকে আসমানটা আজ লালাভাব ছড়িয়ে আছে।সেহেরিশের বুকের ভেতরটায় ধুকপুক শব্দ কম্পন পাশে থাকা কেইন যেন শুনতে পারছে।এমন অপ্রতিভ অবস্থায় সেহেরিশ আগে কখনো পড়েছে কী না তার জানা নেই।
দেওয়ান বাড়ির সবাই খুরশীদ,ফাহমিদা মারুফাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়।বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেইন সহ দেওয়ান বাড়ির কিছু সংখ্যাক লোক।সেহেরিশ এগিয়ে যেতেই তখনি তার মাথায় ঝাকে ঝাকে ফুলের পাপড়ি আছড়ে পড়তে থাকে।অকস্মাৎ কান্ডে উজবুক হয়ে যায় সেহেরিশ।কেইন লাফিয়ে পেছনে সরে যেতেই সামীর সাথে ধাক্কা লাগে।সেহেরিশ অবাক হয়ে উপরে তাকাতেই সেই মূহুর্ত গুলো ক্যামেরায় বন্ধী করে নেয় তুন্দ্র।
– হেই হোয়াটি’স দিস?
সেহেরিসের ধমকে তিনতলার ছাদ থেকে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে আমান বলে,
– সরি আপু ভুলে সব পাপড়ি পড়ে গেছে।
সেহেরিশ চুল থেকে গোলাপের পাপড়ি সরাতেই আফীফের কথা মনে পড়ে যায়।মনে পড়ে যায় আফীফের বলা সেই কথা,
–“শুভ রজনী ফুলপরি”
মূহুর্তেই সব অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে গেছে সেহেরিশের।
অন্যদিকে আড়লে কেউ একজন দুচোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত।কত বছরের অপেক্ষার অবসান আজ ঘটলো তার হিসাব শুধু সে নিজেই যানে।
সেহেরিশের বিরস মুখশ্রী দেখে লোকটি কিঞ্চিৎ হাসে,
– প্রিয় তোমার শহরে আমি নামক ভয়ে’রা তবে এখনো হানা দেয়!
#চলবে….
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
#অন্তরিণ_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৮
বাড়ির লিভিং রুমে বসে আছে সেহেরিশের পরিবারের সদস্যরা।তাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন আহনাফ দেওয়ান।সবাই উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার দিকে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।বর্তমানে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে তবুও এমন শীতে ঘামছে সেহেরিশ।তার চিন্তাররাজ্যে বার বার ভর করছে আফীফ দেওয়ান।সেই আট বছর আগেও ছিল এমন ডিসেম্বর মাস।বাংলাদেশ তখন প্রচন্ড কুয়াশায় ঢাকা।শীতের প্রকটে নিমজ্জিত জনজীবন।সেই পূবাহ্ণে আফীফের সাথে দেখা তার। সেদিন আফীফের থেকে মুক্তি চাইতে কত ছলা কলা কৌশল এটেঁছিল আর আজ সে নিজেই আফীফের দরবারে হাজির।
– আপনাদের সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি।মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়া খুব একটা সুবিধার নয়।তবে আমাদের দেওয়ান বংশের সাথে কোন দিন বেয়াদবি কিংবা চালাকি করতে যায়নি।আমরা যখন যা বলেছি সে করেছে।আজ যেহেতু সৌদি চলে গেছেন সে হিসেবে আমার হাত ফাঁকা।এখন এই মূহুর্তে কোন সিধান্ত আমি নিতে পারবো না।
আহনাফ দেওয়ানের কথায় চিন্তায় মুখ ভার হয়ে গেলো খুরশীদের।
– তবুও আপনি আপনার চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না দয়া করে।আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।আগামী সাপ্তাহ আমার আব্বা আম্মার মৃত্যু বার্ষিক আমি চাইছি এবারের আয়োজনটা বড় করে করা হবে।কিন্তু জমির সমস্যা নিয়ে আমার মনটাই নড়ে গেলো।
– আপনি যে সিধান্তে দেশে এসেছেন সেই সিধান্ত বজায় রাখুন।রমিজ সৌদি থেকে ফিরে আসলেই আমরা আলোচনায় বসবো।তাছাড়া এইসব ঝামেলার কাজ আমার নাতি দেখা শোনা করে।আমার তো বয়স হয়েছে এত কিছুর দখল সামলানোর সময় আমার নয়।
– আপনার নাতি?
-আফীফ দেওয়ান!আমার বড় ছেলের, বড় পুত্র।
আফীফের কথা শুনতেই নড়েচড়ে বসে মারুফা এবং সেহেরিশ।সেহেরিশের শঙ্কিত মুখ দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন মারুফা।
– যাই হোক খুরশীদ সাহেব আমাকে এখন উঠতে হবে!
আহনাফ দেওয়ানের কথা বিচলিত হয়ে যান খুরশীদ।
– কিন্তু আমাদের তো কথা শেষ হয় নি।
– একটু পর গ্রামের সার্লিশে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।তাই এখন আর আপনার সাথে আলোচনা করতে পারছিনা আমি দুঃখিত।
– ঠিক আছে আপনার সাথে আমার পরে কথা হবে।আজ তবে আমরা আসি।
– এ কি আজ চলে যাবেন?দেওয়ান পরিবারের নিয়ম তো নেই মেহমান আপ্যায়ন ছাড়া বিদায় নেবে।আপনাদের আজ রাত এখানেই থাকতে হবে।বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা।এমন শীতের মাঝে মোটেও এত দূর যাওয়া উচিত নয়।আপনারা আজ থেকে যান।
– না না তা হয় না আমরা অলরেডি হোটেল বুকিং করে ফেলেছি।
– আপনাদের ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি নেই?
– না আমার যা ছিল সব অনন্তপুরেই কিন্তু আজ সেই জমিও আমি হারাতে বসেছি।
– তবে বেশ আজ থেকে আপনারা এখানেই থাকবেন হোটেল বুকিং ক্যান্সেল করুন।আমার শেষ কথা এর পর আপনার আপত্তি থাকলেও আমার কিছু করার নেই। আপনার জন্য এখানে থেকে যাওয়াটাই ভালো হবে।
আহনাফ দেওয়ানের কথায় খলবলিয়ে উঠে সেহেরিশ।তাকে দাঁড়াতে দেখে বাদ বাকি সবাই দাঁড়িয়ে যায়।আহনাফ দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দেয়,
– আ…আমরা গ্রামের পরিবেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারবো না। আমরা বরং ঢাকায় ফিরে যেতে চাইছি।
আহনাফ আপাদমস্তক সেহেরিশকে দেখে নিলেন।তার কথায় লীন হেসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দেয়,
– এই বাড়ি দেখে আশা করি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছো কোন কিছুর কমতি নেই।ত্রুটিহীন বাড়িটাকে আরো নিটোল ভাবে সাজিয়েছে আমার দাদুভাই।তাছাড়া শহরে অনেক থেকেছো এবার না হয় গ্রামের হাওয়া গায়ে লাগাও।তা খুরশীদ আনওয়ার আপনি আপনার পরিবার স্বজন নিয়ে আজ থেকে এই বাড়িতেই থাকুন।
– আমার মেয়েটা যখন চাইছে না তখন আপনাদের আর কষ্ট দেবো না।আমরা আজ রাতের বেক করবো
খুরশীদ আনওয়ারের কথা শেষ হতেই সমীরণে ভেসে আসে এক গম্ভীর কণ্ঠ,
– আমার দাদাজানের কথা কেউ কখনো অমান্য করেনি আশা করি আপনিও করবেন না।
আফীফের কন্ঠে সহসা সবাই চকিতে তাকায়।
– আসসালামু আলাইকুম আমি আফীফ দেওয়ান। দাদাজান নিশ্চই আমার পরিচয়টা এতক্ষণে দিয়ে দিয়েছে।
– ওয়া আলাইকুমস সালাম।হ্যা তোমায় চিনতে পেরেছি।
আফীফ আর খুরশীদ সমান তালে কথা বলে যাচ্ছে, এদিকে সেহেরিশ অবাক হয়ে আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।আগের আফীফের উগ্রতার মাঝে বর্তমান আফীফের কোন মিল নেই।নির্মল,সচ্ছল চেহারার কথা বার্তায় মার্জিত।কে বলবে এই লোকটা উগ্র!রাগী!স্বার্থপর।
দ্রুত গায়ে থাকা হুড়ির টুপিটা এঁটো সেঁটো করে মাথায় জড়িয়ে নেয় সেহেরিশ।আফীফ যেন সহযে তার চেহারা চিনতে না পারে।
– আঙ্কেল আপনারা কোন চিন্তা করবেন না।আপনাদের জন্য পার্ফেক্ট থাকার জন্য রুম দেওয়া হবে।হোটেলের বুকিং ক্যান্সেল আমি করছি।আপনারা শুধু আমাদের অনুরোধ টুকু রাখুন
আফীফের সরলতা,ভদ্রতা দেখে ফাহমিদা সহসা সম্মোতি জানান।আর তার সম্মোতি পেয়ে সবাই হা তে হা মেলালেও একমাত্র মারুফা আর সেহেরিশ কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। তবুও সকলের চোখে সন্দেহের বাতি জ্বলার আগেই সেহেরিশ এবং মারুফা রাজি হয়ে যায়।
—-
খুরশীদ-ফাহমিদার জন্য নিচের তলার রুম ঠিক করা হয়েছে।
কেইন-তুন্দ্র,মারুফা-সামী,তাদের জন্য দোতলার বাম দিকের রুম দেওয়া হয়েছে।একমাত্র সেহেরিশের জন্য দোতলার ডানের রুমটি দেওয়া হলো।সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রুমটি সেহেরিশের হওয়ায় তার ভীষণ রাগ লাগলো কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাগারাগি না করে নিজের রুমে গিয়ে ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলতেই একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুমের চারিপাশ।অদ্ভুত সুন্দর ডেকোরেশন পুরো রুম জুড়ে।কেউ দেখে বলবে এই গ্রামে এত সুন্দর রুমের ব্যবস্থা।সেহেরিশ পীল পীল পায়ে এগিয়ে যায় রুমের দিকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ধপ করে বসে যায় বিছানার উপর।
হাজারটা চিন্তার পাসরা রেখে সেহেরিশের মাথায় হুট করেই প্রশ্ন আসে আফীফ কী তাকে চিনতে পারেনি?সবার সাথে কথা বলার সময় আফীফ তার দিকে একটি বারেও তাকায় নি।তবে কি ফুফির কথাই ঠিক!আফীফ সব ভুলে গেছে।হয়তো বা ভুলেই গেছে জমিদারের নাতি হাজারটা কাজ তার ঘাড়ের উপর।তাতে এই সামান্য মেয়েটির কথা মাথায় রাখবে কী করে?
—-
রাতের ডিনার টেবিলে সেহেরিশের পরিবারের সকল সদস্য সহ আফীফ আহনাফ দেওয়ান বসেন।বাড়ির মহিলা সদস্যরা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।একে একে সেহেরিশের পরিবারের সঙ্গে সবার পরিচয় পর্ব শেষ।সেহেরিশ ঘুরে ঘুরে সব মহিলাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।আফীফের মা সেঁজুতি তাকে চিনতে পারছে না।বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনা আফীফের দাদীজান আমেনা এবং আহনাফ দেওয়ান তাকে চিনতে পারলো না।সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেছে।কি করে সম্ভব মাত্র আট বছরে একটি মেয়েকে ভুলে যাওয়া। সেহেরিশতো তাদের ভুলতে পারেনি।
– আপনার নাম কি মিস?
মুনিফের কন্ঠে সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।
– স..সেহেরিশ!
– ওহ সামীর বোন আপনি।আপনার ভাই তো ভীষণ চটপটে তবে আপনি এমন শান্ত কেন?আসার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন চিন্তিত?
সেহেরিশ কিছু বলার আগেই কেইন হড়বড়িয়ে কথা শুরু করে দেয়,
– হেই ব্রো সেহেরিশ মোটেও চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে নয়।সে কথা বলতে নিলেই দশজনের কথা একজনেই বলে দেয়।
কেইনের কথা শুনে সকলেই মৃদু হাসে।সকলের কাছে ডিনার টেবিলে করা আলোচনা স্বাভাবিক লাগলেও। পরিবেশটার সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছেনা সেহেরিশ।আফীফের দিকে যতবার নজর গেছে ততবার তার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়েছে।সব কি তিক্ত অসহ্য লাগছে তাই বাড়ির সবার খাওয়ার মাঝেই সেহেরিশ দাড়িয়ে যায়,
– আমার খাওয়া শেষ মাম্মি আমি ঘরে যাই।
– কি বলিস তোর ভাত এখনো প্লেটে সম্পূর্ণটাই রয়ে গেছে।
– আমার ইচ্ছে করছে না। আমি গেলাম।
সেহেরিশ যেতে নিলেই আফীফের মা সেঁজুতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফীফ চোখ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলেন।সেহেরিশের অর্ধ খাওয়া থালাটার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আফীফের।
তুন্দ্র এবং কেইন রাতে একসাথে আড্ডা দিতে বাড়ির স্টাডি রুমটি খুজে নেয়।সেখানে বসে কিছু দলিল দেখছিল আফীফ তাদের দেখে রুমের ভেতরে আসতে ইশারা করে,
– তুন্দ্র কেইন আপনারা ভেতরেই আসতে পারেন।
– থ্যাংস ব্রো।আপনার স্টাডি রুমের বইয়ের কালেশন তো প্রচুর।
– জি, আপনারা চাইলে নিয়ে পড়তে পারেন।
– অবশ্যই আমি যতদিন এখানে থাকবো অর্ধেক বই শেষ করার প্লানিং নিয়েই থাকবো।
তুন্দ্রের কথায় মৃদ্যু হাসে আফীফ।তুন্দ্র চেয়ার থেকে উঠে প্রতিটি আলমারিতে বইয়ের কালেকশন দেখতে থাকে।এদিকে কেইন তুন্দ্রের ক্যামেরায় সেহেরিশের ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছে।হঠাৎ একটি ছবিতে চোখে আটকে যায় কেইনের তুন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলে,
– হেই তুন্দ্র গায়ে ফুল পড়া ছবিটায় সেহেরিশকে পুরো প্রিন্সেস লাগছে।
– আমি আগেই বলেছিলাম এই ছবিটা বেস্ট ছিল।
– হাহ!
কেইনের কথায় আড় চোখে তাকায় আফীফ।স্বাভাবিক ভাবে সেহেরিশের বন্ধু হিসেবে কেইনকে সম্মোহন করলেও এই মূহুর্তে তাদের সর্ম্পকটা বড্ড জটিল লাগছে আফীফের কাছে।তাই কেইনের মনের ভাব জানার জন্য আফীফ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেইনকে প্রশ্ন করে,
– আপনারা কি শুধু তিন জন ফ্রেন্ড?
– নো,আমরা চারজন।জুহি আসতে পারেনি তার বাবা অসুস্থ।তাই আমরা নিজেরাই চলে এলাম।
– ওহ!আপনার ফ্রেন্ড সেহেরিশ কেমন যেন অদ্ভুত! আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছি।
– না সে ঠিকি ছিল তবে বিডিতে যেদিন আসার সিধান্ত হয় সেদিন থেকে সে অন্যরকম বিহেব করছে।যানি না কেন।
কেইনের আফসোস ভঙ্গির কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।আফীফের দিকে সহসা দৃষ্টি রেখে কেইন ফিসফিস করে বলে,
– হেই ব্রো ইউ আর লুকিং সো কিউট।গার্লফ্রেন্ড আছে তোমার?
– নো!
– পছন্দের কেউ?
-ইয়েস!
– ওয়াও কে সেই লাকি গার্ল?
– অন্যদিন বলবো।তোমার কেউ আছে নাকি কেইন?
– ইয়েস।মাই ক্রাশ,মাই হার্ট,মাই অনলি ওয়ান ফেইরি সেহেরিশ।
সেহেরিশের নামটা শুনতেই আফীফের মুখের রং পাল্টে যায়।হাতে থাকা দলিল গুলো ফাইলে গুছিয়ে রেখে কেইনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটা শুরু করে।এই রাতে কি হবে কে জানে?
শব্দহীন পায়ে দোতলার ডানের সেহেরিশের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞাতে এক ব্যক্তি।গায়ে থাকা হুড়ির জ্যাকেটির পকেট থেকে হাত মোজা নিয়ে দ্রুত দুই হাতে পরে নেয়।দরজার নব ঘুরাতেই সহসা দরজাটি খুলে যায়।ঘোর অন্ধকার মিশ্রিত রুমটার দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে লোকটি।
#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here