লাভ গেম -Part 5

0
372

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৫.
রুশা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। চোখের সামনে বারবার সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। ভয়ে রুশা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গেছে। জগ থেকে পানি ঢেলে এক গ্লাস পানি এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে শেষ করে ফেলল। থরথর করে হাত কাঁপছে। ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে ঝনঝন শব্দ মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। রুশা আবারও ভয় পেয়ে গেল। শরীরের কাঁপুনি বেড়ে গেল। মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠল। পায়ের বুড়ো আঙুল জ্বলছে। রুশা হঠাৎ পায়ের দিকে তাকাল। বুড়ো আঙুলের নক উঠে গেছে। কোনায় কিছুটা কেটেও গেছে। ঘন গাঢ় রক্ত গলগল করে বের হচ্ছে। দরজার সামনে থেকে যে পর্যন্ত পা ফেলে হেঁটেছে সেখানেই রক্তের দাগ। রুশার মাথাটা ঘুরে গেল। গেস্ট হাউজে পড়ে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে কিন্তু বিষয়টা রুশা খেয়াল করেনি। মেঝেতে বসে আঙুল চেপে ধরল।
আদ্রিশ ঠাস করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। রক্তবর্ণ মুখটা দেখে রুশার হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে লাফাতে লাফাতে হৃদপিণ্ডটা বাইরে বের হয়ে আসবে। রুশা উঠে দাঁড়াল। আদ্রিশ ওর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুশার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিছুক্ষণ আগেই এই মানুষটা একটা মানুষকে নির্মম ভাবে আঘাত করছিল। আর সেটা রুশা দেখে ফেলেছে। আদ্রিশ সেটা জেনেও গেছে। এখন ওর হাত থেকে নিজেকে কি করে বাঁচাবে? আদ্রিশ হুট করেই ওর ডান বাহু চেপে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল,
“ওখানে তুই ছিলি তাই না? কেন গিয়েছিলি?”
রুশার শরীরের কাঁপুনি বেড়ে চলেছে। ঠোঁট নাড়াচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। গলায় এসে সব আঁটকে যাচ্ছে। অক্সিজেনহীনতায় ভুগছে। শ্বাস নিতে পারছে না। শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। ঝাপসা চোখে একবার আদ্রিশের দিকে চেয়ে ঢলে পড়ল।
আদ্রিশ ওকে দু’হাতে ধরে কপালে বিরক্তি ফুটিয়ে বিরবির করে বলল,
“ডিজগাস্টিং!”
ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ওর পায়ের দিকে নজর গেল। বুড়ো আঙুল পুরোটাই রক্তাক্ত।
****
রুশার জ্ঞান ফেরার পরে পিটপিট করে তাকাল। সাদা পোশাক পরা একজন মহিলা ডাক্তার ওকে দেখছে। ওর জ্ঞান ফিরতে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আপনি একদম ঠিক আছেন। ভয় পাবেন না।”
ডাক্তার বাইরে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আদ্রিশ ঘরে ঢুকল। ওর চেহারার অবস্থা একই রকম আছে। এখন নিশ্চয়ই আবার ওকে চেপে ধরে প্রশ্ন করবে। মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষণ পর যদি জ্ঞান ফিরত? অথবা দুইদিন পর। তাহলে ওর হাত থেকে কিছু সময়ের জন্য নিরাপদ থাকতো।
রুশা শুয়ে ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশ ওর হাত ধরে টেনে শোয়া থেকে তুলে চেঁচিয়ে বলল,
“কি দেখেছিস তুই?”
রুশা কাঁপা কাঁপা গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আমি কিছু দেখিনি।”
আদ্রিশ ওর কথা শুনে বাঁকা হেসে বলল,
“রাইট! তুই কিছুই দেখিস নি। ওকে?”
রুশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল।
আদ্রিশ শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কেন গিয়েছিলি?”
“মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলাম।”
আদ্রিশ ওর গাল চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“মর্নিং ওয়াক! মিথ্যা বলবি না। তাহলে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। কেন গিয়েছিলি ওখানে?”
“আমি সত্যি বলছি। মর্নিং ওয়ার্কে গিয়েছিলাম।”
“উহু! তুই আমাকে ফলো করছিলি। কেন ফলো করছিলি?”
রুশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সত্যি বলছি আমি মর্নিং ওয়ার্কে গিয়েছিলাম। গার্ডেনের গেস্ট হাউজটা দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ ভেতর থেকে শব্দ আসে তাই কৌতূহল বশত ভেতরে গিয়েছিলাম। আপনাকে ফলো কেন করব? সত্যি বলছি।”
আদ্রিশ ওর গাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো না। অতিরিক্ত কৌতূহল মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তাই সাবধান। বউ বউয়ের মতো বাড়িতে থাকবি। এখানে সেখানে কৌতূহল দেখাবি না।”
আদ্রিশ ওয়াশরুমে চলে গেল। রুশা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। আঙুলে ভর দিতে পারছে না। আদ্রিশ অফিসের জন্য তৈরি হয়ে রুশাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে দেখে বলল,
“অতিরিক্ত কৌতূহল এভাবেই বিপদ ডেকে আনে। দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নেও। ফার্স্ট!”
রুশা দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে আদ্রিশ সামনে নাস্তা রেখে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
“এদিকে এসো তাড়াতাড়ি।”
রুশা ওর পাশে এসে ভয়ে ভয়ে বসল। আদ্রিশ খাওয়া শুরু করলেও রুশা চুপচাপ বসে আছে। আড়চোখে বারবার আদ্রিশকে দেখছে। আদ্রিশ খেতে খেতে ধমক দিয়ে বলল,
“খেতে বসেছো, আমাকে দেখতে নয়। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। কোনো কাজে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা আমার পছন্দ না।”
রুশা চুপচাপ খেয়ে নিল। আদ্রিশ অফিসে যাওয়ার সময় বলে গেল দরকারী সব কিছু ওর রুমেই চলে আসবে। ও যেন এই পা নিয়ে নিচে না যায়।
**
আদ্রিশ যেতেই রুশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ও যতক্ষণ সামনে থাকে রুহু যেন গলার সামনে এসে আঁটকে থাকে। এখন রুশা প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। দু’হাত মেলে চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলছে,
“আপাতত এই ঘরের সম্রাজ্ঞী আমি। প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে সঞ্চয় করে রাখি।”
রুশার মনে হচ্ছে আদ্রিশ মানসিক রোগী। কারণ কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে একটা মানুষকে মারতে পারে না। কোনো ক্রিমিনালও এতটা ভয়ানক হয় না। এমন নয়তো আদ্রিশের বড় কোনো সিন্ডিকেট আছে। ওরা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকে আর ভদ্রতার মুখোশ পরে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে ঘুরে বেড়ায়? আদ্রিশ কি তাই? কোনো মাফিয়া নয়ত? রুশার মাথায় আরেকটা প্রশ্ন এলো যদি মাথায় সমস্যা থাকে তাহলে এত বড় কোম্পানি কি করে চালায়? বড় বড় মানুষদের সাথে চলাফেরা করে কি করে? এর উত্তর তো এখানেই পাওয়া যাবে। যদি মানসিক সমস্যা থাকে তবে মেডিক্যাল রিপোর্ট পাওয়া যাবে। রুশা ঘরের কোনা কোনা ঘাটলো। কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। আঙুলটা ব্যথা করছে। রুশার মনে পড়ল ও এখনো মেডিসিন নেয় নি নিতে ইচ্ছে করছে না। রুশা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। অস্থির লাগছে এমন একটা মানুষের সাথে কি করে থাকবে? এত বড় বাড়ি, গাড়ি, আরাম-আয়েশই কি সব? আদ্রিশ অন্তত কখনো স্বামী হয়ে উঠতে পারবে না। দেখা যাবে ওকেই কোনো দিন মেরে ফেলল। রুশার গেস্ট হাউজের দিকে চোখ যায়। লোকটা কি মরে গেছে? নাকি বেঁচে আছে। একবার গিয়ে দেখবে? মানবতার খাতিরে একবার গিয়ে দেখা উচিত। রুশা যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেল। আদ্রিশের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। আদ্রিশ এইবার জানতে পারলে ওর রক্ষে নাই। তাই না যাওয়াই ভালো।
****
আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরে এসে রুশাকে ঘরে পায়নি। তাই রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওকে ডাকছে।
রুশা ওর চিৎকার শুনে সিড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে আসে। ঘরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“জি।”
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
“একটু নিচে গিয়েছিলাম।”
“নিচে! সকালে তো ঘরেই হাঁটতে পারছিলে না। আর এখন এতগুলো সিড়ি বেয়ে উপর নিচ করছো কি করে? একটা মেডিসিনও তো নেও নি। তোমাকে তো এতটা শক্তও মনে হয় না।”
আদ্রিশ সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।
“আমি মেডিসিন খেতে পারি না। আর সারাদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই একটু নিচে গিয়েছিলাম। মাত্রই গিয়েছি। বিশ্বাস না হলে চাচাকে জিজ্ঞেস করুন।”
“আমি কি করব না করব আমি বুঝব। তোমার কাছ থেকে এডভাইজ চাইনি। আর হ্যাঁ গেস্ট হাউজের ঘটনা ভুলে যাও। এসবে অভ্যাস করে নেও। আমার জন্য স্যুট, টাই বের করে রাখো। বাইরে যাব।”
রুশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মাত্রই তো বাইরে থেকে ফিরলেন। এখন আবার কোথায় যাবেন?”
আদ্রিশ ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। রুশা থতমত খেয়ে বলল,
“বের করে দিচ্ছি।”
আদ্রিশ রুশাকে দিয়ে টাই বাঁধালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে ব্রাশ করছে। রুশার মোবাইল বেজে উঠল। আদ্রিশ চোখের কোনা দিয়ে ওর মোবাইলের স্কিনে তাকাল। এনজিও লেখা।
“এনজিও? কোন এনজিও থেকে কে কল করেছে?”
“একচুয়েলি আশ্রমের অফিসিয়াল নাম্বার আমি এনজিও লিখে সেভ করে রেখেছি। বিশ্বাস না হলে কথা বলে দেখুন।”
“আমি অবিশ্বাস করলাম কখন?”
“না, মানে আপনার মুখ সেটাই বলছিল।”
“শাট আপ! পিক আপ দ্যা কল এন্ড গেট আউট ফ্রম হেয়ার।”
রুশা কল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেল। দুমিনিট পরে ফিরে এসে আর আদ্রিশকে দেখতে পেল না।
***
অন্ধকার রাত। রাতের আকাশে দুই একটা তারার দেখা মিললেও আলো নেই। ঘন কালো অন্ধকার পৃথিবীটাকে ছেয়ে আছে। অন্ধকারবাসীর জন্য এটাই সুবর্ণ সুযোগ। আদ্রিশ গোপন বৈঠক করছে মি.যোশেফের সাথে। হুডি পরা একটা লোক ওদের ফলো করছে। হাতের মোবাইলটা দিয়ে ওদের একটা ছবি খুব গোপনে তুলে নিল। তারপর দ্রুত লুকিয়ে ফেলল। হুডি পরা লোকটাকে সেজান দেখে ফেলল। দেখেও না দেখার ভান করে আড়চোখে ওকে ফলো করছে। খুব সাবধানে প্যান্টে গোজা রিভলবার বের করে ওর দিকে তাক করতেই হুডি পরা লোকটা পালটা গুলি চালাল। ও আগেই প্রস্তুত ছিল। আদ্রিশ গুলির শব্দ শুনে রিভলবার নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বের হয়ে এলো। হুডি পরা লোকটার সাথে আদ্রিশের লোকদের মধ্যে গোলাগুলি হলো। হুডি পরা লোকটা একা ওদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে কোনো প্রকার জখম না হয়েই পালিয়ে গেল।
আদ্রিশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কে ও? আর কি করে এখানে এলো? এড্রেস কোথায় পেল? কি করে জানতে পারল এই গোপন মিটিংয়ের কথা?”
সেজান এদিক সেদিক দেখে বলল,
“ভাই, কেউ মনে হয় আমাদের ফলো করছে। হুডি পরা লোকটা বড্ড শিয়ান। মানতেই হচ্ছে খুব এক্সপার্ট। একা এতগুলো মানুষের সাথে মোকাবিলা করে জান নিয়ে চলে গেল। তার থেকে বড় কথা আমি ওকে দেখে সাথে সাথে গোলাগুলি করিনি। হঠাৎ আক্রমণ করি যাতে
নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। কিন্তু ও তো আমার আগেই প্রস্তুত ছিল। ডেঞ্জারাস!”
আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“অবশ্যই ডেঞ্জারাস তবে আদ্রিশের থেকে বেশি নয়। ওকে তো খুঁজে বের করবই। তারপর দেখব কত ক্ষমতা।”
***
রাতে বাড়িতে ফিরে আদ্রিশ রুশাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। ওকে ঘুমাতে দেখে ক্ষেপে গেল। ওর হাত ধরে টেনে শোয়া থেকে তুলে ফেলল। রুশা কিছু বুঝতে পারছে না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্রেইন কাজ করতে ভুলে গেল। ওর শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠায় মাথা কাজ করছে না। আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলল,
“আমি এখনো বাসায় আসিনি আর তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছো? আমি তোমাকে বিয়ে করে এনেছি কিসের জন্য? শুয়ে বসে আয়েশ করার জন্য? আ’ম ইউর হাসব্যান্ড। আমার প্রতি তোমার অনেক দায়িত্ব কর্তব্য আছে। সেগুলো পালন করো।”
“সরি, হঠাৎ চোখ লেগে গেছে।”
“তাড়াতাড়ি গিয়ে টেবিলে খাবার দেও।”
টাই টেনে খুলতে খুলতে বলল। ওর মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। আজকের মিশন ফেইল। ওর মিটিং সম্পর্কে ওর গুপ্ত শত্রুরা জেনে গেছে। আর ও জানে না সে কে।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here