প্রেম এসেছিলো নীরবে -Part 3+4

0
510

#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে
(3+4)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঝালমুরি খাচ্ছে হিয়া আর ওর বেষ্টফ্রেন্ড ইশি।মূলত তারা অপেক্ষা করছে হেমন্ত’র জন্যে।রায়হানা বেগম মেয়েকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে হেমন্ত আসবে আজ তাকে নিতে আর তার জন্যে না-কি বাড়িতে কি এক সার্প্রাইজও আছে।এই কথা শুনে হিয়া পারেনা উড়ে উড়ে বাড়িতে চলে যেতে।ঝালমুরি শেষ হতেই হিয়া মুখ থে ‘চ’ এর মতো শব্দ করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করলো তারপর বলে,
-” এই হেমন্ত ভাইয়ার আসতে এতোক্ষন লাগে?বাল ভাল্লাগে না।”
হিয়ার কথায় ইশি নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে আস্তে করে বলে,
-” এতো হাইপার হচ্ছিস কেন?ধৈর্য ধরা শিখ।”
হিয়া ইশির কথায় যেন আরো বিরক্ত হলো।সে জানেনা এই মেয়েটা এতো শান্ত আর ভদ্র কেন?মানে এতোটা?এই মেয়ে কারো দিকে ঠিকভাবে চোখ তুলে পর্যন্ত কথা বলতে পারে না।কি একটা অবস্থা।ইশি তো ওকেও তুমি করে বলতো।হিয়ার কতো যে কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে ওকে তুই ডাকার জন্যে।সেই ৩য় বিশ্বযুদ্ধ সে কিভাবে জয় করেছে সেটা শুধু সে নিজেই জানে।হিয়ার ভাবনার মাজেই একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে।হিয়া জানে এটা ওদেরই গাড়ি।কিছুক্ষন পর গাড়ি থেকে নেমে আসলো হেমন্ত।এগিয়ে গেলো হিয়াদের দিকে।ইশি আঁড়চোখে একবার তাকালো হেমন্ত’র দিকে।যেটা হেমন্ত’র নজর এড়ালো না।মেয়েটার এটুন নজরেও যেন হেমন্ত’র নিশ্বাস আটকে যায়।চশমায় আবৃত চোখের চাহনীতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে যখন চশমাবিহীন চোখ দ্বারা তো হেমন্তকে মেরেই ফেলবে এই মেয়ে।গত ১ সপ্তাহ যাবত মেয়েটাকে ঠিকভাবে দেখতে পারিনি হেমন্ত।কারন সে তো ব্যস্ত ছিলো প্রাহিকে খোজার জন্যে।আজ মন ভরে দেখে নিক।হেমন্ত যখন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ হিয়ার প্রকট চিৎকারে তার মস্তিষ্কের নার্ভগুলো ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।হেমন্ত হতভম্ব হয়ে তাকায় হিয়ার দিকে।তারপর ইশি দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটাও ভয়ে চোখ মুখ খিচে রেখেছে।হেমন্ত এইবার চোখ গরম করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” হোয়াদ দ্যা হেল হিয়া।এইভাবে চিৎকার করলি কেন?”
হিয়াও রাগি গলায় বলে,
-” গত আধা ঘন্টা যাবত এই রোদে দাঁড়িয়ে তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।তুই আসলি লেট করে।আর এসে গাড়ি থেকে নেমেই ইশির দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলি।তোকে কতো করে ডাকলাম।তোর তো খেয়ালই নেই তাই তো চিৎকার দিলাম।”
হেমন্ত থতমত খেয়ে যায়।বজ্জাত মেয়েটা ইশির সামনে তার মান ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিলো।এইদিকে ইশি এই কথা শুনে লজ্জায় আর একবারও চোখ তুলে তাকালো না।হেমন্ত আর কথা বাড়ালো না।জানে এই মেয়েটা আবারও ওর মান ইজ্জত নিয়ে হামলে পড়বে।একে তো বাড়ি গিয়ে সাইজ করতে হবে।তাই শান্ত ভাবে নিজের রাগ দমন করে বলে,
-” জলদি গাড়িতে উঠ।”
হিয়া ইশির হাত ধরে হনহন করে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।হেমন্তও গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে।মাজ রাস্তায় ইশির বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ওকে ওর বাড়ি অব্দি পৌছে দিয়ে তারা নিজেরাও বাড়ি চলে আসে।গাড়ি থেকে নেমেই হিয়া হেমন্তকে বলে,
-” ভাই ভালো যেহেতু বাসিস।তাহলে বলে দিস না কেন?”
হেমন্ত মাথা চুলকে হালকা হেসে বলে,
-” তোর বান্ধবি যেই ভীতু প্রোপোজ করলে দেখা যাবে আর আমার সামনেই আসবে না।তাই ঠিক করেছি তোদের পরিক্ষার পরই ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।”
হিয়া খুশিতে চিৎকার করে উঠলো।ইসস, তার বেষ্টফ্রেন্ড তার ভাবি হবে ভাবতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।হঠাৎ চুলে টান পরায় ‘ ও মাগো! ‘ বলে চিৎকার করে উঠে হিয়া।হেমন্ত দাত কেলিয়ে হেসে বললো,
-” ইশির সামনে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানানোর জন্যে এটা তোর শাস্তি।”
হিয়া ‘ ভাইয়া!’ বলে দৌড় লাগায় হেমন্তের পিছু পিছু।সারা ড্রয়িংরুম জুড়ে দু ভাই বোন ছোটাছুটি করছে।রান্না ঘর থেকে রায়হানা বেগম আর হেনা দুজনই বের হয়ে আসলেন।প্রাহিরও এমন চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তাই সেও রুম থেকে বের হয়ে সিড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।ভাই বোনের এতো সুন্দর খুনশুটিময় দৃশ্য দেখে ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। প্রাহি ভালোভাবে হেমন্ত’র পিছু ছুটন্ত মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।নিজের মস্তিষ্কে ভালোভাবে চাপ সৃষ্টি করে মেয়েটি কে মনে করার জন্যে।মনে পরতেই লাফিয়ে উঠে এটা তো ওর হিয়া আপু।ইসস,আপুটা কতো বড় হয়ে গিয়েছে আর কতো মিষ্টি দেখতে।আর কি সুন্দর।প্রাহির আনন্দ যেন আর ধরছে না।দীর্ঘ অনেক বছর পর বুজি সে একটু সুখের সন্ধান পেলো।জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে সে।তবে কি আজ থেকেই ওর সুখের অধ্যায় শুরু?কি জানি? জানে না প্রাহি এসব।শুধু সুবহানাল্লাহ তায়লার কাছে একটাই প্রার্থনা ওর আল্লাহ্ যাই করুক না কেন তা যেন সবার জন্যে ভালোই হয়।
রায়হানা বেগম আর হেনা ছেলেমেয়েদের এমন বাচ্চামো দেখে বেশ বিরক্ত হলেন।এরা দিন দিন বড় হচ্ছে নাকি ছোট হচ্ছে সেটাই বুজেন না উনারা।দুটো সারাদিন ঝগরা করতেই থাকে।অর্থ এই এক সপ্তাহ যাবত বাড়িতে না থাকায় তাদের দুষ্টুমি যেন আরো বেড়ে গেছে।হেনা হালকা আওয়াজে ধমকে উঠলেন হেমন্তকে,
-” হেমন্ত! এইসব কি হচ্ছে?তুই হিয়াকে আবার কি করেছিস?”
হেমন্ত ছুটতে ছুটতেই চেচিয়ে বললো,
-” আমি কিছু করিনি মা।এই শাকচুন্নি শুধু শুধু আমার সাথে লাগছে।”
হিয়া কাধের ব্যাগটা হেমন্ত উদ্দেশ্য ছুড়ে মারলো তা গিয়ে লাগলো হেমন্ত’র পিঠে।হেমন্ত ব্যাথা পেয়ে থেমে গেলো।রাগি চোখের হিয়া দিকে তাকাতেই হিয়া বলে,
-” ছোটমা তোমার ছেলে আমার চুল ধরে টান মেরেছে।”
তারপর আবার হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এখন কি কারনে টান মেরেছিস সেটা বলে দেই।”
হেমন্ত চোখ বড় বড় করে তাকালো।এই মেয়ে যা বিচ্ছু বলেও দিতে পারে।হেমন্ত তড়িঘড়ি করে বোনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” আমার বোনটাকে আর মারবো না।তার জন্যে আমি এখনি হুডা বিউটির শ্যাডোবক্স ওর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।”
হিয়া খুশি হয়ে একঝটকায় হেমন্ত দিকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-” সত্যি ভাইয়া।”
-” হ্যা!”
-” আচ্ছা! যা তোকে মাফ করে দিলাম।”
রায়হানা বেগম আর হেনা চলে গেলেন রান্না ঘরে।এটা নতুন কিছু না এই দুটো ছোট বেলাও এমন করতো।আর হেমন্ত বিদেশ থেকে আসার পরেও এমনি করছে।হেমন্ত হিয়াকে মানিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সোফায় বসলো।হিয়াও খুশি মনে উপরে সিড়ি দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্যে উদ্যুক্ত হতেই সিড়ির উপরে একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো।এই মেয়েটা কে?ওকে তো আগে কখনো দেখিনি।হিয়া আবারও পিছনে ফিরে হেমন্ত’র দিকে তাকালো।তারপর বলে,
-” হেমন্ত ভাইয়া! ”
হেমন্ত চোখ বুজে ছিলো।হিয়ার ডাকে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো।হিয়া এইবার হাত দিয়ে প্রাহিকে ইশারা করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” এটা কে ভাইয়া!”
হেমন্ত হাসলো।তারপর ছোট্ট করে বললো,
-” এটা প্রাহি।আমাদের ছোট্ট প্রাহি।”
হিয়া কথাটা শুনে মুখে হাত দিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেলো।ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা প্রাহি।ওর চোখ ভরে উঠলো।হেমন্ত’র দিকে করুন চোখে তাকাতেই হেমন্ত চোখের ইশারায় বুজায় হ্যা এটা সত্যি প্রাহি।হিয়া আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে দৌড়ে গিয়ে ঝাপ্টে ধরে প্রাহিকে।তারপর ভেজা কন্ঠে বললো,
-” তুই প্রাহি?আমার ছোট্ট প্রাহি।”
প্রাহির চোখের বাধও ভেঙে গেলো।প্রাহি বলে,
-” হ্যা হিয়া আপু আমি প্রাহি।”
হিয়া প্রাহিকে ছেড়ে ওর গালে হাত ছুইয়ে বলে,
-” কেমন আছিস তুই?এতোটা বছর কোথায় ছিলি?”
প্রাহি নিজের জলটুকু মুছে আস্তে ধীরে সংক্ষেপে হিয়াকে সবটা বললো।প্রাহি সব শুনে ঘৃনায় জর্জরিত হয়ে বলে,
-” ছিঃ এতোটা খারাপ কেউ কি করে হতে পারে।”
প্রাহি মাথা নিচু করে আছে।হিয়া একসাইড দিয়ে প্রাহিকে আবারও জড়িয়ে ধরে বলে,
-” টেন্সন করিস না।তোকে আর কেউ কষ্ট দিতে পারবে না।তুই আজ থেকে সুখে থাকবি আমাদের সাথে।”
প্রাহি মাথা নাড়ালো।দুবোন ভুলেই গেলো তারা কোথায় আছে এইখানেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো।
হেমন্ত এতোক্ষন ওদেরকেই দেখছিলো।হঠাৎ ওর ফোনে কল আসায় ফোন বের করে দেখে অর্থ কল করেছে।হেমন্ত হাসিমুখে কল রিসিভ করলো,
-” আসসালামু আলাইকুম ভাই।”
অর্থ গম্ভীর কন্ঠেই বলে,
-” ওয়া আলাইকুমুস সালাম! হেমন্ত ল্যাপটপ চালু কর ভিডিও কল দিবো।”
-” আচ্ছা ভাই!”
অর্থ কল কেটে দিতেই হেমন্ত ল্যাপটপ ওন করে ওয়াইফাই কানেক্টেড করতেই সাথে সাথে অর্থের ভিডিও কল আসলো।
সাদা রঙের শার্টের সাথে এ্যাশ রঙের স্যুট পরা,চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে, হালকা নীল,কালোর সংমিশ্রের চোখের মনিগুলো ফর্সা মুখশ্রীতে বেশ মানিয়েছে।চেহারাটায় একটা দাম্ভীকর্যতা বিদ্যমান।লাল কালচে বর্নের ঠোঁটজোড়া ক্ষনেক্ষনে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।হেমন্ত হাসিমুখেই অর্থকে বলে,
-” কেমন আছো ভাই?আর কবে আসবে?”
অর্থ ঠান্ডা স্বরে জবাব দেয়,
-” আজই আসছি। অফিসের একটা মিটিং শেষ করেই দু ঘন্টা পর রওনা হবো।”
হেমন্ত চোখ কপালে তুলে বলে,
-” কি?কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে?তুমি না পাক্কা পনেরোদিনের সময় নিয়ে গেছিলে?আর যেই কাজ তা পনেরোদিনে শেষ হবে কিনা তাও সন্দেহ ছিলো।”
অর্থ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
-” অর্থ কখনো তার সময়টা নষ্ট করতে পছন্দ করে না। আমি আমার কাছে কোন গাফিলতি করেনা।সো আমার এতোদিন সময় লাগার কথাও না।”
হেমন্ত আর কিছুই বললো না।সে জানে তার ভাই কতোটা কাজ পাগল।অর্থ আবার কিছু বলতে নিবে হঠাৎ হেমন্তের পিছে সিড়ির উপরে দুজন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে এলো ওর।একটা হিয়া সেটা বোজা যাচ্ছে।তবে আরেকজন মেয়ে কে?
অর্থ তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালো সাদা জামা পরিহিত,এলোমেলো চুলে চুল,হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে,মুখশ্রীটা অর্থ ভালোভাবে বুজতে পারছে না।মেয়েটাকে দেখে বুকের বা’পাশটায় হঠাৎ কেমন যেন একটা চাপ সৃষ্টি হলো।অর্থ বুজলো না কেন হঠাৎ এমনটা হওয়ার মানে কি?অর্থ চাইলো চোখ সরিয়ে নিতে কিন্তু পারছে না।অবশেষে জোড়পূর্বক দৃষ্টি সড়িয়ে হেমন্তের সাথে কথায় মনোযোগ দিলো।তাও বার বার নজর মেয়েটার দিকেই চলে যাচ্ছে।অর্থ আর না পেরে নিজের ওপরেই নিজে বিরক্ত হয়ে গেলো।তাই হেমন্ত বলে কল কেটে দিলো।তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।কিছুই ভালোলাগছে না।বিরক্ত হয়ে অর্থ চলে গেলো মিটিংরুমে।তাকে এখন এই লাস্ট মিটিংটা ভালোভাবে শেষ করে দেশের জন্যে রওনা হতে হবে।
#চলবে,,,
কেমন হয়েছে জানাবেন। একটু ভালোভালো মন্তব্য করিয়েন আপনারা।সব শেষে ভালোবাসা সবার জন্যে।
#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(৪)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই।হেমন্ত, হিয়া আর প্রাহি।তারা ওদের ছোটবেলার ছবি দেখবে।হিয়া এইবার ছবির এ্যালবামটা খুললো।সবার আগে আসলো অর্থ কারন সে হলো সবার বড়।ছবিটা দেখেই ওরা হেসে দিলো।অর্থ পুরো উদম হয়ে আছে আর ওর মুখে সুজি ভরা সে কান্না করছে। প্রাহি ছবিটার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো।বাচ্চাটা কে সে জানে না।তবে তার খুব হাসি পেয়েছে।প্রাহি জিজ্ঞেস করলো,
-” এটা কে হিয়া আপু?”
হিয়া হাসতে হাসতেই বলে,
-” আরে এটা অর্থ ভাইয়া।তুই ভুলে গেছিস।ওহ সরি তুই তো আর অর্থ ভাইয়াকে তো তুই আর চিনিস না।”
হেমন্ত বললো,
-” এটা ভাইয়ার যখন দেড় বছর বয়স তখনকার ছবি।ভাইয়া খেতে খেতেই হিসু করে দিছিলো।আর বড়মা উনাকে ন্যাংটু করে দিয়ে আবারও খাওয়াতে চাইছিলো।কিন্তু ভাইয়া ন্যাংটু হয়ে কিছুতেই খাবে না।তাই তো সুজি দিয়ে একেবারে মুখ ভরিয়ে ফেলেছে।”
প্রাহি খিলখিল করে হেসে দিলো।হেমন্ত আর হিয়া প্রাহির হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো।ইসস,মেয়েটা মনে হয় অনেক দিন পর এইভাবে হাসছে।প্রানটা জুড়িয়ে গেলো ওদের।প্রাহি হাসি থামিয়ে আবারও নানান ছবি দেখতে লাগলো।অর্থ’কে ও কখনোই দেখেনি।প্রাহি এইবার জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
-” অর্থ ভাইয়াকে কি আমি কখনই ছোট বেলায় দেখিনি?”
হেমন্ত আস্তে করে বলে,
-” নাহ দেখিস নি।ভাইয়ার যখন জন্ম হওয়ার এক বছর আগেই বড়মা আর বড়বাবা ভাইয়াকে তার মামা, মামির কাছে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়।ভাইয়ার মেধা অনেক ভালো ছিলো তাই। তোর জন্মের পর একবার এসেছিলো দুমাসের ছুটিতে। তখন তোর দু’বছর বয়স ছিলো।তাই তোর কিছুই মনে নেই।”
হিয়া বলে উঠে,
-” ভাইয়া ছোট থেকেই অনেক গম্ভীর একজন মানুষ।আর যেই পরিমান রাগ ভাইয়ার। যখন রাগ উঠে বাড়ির কারো সাধ্য নেই তার রাগ কমানোর।আমরা ভয়ে কেউ যাইনা তার কাছে তখন।এখনো ঠিক সেইরকমি আছে।একটুও বদলায়নি।তবে আমাদের সবাইকে অনেক ভালোওবাসে।”
প্রাহি ছোট্ট করে ঢোক গিললো লোকটার কথা শুনেই কেন যেন ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।না জানি লোকটাকে দেখে ও হার্ট এট্যাক না করে বসে।
….
গাড়িতে বসে আছে অর্থ একটু আগেই সে বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছে।হেমন্ত আসতে চেয়েছিলো ওকে পিক-আপ করতে কিন্তু অর্থ মানা করে দেয়।শুধু বলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে।আজকে অর্থের কাছে কেমন যেন লাগছে।হেমন্ত’র সাথে কথা খাওয়ার পর থেকেই ওর বুকের ভীতরটা অস্থিরতা ছেয়ে আছে।কেন এমন লাগছে কিছুই বুজতে পারছে না অর্থ।গাড়ির হর্ণে ধ্যান ভাঙে।বাড়ি এসে পড়েছে।বাড়ির গেট খোলা হচ্ছে।পার্কিং লটে গাড়ি থামতেই বের হয়ে আসে অর্থ।ড্রাইভারকে লাগেজ নিয়ে আসতে বলে ও এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।ঘড়ির দিকে তাকায় অর্থ রাত এগারোটা বাজে।তার বাড়ির মানুষ আবার এতো তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না।তাদের ঘুমোতে ঘুমোতে ১২ টা বাজে।তাই নির্দিধায় কলিংবেল বাজালো।

-” আমি আর অর্থ ভাইয়া দু বছরের ছোট বড়। হিয়া আমার থেকে আট বছরের ছোট আর অর্থ ভাইয়া থেকে দশ বছরের।”
হেমন্তের কথায় প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সবাই ওর থেকে কতো বড় আর ও কি না ১৬ বছরের একটা পুচকি মেয়ে।লোকে ওকে তাহলে ঠিকই করে বাচ্চা বলে।প্রাহি বললো,
-” তোমার বয়স কতো ভাইয়া?”
হেমন্ত হালকা হাসলো বললো,
-” আমার ২৬ বছর বয়স।অর্থ ভাইয়ার ২৮ আর হিয়ার ১৮।”
প্রাহি মুখ গুমড়া করে বলে,
-” আমি তোমাদের সবার থেকে কতো ছোট।”
হিয়া খিলখিল করে হেসে বললো,
-” তাই তো তোকে পিচ্চি ডাকি।”
হঠাৎ বাড়ির কলিংবেলের আওয়াজে সবাই থেমে যায়।হেমন্ত হিয়াকে বললো গিয়ে দরজা খুলে দিতে।হিয়া উঠে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলেই ‘ ভাইয়া!’ বলে অর্থকে জড়িয়ে ধরে।অর্থও গম্ভীরভাবে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।হিয়া অর্থকে ছেড়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো।এতে অর্থ ভ্রু-কুচকে রাগী কন্ঠে বললো,
-” এতো রাতে এইভাবে চিৎকার করছিস কেন? আমি কি নতুন এসেছি এই বাড়িতে।”
ভাইয়ের রাগি কন্ঠে হিয়া চুপ হয়ে গেলো।অর্থ বাড়িতে প্রবেশ করতেই রায়হানা বেগম ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।কান্নারত গলায় বলে,
-” বাবা তুই এসেছিস।কতোদিন পর আমার ছেলেটাকে দেখলাম।আর তুই যে আসবি আমাকে বললি না কেন?”
অর্থ বিরক্তি নিয়ে বলে,
-” উফফ মা।আই ডোন্ট আন্ডার্স্ট্যান্ড হুয়াই ইউ ক্রায় সো মাচ ইন ওয়ার্ড্স। তুমি জানো না তোমার চোখে জল দেখতে ভালো লাগে না।আর রইলো আমি আসবো সেটা ইচ্ছে করেই জানাইনি।তবে হেমন্তকে বলে রেখেছিলাম।আমার মা’কে একটু সার্প্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
লাস্ট কথাটা বলে হালকা হেসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।সবার সাথে কুশলাদি বিনময়ে যখন ব্যস্ত অর্থ হঠাৎ ওর নজর আটকে যায় একটা মেয়ের উপর।অর্থর ভ্রু-কুচকে দেখছে মেয়েটাকে।মেয়েটার গায়ে জড়ানো বেবি পিংক কালার স্কার্টের সাথে সাদা ফতুয়া আর বেবি পিংক কালারের স্কার্ফ গলায় পেচানো,চুলগুলো পনিটেইল করে রেখেছে।মুখশ্রীটা ভালোভাবে বুজা যাচ্ছে না মাথা নিচু করে আছে বিদায়।মেয়েটার চেহারাটা দেখার জন্যে অর্থের হৃদয়টা ছটফট শুরু করলো।তাই রায়হানা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
-” মা হু ইজ সি?”
রায়হানা বেগম ছেলের প্রশ্নে একবার প্রাহির দিকে তাকালো।তারপর হালকা হেসে প্রাহির কাছে গিয়ে ওকে নিয়ে অর্থের সামনে এসে দাড়ালো।অর্থ কুচকানো ভ্রু-জোড়া আরো কুচকে এলো।রায়হানা বেগম বললেন,
-” এটা হলো প্রাহি।”
অর্থ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে।রায়হানা বেগম আবারো বললেন,
-” ও তোমার ছোটমা’র বোনের মেয়ে প্রাহি।”
অর্থ এইবার বিষ্ময় নিয়ে তাকালো অবাক হয়ে বলে,
-” হুয়াট?ডিড ইউ জাস্ট সে দ্যাট সি ইজ প্রাহি?বাট হাউ ইজ দিছ পসিবল?”
হেমন্ত এইবার এগিয়ে এসে অর্থকে সবটা খুলে বললো।এইবার অর্থ বুজতে পারলো সবটা।হিয়া প্রাহিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” প্রাহি মা ভাইয়াকে সালাম দেও।”
প্রাহি এইবার কাচুমাচু হয়ে আস্তে করে মুখটা উপরে তুললো।কাঁপা কন্ঠে বলে,
-” আস..আসসালামু আলাইকুম ভা..ভাইয়া।”
এদিকে অর্থ স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রাহি মুখটা তুলে ওর দিকে তাকাতেই মনে হলো অর্থের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।এতোটা নিষ্পাপ মুখশ্রী বুজি কারো হয়?আর এতোটা মায়া জড়ানো মুখশ্রী।কাজলটানা চোখগুলোতে অর্থের মন গেঁথে গেলো,গোলাপি ঠোঁটজোড়া হালকা কাঁপছে।ফর্সা গোলগাল চেহারাটা দেখতেই অর্থের এতোক্ষন যে অস্থিরতা ছিলো তা যেন নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো।হিয়ার কথায় অর্থ তার সম্ভিত ফিরে পায়।হিয়া বলছে,
-” ভাইয়া প্রাহি সালাম দিয়েছিলো.! ”
-” হুম!ওহ হ্যা ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
প্রাহি কাঁপতে কাঁপতে আবার জিজ্ঞেস করে,
-” কেমন আ..আছেন ভা..ভাইয়া।”
-” আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো।”
-” ভা..ভালো।”
রায়হানা বেগম এইবার অর্থকে বললো গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসতে।তিনি অর্থের খাবার তার রুমে পাঠিয়ে দিবেন।অর্থ একপলক আবার তাকালো প্রাহির দিকে।তারপর গটগট পা ফেলে চলে গেলো নিজের রুমে।আস্তে আস্তে বাকিরাও চলে গেলো ঘুমোতে কারন রাত হয়েছে।হেমন্ত প্রাহিকে নিয়ে প্রাহির ঘরে গিয়ে প্রাহিকে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে ও চলে গেলো নিজের রুমে।
প্রাহি সুয়ে সুয়ে বার বার এপাশ ওপাশ করছে।কিছুতেই ওর ঘুম আসছে না।আকস্মিক সুখের দেখা পেয়ে প্রাহি অনেকটা ভীতু হয়ে আছে।কারন ওর জীবনে সুখ বেশিদিন টিকে না।সেই ভয়ে ও চেয়েও মন থেকে হাসিখুশিভাবে থাকতে পারছে না।হারানোর ভয় ওকে সর্বদা আকড়ে ধরে রাখে।প্রাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালো।নীকষ আঁধার কালো আকাশে এক থালা চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা মেলা খুব অল্প।তবে জ্যোৎস্নার আলোতে চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে।প্রাহির চোখের কোনে জল ভরে উঠলো।প্রতিটা রাত মা,বাবা না থাকার কষ্টটা যেন ওর হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে দেয়।বোজার বয়স হতে কখনো সে একবেলা ঠিকঠাকভাবে খেতে পারেনি।সবসময় মামা,মামি আর মামাতো বোনের অত্যাচারে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছিলো ওর।বারবার মরে যেতে ইচ্ছে করতো ওর।কিন্তু চেয়েও পারতো না।কারন আত্মহত্যা মহাপাপ। ওর শরীরে যে কতোশতো আঘাতের চিহ্ন তা একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ দেখলেও ভয় পাবে।আর পারলো না প্রাহি বুকে জমে থাকা কষ্টগুলো জল আকারে গড়িয়ে পড়লো ওর মৃসন কোমল গাল বেয়ে।প্রাহি সাথে সাথে চোখের জলটুকু মুছে নিজের ঘরে চলে গেলো।এতোক্ষন সবটাই নিজের ব্যালকনি থেকে দেখছিলো অর্থ।গোসল সেরে সে ব্লাক কফি খাচ্ছিলো ব্যালকনিতে বসে।হঠাৎ প্রাহিকে পাশের ব্যালকনিতে দেখে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে ছিলো।মেয়েটার ফর্সা কোমল চেহারাটা দেখলেই অর্থের কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়।শুধু সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।প্রাহিকে যখন দেখছিলো অর্থ তখন হঠাৎ প্রাহির চোখে জল দেখে কেন যেন ওর বুকের ভীতরটাও মোচড় দিয়ে উঠেছিলো।কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে?এই মেয়েটাকে এই নিয়ে শুধু দুবার ভালোভাবে দেখলো।একবার যখন প্রাহি খুব ছোট ছিলো আর এখব আবার দেখলো।তাহলে এই মেয়ের জন্যে ওর হৃদয়ে এতো অস্থিরতা কিসের। অর্থ বিরক্ত হয়ে কফি মগটা ব্যালকনি থেকে নিচে সজোড়ে আছাড় মারলো।তারপর হনহন করে চলে গেলো নিজের ঘরে।এখন ঘুমই পারবে তাকে এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে।
#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here