#খেলাঘর_১১
আজ আসগর সাহেবের আত্নার মাগফিরাতের জন্য মিলাদ ছিলো আয়নাদের বাসায়,সন্ধ্যার আগেই আত্মীয় যারা এসেছিলো তারা চলে গেছে,আয়না ছাদের দরজার বাইরে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে একমনে, ভিজতে কেমন জানি ভয় ভয় করছে ঠান্ডা লাগছে।আগে বাবার উপর জেদ করে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজত সে এখন কার উপর রাগ করবে?আদৌ কি তার বলতে এখন কেউ আছে?এখনো পর্যন্ত আয়নাকে তার বাবার মৃত্যুর জন্যে কেউ কাদতে দেখে নি,কাছে দূরের আত্মীয়রা এই নিয়ে নানা রকম ফিসফাস করে বিদেয় হয়েছেন।তবে কায়নাত খুব কেদেছে,আয়না জানে তার ছোট বোনটা শুধু তার বাবা মারা গেছে বলে কাদে নি,অন্য কোনো অসহ্য শোকে সে কেদেছে,গতকালই তো সকাল বেলা খাবার টেবিলে কি সাবলীল ভাবে কায়নাত বলল,
—আপু আমি আর প্রহরের সাথে থাকব না,
আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়না বলল,
—না থাকলে না থাকবি ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কারো সাথে থাকা যায় না
—সবাই তোমার মত না আপু,অনেকের ইচ্ছে থাকলেও থাকা হয় না,সবার যদি ইচ্ছে মতো সব হতো তাহলে এই যে দুলাভাই এত চায় তোমাকে কই তোমার সাথে থাকতে পারছে?
বলেই কায়নাত দুম করে টেবিল ছেটে উঠে গেলো আয়না খুব স্বাভাবিকভাবে বসে নাস্তা করলো।
আবরার এতক্ষণ সারাবাড়ি খুজে আয়নাকে পেলো ছাদের দরজার সামনে,বৃষ্টির ছাট এসে আয়নাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে অথচ ওর কোনো নড়ন চড়ন নেই।আবারার আয়নার পাশে এসে দাড়ালো,
—আয়না,
—জ্বী?
—আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি
আয়না তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো,
—জানেন ডাক্তার সাহেব, মা যখন মারা যায়,সবাই খুব ভেঙে পড়েছিলো কায়নাত তো ছোট ও শুধু কাদতো বাবা একদম হতাশ হয়ে গেছিলেন,আমিও কাদতাম এই ছাদটায় এসে লুকিয়ে লুকিয়ে, তখন ওই ছাদে ঠিক ওই কোণায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন আমায় কঠিন করে ধমক দিতো, আমার কান্না থেমে যেত।তার কথার উপর আমি আর কিছু বলতে পারতাম না সে আমায় সাহস জোগাতো।আমার সব খারাপ দিনে তাকে আমার পাশে পেয়েছি সব দুর্বলতায়।আমার বাবা কিন্তু সব জানতেন,তারপর যখন সব ঠিক হয়ে গেলো আমার বাবার কাছে তখন মনে হলো ছেলেটা ভালো না,এলাকায় তার নামে নিন্দা রটে,ছেলে রাজনীতি করে, তার রাগ বেশি।কি অদ্ভুত! বাবাকে শাস্তি দিতে আমি কত কিছু যে করেছি, আপনার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছি,ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজেছি,না খেয়ে থেকেছি।অথচ আজ বাবা কোথাও নেই আবারো আমিই হেরে গেলাম বাবা জিতে গেলো।
আবরার শূন্য দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো,আয়না আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
—বৃষ্টিতে ভিজবেন?
আবারার বলতে পারলো না বৃষ্টির পানি মাথায় পড়লে তার খুব জ্বর আসে ঠান্ডা বসে যায়।তার আগেই আয়না খালি পায়ে ছাদে পা রাখলো ঝুম বৃষ্টি আয়নাকে ভিজিয়ে ফেললো,আবরার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আয়নার কাছে গেলো ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভেজায় একবার তার নিউমনিয়া হয়েছিলো তারপর আবরার আর বৃষ্টিতে ভেজার সাহস করেনি। বৃষ্টির পানিতে আয়নার গায়ের সাথে শাড়ি লেপ্টে গেছে, আবরার নিজেকে সংযত করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রেলিং ধরে দাড়ালো।আবরারের চোখ লাল হয়ে গেছে তার মাথার মধ্যে দপদপ করছে, আয়না আবরারের পাশে গিয়ে দাড়ালো,আবরার শূন্যে দৃষ্টি রেখে বলল,
—আমি যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলাম আমাদের এতিম খানায় তখন একজন লোক এসেছিলেন সব বাচ্চাদের উপহার দিলেন আমার ভালো রেজাল্টের কথা শুনে তিনি আমাকে আলাদা করে হাতে কিছু টাকা গুজে দিলেন। তিনি প্রায়ই আমাদের এতিম খানায় যেতেন আমি এইটে যখন বোর্ডের মধ্যে ফার্স্ট হলাম তিনি আমাকে ভালো স্যার রেখে দিলেন মাধ্যমিকে আমি ভালো রেজাল্ট করতে পারলাম না, একদম ভেঙে পড়লাম ভয় পেলাম এখন যদি আর সাহায্য না পাই ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারি!তখন লোকটা আমাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন তার বন্ধুর সাথে কথা বলে আমাকে শহরের সবচেয়ে দামী কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন,আমাকে স্বপ্ন দেখালেন আমি নিজের চেয়েও তার স্বপ্ন পূরণে উঠে পড়ে লাগলাম।তার সাহস, সাহায্য আমাকে আজকের ডাক্তার আবরার করে তুলেছেন,তিনি আমার জন্যে যা করেছেন তা করেছেন মানুষ আসগর আমিন হিসেবে। কিন্তু তিনি তোমার জন্যে যা করেছেন তা করেছেন বাবা হিসেবে। যে মানুষ হিসেবে এত চমৎকার তাকে বাবা হিসেবে তুমি খারাপ বলতে পারো না।তোমার সব কথা মানলেও এই কথাটা আমি কিছুতেই মানব না।
আয়না এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আবরার ফিরে তাকালো আয়নার দিকে এমন শক্ত একটা মেয়ে তার সামনে ভেঙে পড়ছে,
—আমার বাবা খারাপ নয়, আমার বাবা এই পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাবা, আমি খারাপ আমি আমার বাবাকে কষ্ট দিয়েছি,
আয়না হাউমাউ করে কাদতে লাগলো,আবার শান্ত কণ্ঠে বলল,
—ঘরে যাও আয়না ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে নাও। আমরা পরে কথা বলবো
আয়না ঘরে গেলো না, সে হুট করে আবরার কে জড়িয়ে ধরলো,আবরারের বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ হলো,আয়না অনবরত কাদতে লাগলো,অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলো না।অগ্যতা আবরার আয়নাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর রুমে দিয়ে এসে কায়নাত কে ডেকে বললো
—তোমার আপুর কাছে যাও তো তোমার আপু কাদছে,
কায়নাত চমকে উঠলো আয়না কাদছে!ও দৌড়ে আয়নার ঘরে গেলো, আয়না কায়নাত কে জড়িয়ে ধরে খুব কাদলো,কায়নাতও খানিক্ষণ কাদলো বাবার শোকে,নিজের কষ্টে, মায়ের মতো বোনকে কষ্ট পেতে দেখে তারপর নিজেকে সামলে আয়নার মাথা মুছে শাড়ি পালটে দিলো।
আবরার টলতে টলতে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।ওর খুব মাথা ব্যাথা হতে শুরু করলো আবরার বুঝলো তীব্র জ্বর ওকে কাবু করে ফেলছে অথচ উঠে গিয়ে ওষুধ খাওয়ার শক্তি ও পাচ্ছে না।
আয়না কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলো, কায়নাত আর ওর কাছেই শুয়েছিলো অনেক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও আয়নার ঘুম এলো না, কায়নাতের ঘুমন্ত মাথায় হাত বুলালো,বাইরে বৃষ্টি বাড়তেই থাকলো,আবারার বলেছে কাল চলে যাবে সে কি সত্যি চলে যাবে? আয়ন কি তাকে বলবে কি দরকার যাওয়ার থেকে যান প্লিজ?ও বিছানা ছেড়ে উঠলো,আনমনে হেটে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলো তখন দেখলো গেস্টরুমের দরজা খোলা ও ভেতরে সামান্য উকি দিতেই দেখলো আবরার ভিজে কাপড়ে বিছানায় শুয়ে আছে আয়না ভ্রু কুচকে তাকালো।কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে ভেতরে গিয়ে দেখলো আবরার কিছু একটা বিড়বিড় করছে,আয়না আবরার কে ডেকে তুললো,আবরার আধো আধো চোখে তাকিয়ে হেসে বললো,
—বসো আয়না, আমি শুয়েই থাকি উঠতে পারব না,একটা গল্প বলি কাল তো চলেই যাবো,
আয়না বুঝলো আবরার স্বাভাবিক নেই ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে আয়না ঝুকে এসে আবরারের মাথায় রেখে দেখলো তার জ্বর, শুধু জ্বর নয় আকাশ পাতাল জ্বর। আয়না ভয় পেয়ে গেলো, কি করবে বুঝে উঠলো না ও ধীরে ডেকে বলল,
—ডাক্তার সাহেব আপনার তো জ্বর কি করি বলুন তো,
—বললাম তো তুমি বসো,
আয়না বসলো না ও দৌড়ে মাথায় পানি পট্টি দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে যেতে চাইলেই আবরার হাত টেনে ওকে কাছে বসালো, আবরার জড়ানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো
—শোনো প্লিজ, শোনোই কি হয়েছিলো,আমি যে এতিমখানা তে বড় হয়েছি ওইটা আমার এক দূরসম্পর্কের চাচার, তার কাছেই শোনা আমার মা মারা যান যখন আমি জন্ম নিলাম, আমার বাবা নিজে সংসার করবেন বলে আমায় এতিম খানায় দিয়ে এলেন,বাবা থাকতেও আমি তাদের সাথে বড় হলাম যাদের বাবা নেই।আমি খুব চাইতাম জানো আমি খেতে বসবো কেউ একজন পাশে বসে থাকবে,কারো সাথে আমার সুন্দর একিটা সংসার হবে,আমার মা কে পাই নি,কোনো বোন ছিলো না,এজন্য দেখবে কায়নাতকে আমি খুব স্নেহ করি,আমার কারো সাথে প্রণয় হয় নি,পড়ালেখার জন্যে বান্ধবীদের থেকেও দূরে দূরে থাকতাম একটা সময় অবশ্য খেয়াল করেছি অনেক নারীই আমার সঙ্গ চাইছে কিন্তু আনি সাড়া দেই নি।ভেবেছি এক সময় একটা সাধারণ মেয়ে দেখে বিয়ে করব যার সাথে চুটিয়ে সংসার করা যায়।তারপর আমার তোমার সাথে হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো তুমি আমার দেখা অসাধারণ একটা মেয়ে,তোমার সঙ্গ পেলে যে কোনো পুরুষ হবে শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যবান, কিন্তু…
আবরারের গলা ধরে এলো সে কাদতে লাগলো
—আমি তো হতভাগ্য আয়না,
আয়নার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো, এই মুহুর্তে ওর মনে হলো এই লোকটাকে ও যেতে দেবে না কোথাও না আবরার আবার বলল,
—সেদিন যখন তুমি আমার বাড়িতে গেলে আমি ভাবলাম এবার বুঝি সব কষ্ট দূর হবে তুমি থেকে যাবে, আমি হয়তো এবার একটা আমার মানুষ পাবো এই পৃথিবীতে আমারো কেউ একজন থাকবে তুমি থাকলে না, তুমি এমন কেন এত কঠিন কেন!
আয়নার কি হলো ও আবরারের মুখে হাত দিয়ে আটকে ঝুকে এসে আবরারের কপালে ঠোট ছোয়ালো আবরার এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, আয়নাকে টেনে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো,আয়না কোনোরকম বাধা দিলো না,শুধু বুঝলো আবরার কাদছে। কি আশ্চর্য একটা মানুষ কাদছে ওর জন্যে!
আয়নার ঘুম ভাঙলো কিছুটা বেলায়, আজ নিজেকে ওর খুব পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে কেমন হালকা হালকা লাগছে!বিছানায় আবরারকে না পেয়ে নিজেকে গুছিয়ে বিছানা ছাড়লো,ভাবলো হয়তো আবরার ওয়াশরুমে আছে হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো টেবিলে পেপার ওয়েটের নিচে রাখা একটা কাগজে সেটা হাতে নিয়ে দেখলো,আবরারের হাতের লেখা
আয়না,
আমি জানি না কাল রাতে আমার কি হয়েছিলো, আমি কি বলেছি,আমি তোমাকে চেয়েছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনো তোমাকে অসম্মান করতে চাই নি।আমি খুবই লজ্জিত, আমি তোমার সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সারাজীবনের মত হারালাম।
আবারার
আয়না কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ওর মাথা পুরো ফাকা ফাকা লাগছে।
চলবে…
সামিয়া খান মায়া