বরষায় ভেজা মন
রূবাইবা মেহউইশ
২.
পরশ ভাই ছোট মাছের টক দিয়ে ভাত মেখেছে। তার পাশেই পিয়া ঢেড়শ ভাজিতে ভাত খাচ্ছে পিয়াল ভাই অবশ্য স্মার্ট মানুষ তিনি ডায়েট করছেন। শুধু সালাদ খেয়েই কাটিয়ে দেবেন রাতটা। কলির ভীষণ ভালো লাগল ব্যাপারটা। সে তো এমনই একজন চায় প্রেম করার জন্য যাকে নিয়ে বান্ধবীমহলে সে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, আমার বয়ফ্রেন্ড ভীষণ জেন্টেল। কিন্তু পিয়াল ভাই তো তাকে পাত্তাই দেয় না৷ এই যে রাতের খাবার খেতে এলেই দেখা হবে ভেবে কত সেজেগুজে ডাইনিংয়ে এলো কলি। অথচ দিনভর সে পড়ে থাকে ভেবলির মত অগোছালো।
‘ কোথায় চলে গেলি রে কলি!’
বা হাতে চটাস করে মাথায় একটা থাপ্পড় লাগালো পরশ। পাশেই পিয়া হো হো করে হাসছে আর মামী ধমকালেন, ‘খেতে বসে মারতে নেই পরশ। এত জ্বালাস কেন বোনদের?’
-কি করব মা বুড়ি ধিঙ্গি খেতে বসে কোথায় গায়েব হলো! ক’বার বললাম ভাতের বোলটা এদিকে দে শুনলো সে?
– ভাইয়া থাক, আমি দিলাম তো৷ কলির বোধহয় ফুপির কথা মনে পড়ছে।
কলির হয়ে পিয়া বলল সাথে মামীও বললেন তেমনটাই হবে। কলি মাথায় হাত রেখে বক্র চোখে তাকিয়ে আছে পরশের দিকে। সবাই যা ভাবছে আদতে তা নয় ঘটনা৷ তার চিন্তা পিয়াল ভাইকে ঘিরে। বাড়িতে তো বলে এসেছে একটি মাস সে মামা বাড়ি থাকবে এবার। অথচ মন গহীনে যে লুকানো বাসনা তা বুঝি এক বছরেও পূরণ হবার নয়। খাওয়া শেষে যেচে পড়েই কলি বলল, পিয়াল ভাই কি ভাত খায় না মামী?
– খায় তো। দুপুরে এক মুঠো তাও আবার বোল ভর্তি সালাদ নিয়ে৷
-এতে করে পেট ভরে তার?
-কি জানি বাপু তার পেট ভরে না মন ভরে! কোন এক শেওড়া গাছের ডাইনির পাল্লায় পড়ে ছেলেটা আমার গোল্লায় যচ্ছে।
মামীর কথাটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটালো কলির কানে। তবে কি পিয়াল ভাইয়ের প্রেমিকা আছে! কলি আর বলল না কিছু কিন্তু মামীর বলা থেমে নেই। তিনি বিড়বিড় করে গুচ্ছের গালি সেই ডাইনির উদ্দেশ্যে দিচ্ছেন। রাত বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে বৃষ্টির ছাট। সেই যে বিকেলে শুরু হলো এখনো চলছে কখনো জোরে, কখনো ধীরে। যেন, ছিচকাঁদুনে কোন কিশোরী তার মনের দুঃখ ঢেলে দিচ্ছে এ ধরায়। পিয়ার পাশে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়তেই পিয়া ডাকলো, ঘুমিয়ে পড়বি এখনি?
-তো কি করব? রাত তো এগারোটা ছুঁই ছুঁই।
-গান শুনবি গিটারে?
পিয়ার কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকালো কলি। ঘরের বাতি সবে বন্ধ করেছিল সে পিয়ার কথায় ঠাস করে চেপে ধরলো সুইস পুনরায় জ্বালালো বাতি। ঝামটা মেরে বলে উঠলো, চমৎকার বৃষ্টিরাত নষ্ট করার কোন ইচ্ছে নেই আমার।
-নষ্ট হবে কেন? বড় ভাইয়া দারুণ বাজায়। তুই তো শুনিসইনি কখনো।
-কে বলল শুনিনি! রুনা খালার মেয়ের বিয়েতে গাইলো না, পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়! ওই যে জিৎ কোয়েল জুটির কোনো মুভির।
মুখ বাঁকিয়ে বলে চলল কলি আর তাতেই পিয়া হেসে কুটিকুটি। মেয়েটা সব কিছুতেই খুব হাসে ঠিক তার বড় ভাইয়ের মত।
-আররেহ! ওটা তো বরপক্ষের মেয়েদের ক্ষেপাতে ভেঙচি মেরে গেয়েছে। ভাইয়া কিন্তু তাদের বন্ধুমহলে দারুণ গিটারিস্ট। আজ বৃষ্টি হচ্ছে না দেখিস একটু পরই কানে আসবে গিটারের সুর। বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়া বৃষ্টির রাত, ছুটির বিকেল আর উৎসব -অনুষ্ঠানে প্রায়ই গান করে।
এ পর্যায়ে কলির আগ্রহ জাগল গান শোনার। পিয়াল ভাইয়ের নাম শুনতেই তার মনোবাসনা পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কলি, পিয়ার কথার মাঝেই কানে এলো টুং টাং গিটারের সুর। বৃষ্টির তালে গলার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে ধরা দিল কর্ণকুহরে। মুখে না বললেও মনে মনে স্বীকার করতেই হলো, গানটা পরশ ভাই সত্যিই দারুণ গায়। তবুও একটিবার ছাঁদের ঘরে যাওয়া চাই। পিয়াল ভাইকেও দেখতে হবে তো! পিয়া, কলি দুজনেই বেরিয়ে পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে।
তুই আরেকটু আনমনে থাক
উড়ে যাক তোর কবিতা মাখা চুল
এ শহরে হাজারো বোকা প্রেমিকেরা তোর
ভালো চায়, বলে তাই
উপন্যাসের বন্যা দিয়ে মিছিল করে যায়
আমি অলস তাই পিছে পড়ে রই
দিশেহারা তুই আর আমি মিলে দুই
আমার নীল আকাশ ছিঁড়ে উড়ে গেলি তুই…
পা থমকে আছে কলির। গলা ছেড়ে গাওয়া গান বৃষ্টির তরঙ্গে ঢেউ তুলে ছুঁয়ে যাচ্ছে কর্ণকুহর। চিলেকোঠার ঘরে দরজার ভেতরে চলছে গানের মত্ত আন্দোলন আর দিশেহারা হয়ে উঠছে ষোড়শী কলির অন্তরকুটিরের ভাবুক ভ্রমর। ছাঁদের ওপর ছন্দ তোলা বরষার ভারী বর্ষণ আর চিলেকোঠার কণ্ঠস্বর মিলেমিশে একাকার। আচমকাই বুকের ভেতর ডঙ্কা বাজলো। বদলে গেল মনের বাসনা অচিরেই নাম বদল হলো মন পুরুষের। যেচে পড়ে সেধিয়ে রাখা নামখানা যেন আপনাতেই সরে গেল৷ চুপ করতে ডুব দিলো সেখানে ভিন্নধারার মানুষটির নাম৷ কলি ভাবনার জাল ছিঁড়ে দুপদাপ পা ফেলে চলে এলো পিয়ার ঘরে। বুকের ভেতর যে শঙ্খধ্বনি তা যে খুব ভয়ানক টের পেতেই মন ছুটলো পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিয়া হতবাক চেয়ে রইলো কলির দিকে। কি হলো মেয়েটার! একটু আগেও তো ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, চঞ্চল প্রজাপতির ন্যায় হঠাৎ কেন এত ভীরু হয়ে পালিয়ে গেল!
(পরবর্তী পর্বে হয়ত সমাপ্তি আসবে। ভীষণ অগোছালো লাগছে তবুও লেখাটা চালিয়ে যাচ্ছি। মন্তব্য করে জানাবেন ভাল মন্দ সবটাই)