বরষায় ভেজা মন রূবাইবা মেহউইশ ৩.

0
208

বরষায় ভেজা মন
রূবাইবা মেহউইশ
৩.

‘আর কত লুকিয়ে রাখবি অনুভূতির পায়রাকে? এবার বন্ধনমুক্ত কর শেষ সময়টাতে সামনে গিয়ে দাঁড়া কলি।’

টিপটিপ বৃষ্টি ঝরেছে সকাল, সন্ধ্যে। একটা সপ্তাহ টানা বর্ষণের পর আজ কিছুটা কম হলেও একেবারে থেমে নেই। কলির চোখের বর্ষণ আজ দুটো বছর চলছে অথচ প্রকৃতি দু বছরে ছ দুগুণে বারোবার ঋতুরূপ বদলেছে। সেই যে এসএসসির পর মামা বাড়ি গেল এরপর আর বদল হয়নি তার মনের ঋতুটার। সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষ, সবচেয়ে অসহ্যকর লোকটার জন্য ষোলোর কলি আঠারোতে পরিস্ফুট হয়ে ধরা পড়েনি কারো চোখে। কানে ধরা ফোনের ওপাশ থেকে প্রিয় বান্ধবী রিয়া আবারও বলে উঠলো, কোথায় চলে গেলি রে কলি?

বুকের ভেতর বজ্রাঘাতের মত লাগল রিয়ার প্রশ্নটা। মনে পড়ে গেল বছর দুই আগে সেই বৃষ্টির রাতে খাওয়া পাতে মাথায় থাপ্পড় মেরে এমনই একটি কথা বলেছিল পরশ ভাই । তখন কলির ভাবনমহলে ছিল পিয়াল ভাই আজ সময়ের পরিক্রমায় নাম বদলে হয়েছে পরশ ভাই। রিয়ার কথার কোন জবাব না দিয়ে কল কেটে দিল কলি। সে রাতে পরশ ভাইয়ের গিটারের সুর আর তার গানের গলা শুনতে শুনতে আনমনেই তাকিয়েছিল সে মানুষটার দিকে। দৈবাৎ এক অদৃশ্য আকর্ষণে চোখ ধাঁধিয়ে উঠেছিল তার সে মানুষটাকে দেখে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিয়া আর সে তাকিয়েছিল পরশ ভাইয়ের দিকে। লোহার উঁচু এক স্টুলে বসে গিটার বাজিয়ে গাইছিল তিনি। তার বিপরীতে জানালায় উত্তুরে হাওয়ার দাপটে বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো পরশ ভাইয়ের চুল, গাল আর বাহু ছুঁয়ে টি-শার্টের কাঁধ, বুক সবটা। ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা ষাট ওয়াটের হলদে আলোয় স্বর্ণের মত জ্বলজ্বল করছিলেন তিনি৷ সেই প্রথম পরশ ভাইকে দেখে হৃদমাঝারে ডঙ্কাপেটা হলো পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেল বছর তিনেক আগে নানা ভাইয়ের কথা৷ মৃত্যুমুখে শয়ন শিয়রে তিনি কলির মাকে বলেছিলেন, আমার নাতি নাতনি মোটের ওপর বারোজন। তাদের সবাইকেই আমি সমান ভালবাসি৷ কিন্তু সবাইকে একসাথে নিজ বাড়িতে রাখা সম্ভব নয়৷ তবে আমার একটি মাত্র মেয়ের যেকোন একটি সন্তান চাই আমার বাড়িতে থাকুক।

নানা ভাইয়ের কথায় কারোই দ্বিমত আসেনি৷ কলির বড় বোনের তখন বিয়ে ঠিক হয়েই ছিল এদিকে পিয়া আবার কলির ভাইয়ের বড় হওয়ায় এ সম্পর্কটাও অসম্ভব৷ অনেক ভেবে বড়রাই বলেছিল, পিয়াল আর কলির একটা ব্যবস্থা হোক। বয়সের দিক থেকে চার বছরের বড় পিয়াল একদমই মানানসই কলির জন্য। ব্যস, সেই থেকেই কলি জানে বড় হলেই তার বিয়ে হবে পিয়াল ভাইয়ের সাথে। তাই প্রেমের আয়োজনও যেচে পড়ে সে ওই মানুষটার সাথে করতে চেয়েছিল। কিশোরী মন তখন জানতোই না প্রেমটা কখনো গুছিয়ে হয় না। প্রেম কখনো আয়োজন করে হয় না। কলির বেলায়ও তা হয়নি। বড়রা যে ব্যাপারটা অপ্রকাশিত রেখেছে বরাবর তা অপ্রকাশিতই থেকে গেছে। এদিকে মনে নাটাই ঘুড়ি কখন যে আপনাতেই হাওয়ার তালে ছিঁড়ে গেছে তা কেউ জানতে পারেনি। সামনেই এইচএসসি পরীক্ষা অথচ আগামী সপ্তাহে পিয়ার বিয়ে। আর তার পরের মাসেই পরশ ভাইয়ের এনগেজমেন্ট। মেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করছে। হয়ত এমবিবিএস কমপ্লিট করেই বিয়ের পিড়িতে বসবে। দুটো বছরে মা-বাবা, ভাই আর আপু দু, তিন বার রাজশাহী গেছে বিভিন্ন উপলক্ষ পেয়ে। কলি প্রতিবারই নানা টালবাহানায় এড়িয়ে গেছে সেখানে যাওয়া। কিন্তু এবার! পিয়া রোজ রোজ কল করে ঘ্যানঘ্যান করে তাকে যেতেই হবে। বাধ্য হয়েই স্বীকার গেল সে যাবে অথচ তার পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে সে ফোন করে পিয়াকে মিথ্যে কিছু বলে বসবে। সে কথা জেনেই রিয়া তাকে এতক্ষণ বোঝাতে চাইছিল। কি লাভ অত বুঝে! পারিবারিক ভাবে পাত্রী দেখা এবং পরশ ভাই নিজে পছন্দ করে তবেই বাগদানের তারিখ ঠিক করেছেন।

এবারেও আষাঢ় মাস চলছে। ঘরের সবাই গোছগাছ করে নিয়েছে আজ রাতেই রওনা হবে মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে। কলির মা এসে তাড়া দিলেন, কি কি নিয়েছিস বলতো! ভাবছি তোর জন্য স্বর্ণের একটা সেট সাথে নিয়ে যাব।

-স্বর্ণ কেন?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো কলি।

-তোর আব্বু বলছিল এবার গিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলবে৷ তোর আর পিয়ালের ব্যাপারে। এমনিতেও আব্বার মৃত্যুর পর কেউ একবারও এসব কথা তোলেনি৷ কে জানে পরে আবার তারা অস্বীকার না করে বসে।

চিন্তিত শোনালো কলির মায়ের কণ্ঠস্বর৷ কিন্তু মায়ের চিন্তা কলির গলায় কাঁটার মত বিঁধলো যেন। সে মুখে কিছু বলল না মন বলল, ভুলে যাক সবাই ভুলে যাও তোমরা সব। আমি চাই না ও বাড়ির বউ হতে।

রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের আগমন৷ শেষরাত অবধি তুমুল বর্ষণের পর হঠাৎই প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেছে৷ বৃষ্টিহীন শীতল হাওয়ায় কমলারঙা সূর্যখানি উঁকি দিতেই পরশের ঘুমটা ভাঙল। বৃষ্টি হাওয়ায় রাতটা শীতল থাকায় কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমিয়েছিল সে এখন এই ভোরে কাঁথা গায়ে ভ্যাপসা গরম লাগছে। বিছানা ছেড়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো। সময় দেখে নিয়ে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকতেই কানে এলো পিয়ার গলা। কলি এসেছে! এই একটা কথাই মনে এলো তার প্রথমে।

ডাইনিং টেবিলে চা আর চামচে টুংটাং ছন্দ উঠছে থেকে থেকে৷ কলির বাবা ছাড়া তাদের পরিবারের সকলেই এসে উপস্থিত। পিয়া সবাইকে চা দিচ্ছে, কলি পরোটার প্লেট এনে টেবিলে দিচ্ছে। পরশের মা রান্নাঘরে পরোটা ভাজছেন। একে একে মহিলারা সবাই মিলে হাত চালিয়ে নাশতা দিচ্ছেন। বিয়ে বাড়ির আমেজ আজ সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল। কাল হলুদ পরশু বিয়ে সে কারণে আজ থেকেই দূরের আত্মীয়রা আসা শুরু করেছেন। কলির ভালো লাগছে না এত মানুষের সমাগম। সে সকালের নাশতা শেষেই পিয়ার ঘরে ঘাপটি মেরেছে। পিয়াল এসে দু তিনবার ডেকে গেছে ছাঁদে যেতে। গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হচ্ছে তা সব কাজিনরা মিলেমিশে নির্দেশনা দিচ্ছে বলে পরশই পাঠিয়েছিল পিয়ালকে। কিন্তু কলি আসেনি এমনকি আসার পর থেকে একটিবারও পরশের চোখে চোখে তাকায়নি৷ আর কেউ তা না জানলেও পরশ ঠিক খেয়াল করেছে। ছোট বাচ্চা তো নয় সে! গত দুটো বছরে সে কতরকমে টের পেয়েছে কলির মনের অবস্থা কিন্তু মেয়েটা এই অল্প বয়সেই এত বেশি ম্যাচিউরিটি দেখিয়েছে যে, তার আর ইচ্ছে হয়নি আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার। পাছে নিজের চরিত্রের হ্যাংলামির অপবাদ লাগে! তবুও সে অপেক্ষায় ছিল তার যা মনে হয় কলি তা কখনো প্রকাশ করবে কিন্তু না আজ অব্দি কিছুই প্রকাশ করেনি মেয়েটি উল্টো সব কিছুতেই তাকে এড়িয়ে গেছে। তবুও শেষ সুযোগ হিসেবে পরশ নিজের বিয়ে ঠিক করছে বলে কলির কাছে খবর পৌঁছালো পিয়ার দ্বারা। সেখানেও মেয়েটি কুলুপ এঁটেছে মুখের ভেতর৷

সারাদিন পর সন্ধ্যেতে আবারও শুরু হলো হালকা বৃষ্টি সেই সাথে বিজলি চমকানি। কলি এই মুহূর্তটায় আর বন্দী রাখতে পারল না নিজেকে। বৃষ্টি দেখার লোভ নাকি মনের মানুষটির কণ্ঠ শোনার বাহানা কে জানে! সে পিয়ার ঘর ছেড়ে ধীর পায়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজায়। আনমনেই দৃষ্টি ফেলল চিলেকোঠার ঘরের ভেতর। সেই হলদে আলো, সেই বর্ষণ শুধু বদলে গেছে মানুষটার বাহ্যিকরূপ অনেকটা৷ সেবার ছিল পোশাক ট্রাউজার, টি শার্ট পরনে, মাথা ভর্তি বড় বড় চুল রেশমের মত। পরিপূর্ণ ঝকঝকে মুখটাতে দাঁড়িগোফের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। আর আজ! থ্রি কোয়ার্টার গ্যাবাডিন, এই বৃষ্টি শীতল আষাঢ় সন্ধ্যায় গায়ে আর কিছুই নেই। মাথাভর্তি চমৎকার চুলগুলো বড্ড অযত্নে বেড়া ওঠা স্পষ্ট সেই সাথে গাল ভর্তি জঙ্গুলে দাঁড়ি, হাতে তার গিটার আঙ্গুল ছুঁয়ে গেছে সেই গিটারের তার। নির্নিমেষ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কলি তার জীবনের অধরা নক্ষত্রটিকে। আপন দৃষ্টিতে এতই বেখেয়ালি ছিল সে যার ফলে বুঝতেই পারেনি ওপাশের মানুষটিও ঠিক একইরকম অনিমেষ দেখছে তাকে। সময় বয়ে গেল সেকেন্ড, মিনিট। হঠাৎই বিদ্যুত চমকানোর সুক্ষ্ম সরু আলোর রেখা বোধ ফিরিয়ে দিল মানুষ দুটোর। হুঁশ পেতেই কলি উল্টো পা বাড়ালো নিচে নামতে তখনই কানে এলো সেই কণ্ঠ,

এই অবেলায়
তোমারই আকাশে
নিরব আপোশে
ভেসে যাই!
সেই ভীষণ
শীতল ভেজা চোখ
কখনও দেখাইনি তোমায়!!

(রেসপন্স কম বলেই লেখার আগ্রহ হারিয়ে যায় এটা পুরনো কথা। এবার গল্পের সাইজ ছোট করাটার পেছনে সেই রেসপন্সহীনতাই দায়ী। এই গল্প কেন পরবর্তী হয়ত সকল গল্পই আমি সল্প পর্বে সমাপ্তি টানব৷ এত কম মন্তব্য, রিয়াক্টে লিখতে সত্যিই ভালো লাগে না)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here