চিরকুট ( শেষ পর্ব )

0
367

#চিরকুট ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৪>
সেদিনের পর জীবনটা সুন্দর একটা সাজানো ছবির মতন হয়ে উঠেছিল গৌরব আর সৃজার চিরকুটকে নিয়ে। এখন তো সৃজা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় বাবা মেয়ের বন্ড দেখে! গৌরবকে চিরকুট নিজের সব কথা বলে। স্কুলে কি হলো, কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া হলো, কার সাথে মিল, কোন টিচার কি বললো, সমস্ত কথা। আর বাবাও মেয়ে অন্ত প্রাণ। অফিসের অতো কাজের চাপ সামলেও ঠিক উইক এন্ড এ চিরকুট কে নিয়ে কলকাতা শহরের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে। তারপর রোজ রাতে গল্প বলে ঘুম পাড়ানো, আদর করে সকালবেলা ঘুম থেকে তোলা, মেয়ের পছন্দের জিনিস গুলো রান্না করে হঠাৎ সারপ্রাইজ দেয়া, সব কিছু করে গৌরব ভীষণ ভালোবাসা থেকে।
এইভাবেই প্রায় দুটো বছর কেটে গেছে ধীরে ধীরে। তবে এই দু বছরে গৌরব সৃজার জীবনের সাথে সাথে সমীরণবাবু অনন্যারও জীবন বদলেছে কেমন। দু বছর আগের রাগ অভিমান গুলো সময়ের সঙ্গে ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে যেন। এই ফাঁকা বাড়ি, একাকিত্ব বার বার বুঝিয়ে দিয়েছে সন্তান থেকেও সন্তানহীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা। মনে হয়েছে নিজের রাগটা বজায় রাখতে গিয়ে কি অনেক বেশী কঠিন হয়ে গেছে ওরা! সৃজা তো বৌমা হিসেবে ভালোই ছিল। যতদিন ওই ফ্ল্যাটে থেকেছে সাধ্য মতন খেয়াল রেখেছে মেয়েটা। ঠিক সময়ে ডাক্তার দেখানো, পছন্দের খাবার বানিয়ে দেয়া, সব করেছিল সৃজা যত্ন নিয়ে। কিন্তু ওর বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সেই যত্নের সিকী ভাগও কি ফিরিয়ে দিয়েছে ওরা মেয়েটাকে! না কি ওই দগদগে ঘা এ আরো বেশি করে যন্ত্রণা দিয়েছে অবুঝের মতন। কথাগুলো আজকাল খুব মনে হয় অনন্যা আর সমীরণ বাবুর। সব থেকে বেশি সেদিন থেকে, যখন অনন্যার হঠাৎ এপেন্ডিক্স এর যন্ত্রণা উঠেছিল রাত্রে। সেদিন সমীরণ বাবু নিরুপায় হয়ে ছেলেকে ফোন করেছিলেন; আর সেই একটা ফোন কলের পরই গৌরব সৃজা ছুটে এসেছিল ওদের কাছে। তারপর সৃজা গৌরবের সাথে সারা রাত ছিল হসপিটালে। শুধু তাই না, যতোদিন অনন্যা সুস্থ্য হয়নি, মেয়েটা রান্না করে গৌরবের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিত সকাল বিকেল ওদের জন্য।
এইসব দেখে নিজেদেরই কেমন অপরাধী মনে হতো অনন্যা সমীরণবাবুর। তবে ছেলের সাথে এতদিনের দূরত্বের জন্য এত সুক্ষ একটা কাঁচের দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে, যে কিছুতেই সেই দেয়াল ভেঙে কাছে আসা সম্ভব হতো না দুজনের।
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো কাটছিল। কিন্তু সেই শুক্রবার একটা ঘটনা ঘটলো। সেদিন সমীরণ বাবুর ভাই অভিনন্দন বাবুর নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশ ছিল। আর গৌরব ছোট থেকেই কাকার খুব ক্লোজ। নিজের মা বাবার সাথে যতই দূরত্ব তৈরি হোক, কিন্তু কাকার সাথে সব সময়ই যোগাযোগ ছিল গৌরবের; তাই সপরিবারে গেছিল এই অনুষ্ঠানে। এদিকে সমীরণ বাবু আর অনন্যাও গেছিল এই গৃহ প্রবেশে। আর সেখানে গিয়েই ওরা প্রথম দেখেছিল চিরকুটকে। দেখেছিল গৌরব কিভাবে ওকে কোলে করে নিয়ে এসেছে এই অনুষ্ঠানে। তারপর সারাক্ষণ ওই বাচ্চা মেয়েটাকে কেমন আগলে আগলে রাখছে যেন! ওকে খেতে বসে মাছের কাঁটা বেঁছে দেয়া থেকে না না রকম এলোমেলো গল্প করা, সারা অনুষ্ঠান জুড়েই কেমন চিরকুটের সাথেই আছে গৌরব প্রত্যেকটা মুহূর্তে। এইসব দেখে সমীরণবাবু অনন্যা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল হঠাৎ। যদিও গৌরব মেয়েকে নিয়ে ওদের কাছে আসেনি আলাপ করানোর জন্য; কারণ যারা চিরকুটকে পছন্দ করে না, তাদের কাছে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই বলে মনে হয় ওর। যদিও সৃজা বলেছিল এসে একবার চিরকুটের সাথে ওদের আলাপ করিয়ে দিতে, কিন্তু গৌরব রাজি হয়নি। হয়তো ওর সন্তানকে এতদিন ধরে অস্বীকার করার জন্য একটা অভিমান তৈরি হয়েছিল মা বাবার ওপর মনে মনে!
সেদিন এসবের ভিড়েই দিনটা এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে একটা সময়ের পর অভিনন্দন বাবু এসেছিল নিজের দাদা বৌদির কাছে কিছু কথা বলতে। সেদিন উনি কোন রাখঢাক না করে সোজাসুজিই বলেছিলেন,
——–” দাদা, এবার নিজের চিন্তাধারাটাকে একটু বদলা! নইলে সারা জীবন আফসোসের শেষ থাকবে না। তুই আর বৌদিও আজ গৌরব সৃজার এই আনন্দের দিনগুলোতে সাথে থাকতে পারতিস, যদি নিজেদের ধারণা গুলোকে বদলে ফেলতিস। আজ গৌরব ওই বাচ্চাটার সাথে কতটা খুশি! ওই ছোট্ট মেয়েটাই যেন ওর প্রাণ! এটা দেখে তোদের ভালো লাগছে না? মনে হচ্ছে না ওদের এডপশন এর ডিসিশনটা একদম ঠিক? ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অভিনন্দন বাবু। কিন্তু এই প্রশ্নে সমীরণ বাবু কিছুটা সময় নিয়ে একটু থেমে থেমে বলেছিল,
——–” না মানে, আমি ভাবছিলাম প্রথমে, যে কার না কার রক্ত হবে! ”
না, কথাটাকে ওনার শেষ হতে না দিয়েই অভিনন্দন বাবু আবার বলে উঠলো,
———” দাদা প্লিজ! ওইসব চিন্তা যে তোর ভুল ছিল, এখন তো বুঝতে পারছিস! আর এইসব রক্ত বংস জাত এইসব বাদ দিয়েও একটা সম্পর্ক হয়, সেটা হচ্ছে ভালোবাসার সম্পর্ক। যেই সম্পর্কটা গৌরবকে বেঁধে রেখেছে ওই বাচ্চা মেয়েটার সাথে। এখনো সময় আছে। নিজের ছেলের সাথে যা মনোমালিন্য আছে মিটিয়ে নে। আর তোর আর বৌদির তো খুশি হওয়া উচিত। তোদের ছেলে সৃজা আর চিরকুটের সাথে কতটা ভালো আছে, কতটা সুখে আছে! এটা দেখে। কারণ গৌরবের ভালো থাকাটাই তো সব থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট। তাই না?”
কথাগুলো খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন অভিনন্দন বাবু। তবে এইসব শুনে অনন্যা আর সমীরণবাবু দুজনেই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। হঠাৎ করে কেউ এসে এতদিনের বদ্ধ চিন্তা ভাবনাগুলো ভেঙে ফেললো হঠাৎ! আর নিজের চোখে ওই বাচ্চা মেয়েটার সাথে গৌরবকে এতটা খুশি না দেখলে হয়তো এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না ওরা। ভুলটা বুঝতে পারতো না। মিথ্যে অভিমান পুষে রেখে সারা জীবন দূরেই থাকতো দুজনে!
সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই বাড়ি এসে অনন্যা সমীরণ বাবু দুজনেই খুব চুপ ছিল। আসলে সেই অদৃশ্য দেয়ালটা ভেঙে কিভাবে ছেলের কাছে ফিরে যাবে, এটাই বুঝতে পারছিল না দুজনে। তবে অবশেষে অনন্যা বলে উঠলো,
——–” আর এইভাবে একা একা থাকতে পারছি না আমি! যখন ভুল আমরাই করেছি, তখন সেটাকে ঠিক করার দায়িত্বও আমাদেরই। তুমি গৌরব কে ফোন করো। আমাদের নাতনি আর বৌমা কে নিয়ে ওকে এই বাড়ি আসতে বলো। অনেক হয়েছে! ”
কথাগুলো চোখে জল নিয়ে বলেছিল অনন্যা। তবে সমীরণ বাবু আজ আর কঠিন থাকতে পারেনি। অনন্যার সাথে কোন বিরোধ না করেই কিছুটা সময় নিয়ে ফোন করেছিল গৌরবকে।
সেদিন মোবাইলের স্ক্রিনে বাবার নাম্বার দেখে হঠাৎ ঘাবড়ে গেছিল ও! আবার দুজনের কারোর শরীর খারাপ হলো না কি! কথাটা ভেবে বেশ চিন্তায়ই ফোনটা ধরে বলেছিল,
——–” হ্যালো। কি হয়েছে? তোমরা ঠিক আছো তো? মায়ের শরীর ঠিক আছে? ”
এই এতগুলো প্রশ্নে এবার সমীরণ বাবু খুব স্থির গলায় বলে উঠেছিল,
——–” না, আমরা ঠিক নেই। তোর মা আমি একদম ঠিক নেই; তোদের ছাড়া। আসলে খুব ভুল হয়ে গেছে গৌরব, প্রথম থেকে ভুল করেছি আমরা। তোকে বুঝতে, বৌমাকে বুঝতে! কিন্তু সৃজা এত কিছুর পরও সব সময় আমাদের খেয়াল রেখেছে। আর আজ চিরকুটের সাথে তোদের এতটা আনন্দে দেখে যেন চোখ খুলে গেল আমাদের! আমরা আজ বুঝেছি, মা বাবা আর সন্তানের সম্পর্ক সব সময় রক্তের হয় না; ভালোবাসার হয়। যেই ভালোবাসাটা তোর আর সৃজার মনে চিরকুটের জন্য আছে। যেই মায়ায় তোরা ওই ছোট্ট শিশুটার সাথে এতটা জড়িয়ে গেছিস! ”
কথাগুলো ভীষণ থমকে থাকা গলায় বললেন সমীরণ বাবু। কিন্তু গৌরব এই মুহূর্তে কিরকম মূর্তির মতন চুপ হয়ে গেছিল যেন! এতদিনে বাবা মা ওদের সাথে চিরকুটের সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছে। বুঝেছে এই সম্পর্কের মানে! কথাটা ভেবেই কেমন শব্দহীন লাগছিল নিজেকে। কিন্তু এই সময় সমীরণবাবু আবার বলে উঠলেন,
———” আমাদের নাতনিকে নিয়ে আসবি একবার আমাদের কাছে? একটা সুযোগ দিবি আমাকে আর তোর মা কে পুরনো ভুলগুলোকে সুধরে নেয়ার? আরেকবার নতুন করে সবটা শুরু করার সুযোগ দিবি আমাদের? ”
কথাগুলো কেমন ভেজা গলায় বললেন উনি। কিন্তু গৌরব আর চুপ থাকতে পারলো না এরপর। নিজে থেকেই বলে উঠলো,
———-” কালই আসছি আমরা বাড়ি। তুমি মা একদম ভেবো না। একদম মন খারাপ কোরো না। ”
সেদিন এরপর আনন্দে কথাগুলো গৌরব সৃজাকেও বলেছিল। সৃজা তো এইসব শুনে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিল না! অবশেষে ওর সন্তান নিজের দাদু ঠাকুমার ভালোবাসা পাবে। এটাও সম্ভব! ভেবেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিল যেন সব কিছু। তবে পরেরদিন ওই বাড়ি গিয়ে অনন্যা আর সমীরণ বাবুর চিরকুটের প্রতি ভালোবাসা দেখে মনটা স্থির হয়েছিল যেন। সেদিন অনন্যা নিজে হাতে রান্না করেছিল চিরকুটকে খাওয়াবে বলে। আর সমীরণবাবু নিজের পছন্দের কিছু গল্পের বই কিনে এনেছিল নিজের নাতনির জন্য। দুজনেই খুব মন থেকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিল চিরকুটকে। আর একটা ভাঙা সংসার আবার জোড়া লেগেছিল। গৌরব সৃজার হারানো অপ্রাপ্ত মুহূর্তগুলো ফিরে এসেছিল যেন আবার। সমীরণবাবু অনন্যার ছেলের সাথে তৈরি এতদিনের কাঁচের দেয়াল ভেঙে গেছিল এক মুহূর্তে। একাকিত্বে ভরা দুজনের নিঃস্ব জীবনে আবার কিছু হাসি, কিছু কথা, আর ভালো লাগার স্মৃতি ফিরে এসেছিল; চিরকুটের হাত ধরে। আসলে এই বাচ্চা মেয়েটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছিল সম্পর্কের মাপকাঠি, আপন পরের মাপকাঠি রক্ত হয় না; ভালোবাসা, শুধু ভালোবাসা হয়।
——–< সমাপ্ত >———-
( ঈপ্সিতা মিত্রর নতুন উপন্যাস ‘ মন পলাশ ‘ প্রকাশিত হয়েছে আজ। অর্জুন আর সৌমীর জীবন নিয়ে লেখা ‘ মন পলাশ ‘। পিডিএফটির মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। ইবুক টি সংগ্রহ করার জন্য এবং পেমেন্ট ডিটেলস জানার জন্য যোগাযোগ করুন 8910333272 এই হোয়াটস অ্যাপ নাম্বারে। ফোন পে, জিপে, পেটিএম, অথবা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিলে পিডিএফ টি পাঠিয়ে দেয়া হবে হোয়াটস অ্যাপ এ। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here