তাড়াহুড়া করে অফিসে ঢুকতেই রিসেপশের সামনে একটা দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে গেলো মীরা। হাতে থাকা সমস্ত কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো ফ্লোরে। অফিসে আজকে প্রথম দিন তার, আর আজকেই সে লেট হয়েছিল। তার ওপর এভাবে কাজ বেড়ে যাওয়ায় মেজাজটাও চড়ে গেলো তার। কিন্তু প্রশ্ন হলো মাঝ রাস্তায় দেয়াল এলো কোথা থেকে!! কোনোরকমে নিজেকে সামলে উঠে দাড়াতেই দেখলো একটা বডি বিল্ডার টাইপ লোক দাড়িয়ে। তারমানে ইনিই ধাক্কা দিয়েছেন। মীরা লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।
এতোক্ষণে সামনে দাড়ানো লোকটার সাথে চোখাচোখি হলো মীরার। অত্যন্ত সুদর্শন একজন পুরুষ মীরার সামনে দাড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে হয়তো মীরা একটু পরখ করে দেখতো লোকটাকে। কিন্তু এখন সে রেগে আছে। অনেক কষ্টে এই চাকরি টা জোগার করেছে। আর প্রথম দিনেই লেট হয়েছে। না জানি বস এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়ার আগেই বের করে দেয়।
🍂
লোকটা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ লোকটার হাতের কাগজ গুলোও নিচে পরে গেছে। একজন পিয়ন লোকটার সব কাগজ তুলে দিচ্ছেন। লোকটা মোবাইলটা বের করে কিছু করছেন। এটা দেখে মীরার রাগ আরো বেড়ে যায়। কোথাকার কোন রাজার পুত্র এসেছে যে পিয়ন তার কাগজ তুলে দিচ্ছে। প্রচন্ড রকম ঝগড়ার মুড নিয়ে মীরা লোকটার দিকে তেড়ে যায়।
মীরা: ওই মি. কানা তুই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেনো? দেখতে পাস নি বুঝি আমার মতো এতোবড় মানুষকে? আমার সব কাগজপত্র ফেলে এখন জমিদারের মতো দাড়িয়ে থাকা হচ্ছে।
লোকটি: Excuse me Miss. তুই-তুকারি করছেন কেনো আপনি। ম্যানার্স বলতে কিছু নেই আপনার মধ্যে!
মীরা: ওরে আমার সভ্যতার পুতুল রে আসছে আমাকে ম্যানার্স শিখাতে। ভুলটা আপনার। আপনি আমাকে ধাক্কা কেনো দিলেন? জানেন আজকে আমার জবের প্রথম দিন। আর আজকেই আপনার জন্য আমি লেট হলাম। আপনি একটা শাকচুন্নি।
লোকটি: মাইন্ড ইউর টাং মিস। আমি চুপচাপ শুনছি মানে এই না আপনি যা মুখে আসবে তাই বলবেন। ম্যানার্স যেহেতু শিখেন নি তাই না শিখা অব্দি বাসা থেকে বের না হলেই তো পারতেন।
লোকটার কথায় মীরার মাথায় আগুন ধরে যায়। মীরার জীবনের ১৯ বছরে কেউ তার সাথে রুডলি কথা বলে নি। এই লোকটা কেনো বললো!!
মীরা: তুই শিখাবি আমাকে ম্যানার্স! আরেহ তুই তো আস্ত একটা এনাকন্ডা তাও আবার আফ্রিকান এনাকন্ডা। ৭ টা শাকচুন্নির একটা জামাই তুই।
লোকটি: আর আপনি একটা অশিক্ষিত ইডিয়ট! রাবিশ!
কথাগুলো বলেই লোকটা সেখান থেকে হনহন করে চলে গেলো। মীরার রাগে নিজেই নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। রাগের কারণটা হলো সে ঝগড়ায় হেরে গেছে। যদিও ঝগড়া টা সম্পূর্ণ হতে পারে নি। তার আগেই লোকটা চলে গেছে। দোষটা তার ছিল সে জানে কিন্তু তবুও স্বীকার করবে না।
এদিকে রিসেপশেনর সবাই হা করে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন তার নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। কোনোরকমে মুখ লুকিয়ে সেখান থেকে কেটে পরলো মীরা।
।
।
।
।
।
যেই অফিসে মীরার জব হয়েছে সেটা বিরাট বড় একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি। মীরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। টিভি ছাড়া বাস্তবে এই ধরনের পরিবেশ সে কখনও দেখে নি। গ্রাউন্ড ফ্লোরের রিসেপশন থেকে খোঁজ নিয়ে চতুর্থ ফ্লোরে চলে গেলো সে। হ্যাঁ এই চার তলাই তার কার্যালয়। সে নিজেও জানে না এই অফিসে তার কাজ কি। তাই রিসেপশনে গিয়ে হাতে রাখা কার্ডটা দেখালো।
রিসেপশনে সুন্দর মতো একটা মেয়ে বসে আছে। দেখতে যেমন সুন্দর পোশাকও তেমনি স্টাইলিশ। শুধু সেই মেয়েটিই না। অফিসের প্রায় সব মেয়েই জিন্স, লেডিস শার্ট বা ফরমাল পোশাক পরে আছে। একমাত্র মীরাই চুড়িদার পরে আছে। এই মুহূর্তে তার নিজেকে মঙ্গলগ্রহ থেকে আগত এলিয়েন মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাড়িতে এই মুহূর্তে উপার্জনক্ষোম একমাত্র সে। যেখানে পুরো সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে সেখানে এসবকিছু করা শুধুই বিলাসিতা।
কিছুটা মন খারাপ নিয়ে মীরা রিসেপশের সামনে দাড়িয়ে রইলো। রিসেপশনিষ্টের নাম মোনা।
মোনা: অঙ্কুর স্যার পাঠিয়েছেন তোমাকে?
মীরা: হ্যাঁ।
মোনা: নাম কি তোমার? আর পেপার্স এনেছো?
মীরা: আমার নাম মীরা রহমান। আর কাগজ যা যা বলেছিল সবই এনেছি।
মোনা: তোমার তো গ্র্যাজুয়েশন করা হয় নি। এখনও স্টুডেন্ট। কিন্তু যেহেতু অঙ্কুর স্যার তোমাকে রেফার করেছেন কিছু কোয়ালিটি আছে হয়তো।
মীরা: কোয়ালিটির কথা আর বলতে। নিজের মুখে আর নিজের কি তারিফ করবো, সর্ব গুণে গুণান্বিত আমি।
মীরার কথা শুনে মোনা হেসে দিলো।
এই অফিসের এম.ডি এর PA এর পোষ্টের জন্য মীরাকে রেফার করা হয়েছে। যে মীরার চাকরির ব্যবস্থা করেছে মীরা তার পরিচিত না। শুধু নাম টাই জানে,, অঙ্কুর স্যার। যেহেতু মীরা নতুন তাই তার নিজের কোনো ডেস্ক দেওয়া হবে না। মোনা মীরাকে নিজের সাথেই বসিয়ে রাখলো।
বেশকিছুক্ষণ পর বসের রুম থেকে মীরার ডাক পরলো। যতো দোআ-দূরদ জানা আছে সব পড়তে পড়তে মীরা এগুতে লাগলো। এমডির কেবিনের দরজায় নক করতেই ভিতরে যাওয়ার অর্ডার এলো। কিছুটা ভয় আর অনেকটা কনফিডেন্স নিয়ে মীরা ভিতরে ঢুকে পরলো।
দরজার অপর পাশে ফিরে জানালার কাঁচে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছেন মীরার বস। মীরা অনেকটা সাহস নিয়ে বসের দিকে এগিয়ে গেলো, উদ্দেশ্য হ্যান্ড শেক করবে। মীরা বসের দিকে হাতটা এগিয়ে দিতেই বস ওপাশ ফিরেই বললো,
বস: Go and get me a coffee.
বসের কথা শুনে মীরার ভ্রু কুচকে গেছে। এসেছে PA এর জবের জন্য আর প্রথম দিনেই লোকটা তাকে ওয়েটার বানিয়ে দিলো!! যতোই ভ্রু কুচকাক, বসের অর্ডার তো আর ফেলতে পারে না সে।
মীরা: বলছি কি স্যার,, কোথায় পাবো কফি!
বস: জবের জন্য এসেছো আর এটুকু জানো না যে কফি আকাশ থেকে পরবে না। বানাতে হবে। পিয়নকে বলো সে দেখিয়ে দেবে কোথায় বানাতে হবে। নিজে বানিয়ে এনো।
মীরা: ওহ তার মানে ওয়েটার নয় রাঁধুনী বানাবে। (আস্তে আস্তে)
বস: একা একা বিরবির না করে ফাস্ট কাজ করো। I don’t like wasting time. Time is money for me. Go now!
বসের গম্ভীর গলা শুনে মীরা ভয়ে সেখান থেকে বেরুলো। পিয়নের হেল্প নিয়ে কিচেনে গিয়ে কফি বানানো স্টার্ট করলো। মীরা কফি বানাচ্ছে আর বসের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।
কফি বানিয়ে নিয়ে আবারো বসের রুমে গিয়ে নক করলো মীরা। এমডি এখনও আগের মতোই কাঁচ ধরে দাড়িয়ে আছেন।
মীরা: স্যার আপনার কফি। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে।☺️।
বস মীরার দিকে ঘুরতেই মীরার হাত থেকে কফি মগটা নিচে পরে গেলো। মীরাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখ জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। কারণ সামনে দাড়ানো তার বস ই সেই লোক যাকে কিছুক্ষণ আগে সে ৭ টা শাকচুন্নির একটা জামাই বানিয়েছিল।
অর্ণব চৌধুরী, চৌধুরী বংশের প্রদীপ আর এই কোম্পানীর এম ডি। অর্ণব মুখে ভিলেন হাসি নিয়ে মীরার সামনে দাড়িয়ে আছে। আর মীরা ভয়ে কাচু মাচু করছে। অর্ণবের মুখে হাসি হলেও চোখে ক্রোধের আগুন স্পষ্ট।
মীরা ধারণা করতে পারছে কিছুক্ষণ পর তার সাথে কি হবে। হয় অর্ণব তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে আর নয়তো তার চাকরি খাবে। এসি রুমেও মীরা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে সে আবারো দোআ-দূরদ পড়া শুরু করে দিয়েছে। অর্ণব তার দিকেই এগিয়ে আসছে আর সে এক পা দু পা করে পিছাচ্ছে। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে মীরার পিঠ ঠেকে গেছে।
মীরা: নাহ এবার আর শেষ রক্ষা হবে না। এবার আমার চাকরি শেষ।
অর্ণব মীরার একদম কাছাকাছি এসে পরেছে। মীরা ভয়ে চোখমুখ খিচে দাড়িয়ে আছে। মীরার ভয়ার্ত মুখটা দেখে অর্ণবের বেশ হাসি পাচ্ছে। একদম ছোট বাচ্চারা ভয় পেলে যেমন লাগে তেমনি লাগছে। অর্ণব আগেই মীরার বায়োডাটা দেখে নিয়েছিল। তাই সে নর্মাল বিহেভ করছে। অর্ণবের নজর মীরার গালের কালো কুচকুচে তিলটার দিকে পরতেই অর্ণবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুহূর্তেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। মীরার থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে সে কড়া গলায় বলতে শুরু করে,
অর্ণব: প্রথম দিনেই আমার লস করিয়ে দিলে তো। এই কফি মগটার দাম তোমার সেলারি থেকে কেটে রাখা হবে। এখনই এটা পরিষ্কার করে আরেকটা কফি বানিয়ে আনো।
মীরা ভেবেছিল হয়তো সকালের করা কাজের জন্য অর্ণব তাকে বের করে দেবেন কিন্তু অর্ণের এমন কিছুই না করাতে মীরা বেশ অবাক হলো।
অর্ণব: দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি হাওয়া গুণছো! যাও এখান থেকে। কোনো কাজে দেরি করা আমার পছন্দ নয়। So do it fast!
মীরা হু হা কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। পিয়নকে ডেকে আনলো কফিটা পরিষ্কার করার জন্য।
অর্ণব: ওয়েট রহিম কাকা। তুমি এটা পরিষ্কার করবে না। মিস মীরা কফিটা ফেলেছে তাই মেঝে টা পরিষ্কারও সেই করবে। ঠিক বলেছি না আমি মিস মীরা!
মীরা তার সাদা ধবধবে দাঁত গুলো হালকা দেখিয়ে কাজে নেমে পরলো। মুখে যতোই হাসি দেখাক ভিতরে ভিতরে মীরা অর্ণবের সবগুলো চুল ছিড়ছে। মীরা মেঝে পরিষ্কার করছে আর অর্ণব তাকে এক দৃষ্টিতে দেখছে। উপর হয়ে কাজ করায় মীরার চুল গুলো এক সাইডে চলে এসেছে। কাঁধটা উন্মুক্ত হওয়াতে বাম কাঁধে থাকা একটা তিলের দিকে অর্ণবের চোখ আটকে যায়। তিলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু সে তার নজর ফেরাতে পারছে না।
অপরিচিত একটা মেয়ের প্রতি এই ধরণের ফিলিংস মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু হঠাত কি হলো তার। অর্ণব অনেক বিচলিত হয়ে পরেছে। এই মুহূর্তে মীরাকে তার সামনে সহ্য করতে পারছে না।
অর্ণব মীরাকে পুনরায় কফি বানানোর জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজের স্ট্রেস বলটা হাতে নিয়ে চাপতে শুরু করে দিলো। মাঝে মাঝে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তার এই দূর্বলতাকে সে প্রশ্রয় দিতে চায় না। আর মিস মীরা!! সে তো!! তার চেহারা!! না না আর কিছু ভাবতে পারছে না অর্ণব। মনে হচ্ছে ভিতরে লুকায়িত পশুটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
🍂
কিছুক্ষণ পর মীরা কফি নিয়ে ভয়ে ভয়ে অর্ণবের রুমের দরজায় নক করলো। অর্ণবের জবাব না পাওয়াতে সে ধীর পায়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। কফিটা সেন্টার টেবিলে রেখে একবার পুরো কেবিন টায় চোখ বুলালো সে।
অনেক বড় কেবিন এমডির। এতোবড় অফিসের মধ্যমণির বসার জায়গাটা যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনি। দেয়ালে অর্ণবের একটা ছবি টাঙানো আছে। হয়তো বিজনেস সংক্রান্ত কোনো এওয়ার্ড রিসিভ করার সময়ে তোলা ছবিটা। মীরা ছবিটার দিকে খুব বেশি মনযোগ দিয়ে দেখছে। অর্ণব আসলেই অনেক সুদর্শন। লম্বায় পুরো ৬ ফিট, ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একটু বড় চুল গুলো, সুঠাম দেহ সব মিলিয়ে জাষ্ট পারফেক্ট।
ছিঃ ছিঃ এসব মীরা কি ভাবছে! কোথায় অর্ণব আর কোথায় সে। অর্ণব তো বাস্তব জীবনের বিল গেইট্স আর সে! বিল গেইট্সের বাড়ির কাজের লোক। হিহিহি! বাসায় অসুস্থ বাবা, ছোট বোনের পড়া লেখা। কতোকিছু তার কাঁধে। আর সে কি না খোলা চোখে স্বপ্ন দেখছে!! ধ্যাত্ কেনো যে এসব চিন্তা করতে গেলো সে। মুডটাই নষ্ট হয়ে গেলো।
মীরা রুম থেকে বের হতে গেলেই অর্ণব ওয়াশরুম থেকে বের হয়। অর্ণবকে দেখে মীরা দাড়িয়ে পরে। হয়তো অর্ণব মাত্রই মুখ আর মাথা ধুয়ে বেরিয়েছে। শার্টটা গলার দিকে খানিকটা ভেজা, চুল গুলোও ভেজা। ভেজা চুল গুলো অর্ণবের মুখে এসে পরেছে। টপটপ করে পানি পরছে অর্ণবের মুখে। মীরার চোখ অজানা কোনো এক লজ্জায় একাই নিচে নেমে যায়।
অর্ণব কিছু একটা বলার আগেই কেউ হুরমুরিয়ে রুমে ঢুকে অর্ণবকে জরিয়ে ধরে।
চলবে..
#তোমাতেই_আমি
#পর্ব_০১
#Tabassum_Kotha
আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। কেমন লাগছে জানাবেন। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।😊