#বৌপ্রিয়া #আভা_ইসলাম_রাত্রি #পর্ব – ৩০

0
393

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ৩০

‘আম্মা, দ্রুত তৈরি হও। ঊষাদের বাড়ি যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।’

সাহেদা চোখ চড়কগাছ করে চেয়ে আছেন ইয়াহিয়ার দিকে। ইয়াহিয়ার চোখ ভীষন লাল। শান্ত অথচ রাগে যেমন ভোসভোস করছে। কুসুম এগিয়ে এল। মাকে ছুঁয়ে বলল,

‘আম্মা?’

সাহেদা নিজেকে স্বাভাবিক করলেন। বললেন,

‘ওরা যদি আবার তোকে অপমান করে? তোর বাবা নেই। আমাদের মূল্য ওদের কাছে এখন আগের ন্যায় নেই। আর এই কান্ড পর ওরা আমাদেরকে এখন চোখেই দেখবে না।’
‘না দেখুক। মেয়ে না দিলে, ছিনিয়ে আনব। তোমার কোনো আইডিয়া আছে, ওরা ঊষার সঙ্গে কি করছে? জানোয়ারও এর চেয়ে ভালো। টাকার গরমে ফুপা অন্ধ হয়ে গেছেন। উনার অন্ধগিরি আমি ছুটাচ্ছি আমি। তুমি আগে তৈরি হও। কুসুম, যা তৈরি হয়ে আয়। আমি যা যা গিফট লাগে, কিনে আনছি।’

কুসুম মায়ের দিকে তাকাল। সাহেদা বুঝতে পারছেন, ঊষার হয়ত কিছু হয়েছে। নাহলে তার শান্ত ছেলে এমন ভয়ংকর রণমূর্তি হয়ে যাবার কথা না। সাহেদা রাগান্বিত ছেলের দিকে একপল চেয়েই নিজের রুমে ছুটলেন।
____________________________
‘বাবা? প্লিজ! দয়া করো আমার উপর। এই বিয়ে করতে পারব না আমি। বেচে থাকতে জিন্দা লাশ বানিয়ে দিও না আমাকে। প্লিজ!’

ঊষার বাবা মিষ্টির প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে রক্তচোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। ঊষা বাবার এমন চাওনি দেখে ভয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। ছলছল চোখে চেয়ে দেখল পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে। মায়েরও যে কিছু করার নেই। বাবার উপর এই বাড়িতে কেউই কথা বলতে পারে না। ঊষা পাথরের ন্যায় হেলেদুলে নিজের রুমে গেল। দরজা বন্ধ কর মেঝেয় বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সব শেষ, সব কেমন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এক নিমিষে। ঊষা আরেক পুরুষের ঘরে যাবে, তার সাথে শুবে, তার ছোঁয়া সমগ্র দেহে নিয়ে ঘুরবে! এসব কিছু ভাবতেই ঊষার পেট বিতৃষ্ণায় গুলিয়ে আসছে। অন্য পুরুষের ছোয়া দেহে লাগার আগেই ঊষা ছেড়ে দেবে এই দুনিয়া। ইয়াহিয়া…. ওর ইয়াহিয়া এখন কেমন অবস্থায় আছে কে জানে? ঊষা দ্রুত মেঝে থেকে উঠল। লাগেজ বের করে বহু আকাঙ্ক্ষিত একটা কাগজ বের করে। কাগজটা ওর কাছে বড্ড অদ্ভুত!
শক্ত কাগজের চতুর্দিকে ঊষার লিপস্টিকের দাগ। মাঝখান কালো ছোপছোপ দাগ। সেখানে ইয়াহিয়ার সবসময় ব্যবহৃত পারফিউম স্প্রে করা। ঊষা কাগজটা নাকের কাছে নিয়ে পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকল। সেদিনের কথা মনে আছে তার। ঊষার সঙ্গে বাড়ির বাইরে তৃতীয় দেখা হয় ইয়াহিয়ার।
ঊষাকে অনেকবার চুমু খাওয়ার রিকোয়েস্ট করলে, ঊষা বারবার ফিরিয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া এতে মুখে কিছু না বললেও মনেমনে মনক্ষুন্ন ছিল। ঊষা তা বুঝতে পেরে সান্তনাস্বরূপ একটা শক্ত কাগজে তার ঠোঁটের ছাপ বসিয়ে গিফট হিসেবে কাগজ ইয়াহিয়াকে দেয়। কাগজের এক পাশে গ্লিটার পেন দিয়ে লেখা,

‘শখের তোলা আশি টাকা। আমাদের সকল শখ বিয়েতেই পূর্ণতা নেবে! আমি অপেক্ষায় সেদিনের। ঠোঁটচুমু না খাও, কাগজচুমু দিলাম প্রাণ ভরে। গ্রহন করো এবং আমার অসংখ্য চুমুর ভালোবাসা নিও। ভালোবাসি! জানি তুমিও বাসো! তাই জিজ্ঞেস করলাম না।’

ঊষা হাত বাড়িয়ে গ্লিটার পেনে লেখাগুলো ছুঁয়ে দিল। চোখ উপচে জল গড়িয়ে কাগজে পরছে। ঊষার মনে আছে, সেদিন ইয়াহিয়া ঊষার এই ব্যাপারে খুব হেসেছিল। ঊষা তো লজ্জায় প্রায় আধমরা। ইয়াহিয়া হেসে তার সবচেয়ে পছন্দের পারফিউম কাগজে স্প্রে করে বলেছিল,

‘আমি যেমন তোমার ঠোঁটচুমুর পাগল, তেমন তুমিও আমার এই পারফিউমের দেওয়ানা। লুকিয়ে লুকিয়ে পারফিউমের গন্ধ শুকবে না। যখন ইচ্ছে করবে এই কাগজের ঘ্রাণ শুকে নিবে। আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে হাসব না আর। ভালোবাসি! জানি তুমিও বাসো। তাই আর জিজ্ঞেস করলাম না।’

ঊষা ইয়াহিয়া হাতের লেখা ছুঁয়ে দিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে আউড়াল,

‘বাস্তবে তোমার বুকের সঙ্গে মিশে বোধহয় আর কখনো তোমার পারফিউমের গন্ধ নেওয়া হবে না। আমাকে মাফ করে দিও। আমি আমাদের বিয়ের ওয়াদা রাখতে পারিনি।’
____________________________
ঊষাকে পাত্রপক্ষের সামনে বসান হল। সকল নিয়ম পূরণ করে কাজি ঊষাকে কবুল বলতে বললেন, ঊষা বলছে না। বেশ সময় পেরিয়ে গেলেও ঊষার মুখে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। ঊষার বাবা লজ্জিত চোখে ছেলেপক্ষের দিকে চেয়ে আবারও গরম চোখে ঊষার দিকে তাকালেন। ঊষা বাবার চাওনি দেখে দমে গেল। কিন্তু এখনও কবুল বলছে না। তার চোখ লেগে আছে সদর দরজার দিকে। প্রিয় মানুষটা আসার অপেক্ষায় এখনো সে বসে, প্রহর গুনছে। ছেলের বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘মেয়ের প্রথম প্রেমিক ভুলে নাই এখনো? এমন হলে বিয়ের এই নাটক কেন সাজিয়েছিস? আমাদের বোকা বানাতে?’

ঊষার বাবার এবার রক্ত গরম হয়ে গেল। সোফা ছেড়ে উঠে চপাট করে মেয়ের গালে থাপ্পড় বসাবেন উদ্যত হলেন, তার আগেই ঊষা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ইয়হিয়া?’

ইয়াহিয়ার অতৃপ্ত চোখ নিবদ্ধ ঊষার দিকে। ঊষার চোখে অবিশ্বাস। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের জল বাঁধ ভেঙে টুপ করে গড়িয়ে পরল। ঊষার বুকটা মুচড়ে উঠল যেমন। ইয়াহিয়া এগিয়ে আসল। সাহেদা সকল উপহার ঊষার মায়ের কাছে তুলে দিলেন। অনেক আশা নিয়ে সুধালেন,

‘আমরা ইয়াহিয়ার জন্যে ঊষার হাত চাইতে এসেছি আপা।’

ঊষার মা সাহেদার দিকে ছলছল চোখে চেয়ে পুনরায় স্বামীর দিকে তাকান। ঊষা এখনো চেয়ে আছে ইয়াহিয়ার দিকে। ইয়াহিয়ার তীক্ষ্ম নজর ঊষার পাশে বাঁকা হেসে বসে থাকা ঊষার হবু স্বামী উল্লাসের দিকে। ঊষা আড়চোখে বাবার দিকে তাকাল। ঊষার বাবা ইয়াহিয়াকে দেখে তেতে উঠলেন। তেড়ে আসলেন,

‘তুমি কি করো এখানে? খবরদার আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করলে তোমাকে আমি পুলিশে দেব। এটুকু ক্ষমতা আছে আমার।’

ইয়াহিয়ার চোখ এবার সোজা নিক্ষেপ হল ঊষার বাবার দিকে। সে শান্ত স্বরে উত্তর দিল,

‘আমরা এখানে কি জন্যে এসেছি আম্মা বলেছেন আপনাদের। এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত জানান। আমরা অপেক্ষা করছি।’

ঊষার বাবা দায়ছাড়া ভাবে উত্তর দিলেন,

‘আমি আমার মেয়ে তোমার কাছে নিয়ে দেব না। চাকরি করে ক টাকা পাও? হাজার কয়েক? এতেই আমার মেয়ের হবে? পোষাবে ওর? আমি যার কাছে আমার মেয়ে বিয়ে দেব সে লাখপতি হতে হবে আমার মত। নাকি তোমার মত পথেঘাটে থাকা কোনো ছেলে?’

ইয়াহিয়া হাসল খানিক। হেসে বলল,

‘এই পথেঘাটে থাকা পরিবার থেকেই আপনি নিজের জন্যে বৌ এনেছেন ফুপা। তখন এসব মাথায় আসেনি?’

ঊষার বাবা দমলেন খানিক। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে চেয়ে পুনরায় তেজ নিয়ে বললেন,

‘হ্যাঁ এনেছি। কারণ আমি পুরুষ মানুষ। আমার ইনকামে ঘর চলে নাকি তোমার ফুপুর ইনকামে? আমার মেয়েও তার স্বামীর ইনকামে চলবে। তাই তার যেখানে বিয়ে হবে সেও আমার মত টাকা পয়সার দিক থেকে অন্যতম থাকবে। এটাই নিয়ম।’

ইয়াহিয়া উত্তর দিল,

‘আমার ক্ষেত্রে নিয়মটা আলাদা ফুপা। ঊষা মেধাবী ছাত্রী। আমি তাকে ঘরে বন্দি রেখে তার এতদিনের মেধার পরিচয় আটকে রাখব না। আমি তাকে সাবলম্বী বানাব। যেন ভবিষ্যতে তার উপর কেউ আঙুল তুলে না বলে, তার স্বামীর ইনকামে তার ঘর চলে, তার নিজের ইনকামে না। এবং আমি তার পাশে থাকবে, সর্বদা, সবসময়।’

ঊষার বাবা বুঝতে পারলেন, ইয়াহিয়া তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে। নিজের স্ত্রী মেয়েকে ছোট করে দেখার বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ঊষার বাবা আর উপায় না পেয়ে বললেন,

‘যাই হোক। বড়বড় বাণী না ছেড়ে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাও। আমি তোমার কাছে যেকোনো মূল্যে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’

ইয়াহিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘শিউর? আপনি সত্যি রাজি হবেন না?’

ঊষার বাবা রাগ নিয়ে তাকালেন। ইয়াহিয়া যা বোঝার বুঝে গেল। সে মৃদু হাসল। ঊষার বাবার সামনে থেকে চলে গেল। এগিয়ে গেল স্বয়ং ঊষার দিকে। ঊষা এতক্ষণ ওদের ঝগড়া দেখছিল। ইয়াহিয়া ঊষার সামনে এসে দাড়াল। ঊষার হাত আলগোছে নিজের হাতে নিয়ে বলল,

‘আমাকে চাও তুমি? হ্যাঁ বা না উত্তর দিবে!’

ঊষা উত্তর দিল, ‘চাই,অনেক চাই।’

‘বিয়ে করবে আমাকে?’

ঊষা আড়চোখে বাবার দিকে তাকাল। ঊষার বাবা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে। ঊষা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, ‘বিয়ে করব।’

‘ সংসার করার জন্যে আমি এবং আমার পরিবার যথেষ্ট তোমার জন্যে? বাবাকে ছেড়ে আমার কাছে একেবারে চলে আসতে পারবে? ভয়ে ভয়ে নয়, আমি চাই তুমি নিজের উপর বিশ্বাস রেখে চারপাশ পরোয়া না করে উত্তর দিবে! তোমার উত্তরকে আমি সম্মান করব।’

ঊষা বাবার দিকে ছলছল চোখে তাকাল। কি উত্তর দিবে সে? ঊষার বাবা চুপ করে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন। মেয়ের উত্তর শোনার জন্যে তিনি মুখিয়ে। ঊষা চুপ করে চেয়ে আছে বাবার দিকে। একসময় বলল,

‘আমার তোমাকে চাই, তোমার পরিবার চাই, সঙ্গে চাই আমার নিজের পরিবারও। এটা কি আদৌ কখনো সম্ভব হবে? আমি দোষ করিনি কিছু, তাহলে কোন দোষের এতবড় শাস্তি পাচ্ছি বলতে পারো?’

ইয়াহিয়া শুনে। ঊষার হাতে হাত রেখে বসে থাকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। ঊষা কেঁদে উঠে। ইয়াহিয়া ঊষার কান্না চুপ করে চেয়ে দেখে। ঊষা ইয়াহিয়া হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এগিয়ে যায় বাবার দিকে। কিছুক্ষণ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়।তারপর হঠাৎ আচমকা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাদতে কাদতে বলে,

‘বাবা, আমাকে এতবড় শাস্তি দিও না প্লিজ। আমি তোমাদের ছাড়া বেচে থাকতে পারব না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। ওকেও ঠিক তোমার মত করেই ভালোবাসি আমি। আমি কোথায় যাব বাবা, কার কাছে যাব? কার কাছে আমার দুঃখ বলব? বাবা, আমার দুঃখ শুষে নাও তুমি। আমাকে পর করে দিও না। আমি বেচে থাকতে পারব না বাবা, পারব না।’

ঊষার বাবার চোখে জল জমেছে। মেয়ে তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। নাহলে মেয়ের উপর এ কদিন যে পরিমাণ অত্যাচার তিনি করেছেন, তাতে ইয়াহিয়ার এক ডাকে ঊষার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার কথা। সেখানে মেয়ে এখনো লেগে আছে তাকে মানানোর পেছনে। ছোটবেলায় যেমন বায়না করলে পাঞ্জাবি চেপে ধরে ঝুলে থাকত, তেমন বড় হয়েও আজকে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ বায়না ধরেছে। আর আগের মতোই ঝুলে আছে তার বুকের সঙ্গে। ঊষার বাবা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরলেন। একপর্যায়ে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে মেয়ের কথা ভেবে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘আমার পছন্দ করা ছেলে থেকে ইয়াহিয়া তোকে বেশি সুখী রাখবে বোধহয়। আমার আর কিছু বলার নেই। তুই সুখি থাকলেই আমি সুখি। এটুকুই আমার চাওয়া শুধু।’

#চলবে
অনেক বড় পর্ব, উফ! আজকের পর্বে সেরা কমেন্টকারীদের নাম বৌপ্রিয়ার নেক্সট পর্বে গল্পের নিচে তাদের নাম উল্লেখ করা হবে। আগের গল্পে আমি এটা করতাম। এখন আবার শুরু করলাম। তাছাড়া সেরা কমেন্টকারিদের আমি রিপ্লাই করব অবশ্যই।

গল্প কবে দেই, বা গল্প সম্পর্কিত সমস্ত আপডেট পেতে জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে, গ্রুপ লিংক,
https://facebook.com/groups/929533097975216/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here